Thursday, January 12, 2012

একজন আধাপাগল এবং একটি ফার্মের মুরগি [ Collection of Love Stories -19 ]




"ওই মুরগী ,আমার প্রক্সিটা দিয়ে দিস মনে করে।নতুন প্রোজেক্টটা নিয়া হালকা বিজি আছি।"
আমি খুব সাবধানে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলাম।রাফি শেষ কবে আমার আসল নাম ধরে ডেকেছিল সেটা মনে করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।এই ক্লাস আওয়ারে সে যে প্রোজেক্টটা নিয়ে বিজি আছে তার নাম হল মারিয়া।প্রতি মাসেই নিয়মের বিন্দুমাত্র ব্যাতিক্রম না ঘটি...য়ে এবং পূর্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে রাফির গার্লফ্রেন্ড বদল হয়।যদিও তাদের গার্লফ্রেন্ড বলতে বাড়াবাড়ি রকমের আপত্তি আছে তার!তার ভাষায় ওরা হল তার একেকটা প্রোজেক্ট!সে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখছে,কোন প্রোজেক্টটা তার জন্য উপযুক্ত!যেদিন তার কাউকে সত্যিই উপযুক্ত মনে হবে(সেই সুদিন আমরা আদৌ কোনোদিন দেখব এমন দুরাশা এখনো করে উঠতে পারিনি),সেদিন তার এই খোঁজ-দি সার্চ শেষ হবে।যদিও যেকোন মেয়ের সাথে ৩-৪ দিন ঘোরার পরই রাফি তার প্রতিযাবতীয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং তার রাজ্যের খুঁত খুঁজে বের করে!সেসব খুঁতও হয় একেবারে অনন্য।

এই যেমন,মেয়ের হাসি হায়েনার মত,চোখ চাইনিজদের মত,অথবা সে ট্রেনের ইঞ্জিনের মত শব্দ করে চা খায়,হিন্দি সিরিয়াল দেখে... ইত্যাদি ইত্যাদি!একটা মেয়ের যে দোষ শুনে সবচে পুলকিত হয়েছিলাম সেটা হল সেই মেয়ে নাকি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার,কট্টর ব্রাজিলিয়ান সাপোর্টার রাফি চিরশত্রু বিয়ে করবে নাকি!নৈব চ নৈব চ!

                              
                রাফির সাথে আমার পরিচয়ের ইতিহাসটা একটু বলি।প্রথম যেদিন আমাদের ক্লাস শুরু হয়,কোন ধরনের সংকোচের ধারেকাছে না গিয়ে উরাধুরা চেহারার একটা ছেলে আমার মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিল,"এই মেয়ে, তোর নাম চিঠি ক্যান?আর কোন নাম খুঁজে পাস নাই?"

আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে বললাম,"কি আশ্চর্য!আপনি আমাকে তুই তুকারি করছেন কেন?"হা হা করে হাসতে হাসতে বেয়াদব ছেলেটা বলল,"এই পুচকা মেয়ে বলে কি!তাইলে কি আপনি করে বলব চিঠি?"

"আমার নাম চিঠি না, দিঠি"।

"ওই একই হল।তুই এরকম আঁতেলের মত প্রথম দিন ক্লাসে এসেই পড়ালেখা শুরু করছিস ক্যান?থাপ্পড় চিনস?"

তারপর আমাকে পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে সে আমার পাশে এসেই বসে পড়লো। দুর্ভাগ্যবশত,সেই আধাপাগল রাফিই এখন আমার সবচে কাছের বন্ধু।এখন আর আমাকে চিঠি ডাকে না ও।মাঝে কিছুদিন ডাকতো আঁতেল,তারপর কুনোব্যাঙ,এখন ডাকে ফার্মের মুরগী।প্রায় চার বছর ধরে আমরা একসাথে পড়ছি।এই চার বছরে ওকে মানুষ বানানোর সব অপচেষ্টাই আমার বৃথা গেছে।একদিন ওকে সিগারেট ছাড়তে বলেছিলাম, ওর উত্তর ছিল,"আর কোনোদিন আমার গুরুকে নিয়া উল্টাপাল্টা বললে এক্কেরে কানের নীচে খাবি কিন্তু!দুইদিন কানে শো শো ছাড়া কোন শব্দ শুনবি না!"

এবার আমার একটা হাল্কাপাতলা বর্ণনা দেই।আমাকে হয়ত দায়সারা ভাবে একটা মেয়ে বলে চালিয়ে দেয়া যায়।রাফির রূপবতী প্রোজেক্টদের মত আমি ঠোঁটে কটকটে রঙের ভয়ঙ্কর লিপস্টিক লাগাই না,হাইহিল জুতা পরে র‍্যাম্প মডেলদের মত গটগটিয়ে হাঁটতেও পারিনা।আরও বিপদের কথা,আমি ওদের মত রক মিউজিক এর সাথে ডিজে পার্টিতে নাচানাচি করতেও  বাড়াবাড়ি রকমের অপটু!গর্তজীবী প্রাণীর মত রোকেয়া হল এর দোতলায় আমার আস্তানায় আমি নিরুপদ্রব বসবাস করতে পছন্দ করি। এই যুগেও আমি কিনা রবীন্দ্রসংগীত শুনি আর শরৎচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাস পড়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদি!পোশাক আশাকেও আমাকে নব্বই দশকের মা-খালার সাথে মিলিয়ে ফেলা খুব একটা অস্বাভাবিক না।আমি ক্লাসে যাই বেঢপ লম্বা কামিজ পরে।চুলে থাকে লম্বা বেণী আর চোখে থাকে ফ্রেম দেয়া ভারী চশমা।হয়ত একারণেই কিউপিড বেচারা কোন ছেলের মনে এখনো আমার জন্য ভালোবাসার তীর বিদ্ধ করায় ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেনি!

                              
                অবশ্য এটা নিয়ে আমার বিশেষ কোন বিকার নেই।মন খারাপের সময়,মেজাজ গরমের সময়,অথবা আনন্দের সময়......সব সময়ই আমাকে ব্যাস্ত এবং খানিকটা বিরক্ত রাখতে বিধাতা রাফিকে একেবারে কমান্ডো ট্রেনিং দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন!আমার মন খারাপ থাকলে সে রাত একটার সময়ও আমার হলের সামনে হাজির হয়,আমার প্রিয় ক্যাডবেরি চকলেট হাতে।একবার এক ছেলে আমার ডেস্কে তেলাপোকা ছেড়ে দিয়েছিলো।আমার কান্না দেখে রাফির কি হল কে জানে।এক দৌড়ে আমার ডেস্কের ভেতর থেকে সেটাকে উদ্ধার করে ওর পেন্সিল বক্সের ভেতর পুরে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চলে গেল।ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখি ছেলেটা বমি করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে,আর রাফি ছেলেটার শার্টের কলার চেপে ধরে মুখ লাল করে বলছে,"আর যদি কোনোদিন দিঠির সাথে ফাজলামি করার চেষ্টা করিস......আজকে তো শুধু তেলাপোকা খাইয়েছি,এরপর একেবারে কাঁচা সাপ খাইয়ে দেব।"

এরপর শিস দিতে দিতে আমার কাছে এসে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,"ওই মুরগি,বিশটা টাকা দে তো।"

"কেন?"

"আরে আজব মেয়েমানুষ!ফ্রী সার্ভিস পাইছস নাকি! তোর বডিগার্ডের ভূমিকা পালন করলাম...এখন আমার বেনসন খাওয়ার পয়সাটা অন্তত দে!"আমি হতাশ ভঙ্গিতে বিশ টাকা বের করে দিলাম।রাফি আহত গলায় বলল,"মেয়েমানুষ আর যাই হোক,কঞ্জুসি ছাড়তে পারবে না।ভদ্রতা করে হলেও তো দশটা টাকা বেশি দিতে পারতি!"

                              
                কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যেটা অনেক সময় অন্য সব জাগতিক সম্পর্ককে হারিয়ে দিতে পারে।যে সম্পর্ককে কোন সীমারেখা দিয়ে আটকে ফেলা যায়না।যেখানে থাকে কাছে থাকার তীব্র আকুলতা, মানুষটাকে একেবারে কাছাকাছি রাখতে চাওয়ার ছেলেমানুষি ইচ্ছা।রাফির সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা সেরকম।

কিন্তু ক্ষুদ্র একটা সমস্যা আছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সবচে কাছের বন্ধু হলে কোন এক বিচিত্র কারণে তাদের সম্পর্কটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধুত্ব থেকে খানিকটা এগিয়ে যায়।প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি,আমি কি ওকে ভালবাসি??
হয়ত বাসি।কিন্তু আমার জীবনে ও একটা আলোর মত,যেটা আমার খুব কাছ দিয়ে যাবে,কিন্তু হাত বাড়িয়ে কখনো তাকে ছোঁয়া যাবেনা।ওর কি দায় পরেছে আমার মত একটা আঁতেলকে ভালোবাসার!ওর নিত্যনতুন প্রোজেক্টদের সাথে আমার তো তুলনাও চলেনা।না বাপু,ও বন্ধু আছে,বন্ধুই থাকুক।প্রেম ভালবাসার মত বায়বীয় ব্যাপার আর যাই হোক,আমার জন্য নয়।আর ভালবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমনটা তো আর সংবিধানে লেখা নেই।ও সব সময় হয়ত আমার কাছাকাছি থাকেনা,কিন্তু পাশাপাশি থাকে সব সময়। মিথ্যে বলব না, যখন ওকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখি খারাপ লাগে......ভীষণ খারাপ।ভীষণ অভিমান হয়...

                  "ওই মুরগী কি করস?"রাফির ডাকে পেছন ফিরলাম।সাবধানে ডাইরিটা এক পাশে লুকিয়ে বললাম,  "আঁতেল মানুষ,কি করব আর বল?পড়ছিলাম।"

"পড়তে এত ভাল্লাগলে এইটা পড়।"হাই তুলতে তুলতে আমার দিকে দলামোচা করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল।তাতে কয়েকটা লাইন লেখা-
"যারা কাছে আছে,
তারা কাছে থাকে
তারা তো পারেনা জানিতে
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছো
আমার হৃদয় খানিতে।"



আমি বিস্মিত হয়ে বললাম," এটা তুই নিজে লিখেছিস?"

"হুম।যদিও আমার আগে নিমাই ভট্টাচার্যও একবার লিখেছিল।"

"হুম"

"হুম মানে!আমি এত সুন্দর একটা কবিতা লিখে দিলাম তোকে,আর তোর প্রতিক্রিয়া হল একটা শুকনা ম্যাড়ম্যাড়ে হুম!"

"তাহলে কি বলব?"

"কি বলব মানে!তুই কি কিছু বুঝস নাই!"

"বুঝছি তো!"

"কি বুঝছিস?"

"বুঝছি যে এই কবিতাটা ভুলক্রমে তোর আগে নিমাই ভট্টাচার্য লিখে ফেলছে।"

রাফি হতাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো,"বুঝে নাই,মাইয়া কিচ্ছু বুঝে নাই।"

তারপর  হঠাৎ দুই হাতে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,"খালি পড়ালেখা বুঝলেই হবে?তাকা আমার চোখের দিকে।

দেখ কিছু বুঝিস কিনা।"ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম!প্রকৃতি কি কোন রসিকতা করছে আমার সাথে!

অনেকটা সাপ লুডু খেলার মত,যেখানে আমাকে প্রথমে খুশি মনে মই বেয়ে ওপরে উঠতে দেয়া হবে,তারপর এক পর্যায়ে সাপের কামড়ে মইয়ের তলদেশে পতন!আমার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে?

                              
                         রাফি প্রবল বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,"আমি ভেবেছিলাম তুই একটু হলেও বুঝিস।কিন্তু তুই তো একটা ফার্মের মুরগী! আমি যে এত মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াই,তাদের কাউকে শেষ পর্যন্ত কেন ভাল লাগেনা আমার?কারণ তুই-ই তো আমার ফাইনাল প্রোজেক্ট......এখন বল মুরগী,তুই কি আমার তুমি হবি?"

ওর কথা শেষ না হতেই ভ্যা করে কেঁদে দিলাম আমি!রাফি হতভম্ব হয়ে বলল,"এই মেয়ে কাঁদে ক্যান!!এই মেয়ে,এই... আরে বাবা মাফ চাই।কি বিপদে পড়লাম!থাক থাক তোর কিছু বুঝা লাগবে না।ইভ টিজিং এর মামলা খাওয়াবি নাকি!"

আমার কান্নার বেগ বাড়তেই লাগলো।।রাফি আমাকে ফেলে সোজা উল্টো দিকে হাঁটা দিল এবার।পেছন থেকে গিয়ে ওর হাতটা ধরলাম আমি।অবাক হয়ে পেছন ফিরল ও।আমি বললাম,"একটা কবিতা শুনবে?"উত্তরের অপেক্ষা না করেই শিশুদের মত চেঁচিয়ে উঠলাম-

"তাকিয়ে দেখি তোমার দুটি বিশাল কালো চোখ
দিন দুপুরে চেঁচিয়ে উঠি-একটা কিছু হোক!"

গাধাটা চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইশ!ছেলেটার চোখ জোড়া এত সুন্দর কেন?


 লিখেছেন  : আয়শা কাশফী

গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%B2-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A6%BF/334305776589397



Saturday, December 31, 2011

।। থাবা ।। [ Ghost Stories - 01]




অনেকদিন আগে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতি নামে ছোট একটি গাঁয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এক দানব। দানবটাকে কেউ দেখেনি। শুধু তার অস্তিত্বের প্রমাণ ছিল নির্মম শিকারের বলি হওয়া গ্রামবাসী।

একইভাবে খুন হয়ে যেত সবাই- প্রত্যেকের ঘাড়ে থাবার চিহ্ন। দানব দশটা নখ বসিয়ে দিতো শিকারের ঘাড়ে। শুরুতে মানুষ নয়, ছোটখাট প্রাণী দানবটির শিকার হচ্ছিল। একদিন সকালে এক কৃষক ঘুম থেকে উঠে দেখে তার তিনটা ছাগল রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে রয়েছে। এরপরে গাঁয়ের তিনটে পোষা কুকুরকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সবার ঘাড়ে অদ্ভুত থাবার চিহ্ন।

গুজব ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। প্রাণীগুলোর অন্তিমদশার কথা জানে সবাই। কিন্তু কেউ বলতে পারে না কীভাবে মারা গেল জানোয়ারগুলো। একটি বাছুরও রক্তক্ষরণে মারা গেল। নিরীহ প্রাণীটির ঘাড়ে শিরা টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে দশ আঙুলে। ঘাড়ে দশটি ধারাল নখের চিহ্ন। এরপর সাবধান হয়ে গেল গ্রামবাসী। বিছানার পাশে দা-কুড়াল-খন্তা রেখে তারা ঘুমাতে লাগল। গোয়াল ঘরে তালা মেরে রাখা হলো পোষা জন্তুদের।
গোটা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। নানানজনে নানান গল্প বানাতে লাগলো। একে অন্যের দিকে তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।

এরপরে ঘটল সেই ঘটনা-যে ভয়টা এতদিন সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। দানব হামলা চালালো মানুষের ওপর। আক্রমণের শিকার হলো মাতাল জমির উদ্দিন। একদিন সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল তাকে। ঘাড়ে দশটা নখ বসানো চিহ্ন। গর্ত হয়ে আছে। কুকুর, ছাগল এবং বাছুরের মত একই পরিণতি হয়েছে তার। প্রবল রক্তক্ষরণে মারা গেছে। তিন কুলে যার কেউ নেই সেই ভবঘুরে জমির উদ্দিনের মৃত্যুতে গাঁয়ের মানুষ শোক প্রকাশ করলো না, তবে ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেল সবার। কারণ সবাই জেনে গেছে মানুষ শিকারেও অরুচি নেই দানবের। যে কেউ তার শিকার হতে পারে।

ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী এবারে গড়ে তুললো একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। তারা রাতের বেলা পালা করে গ্রাম পাহারা দেবে। তবে মুশকিল হলো কেউ জানে না কীসের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে। লিটু আর টিটু নামে দুই ভাইকে করা হলো সেচ্ছাসেবী দলের নেতা। এরা গাঁয়ের সবচেয়ে সাহসী দুই তরুণ। একমাত্র এদের বাড়িতেই দুটি বন্দুক আছে। বন্দুক দিয়ে তারা মাঝে মাঝে গাঁয়ের পাশের জঙ্গলে শিকার করে। আর এদের বাড়ি জঙ্গলের ধারেই। এবং লোকের ধারণা দানবটা জঙ্গলেই আস্তানা গেড়েছে। ওদের বাছুরটাকেই মেরে ফেলেছে দানব।

সেচ্ছাসেবী দল গঠন হওয়ার পরে লিটু-টিটু বাড়ি গেল কীভাবে রাতে পাহারা দেবে তা নিয়ে আলোচনা করতে। শীতের রাত। তাই রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে বসলো দুই ভাই। ওদের মা নেই। বাবা আছে। আর বুড়ি দাদী। দাদী প্রায় বেশিরভাগ সময় চুলোর পাশে বসে থাকে গায়ে কালো একটা চাদর জড়িয়ে। উনুনের উত্তাপে শরীর গরম রাখে।

আজ রাত থেকেই শুরু পাহারা,’ নিচু গলায় বলল বড় ভাই লিটু। দলনেতা হিসেবে আমাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তেছে। তা ছাড়া অন্যরা এখনই পাহারায় যেতে ভয় পাচ্ছে।
হুঁ,’ সায় দিল ছোট ভাই টিটু। ওটা-যাই হোক না কেন-প্রতি পাঁচদিন পরপর হামলা চালায়। জমির উদ্দিন মারা গেছে আজ পাঁচদিন হলো। আজ রাতে আবার ওটা হামলা চালাতে পারে। কাজেই আজই পাহারা বসাতে হবে।
তোরা পাহারা দিতে যাচ্ছিস যা,’ বলে উঠলো ওদের বাবা। 

তবে কিসের সঙ্গে টক্কর দিবি সে কথা মনে থাকে যেন। ওটা কিন্তু আকস্মিক হামলা চালায়। এ পর্যন্ত যে কটা হামলা হয়েছে, ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কাজেই খুব সাবধান। আম্মা, আপনি কি বলেন ?
চুলোর পাশে বসা দাদী তাঁর ছেলের দিকে একবার চোখ তুলে চাইলেন। কেন জানি শিউরে উঠলেন। তারপর আবার মুখ নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন জ্বলন্ত চুল্লির দিকে। ওরা তিনজন নিজেদের আলোচনায় ফিরে গেল। বুড়ির কাছ থেকে অবশ্য কোনও জবাব আশাও করেনি। কারণ দাদী স্বল্পবাক মানুষ। তা ছাড়া বেশ কবছর ধরে তাঁর মাথারও ঠিক নেই। হঠাৎ হঠাৎ উল্টোপাল্টা সব কাজ করে বসেন।
লিটু তাদের পরিকল্পনার কথা জানালো বাবাকে। আমি আর টিটু আজ রাতে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে যাব। তবে জঙ্গলে ঢুকব না। জঙ্গল আর গাঁয়ের মাঝখানের রাস্তায় পাহারা দেব। দানবটা যদি আসেই আমাদের চোখ এড়িয়ে গাঁয়ে ঢুকতে পারবে না।
তোরা পাহারা দিবি কিভাবে?’ জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বাবা।
আমরা একজন আরেকজনের ওপর নজর রাখব,’ জবাব দিল লিটু। হাঁক-চিৎকার দিলে শোনা যায় এরকম দূরত্বে থাকব দুজন। জঙ্গলের দিকে চোখ থাকবে আমাদের। দানব যদি সত্যি জঙ্গলে থাকে, বেরুনো মাত্র ওকে গুলি করব।
কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতেই হবে.টিটু বললো তার বাবাকে। জানি না দানবের পরবর্তী শিকার কে হবে, তবে হাত-পা গুটিয়ে অসহায়ের মতো আর বসে থাকা যায় না।
বাবা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। বেঁচে বর্তে ফিরে আসিস, বাপ।বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল সে।
লিটু দেয়ালে ঝোলানো বন্দুক জোড়া নামাল। টিটু কাঠের সিন্দুক খুলে ধারাল দুটি রাম দা বের করল। একটা দিল বড় ভাইকে। নিজের কাছে রাখল অন্যটা। তারপর দাদীকে সালাম করে বেরিয়ে পড়ল দুজনে।

বাইরে ঘোর অন্ধকার। পশ্চিমাকাশে কাস্তের মত একফালি বাঁকানো চাঁদ। পুবর্দিকে পা বাড়াল দুই ভাই। ওদিকেই জঙ্গল। ওরা যেখানটাতে পাহারায় দাঁড়াবে ভেবেছে, কাছাকাছি আসতে ফিসফিস করল টিটু, ‘ভাবছি ওটা দেখতে কেমন।
আমিও একই কথা ভাবছি, ‘বলল লিটু। হয়তো কোনও দানব পাখি-টাখি হবে। সাঁৎ করে আকাশ থেকে নেমে এসে ঘাড়ের শিরা ছিঁড়ে পালিয়ে যায়।
দুজনেই আকাশে তাকাল। পাতলা, সরু চাঁদটিকে ঘিরে আছে মেঘ। আকাশ থেকে কিচু উড়ে এলেও আঁধারে ঠাহর করা যাবে না।
ওটা মাটির নিচের কোনও প্রাণীও হতে পারে,’ মৃদু গলায় মন্ত্রব্য করল টিটু। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে থাকে। সুযোগ বুঝে হামলা চালিয়ে বসে পেছন থেকে।
ছোটভাইয়ের কথা শুনে গা কেমন ছমছম করে ওঠে বড়ভাইয়ের। পেছন ফিরে তাকায় সে। দেখাদেখি টিটুও। কিন্তু নিকষ আঁধারে কিছুই দেখা যায় না। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল দুই ভাই। শেষে নীরবতা ভাঙল লিটু। চল, যে যার জায়াগায় গিয়ে দাঁড়াই। তবে বেশিদূর যাসনে। হাঁক ছাড়লেই যেন সাড়া পাই।

দুভাই দুদিকে চললো। লম্বা লম্বা চল্লিশ কদম ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অন্ধকারে বন্দুকে গুলি ভরল লিটু। তারপর রামদাটা নরম মাটিতে পুঁতল। রামদার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

চল্লিশ কদম দূরে, অন্ধকারে ভীত ভঙ্গিতে বন্দুকে হাত বুলাচ্ছে টিটু। তার হাত কাঁপছে। এতদিন জঙ্গলে খরগোশ, বুন বেড়াল এবং বন মোরগ ছাড়া কিছু শিকার করেনি। সাহস বলে যতই নাম-ডাক থাকুক, ভূতের ভয় তার বেজায়। স্রেফ লজ্জায় না বলতে পারেনি। বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে পাহারায়। দানবটা ভূত-প্রেত হতে পারে। নইলে তাকে কেউ এতদিন দেখতে পায়নি কেন? ভূতের বিরুদ্ধে কি বন্দুক দিয়ে লড়াই করা চলে? আর ওটা যদি ভূত না-ও হয়, ভয়ঙ্কর কোনও জন্তুও হয়, প্রয়োজনের সময় বন্দুক চালাতে পারবে তো সে? বড় ভাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করল লিটুর। কিন্তু ঝোপ এবং গাছের গাঢ় ছায়া যেন গিলে খেয়েছে লিটুকে। দেখা যাচ্ছে না।
ঘুরলো টিটু। তাকালো গাঁয়ের দিকে। ইস্, কেন যে মরতে মীটিং-এ সবার সামনে বড় বড় কথা বলেছিল। বাবার সামনেও হামবড়া ভাব দেখিয়েছে, যেন কিছু গ্রাহ্য করছে না। পেছনে টাশ্শ্ শব্দে একটা মরা ডাল ভাঙল। চরকির মত সরল টিটু। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না, আর কোনও শব্দও শোনা গেল না।
পেশীতে ঢিল পড়ল টিটুর। বন্দুকের কুঁদো ঠেকাল মাটিতে, হেলান দিল। ঘুম ঘুম আসছে।
আর ঠিক তখন ঘাড়ে সুচের মত তীক্ষ্ণ ব্যথা ফুটল। কেউ ওর গলায় ধারাল নখের থাবা বসিয়েছে।

তীব্র, তীক্ষ্ণ আর্ত-চিৎকারে ভেঙে খানখান হয়ে গেল বনভূমির নিশি-নৈঃশব্দ্য। লাফিয়ে উঠল লিটু। ওর ভাইয়ের গলা না? এক হাতে বন্দুক, অপর হাতে রামদা নিয়ে চিৎকারের উৎসের দিকে ছুটল ও। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

এমন সময় টিটুর ঘরঘরে গলা শুনতে পেল টিটু। গোঙাচ্ছে। গোঙানি লক্ষ্য করে ছুটল ও। আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল গোঙানি। ভাইকে দেখা যাচ্ছে না তবে ওর বেশ কাছে এসে পড়েছে লিটু বুঝতে পারছে। বন্দুকটা ফেলে দিল ও। অন্ধকারে গুলি করলে টিটুর গায়ে গুলি লাগতে পারে। দুহাতে রামদা ধরে মাথার ওপর বনবন করে দুপাক ঘোরাল লিটু। কিছু একটার সঙ্গে বাড়ি খেল ধারাল ফলা। রক্ত জল করা একটা চিৎকার শুনল লিটু। গা হিম হয়ে গেল ওর। টিটুর লাগেনি তো? ও তো আর গোঙাচ্ছেও না। অন্ধকারে হয়তো রামদার কোপ ভাইয়ের গায়ে লেগেছে। মারা গেছে সে। বুক ফেটে কান্না এল লিটুর। এমন সময় আবার গোঙাতে শুরু করল টিটু। স্বস্তির পরশ ঝিরঝির করে নামল লিটুর শরীরে। নাহ্, ওর ভাই মারা যায়নি।

হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেল লিটু। মরা পাতার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কিছু একটা খচমচ শব্দ তুলে। ধেড়ে ইঁদুর-টিদুর হবে হয়তো। তবে ওটাকে দেখতে পেল না লিটু। সে আন্দাজে ভাইয়ের পাশে এসে বসল। তখন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ক্ষীণকায় চাঁদ। তার অতি অল্প আলোয় টিটুর দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল লিটু। টিটুর ঘাড়ে গেঁথে আছে চিমসানো একটা কাটা হাত। কাটা কনুই থেকে রক্ত ঝরছে। হাতটার আঙুলে বড় বড় ধারাল নখ। নখগুলো খামচে ধরে আছে টিটুর কাঁধসহ ঘাড়। অন্ধকারে রামদার পোপে এ হাতটাই কেটে ফেলেছে লিটু। সময় মত এসে পড়ায় রক্ষা পেয়েছে টিটু। কাটা হাতের মায়া ত্যাগ করেই পালাতে হয়েছে দানবকে।

লিটু টিটুর ঘাড় থেকে টান মেরে ছুটিয়ে আনল কাটা হাত। নখের আঘাতে গর্ত হয়ে গেছে ঘাড়ে। রক্ত ঝরছে। ক্ষতস্থানে রুমাল বেঁধে দিল লিটু। তারপর ভাইকে নিয়ে রওনা দিল গাঁয়ে। কাটা হাতটা পড়ে রইল জঙ্গলে।
ওদের বাবা ভয়ার্ত শুকনো মুখে অপেক্ষা করছিল দোর গোড়ায়। ছোট ছেলের চিৎকার শুনতে পেয়েছে। দুছেলেই বেঁচে আছে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো সে।
টিটুকে খাটিয়ায় শুইয়ে দিল ওরা। ডেটল আর পানি দিয়ে পরিস্কার করল ক্ষতচিহ্ন। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরী করলেই খবর হয়ে যেত টিটুর। ওকে জ্যান্ত ফিরে পেত না লিটু। ভাইয়ের ঘাড়ে ব্যাণ্ডেজ করতে করতে দানবের কথা ভাবছিল লিটু। কাটা হাত নিয়ে রক্তক্ষরণে ধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলেই হয়তো মরে পড়ে থাকবে দানবটা।
আহত টিটুকে নিয়ে লিটু এবং তার বাবা এত ব্যস্ত ছিল যে খেয়াল করেনি চুল্লির পাশে দাদী নেই। দাদী যে খিড়কির দরজা দিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকেছেন তাও লক্ষ করেনি কেউ। দাদী কাঠের পিঁড়িতে বসে শীতল, ক্রুর চোখে দুই নাতির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কেউ শুনল না তাঁর অসংখ্য ভাঁজ পড়া মুখ থেকে হিসহিস শব্দ বেরিয়ে আসছে। এবং কেউ দেখল না কালো চাদরের নিচে তিনি রক্তাক্ত একটি মাংসপিণ্ড লুকিয়ে রেখেছেন।

লিখেছেনঃ অনীশ দাস অপু

গল্পটি ভালো লাগলে Like ক্লিক করতে ভুলবেন না।।