Wednesday, May 22, 2013

**এক্সিডেন্ট (ভৌতিক গল্প)** [ghost stories 49]


**এক্সিডেন্ট (ভৌতিক গল্প)**


লিখেছেন: এম এস ই শাহীন....


কয়েকদিন থেকে নানা ব্যস্ততার কারনে ঘটনাটি শেয়ার করতে পারিনি। তো যাই হোক, আমার বাড়ী থেকে দক্ষিনপূর্ব কোণে কালসারডাড়া নামক একটি স্থানে মাঝে মধ্যে যেতে হয় আমার ব্যবসায়িক কারনে । আমার বাড়ী থেকে ঐ যায়গার দূরত্ব মাত্র ১০ কিঃমিঃ । আমি অবশ্য বাইকটা নিয়েই চলাচল করি সেখানে । কয়েকদিন আগেও গিয়েছিলাম সেই যায়গায় । নানা কাজ সেরে সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত শোয়া এগারোটা বেজে গেল । মনের মধ্যে খানিকটা ভয় ভয় কাজ করছিল । একঃ চোর ডাকাতের দুইঃ জ্বিন ভূতের । ঐ যায়গায় যাওয়ার পথে অনেক পুরাতন কবরস্থান সংলগ্ন একটি ঈদগাহ মাঠ পড়ে । অবশ্য এই ঈদগাহ মাঠ ও কবরস্থানের আশে পাশে কোন জনবসতি নেই । বিশাল বিস্তীর্ন পাথারের মাঝে এটি অবস্থিত । এ যায়গাটি নিয়ে নানাকল্প কাহীনিও ছড়িয়ে আছে মানুষের মাঝে । এখানে নাকি অনেকেই অনেক ভৌতিক ঘটনার সম্মুখিন হয়েছেন । সন্ধ্যার পর তাই এই রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল কম । চলাচল করলেও দলবেধে বা সাথী ছাড়া কেউ করেনা । । যদিও আমি এগুলোকে তেমন একটা গুরুত্ব দেইনা । হয়তঃ মনে করছেন আমি খুব সাহসী, আসলে তা নয় একটু একটু ভয়ও কিন্তু করি । বাড়ী ফিরছিলাম একা একাই। ঘড়ির কাঁটা রাত ১১:১৫ । যথারীতি ৫০-৬০ কিঃমিঃ বেগে ড্রাইভ করছি । জনমানবহীন রাস্তা,চলছি আমি একা, রাস্তার দু ধারে লাগানো মেহগনি গাছের সারি । রাতের বেলা এমন রাস্তা দিয়ে যেতে ধরলে কার না গাঁ ছমছম করে ।




যখন ভৌতিক যায়গা থেকে মাত্র ১ কিঃমি দূরে ঠিক তখনই আমার শরীরটা অজানা এক ভয়ে শিউরে উঠলো । যায়গাটি তাড়াতাড়ি পার হওয়ার জন্য বাইকের গতি বাড়ালাম । প্রায় ৮০ কিঃমিঃ বেগে চলছে , মিটারে লক্ষ্য করলাম । এখন আমি যায়গাটির ঠিক ১৫-২০ গজ দূরে । কলিজাটা আরেকবার মোচড় দিয়ে উঠলো । কবরস্থান ক্রস করছি ঠিক এমন সময় কোন কারন ছাড়াই গাড়ীর হেডলাইট অফ হয়ে গেল ।কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয় । আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো । চলন্ত গাড়ীর এভাবে হেডলাইট অফ হওয়াতে আমি নিজের উপর আস্থা হারালাম । ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার চারিদিকে । কিছুই বুঝার উপায় নেই । মাত্র ১ হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছেনা । আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় । প্রচন্ড ভয়ের পাশাপাশি জীবনের প্রথম এক্সিডেন্ট করতে যাচ্ছি তাও আবার জনমানবহীন এক ভুতুড়ে যায়গায় । এখানে এক্সিডেন্ট করে আহত হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সারারাত পড়ে থাকলেও উদ্ধার করার কাউকে পাওয়া যাবেনা । এমতাবস্তায় একজন ড্রাইভারের যা করনীয় ছিল আমিও ঠিক তাই করলাম । দ্রুত কড়া ব্রেক করলাম । এত স্পীডের গাড়ী ব্রেক করতে করতে খানিকটা পথ চলে গেল । ঠাস করে একটা শব্দ হলো আর একটা ঝাকুনি দিয়ে সাথে সাথেই গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ হলো । একটা মেহগনি গাছের সাথে আচমকা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলাম । নাহ্ পড়ে যাইনি । গাড়ীর উপরেই আছি । আমি নিজেকে পাঁকা রাস্তা ও সাইডের কাঁচা যায়গা পার হয়ে মেহগনি গাছের গোড়ায় আবিস্কার করলাম রাস্তার একদম ঢালু কিনারে । হাত, পা, শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো । সব যেন অবশ হয়ে গেছে । কোন দিকে তাকাতেও পারছিনা ভয়ে । তবুও বাঁচার আশা ছিল মনে । এমন যায়গায় বেশিক্ষন থাকাটাও নিরাপদ না ভেবে দ্রুত গাড়ী নিউটাল করলাম । গাড়ী থেকে নেমে ওটাকে ঠেলে পাকায় তুললাম । এরপর কোন দিকে না তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ীতে উঠে বসলাম । ভেবেছিলাম গাড়ী হয়তো স্টার্ট হবে না । কিন্তু কি আশ্চর্য্য প্রথম চেষ্টায় সফল । মানে গাড়ী স্টার্ট হয়েছে আর হেডলাইটও জ্বলছে । তারমানে হেডলাইট নষ্ট হয়নি ? তাহলে হঠাত্‍ এরকম হেডলাইট অফ হলো কেন ? এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই । আলো জ্বলায় খুশিতে মনটা নেচে উঠলো । আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালাম । তিনি আমাকে তার কুদরতি ক্ষমতায় এতবড় একটা দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেছেন । হয়তঃ আপনাদের মাঝে ফিরে আসবো বলে. . . . .


সওদা প্রথম খন্ড [Ghost stories - 48]




সওদা- ১ম খন্ড



(গল্পটি বেশ বড় বিধায় দুটি খন্ডে শেয়ার করা হবে)


*এক*


খুব দ্রুত জামাটা গায় দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম । দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে নটা বাজে । দেরি হয়ে গেছে । ইদানিং কোন কাজই সময় মতো করতে পারছিনা। সব কাজে কোন না কোন কারণে দেরি হয়ে যায় । বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজগুলো । সাড়ে দশটার মধ্যে এফডিসিতে পৌছতে হবে । অনেক ধরাধরির পর বিখ্যাত পরিচালক এহতে সামস্ সময় দিয়েছেন, তাও আবার পাঁচ মিনিট । মানুষের সময়ের মূল্য যে কতো, তা এ সব বিখ্যাত মানুষগুলোকে না দেখলে বোঝা যায় না। এই পাঁচ মিনিট সময়ের
মধ্যে তাকে পুরো চিত্র নাট্যটি বোঝাতে হবে । যদি তার পছন্দ হয়, তা হলে তিনি তার পরবর্তি ছবির জন্য আমার লেখাটি নেবেন । এটাই কোন পরিচালকের সঙ্গে আমার চিত্রনাট্য নিয়ে প্রথম সাক্ষাত নয় । এর আগেও
অসংখ্য বার অসংখ্য পরিচালক আমার চিত্রনাট্য দেখেছেন । এবং প্রতিবারই আমি প্রত্যাক্ষিত হয়ে যন্ত্রনার শেষ সীমায় পৌছে পার মাতাল হয়ে মেসে ফিরেছি । বাংলা সিনামায় চাকবুম চাকবুম বিষয় না থাকলে ঠিক জমে না । অথচ আমি সেই চাকবুম চাকবুম জিনিষটাকে আমার চিত্রনাট্য থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছি । চিত্রনাট্য নেড়ে চেড়ে সিগারেটের পেছনে দম দিতে দিতে এক এক জন বলছেন, মিয়া নাচ-গান নাই এইটা কোন
সিনামা হইলো ? নাচে গানে ভরপুর কিছু নিয়া আস, পার্বলিক নায়িকার উত্তাল নাচ দেখতে চায় । নায়িকারে বৃস্টিতে ভিজাও পানিতে চুবাও , প্রয়োজনে বন জঙ্গলে নিয়া হাটুর উপড়ে সাপের কামড় খাওয়াও তা হইলেই না সিনামা হিট হইবো আমি নায়িকারে বৃস্টিতেও ভিজাতে পারছিনা আবার পানিতেও চুবাতে পারছি না । না পারছি হাটুর উপড় সাপের কামড় খাওয়াইতে । তাই কোন পরিচালক আমার চিত্রনাট্য গিলছে না । কাজেই
প্রত্যাক্ষিত হয়ে মাতাল হয়ে পরিচালকদের চৌদ্দগোস্টিকে গালিগালাজ করে মেসে ফেরা ছাড়া আমার কোন উপায় নাই ।


মধুমিতা মেসের মালিক সদু ভাই আমাকে বিশেষ ভালবাসেন বিধায় ঐ অবস্থায় আমি মেসে ফিরতে পারি । তা না হলে যে কি হতো কে জানে । তা ছাড়া এ জগতের মানুষের এ অভ্যাসটাকে লোকে অনেকটা মেনে নিয়েছে । আজও হয়তো ভাংঙ্গা মন নিয়ে মাতাল হয়ে আমাকে গভীর রাত্রিরে মেসে ফিরতে হবে । যতোটা উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছি; হয়তো তার চাইতেই ঢের বেশি মনকষ্ট নিয়ে ফিরে আসবো । তাই বলে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র আমি নই । একবার না পারিলে দেখ শতবার নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলেছি ।


টেবিলের উপরে রাখা ব্যাগটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম । লেখাটি ঠিক মতো আছে কিনা । গত রাতে পুরো চিত্রনাট্যটি বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটাছেড়া করেছি। পরে ফ্রেশ করে নেওয়া যাবে । এখন সময় নেই । আলমারি খুলে এ মাসের বেতনের শেষ পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে মানিব্যাগে নিলাম। মাসের বাকি এখন ও দশ দিন । বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে কে জানে ।


দরজায় তালা দিয়ে । সিড়ি দিয়ে নীচে নামতেই কাউন্টারের সামনে দেখি সদু ভাই দাঁড়িয়ে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন । খুব সম্ভব এরা মেসের বাবুচি হবে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে তারাহুরো করে নামতে দেখে সদু ভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে-কাউন্টারের উপড় রাখা পিক দানিতে পানের পিক ফেলে বললেন, কি রাইটার সাব , আবারও মনে হয় যাইতাছ ? আমি একটু থেমে মাথা নেড়ে বললাম , জি সদু ভাই, দোয়া করবেন ?
তা এইবার কারে দেখাইবা ?
এহতে সামস্ । আমি ছোট্র করে নামটা বললাম ।
ক ও কি মিঞা ? ঐ ব্যাটা তো হুনছি হিটের পর হিট । ঠিক লোকরেই ধরছো মনে হয় । তোমার দিয়া হইবোই হইবো এইডা আমি কইয়া দিলাম । সদু ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপর দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে জর্দ্দার কড়া গন্ধ নাক এসে নাকে লাগল । আমি চলে যাবার ভঙি করে, বললাম, দোয়া করবেন সদু ভাই ।
দোয়া তো করমুই, এইডাই তো এখন আমাগো বাংলাদেশে একমাত্র ফ্রি জিনিষ । তা কুনহানে দেহা করবা ওনার লগে ? যাইবা কই ?
এফডিসিতে ?
কও কি ?
জ্বি, ওনার একটা সুটিং আছে. ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলবেন ।
বা: বেশ ভাল । হাতে সময় থাকলে তোমার লগে যাইতাম । এফডিসির ভেতরটা দেহনের আমার খুব সখ ।
সদু ভাই, আমি তাহলে আসি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, হাতে একদম সময় নাই । সাড়ে দশটার মধ্যে পৌছাতে হবে । আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললাম । আরে তাইলে তো আসলেই সময় নাইকা । এহনতো অফিস টাইম । এখন গাড়ি ঘোড়াও পাওয়া কঠিন; চলো আমার লগে দেহি নাসিরার গ্যারেজে গাড়ি আছে কিনা । আমি চমকে উঠলাম । কেননা সদু ভাই এর সঙ্গে যাওয়া মানে আরেক যন্ত্রনা । দেখা যাবে গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে দশটা বেজে যাবে । আমি তারাতারি না,না করতে করতে বললাম, আপনাকে কষ্ঠ করতে হবে না সদু ভাই, আমি খুঁজে নিবো ।
আরে মিঞ খুঁইজা নিবা বললেই হইলো নাকি ? গাড়ি পাইতে হইবো না ? চলো আমার লগে। সদু ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, রাতের জন্য পোলাও গোস্ত করিস । আজ রাইটার সাহেবের জয় হইবোই হইবো। আমি সদু ভাইয়ের এই স্নেহের কাছে পরাস্ত হয়ে তার পিছু পিছু মেস থেকে বের হয়ে এলাম । বুক চিরে বের হয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস ।


নাসিরের গ্যারেজে অতি সহজেই গাড়ি পাওয়া গেল । গ্যারেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সদু ভাই বললেন; চলো আইজকা তুমি সফল হইবা কি হইবা না তার একটা ছোট্র পরীক্ষা কইরা ফেলাই ?
কিভাবে ? আমি দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম । যদি নাসিরার গ্যারেজে যাইয়াই গাড়ি পাইয়া যাই তাইলেই মনে করুম তুমি আজ সফল । ঐ পরিচালক ব্যাটা তোমার বই লইবোই লইবো ।
আমি এসব বিশ্বাস করি না । তাই মুখে কিছু বললাম না । কিন্তু তবুও দেখা গেল সত্যিই
গ্যারেজে গাড়ি পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখার জন্য মনে মেনে বেশ উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম ।


নাসিরের গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি, দরজার সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সদু ভাই
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, তুমি জিতা গেছ । যাও, আইজকা
তোমারে আর কেউ আটকাইতে পরবোনা কইয়া দিলাম । প্রাথমিক বিজয়ে আমার মনটাও খুশিতে
ভরে উঠল ।
গ্যারজের মালিক নাসির একটা ময়লা বিছানার উপড়ে বসে চা খাচ্ছিল, সদু ভাইকে দেখে
তারাহুরো করে নেমে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু লাগবো ভাই ? আমারে খবর
পাঠাইলে তো আমিই যাইতাম ।
তা,তো যাইতিই। এখন দেখ একটা গাড়িটারি আছে কিনা,আমাগো রাইটার সাব এফডিসিতে
যাইবো ।
এই সিএনজিতে গেলে হয় না ভাই, নাকি গাড়িই লাগবো ? নাসির আমার দিকে তাকিয়ে
দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা সিএনজিটা দেখিয়ে বলল ।
গাড়ি লাগবে না, সিএনজিতে হলেও চলবে । বলে আমি সদুভাইয়ের দিকে তাকালাম ।
তোর ড্রাইবার কই ?
আছে, মনে হয় মুততে গেছে । দাঁড়ান আমি ওরে লইয়া আইতাছি । বলেই নাসির দৌড়ে
গ্যারেজের পেছনে চলে গেল ।
নাসিরারা কামডা দেখলা, এইসব পোলাপান হালায় ম্যানার জানে না; তোমার সামনে
ক্যামনে কইলো মুততে গেছে । তুমি কিছু মনে কইরো না । আইউক দিমুনে কানের পেছনে
দুইডা ভনচটকোনা, হালায় পুতে কইবোনা, বার্থরুমে গেছে । যাও যাও তুমি জিএনজিতে
যাইয়া বও । রাইতে তারাতারি আইয়া পইরো পোলাও গোস্ত হইবো কিন্তু । আমি মাথা
নেড়ে সিএনজিতে উঠে বসলাম । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে
এসে , সিএনজি স্ট্যাট দিল ।
সদু ভাই কাছে এসে বলল, এক্কেবারে ঝড়ের বেগে লইয়া যাবি । সময় মতো পৌছাইতে না
পারলে কিন্তু ঘারে খাবি । সদু ভাই এর এই বাড়াবারি দৃস্টিকটু, অনেক সময় অসহ্য লাগে।
কিন্তু প্রচুর অর্থ কড়ি , উদারতা আর সান শওকতের জন্য সবাই সদু ভাইকে বেশ সমিহ করে
চলতে বাধ্য হয় ।


ছেলেটা আমায় সত্যিই ঝড়ের বেগে নিয়ে এলো । আজ সবই দেখি বেশ ভালয় ভালয় হচ্ছে। রাস্তাতে জ্যাম ছিল না বললেই চলে । এফডিসির গেটে বিশাল ভীর । নায়ক নায়িকাকে দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের অভাব নাই । অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে গেটে পৌছে গেট পাস দেখাতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।


১১ নম্বর ফ্লোরে এহতে সামস্ সাহেবের সূটিং চলার কথা । ১১ নম্বরটা কোথায় তা কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করে ১১ পৌছে দেখি বিশাল এক তালা ঝুলছে । গেটের সামনে কয়েকজন গার্ড বসে গল্প করছে । মনটা খারাপ হয়ে গেল । অনেকটা অনিচ্ছা সত্যেও গার্ডদের এহতে সামস্ কথা জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলল, স্যার, ইউনিট নিয়ে ১৩ নম্বর গেছে । ঐ হানে যান, ১১ নম্বরের জেনারেটার খারাপ হইছে তাই এইহানে সুটিং বন্ধ । ১৩ নন্বরটা কোন দিকে তা জেনে নিয়ে আমি জোরে পা চালালাম ।


*দুই*


১৩ নম্বরে পৌছে আমি এহতে সামস্ সাহেবকে সালাম দিলাম । তিনি আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন । আমি পেছনে দিকে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম । এটা সেটা করে পুরো সেট রেডি করতে করতে ২টা বেজে গেল । লাঞ্চের পর সূটিং শুরু হলো । সূটিং মানে এক এলাহিকান্ড । আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে সুটিং দেখতে লাগলাম । এক একটা সট তিন চারবার করে নেওয়া হচ্ছে । যে সটটা আমার কাছে ওকে মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সেটাই পরিচালক সাহেব কাট করে আবার নতুন করে টেক করছেন । টানা রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত
সূটিং চলে প্যাক আপ করা হলো । আমার অবস্থা ততোখনে কাহিল । এতো দীর্ঘ সময় প্রতিক্ষা আমাকে আর কখন ও করতে হয়নি । কয়েকবার মনে হয়েছিল চলে যাবার কথা । কিন্তু নিজের স্বপ্ন , নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চলে যেতে পারিনি । আর তাছাড়া চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষটা ব্যস্ত । নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়ে বেধে রেখেছি যে, কস্ট না করলে, কেস্ট মেলে না ।


প্রায় পৌনে ১২টার সময় আমার ডাক পরলো । পুরো সেট তখন প্রায় খালি হয়ে গেছে । কয়েকজন সেট থেকে এটা সেটা খুলে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে । এহতে সামস সাহেব বেশ রাশ গম্ভীর মানুষ । অপরিচিত জনের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না । পুরো সূটিং চলাকালীন সময় আমি তাকে একবারের জন্যও হাসতে দেখিনি । আমাকে নিয়ে তিনি বসলেন পরিচালকদের রুমে । ওনার হাতে ছোট একটা গ্লাস । আমি রুমে ঢুকে আবারও সালাম দিতে উনি , মাথা নেড়ে বসতে বললেন । তারপর গ্লাসে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে বললেন
কতো দিন ধরে লেখালেখি করছো ?
জ্বী,ছোটবেলা থেকেই ।
ছোটবেলা থেকে ? তিনি ঠোট উল্টে তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে আমার কথাটা রিপিট
করলেন ।
তা দুএকটা নাটক টাটক কি টিভিতে গিয়েছে ?
জ্বি না , আমি টিভির জন্য কোন নাটক লিখিনি ।
টিভিতে না লিখে একেবারে চলচিত্রে ? ছোট থেকে না শুরু করতে হয় । 
বলে তিনি আবারও গ্লাসে চুমুক দিলেন ।
আমি কিছু বললাম না । আমি মনে মনে বললাম, আমি বড় থেকে ছোটর দিকে যাবো বলে ঠিক
করেছি । সুযোগ পেলেই মানুষ উপদেশ ঝারতে শুরু করে । তার উপড়ে হাতে যদি রঙ্গিন পানির গ্লেলাস থাকে তা হলে তো আর কথাই নেই । আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন ,দেখি কি এনেছো আমার জন্য ? বলে তিনি হাত বাড়ালেন । আমি ব্যাগ থেকে চিত্রনাট্যটা বের করে হাতে
দিলাম ।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চিত্রনাট্যটার একটা একটা করে পাতা উল্টাতে লাগলেন আমার বুক তখন ধুকধুক করছে । আমি মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করছি এই জন্য যে, এবার যেন আমাকে আর প্রত্যাক্ষিত হতে না হয় । এবার যেন খুশি মনে ফিরতে পারি । এ লাইনের নিয়মই হচ্ছে একবার যদি কোন পরিচালক একটা লেখা নিয়ে কাজ শুরু করেন তা হলে আর বসে থাকতে হয় না। একেরপর এক কাজ আসতেই থাকে । যতো সময় যাচ্ছিল তোতোই উত্তেজনার আমার হাত পা কাঁপতে লাগল । আমি কোন রকম বসে রইলাম । তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছেন । আর আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে । অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। আমি যেন আমার সাফল্যের হাতছানি দেখতে পাচ্ছি।


একসময় তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন এটা তুমি লিখেছো ?
জ্বি ? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম ।
তোমার লেখাটা এক কথায় চমৎকার প্রচুর কাজ করেছো বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু এ লেখা নিয়ে তো আমি কাজ করতে পারবো না । তোমার এ গল্পটা হলিউডে হলে লুফে নিত । কিন্তু আমাদের দেশের পারিপাশ্বিক অবস্থার জন্য এ গল্প চলবে না । আমি দু:খিত । তুমি অন্য একটা গল্প নিয়ে আস ।
আমার মন ভেঙ্গে গেল । আমি কিছু বললাম না । উঠে দাঁড়ালাম ।
আমাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন তোমার হাতের টার্ন ভাল , আমি তোমাকে একটা থিম দিচ্ছি তুমি এটা নিয়ে কাজ করো ।
সরি স্যার, আমি শুধু নিজের থিম নিয়েই স্টরি তৈরি করি । আমি ওনার হাত থেকে চিত্রনাট্যটা নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে এলাম । সঙ্গে সঙ্গে একঝাক হতাশা আমায় ঝেকে ধরলো । মনে হলো এ জীবনের কোন মানে হয় না । এ জীবনের জন্য শুধু ব্যর্থতা পর ব্যর্থতাই অপেক্ষা করছে ।


অনেক রাত হয়ে গেছে । পথ ঘাট একেবারে জন শুন্য । কিভাবে মেসে পৌছাব আমার সে চিন্তা নেই । এফডিসি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম । কয়েক কদম হেঁটে মাছের আড়ৎটার সামনে আসতেই একটা লোককে দেখতে পেলাম । একটা খুটির সঙ্গে হেলাম দিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেপুরানো কালো একটা কোট গায়ে দিয়ে আছে । পাদুটো খালি । মাথাটা কেমন অস্বাভিক রকমের বড় । লোকটাকে দেখে আমার পাগল বলে মনে হলো । আমি না দেখার ভান করে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম । লোকটার সামনে যেতেই লোকটা গলা খাকারি দিল । আমি ফিরে তাকালাম লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে কোন রকম জড়তা ছাড়াই বলল কি কিছু হলো ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । লোকটা আবারও বলল, কিছুই হয়নি তাই না?
কি হয়নি ? আমি চরম বিরক্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম ।
তোর চিত্রনাট্য তো ঐ বুড়ো ভামটা নেয়নি, তাই না ?
আমি বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম । এহতে সামস্ এর সঙ্গে আমার কি কথা হয়েছে তা তো এই পথের লোকটার জানার কথা নয় । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞিস করলাম, কে আপনি ?
আমি কে ? সেটা বড় কথা না , আমার কথা সত্য কিনা সেটা বল ।
আমি অনিচ্ছা সত্বেও মাথা নাড়লাম । যার অর্থ হলো , হ্যা , তিনি আমার লেখাটি নেননি ।
ঐ বুড়ো ভামটা যে নিবে না তা আমি আগেই জানতাম । বলে লোকটা খেক খেক করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে আমি কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম । মাছের আশটে গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগল ।
দুপা পিছিয়ে এসে প্রশ্ন করলাম আপনি কে , কি করে এসব জানলেন ?
বললাম না , আমি কে সেটা বড় ব্যাপার না । আমি সব জানি । তোর অতীত জানি, তোর বর্তমান জানি; আবারও তোর ভবিষ্যতও জানি । লোকটা আবারও ভয়াল ভাবে হাসতে লাগল এবার আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম । কোন এক অজানা ভয়ে ভেতরটা কেপে কেঁপে উঠল । আমি কোনরকম তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কি চাই আপনার, কি চাই?
তোর সঙ্গে সওদা করতে করতে চাই ? লোকটা হাসি থামিয়ে সরাসরি আমার চোখের দিকে
তাকিয়ে বলল । ভয়ন্কর হলুদ দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার পুরো শরীর কাপতে লাগল ।
হঠাৎ আমার মনে হলো আমার বমি পেয়েছে । বমি করতে পারলে ভাল হতো । আমি আবারও
তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কিসের সওদা ?
তোর খ্যাতি, যশ্, প্রতিস্ঠা তোর সকল স্বপ্ন পুরণের সওদা ।
মানে ?
মানে সোজা ,তুই উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ান্তে যেখান থেকে সব কিছু অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। যেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না । করবি এমন সওদা ? আমি তোকে সব সব দেবো । লোকটা আমার মুখের কাছে এসে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল । বিশ্রী মাছের আশটে গন্ধটার জন্য আমি আবারও পিছিয়ে গেলাম । টের পেলাম তীব্র ভয়ে আবার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । ভয়ন্কর কিছুর শন্কায় আমি ছুটে পালাতে চাইলাম । লোকটা মনে হয় আমার মনোভাব বুঝতে পেরে খপকরে আমার বাম হাতের কব্জির উপড়ে চেপে ধরল । আমি তীব্র ব্যর্থায় উহু করে শব্দ করে উঠলাম । লোকটা হাসতে হাসতে বলল , রাজি আছিস ?
রাজি আছিস ? তুই মনে মনে যেমনটা চেয়েছিস ঠিক তেমনটাই হবে,তরতর করে উঠে যাবি
খ্যাতির চুড়ায় । এসব বুড়ো ভামরা লাইন দিয়ে পরে থাকবে তোর লেখার জন্যে , বল রাজি
আছিস কিনা । বলে ফেল, বলে ফেল ।
আমি কয়কে মিনিটের মধ্যে যেন আমার ভবিষ্যত দেখে ফেললাম । সকল ভয়কে উপেক্ষা করে
বললাম , তাতে আপনার কি লাভ ?
আমার কি লাভ ? বলে লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল । তাতে আমার পুরো শরীর আবারও
কাঁটা দিয়ে উঠল ।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, দেবার মতো তো আমার কিছু নেই ।
তোর সব আছে, আমার প্রয়োজনে আমি চেয়ে নেবে । তোর প্রয়োজনে তুই চেয়ে নিবি । আছিস
রাজি ? বলে ফেল , বলে ফেল ।
আমি মনে মনে চিন্তা করলাম । হারাবার মতো আমার কিছুই নেই । আবার দেবার মতোও
নেই কিছু । তা হলে লোকটা কি চাচ্ছে ?
ঠিক তখনি আমার ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল রাজি; আমি রাজিতোর তো আপন কেউ
নেই, তাই হারাবারও কিছু নেই ।
তুই তাহলে রাজি ? লোকটা আমার দিকে অদ্ভূত ঘোর লাগা চোখে তাকাল ।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, রাজি । সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিল আমার কাছে
মনে হলো পুরো হাতটা অবশ হয়ে গেছে । আমি হাতটা ঝারতে ঝারতে লোকটার চোখের দিকে
তাকালাম । মনে হলো, আমার পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো । সঙ্গে সঙ্গে আমি বর্মি করে
ফেললাম । অনেকক্ষন বর্মি করার পর একটু আরাম হলো । আমি লোকটার দিকে তাকাতেই
দেখি কেউ নেই। কালো খুঁটিটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে । আমি মাতালের মতো
টলতে টলতে মেসের দিকে পা বাড়ালাম ।


*তিন*


মধুমিতা মেসের সামনে ভীড়টা চোখে পরার মতো । মূল রাস্তায় দুটো পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । অনেকক্ষন হাঁটার ফলে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করছি । মনে হচ্ছে গোসল করতে পারলে ফ্রেস লাগত । কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে এতো লোকজন কি করছে বুঝতে পারলাম না । কৌতুহল নিয়ে মেসের ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই গেটের কাছে একজন এসআই আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল । আমাকে আপাত মস্তক এক নজর দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, কে আপনি ?
জ্বি, আমার নাম রন্জু । এখানেই থাকি ।
এতো রাতে কোথা থেকে এলেন ?
জ্বি কাজ ছিল একটা ।
কি কাজ ?
এফডিসিতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ।
করেন কি ?
লেখালেখি করি ? গল্প, উপন্যাস , চিত্রনাট্য লিখি ।
ও বই লিখেন ?
লোকটা কি বুঝে প্রশ্ন করল বুঝলাম না, মাথা নেড়ে বললাম, হ্যা ।
তা, কতো দিন ধরে এখানে আছেন ?
বছর তিনেক হলো ।
কাউন্টারের কাছে ম্যানেজার বদরুলকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে । এতো বড় একজন
মানুষের কান্না দেখতে ভাল লাগেনা । তার উপরে বদরুলকে তো আরো না । আমাকে দেখে
বদরুল রন্জু ভাই বলে ছুটে এসে জরিয়ে ধরল ।
বদরুল লোকটাকে আমার বিশেষ পছন্দ না । আমি পারত পক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলি না ।
বদরুলও আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে । সেই বদরুলের এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরায় আমি
অবাক না হয়ে পারলাম না । মানুষের আবেক কে কখনও উপেক্ষা করতে নেই । হোক না সে
যেমনই মানুষ । কিন্তু বদরুলের ব্যাপারটা ভিন্ন । আমি বদরুলকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম
অথচ শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম;কি হয়েছে বদরুল ?
সদু ভাই ; বলে বদরুল আবারও কাঁদতে লাগল । আমার কাছে মনে হলো বদরুল অভিনয় করছে ।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলাম, সদু ভাই কি ?
সদু ভাই আর নেই ।
নেই মানে কি? কোথায় গেছেন ? ভনিতা না করে আসল কথা বলো । আমি আস্থির হয়ে উঠলাম ।
সদু ভাই, সদু ভাই আত্মহত্যা করেছেন । বলে বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে লাগলো।
এবার আর ওর কান্নাটাকে অভিনয় বলে মনে হলো না ।
আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, কোথায়, কেন ?
উপড়ে বলে, বদরুল আঙুল দিয়ে দোতালাটা দেখিয়ে দিল।


দোতালার শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটা রুম আছে । সদু সেটাকে অফিস হিসাবেই ব্যবহার
করেন । পাশে একটা বিছানা পাতা আছে মাঝে মাঝে রাতে থেকে গেলে সেটাতে সদু ভাই
ঘুমান ।
আমি এসআইয়ের দিকে উপড়ে যাবার অনুমতি পাবার দৃস্টিতে তাকালাম । এসআই আমার কাঁধে
হাত রেখে বললেন, যান। তবে কিছু স্পর্শ করবেন না । এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।
ঠিক আছে, বলে দ্রুত উপড়ে উঠে এলাম । বারান্দায় চেনা অচেনা অনেক মানুষ । কয়েকজন
পুলিশ ও রয়েছে । আমার রুমটা মাঝামাঝি । আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়
দেখলাম তালা দেয়া ।
যারা আমাকে চেনে তারা আমাকে দেখে সরে গিয়ে ভেতরে যারার রাস্তা করে দিল । সদু
ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই আমি ভয়ন্কর রকমের ভয় পেয়ে গেলাম, ফ্যানের সঙ্গে বিশ্রী ভাবে
সদু ভাইয়ের দেহটা ঝুলছে । জ্বিবটা মুখ থেকে বের হয়ে আছে । চোখ দুটো খোলা ।
বিশাল দুটো হাত দুপাশে ছড়ান । পুরো শরীরে কোন কাপড় নেই । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে
গেলাম । হঠাৎ টের পেলাম আমার মাথা ঘুরছে। আমি কোন রকম বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।


থানা থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল রিপোট তৈরি করে পোস্টমটেমের জন্য লাশ
নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো । পুলিশ মেসের বোর্ডারদের থানাতে না জানিয়ে কোথাও না
যাবার নির্দেশ দিয়ে চলে গেল । ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। ইতিমধ্যে আমি একটু
ধাতস্ত হতে পেরেছি । সদু ভাই নেই । কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতটা কেমন জানি করে
উঠছে। বারবার সদু ভাইয়েই মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।


রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের উপড় আমার খাবার ঢেকে রাখা । তারমানে হচ্ছে সদু ভাইয়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমার খাবারটা রুমে দিয়ে গেছে । আহা: সদু ভাই, আমি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম । বুক চেপে ধরে খাটের উপড় বসে পরলাম। হঠাৎ এফডিসির বাইরে দেখা লোকটার কথাটা কানে ভাসতে লাগল, তোর তো আপন কেউ নেই , তাই হারাবারও কিছু নেই । তুই তাহলে রাজি ? তুই তাহলে রাজি ? আমার মনে হলো সদু ভাই আমার আত্মীয় না হয়েও অনেক বেশি আপন ছিল । অনেক, অনেক বেশি ।


পরের দিন সাড়ে ১২টার সময় দরজার প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । তারাহুরো করে উঠে দরজা খুলে দেখলাম বদরুল দাঁড়িয় আছে ওর পাশেই পরিচালক এহতে সামস্ । আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম । আমার মেসে এহতে সামস্ এর মতো পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি । 
আমি একটু ঘাবরে গিয়ে বললাম স্যার আপনি ?
দেখ, দেখি তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম; তা তুমি কি ফ্রি আছো ? তাহলে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিতাম ।
জ্বি স্যার, আসুন ভেতরে আসুন । বলে আমি দরজা থেকে সড়ে দাঁড়ালাম । এই প্রথম রুমের ভেতরের অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা লাগল । এহতে সামস্ চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে টেবিল থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরলেন । আমি বললাম, স্যার যদি কিছু মনে না করেন ; আমি হাত মুখটা ধুয়ে আসি । তিনি মাথা নেড়ে বললেন, সিওর । তারপর এগিক ওগিক তাকিয়ে বললেন, তোমার এখানে এসট্টে নেই ? সিগারেট ছাড়া আমি আবার একদম চলতে পারি না। আমি খাটের নীচ থেকে একটা ভাঙা চায়ের কাপ অনিচ্ছা সত্বেও বের করে টেবিলের উপর রাখলাম । এহতে সামস্ কাপটা দেখে হেসে সিগারেট ধরালেন । আমি বদরুলকে চা বলে বার্থরুমে ঢুকে গেলাম ।


এহতে সামস্ সাহেব আমাকে দুলাখ টাকার একটা ক্যাশ চেক দিয়ে একটা কাগজে সাইন
করিয়ে নিলেন । আমার চিত্রনাট্যটি নিয়ে তিনি কাজ করবেন । সূটিং শুরু হবে মাস
দুয়েকের মধ্যেই । তখন আরো তিন লাখ পেমেন্ট করবেন । জীবনের প্রথম সাফল্যে আমি
থরথর করে কাঁপতে লাগলাম । উত্তেজনায় কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে সেটাও ভাল করে
পড়তে পারলাম না । এহতে সামস্ এর দেখানো জায়গাতে সাইন করে চেকটা হাতে নিলাম
হঠাৎ সদু ভাইয়ের জন্য আবারও মনটা কেদে উঠল । মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ সব চাইতে
বেশি খুশি হতো । এহতে সামস্ সাহেব বিদায় নেবার পর আমি ব্যাংকে ছুটলাম। সদু
ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য কিছু টাকা খরচ করবো ।


সদু ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেসটা যেন অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে । দোতালার বেশ
কয়েকজন বোর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে মেস ছেড়ে চলে গেছে । অনেকেই বলাবলি করছে
রাতের বেলা তারা নাকি সদু ভাইকে দেখেছে মেসের বারান্দা দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে
হাঁটতে । কথাটা এ কান ওকান হয়ে আমার কানে এসে পৌছলে আমি সেটাকে মোটেও গুরুত্ব দেলাম না । বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি, মরে গিয়ে সে কিনা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটবে ? সব চাইতে বেশি কথা ছড়াচ্ছে কাজের বুয়া রেহানার মা । বুয়াটা রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছে । সদু ভাইকে বুয়া নাকি রান্না ঘরে দেখেছে । সকাল বেলা বুয়া থালা বাসন ধুচ্ছিল, তখন হঠাৎ রান্না ঘরে খটর মটর শব্দ শুনে বুয়া রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, সদু ভাই খালি গায়ে চুলার কাছে কি যেন খুঁছছে । বুয়া দরজার কাছেযেতেই, সদু ভাই নাকি বলে উঠেছে, ও রেহানার মা ম্যাচটা কোথায় রেখেছো
 ম্যাচটা দাও, সিগারেট খামু ।


বুয়ার এ গল্পটাই সব চাইতে বেশি ছড়িয়ে পরেছে । আশে পাশের দশ বাড়িতেও এ নিয়ে
বিস্তর আলোচনা চলছে । আমি এসব কথাবার্তাকে মোটেও গুরুত্ব দেচ্ছি না। কারো সঙ্গে এ
প্রসঙ্গে আলোচনা ও করছি না । বার দুয়েক বদরুল এসেছিল আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা
বলবে । এর কথার শুরুতেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, বদরুল বাজে বিষয় নিয়ে কথা
বলে আমার সময় নস্ট করবে না, যাও নিজের কাজ করো গিয়ে । বদরুল আর কিছু বলেনি
মাথা নীচু করে চলে গেছে । যতোসব বাকোয়াস কথাবার্তা । আমি পূর্ণ উদ্যোমে লেখা
লেখি চালিয়ে যাচ্ছি । ইতিমধ্যে একটি পত্রিকায় আমার ছোটখাটো ইন্টারভিউও ছাপা
হয়েছে । অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বিদ্যূতের গতিতে নতুন চিত্রনাট্য লিখে চলেছি ।
পরপর দুটো ফিকুয়েন্সের কাজও শেষ করে ফেলেছি । ঝামেলা বাঁধল তৃতীয়টার সময় । সদু
ভাইকে মেসে দেখার ঘটনাগুলো আমি গুরুত্ব না দিলেও আমার অজান্তেই মেসের ভেতর একটা
কিছু ঘটে যাচ্ছিল তার প্রমান পেলাম আরো দুদিন পর । আমার পাশের রুমে থাকেন
ব্যাংক কর্মকতা ওমর ফারুক সাহেব । সাদাসিদে অমায়িক লোক । কারো আগে পিছে নেই ।
তিনি কিনা রাতের বেলায় কি দেখে ভয় পেয়ে হার্ট এ্যটাক করে হাসপাতালে ভর্তি
হলেন । ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব একটা কতাবার্তা না হলেও আমি তাকে হাসপাতালে
দেখতে গেলাম ।


ইদানিং বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর চেহারা বদলে গেছে । ঝকঝকে তকতকে
হাসপাতাল দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। ওমর ফারুক সাহেব আছেন হাসপাতালের দোতালার
একটি কেবিনে । আমি তার কাছে পৌছে দেখি তিনি আঙুর খাচ্ছেন । দশ কি বারো বছরের
একটি মেয়ে তার মুখে একটা একটা করে আঙুর তুলে দিচ্ছে । আমাকে দেখে ওমর ফুরুক সাহেব
একটু লজ্জা পেলেও হেসে বললেন, আসেন লেখক সাহেব । আমি ভেতরে ঢুকে হেসে জিজ্ঞেস
করলাম, তা এখন কেমন আছেন ?
জ্বি ভাল । ওমর ফারুক সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি আবারও লজ্জা পেলেন ।
ও কি আপনার মেয়ে নাকি ? আমি মেয়েটার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম ।
জ্বি । দেখুনতো কতো করে বলছি হাসপাতালে ছোটদের আসার দরকার নেই, কিন্তু তবুও
নাছোড়বান্দা আমাকে দেখতে নাকি আসতেই হবে । মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু
অনেক মিস্টি । আমি মেয়েটাকে কাছে টেনে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কি মা ?
মেয়েটা ছোট করে বললো, মায়া ।
বাঃ সুন্দর নাম ।
তা, তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
ক্লাস থ্রি তে ।
আমিও তো থ্রি তে পড়ি । যাক তুমি আর আমি একই ক্লাসে পড়ি । আমি হেসে বললাম ।
তুমি মিথ্যা বলছো । তুমি তো বড় । তুমি আব্বুর লেখক বন্ধু । আব্বুর সঙ্গে থাকো । আমি সব
জানি ।
ওমা তাই নাকি ? তুমিতো দেখছি তোমার আব্বুর বুড়ি মা ।
আমি বুড়ি না আমার বয়স তো মাত্র এগারো বছর । এমন সময় ওমর ফারুক সাহেবের স্ত্রী
আসলেন । তিনি মেয়েকে নিয়ে বাহীরে গেলে ওমর ফারুক সাহেব আমাকে বললেন, ভাই
আমি আর ঐ মেসে যাবো না । একটু সুস্থ্য হলে জিনিষ পত্র সব নিয়ে আসবো ।
কিন্তু কেন ?
মেসটার দোষ হয়েছে । ওখানে খারাপ আত্মা বাসা বেঁধেছে । আমি বলতে যাচ্ছিলাম এসব
বাজে কথা। কিন্তু কিছু বলার আগেই ওমর ফারুক সাহেব বলে উঠলেন, আমি জানি আপনি এসব
বিশ্বাস করেন না । তবুও বলছি, সম্ভব হলে আপনিও মেসটা ছেড়ে দিন ।
আপনি ভয় পেলেন কি দেখে ? আমি সরাসরি ওমর ফারুক সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে
প্রশ্ন করলাম ।
ওমর ফারুক সাহেব একটু স র্সত নিয়ে বললেন, সদু ভাইকে দেখে ।
সদু ভাইকে ?
জ্বি ।
তা কি দেখলেন ?
বার্থরুমে যাবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায় বের হয়েছ দেখি সদু ভাইয়ের রুমের দরজা
খোলা । আলো জ্বলছে । এতোরাতে সদুভাইয়ের রুমে কে, কি করছে তা দেখার জন্য আমি
এগিয়ে গেলাম । দরজার দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিতেই দেখি; সদু ভাই হাতে একটা মোটা
দড়ি নিয়ে ফ্যানের নিচে একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন । দড়িটা ফ্যানে বাঁধার চেস্টা
করছেন। আমি, কে ? বলার সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
ব্যান্কার ভাই চেয়ারটা একটু শক্ত করে ধরো তো দেখি । মনে হচ্ছে পইড়া যামু । আমার
আর কিছু মনে নেই । সঙ্গে সঙ্গে বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি । তারপর বুক চেপে ধরে
পরে গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে ।


ওমর ফারুক সাহেবের কথা ফেলে দিতে পারলাম না । একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গেল ।
ভয় হচ্ছে সংকামক ব্যধির মতো একবার কারো ভেতর ঢুকে গেলে ডাল পালা ছড়ায় অন্যের
ভেতরে ঢোকার জন্য । নানান যুক্তি দিয়েও এর কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না ।
একরাশ চিন্তা নিয়ে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে মেসে ফিরলাম রাত ১১টার সময় ।