Monday, December 19, 2011

ছেঁড়া ডায়েরী [ Collection of Love Stories -13 ]





চারপাশে আমাকে নিয়ে যে কানাঘুষা চলছে তা বেশ বুঝতে পারি । আমাকে দেখেই সবাই কেমন করে জানি তাকায় । আমার উপস্থিতিতে হঠাৎ থেমে যায় চায়ের দোকানের বিতর্ক । আমার দিকে নীরবে তাকায় । আমি তাদের চোখে খুজি চিরচেনা সেই বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসা । কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেগুলো । আজ তাদের চোখে কেবলি ভয় আর ঘৃণা । আমি ওদের কাছে আর সম্মানের বশির মাস্টার নই, আজ আমি বিশ্বাসঘাতক । তাদের ধারনা আমি হাত মিলিয়েছি পাকিস্থানীদের সাথে ।

                                                                                   ****

আজ পাকিরা আমার স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে । মোট শখানেক সৈন্য । আমার স্কুলের সবগুলো ঘর নিয়েছে তাদের থাকার জন্য । উত্তরের মাঠের পাশে আর দক্ষিনের পুকুরপাড়ে বাংকার খুঁড়ে ভারি এল.এম.জি. বসিয়েছে । উত্তর-দক্ষিন দুই দিকই বেশ সুরক্ষিত করেছে। ঘন্টায় ঘন্টায় পালা করে পাহারা দিচ্ছে জওয়ানেরা । তাদের  হাবভাবে বেশ বোঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওরা যমের মত ভয় পাচ্ছে । স্কুলের পেছনের জঙ্গলটাকে রীতিমতো পরিষ্কার করে ফেলেছে । স্কুলের ছাদে বসিয়েছে ভারি মর্টার গান । পুবদিকে নদী থাকায় ওদিকেই বেশী ক্যাম্প ফেলেছে সৈন্যদের থাকার জন্য । অধিকাংশ পাকি জওয়ান সাঁতার জানে না । তাই ওরা ধরেই নিয়েছে যে কোনো শত্রু এই খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আক্রমন করার সাহস পাবে না । আমাকে ওদের মেজর বার বার ডেকে নিয়ে গ্রামের ব্যাপারে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে ।

                                                                                    ****

মানুষ যে এতটা নির্মম হতে পারে তা আমারজানা ছিলনা । কতইবা বয়স হবে আকমল ছেলেটার। গত বছর সবে মেট্রিক পাস করেছে । আমার চোখের সামনে বড় হল ছেলেটা । কি নির্মম

নির্যাতন করল ছেলেটার উপর । ও নাকি মুক্তিদের খবর জানে । আমার সামনেই একটা একটা করে ওর হাতের আঙ্গুল কেটে নিলো । তীব্র ব্যথা আর পিপাসায় যখন ছেলেটা পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিল এক ফোটা পানিও ওকে দিল না নরপিচাশ গুলো । আমি শত চেষ্টাতেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । দিন দিন কেমন জানি বোধশক্তি হারিয়ে পশু হয়ে যাচ্ছি । না হলে কিভাবে আমি আমার ছাত্রের উপর এমন অন্যায় সহ্য করলাম ? বাড়ি ফিরে বারবার নিজেকে নিজেই খুন করতে ইচ্ছে করছিল । কি লাভ এই পশুর জীবন নিয়ে বেচে থেকে ? বারবার মনে পড়ছিলো আকমলের অসহায় দৃষ্টির কথা । ওর ঠোটের কোণের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করছিল আমাকে । আকমল, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা । তোর মৃত্যুর সময়েও আমি তোর মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারিনি, এ যে আমার জন্য কতবড় অপমানের তা কেবল আমিই জানি ।

                                                                                     ****

গ্রামের সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে । আমার জন্য তাদের মনে আর সেই ভালবাসার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই । তারা ভেবেছে আমি পাকিদের সাথে হাত মিলিয়েছি । ওরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছে । কিন্তু আমি অসহায়, তাদের কাছে আমার অসহায়ত্ব আমি বোঝাতে পারব না । শুধু আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কতটা ঘৃণা করি আমি ওই হায়েনাদের । যারা আমাদের শোষন করেছে বছরের পর বছর । আজ আবার রক্তাত্ত করছে আমার সোনার বাংলাকে । ওই সব নরপশুদের সাথে হাত মেলানো কিছুতেই সম্ভব না আমার পক্ষে । তবুও আমি অসহায়, আমাকে আমার কাজ করেই যেতে হবে । আমি যে গুরু দায়িত্ত্ব নিয়েছি জীবন দিয়ে হলেও সেই দায়িত্ত্ব আমাকে পালন করতেই হবে । আমি যেন গেরস্থের বাড়ির পাশের সুপারি আর ডাব গাছ । ঝড়- বৃষ্টি মাথায় করে আমায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । আমি ভেঙ্গে পড়লে যে গেরস্থের ঘরের চাল

উড়িয়ে নেবে ঝোড়ো বাতাস ।

                                                                                       ****

আজ রাতে এসেছিলো ছেলেগুলো। ওদের চোখে আমি আগুনের লেলিহান খেলা করতে দেখেছি । বুক ভরা তাদের স্বপ্ন। আমরাও কান পেতে থাকি একদিন আবার এইদেশ এর আনাচে কানাচে বউ কথা কও আর কুটুক পাখির ডাক শোনার জন্য । আবার আমরা প্রান খুলে গান গাইতে পারবো, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারব । যেদিন আর কোন হায়েনার ডাকে কেপে উঠবে না বাংলার ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সোনালি ধানের শীষের দোলায় প্রান নেচে উঠবে কৃষকের । আমি বিশ্বাস করি, এটা স্বপ্ন

নয় । খুব বেশি দূরে নয় সেইদিন । খুব গোপনে আমি দিয়ে এসেছি নকশাটা । আমার ক্যাম্পে আসা যাওয়ার যেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই নকশাতে দেখানো আছে পুরো ক্যাম্পটা । কোথায় কোথায় পাহারা থাকবে, কোথায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কোনদিকটা বেশি অরক্ষিত, সব আছে এই নকশায় । এখন শুধু পরিকল্পনা করে ঝাপিয়ে পরার অপেক্ষা । এখন শুধুই প্রতিশোধ নেয়ার পালা......







পড়তে পড়তে আমার চোখে জল চলে এলো । যাকে আমি এতোদিন এতো ঘৃণা করেছি, যার কথা ভাবলেই আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতো, যে মানুষটার জন্য আমি কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারিনি সমাজে সেই মানুষের লেখা ডায়েরীতে আমি এটা কি পড়লাম । এই মানুষটিই কি আমার বাবা, যাকে আমি বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিলাম । এই মহান হৃদয় মানুষটিকে আমি কেনো এতোদিনেও চিনতে পারিনি । কেনো আমি খুজে পাইনি এই ডায়েরী আর আগে ? আজ আমার আকাশ-বাতাস বল্যে ইচ্ছে করছে আমার বাবা দেশের মানুষের সাথে বেঈমানী করেননি । তিনি নিজের জীবন দিয়েছেন এই দেশের জন্য । তোমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা না বল, তিনি আজ আমার কাছে মহানায়ক । তিনি আমার গর্ব, জন সন্তানের ভাগ্য হয় ?





পরিশেষঃ ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিলো না । ধারনা করা হয়, সেদিনের সেই অভিযানে বশির মাস্টারও অংশ নিয়েছিলেন । ক্যাম্পের ভিতর তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল । সেই অভিযানে কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন । বশির মাস্টারের এই গোপন মিশনের কথা কমান্ডার ছাড়া কেউ জানত না । তাই সবাই ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে বশির মাস্টার প্রাণ

হারিয়েছে । আমাদের আশে পাশেই এরকম হাজারো বশির মাস্টার আজও আড়ালেই রয়ে গেছেন, আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি । অথচ, এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আজ বুক ফুলিয়ে বলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা যাদের কিনা জন্মও হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে । আর কতদিন এভাবে অসম্মানিত করা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ?




_________________________________________________________________________________



লিখেছেন-Raisul Zudge



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ছেঁড়া-ডায়েরী/209666862446804 

আনন্দ বেদনার কাব্য [ Collection of Love Stories -12 ]


যুদ্ধ মানে কি? সংগ্রাম? লড়াই? আর বিজয় মানে কি অর্জন? মমতা ভাবেন আর ভাবেন। এই যে অবিরাম যুদ্ধ, এর শেষ কোথায়!!!




অরিত্রর জন্ম সেই যুদ্ধের সময়। সেই ছেলে দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। পঁচিশ ছুঁই ছুঁই ছিপছিপে এক যুবক। এই যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ।পরনে আকাশ নীল একট টি- শার্ট। হাল্কা কোঁকড়ানো চুল। মসৃণ কাঁধ, ঝকঝকে গায়ের রং আর বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ। একদম মাহিন এর কার্বন কপি । দেখতে এমন এ ছিল মাহিন। শান্ত চেহারা কিন্তু ভেতরে অনেক জেদ। অনেক স্বপ্ন। একটু আবেগপ্রবণ কিন্তু নীতিতে অটল।

-মা নাস্তা দাও।    

-টেবিল এ চল।

-তুমি খেয়েছ?

-না।

-কেন?               

-এমনি।

-খাওনা কেন? এত সকালে উঠো।

-তুই খাবি চল।

-ভাত খাব মা।

-এই সকালে?

-হু। দুপুরে খাওয়ার ঠিক থাকে না।

-বাসায় চলে আসলেই তো পারিস।

- টাইম পাইনা । তোমার সেই কালকের মাংস আছে না?  ফাটাফাটি হইছিল ।

-হু, চল।

-আজকে ফিরতে দেরি হবে মা। প্রোজেক্ট এর কাজ।

-সে আর নতুন কি।

-আমার ভালো লাগে না মা।

-কি?

-এইযে চাকরি খোঁজা ।

-হবে চেষ্টা কর।

-আর কত?

-পানিতে ত পড়িস নাই।

-তুমি আর কত?

-আমার আরো চাকরি আছে ৩ বছর। হয়ে যাবে।নাস্তা খাবি  চল।

-মা তোমার কোন কিছুতে মন খারাপ হয়না?

-না।

-কেন?

-লাভ নাই তাই।

-তোমার কি দারুন ফিলসফি।

-এই ভাত খাবি ত চল।

পিছনে পিছনে অরিত্র আসে। গরম ভাত আর তাতে জ্বাল দেয়া কোরবানির মাংস । ঝুরা ঝুরা হয়ে গেছে , অরিত্রর তাই পছন্দ। তাতে ডাল।গরম গরম।তাতে  মরিচ। অরিত্র হাপুস হুপুস খায়।

-বলে মা রনির জব হল শাফিক এর ও হল একটা । আমার যে কবে হবে।

-হবে হবে আল্লাহকে ডাক।

-তোমার আজকে কি রুটিন?

-মিটিংএকটা আর কিছু নাই।

-কখন যাবা?

-এইত।

-চল একসাথে বের হই।

-না রে। তুই যা।

অরিত্র বেরিয়ে যায় ।



 মমতা গোসল করে রেডি হতে যান। তার এখন ও অনেক লম্বা চুল। টানা মসৃণ । কোমর ছাপানো। তাতে সকালের সূর্যের  আলো পড়ে ঝলমল করছে। একটা হাত খোঁপা বাঁধেন। তার পঞ্চাশ পেরিয়ে  গেছে  কিন্তু মুখে এখন ও তারুণ্য এর আভা। এককালে খুব সুন্দর ছিলেন তিনি। শাড়িতে খুব দারুন লাগত। এখন ও তাই। একটা  হাল্কা আকাশি শাড়ি বের করেন। তাতে সাদা ব্লাউজ।আজকে departmental মীটিং . Agenda আগে ই ঠিক করা।

দরজাতে তালা লাগিয়ে বের হতে হতে ১০ টা। তার আগে একটা বিস্কিট, এক কাপ গ্রীন টি।

চেয়ারম্যানশিপ এর দুই বছর চলছে।সপ্তাহে ২টা ক্লাস। আজকে ক্লাস নাই।

রুম এ রুমানা বসে আছে ।দেখতে খুব নরম শরম শান্ত । তার ছোট বোন তুলির মেয়ে।এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। এই মেয়েকে দেখলে তার নিজের সেই বয়স এর প্রতিচ্ছবি মনে হয়। ওর স্নিগ্ধ হাসি অনেক কথা বলে।

-কিরে রুমানা খবর কি?

-এইত চলছে।খালা এক্সাম কি পিছাবে? উড়া উড়া শুনি।

-তাই নাকি?

-তাইলে ত গেলাম।

-কেন?

-সময় চলে আসল না?

মমতা হাসেন। বলেন -সময়  বাড়ায়া নে ।অনার্স টা শেষ কর... তারপর

রুমানার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সামনের জানুয়ারীতে। ছেলে জাপান প্রবাসী ডাক্তার। বিয়ের পরই ও কে নিয়ে  যাওয়ার কথা। রুমানাকে বিষণ্ণ লাগে। চোখ দুটো কি এক কষ্টে ছল ছল করে।

গহন কালো চোখ দুটি তুলে বলে

-হু... বিয়ে বড় না পড়াশোনা?

-তাইতো। চিন্তিত ভাব দেখান মমতা। তা তোর হবু বর কি বলে?

-বলে পড়াশোনা করে লাভ কি? তুমি কি চাকরি করবা?

-তুই কি বলিস?

-বলি তাইত রান্না করতে আর বাসন মাজতে তো আর ডিগ্রি লাগেনা। কিন্তু খালা আমি এত সহজে ছাড়বনা। ফাইট দিব। পড়াশোনা শেষ করবই।

-জাপান এ গিয়ে জাপানিজ ফাইট? তোর মা কি বলে?

হাসে রুমানা। বলে মা আমার পক্ষে আছে। তোমার এক্সামপল দেয়। বলে মমতার মত হ। লাইফ এর কোন গ্যারান্টি আছে?

 -তুই তো এই যুগ এর মেয়ে। আমার মত কেন হবি? আরো আগাবি না ?

-তোমার মত হইলে এ হবে। দোয়া কইর। অরিত্র ভাই এর কি খবর?

-আছে।

-যাবনে বাসায়।

- আসিস।                                                                               



রুমানা চলে গেল।কিন্তু ওর সুবাস ছড়িয়ে রইল। সাহস এর দৃঢ়তার। মায়বি চেহারাতে কি যেন বলে গেল রুমানা! তার মত হতে চায়। লড়াই করতে চায়। বোকা মেয়ে। লড়াই করা কি খুব সুখের? একটা সময় ছিল যখন রুমানার মত ছিলেন তিনি। তেজি আর সাহসি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব সংবেদনশীল।



সেই মনের প্রেমে পড়ে গেল মাহিন । অভিজাত পরিবার এর একমাত্র সন্তান । হৃদয়বান মেধাবি আর পরোপকারী। তুখোড় বিতারকিক আর আবৃত্তিকার । সেই মাহিন এর বনলতা হয়ে গেলেন তিনি। মফঃস্বল থেকে আসা মহিলা কলেজ এ পড়া মমতা ।তার অসাধারন মুখশ্রী, মিষ্টি  গানের গলা আর নিবিড় কাল চুলের জন্য ফিদা হয়ে গিয়েছিল মাহিন। কি যে সময় গেছে তখন । অপ্রেমের কাল থেকে প্রেম এর কাল। রোকেয়া হল থেকে মুজিব হল।ডাকসু থেকে TSC.  

বিয়ের বছর এ যুদ্ধ। ততদিনে এ পাশ করে বেড়িয়ে গেছেন দুজনেই। মাহিন ইউনিভার্সিটির টিচার। মমতা  একটা সরকারি কলেজে। মাহিন এর চেষ্টাতো ছিলই নিরন্তর। জীবন গোছানোর। Full bright scholarship  হয়ে গেল। যাওয়ার গোছগাছ চলছে তখনি যুদ্ধ।

না সেই কাহিনি আর মনে করতে চান না মমতা। বাইরে ভিতরের নিরন্তর যুদ্ধের কাল। নিজেকে রক্ষা করা,  অরিত্রর জন্ম, তাকে একা হাতে মানুষ করা... আর অপেক্ষা ... কত দিন রত্রি প্রহর গেল... অপেক্ষা আর শেষ হয়না । আহ চোখে পানি আসে কেন ?

মিটিং আর টুকটাক কাজ সেরে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হতে হতে বিকেল। বাসা ৫ মিনিট এর হাঁটা পথ।এতটুকুতেই ফুরিয়ে  যায়। এবার অনেক ফুল ফুটেছে । কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর নাম না জানা কত ফুল। । মমতা ফুলের সুবাস মেখে ফুলার রোড এর রাস্তায় হাঁটেন আর ফুল দেখেন। মাহিন এর অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক বড় হবার, অনেক কিছু করার এই দেশটার জন্য । সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল  একদিন ১৯৭১ র এপ্রিল এর এক সকালে আর ফিরে এলোনা। কোথায় গেলো... কত খোঁজ .. . কত খোঁজ ...।  আর কত অপেক্ষা , আর কত চোখের জল। এই মাটিতে  কোথায় ঘুমিয়ে আছে।  কে জানে। বিয়ের পর পর অরিত্র এসেছিল গর্ভে । কি সুখ, কি আনন্দ, কত কল্পনা। ছেলে না মেয়ে। ছেলে হলে অরিত্র আর মেয়ে হলে বর্ষা। ছেলে হলে বুয়েট আর মেয়ে হলে মেডিকেল। স্বাধীন দেশে বড় হবে ওরা, সেই স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা।  সবই হল শুধু মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল মাহিন , ইংলিশ বিভাগ এর তরুন প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক শিক্ষক।



মুঠোফোন টা বেজে ওঠে।

-মা মা তুমি কই?

-কেন? কি হল?

-বলনা মা

-কি ? এই ত বাসার কাছে

-আস মা, তাড়াতাড়ি।

-তুই কই?

-বাসায় মা।আস...



বিকেল নেমেছে ফুলার রোড এ। তার সোনালি আলোতে মেখে আছে দশদিক। কাঁচা সোনার মত রোদ। এই রোদ এ রিকশা করে ঘোরা ছিল মাহিন এর খুব এ প্রিয়। আর তার সাথে গান। মমতার গান।

এক বিকাল এর কথা মনে পড়ল। সোনা সোনা রোদ। তার মাঝে আচমকা  বৃষ্টি। মাহিন এর কি উচ্ছাস। রাধাচূড়া ফুল আর বেলি ফুল এর গন্ধ মাখা রাস্তা। রিকশার পরদা ফেলা। আচমকাই হাতের পাতায় হাত। অসম্ভব ম্যানলি গলায় গহন ঘোর।

-মমতা প্লীজ বৃষ্টির গান কর একটা

মমতা অভ্যস্ত মাহিন এর পাগলামিতে। তাও বলেন কি বল না বল। রিকশাওালা শুনবে ত।

 চকিতে দুষ্টামি মাহিন এর গলায়। দারুন হাসিতে রাস্তা কাঁপিয়ে বলে আরে ওরে না হয় ২ টাকা কম দিবো... ফ্রী গান শুনবে তাই।

-আরে বল কি

-আরে লতা মুঙ্গেশকার, গান না একটা গান। নাহয় রিকশাওয়ালারে জিজ্ঞেস করি তোমার  গানের বদলে ফ্রী নিয়া যাবে নাকি আমদের?  

-না গাইলে কি করবা?

 -কি যে করব, হুড ফেলে বৃষ্টিতে তোমারে গোসল করাই দিবো। আর না হয় আমিই গান শুরু করব। চিল্লাব তখন বুঝবা কত ধান এ কত চাল।   তুমি ভালো বিপদ এ পড়বা।

 -এত জ্বালাও কেন তুমি?

-বউ হবা না আমার ? জ্বালা ত সইতেই হবে।।

 কি গান গেয়েছিলেন মনে নাই। ঝর ঝর মুখর শ্রাবন দিন এ না  অন্য কিছু... তাতে কি আনন্দ মাহিনের বলল আজকে আমারে বিয়ে করবা? প্লিজ চলনা কাজী অফিস। রাত বিরাতে তোমার গান শুনতে চাইলেও পারব তাইলে।



দরজাতেই দাঁড়িয়ে অরিত্র।। জড়িয়ে ধরল মাকে।

- মা মা দারুণ একটা ব্যাপার।          

-কি রে? কি হইছে?

-হয়ে গেছে মা , হয়ে গেছে।

-কি?

- গেস কর মা।

- চাকরি হইছে?

-না মা।

-তাইলে  কেমিক্যাল এর মুমু নিজেই তোরে বলছে তরে ছাড়া বাঁচবে না।

 -না মা

 -তাইলে... না রে তুই বল

-স্কলারশিপ পাইছি মা

-কোনটা

ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি তে মা... ফুল স্কলারশিপ মা

-সত্যি?

-তিন সত্যি মা।

 -কখন দেখলি?

-এইত রুমির বাসায় অনলইন হইলাম । তখনই । ফোনে বলতে ইচ্ছা করলনা তাই বাসায় আসলাম।

-কবে সেশান?  

-এইত মা সেপ্টেম্বরে । আর মাত্র ২ মাস।   

-তাইতো। সময় যে অনেক কম ।

-চল মা। সেলিব্রেট করি। তোমারে বাইরে খাওয়াব।  নতুন একটা দোকান হইছে  ধানমণ্ডিতে। ধানসিঁড়ি। ওদের  মাটন কাচ্চি আর চিকেন কড়াই। সাথে বোরহানি আর রায়তা। শেষে তোমারে পানবাহার এর একটা পান। দিলখুশ হয়ে যাবে।

অনেকদিন অনেকদিন কষ্টে ছিল অরিত্র। বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার । কোন চাকরি নাই ।  ছোটোখাটো প্রোজেক্ট এর কাজ আর কয়েকটা কোচিং এ ক্লাস। এবার খুশি। মমতার চোখে পানি আসে। সুখের দিন কি এসে গেল!! তার মিশন কি এইবার শেষ হল। তার যুদ্ধ কি বিজয় পেল? চোখের পানি ফেলার দিন কি শেষ হল?

-আমারে কেন? বন্ধুদের বল। আমি টাকা দেই।ভালমত খা। যা যা মন চায়। যতজনরে খাওয়াতে মন চায়।

-বন্ধুরে ই ত বললাম মা। সবচে বড় বন্ধু।   

-আরে ধুর।।                                                                        

-চলনা মা।শাড়ি বদলাইতে হবে না। তোমারে দারুন লাগতেছে মা।

-হইছে হইছে আর বলতে হবে না।

আবারও চোখে পানি আসে। আর মাত্র দুই মাস। অরিত্র ও চলে যাবে।

নিচে নেমে এসে রিকশাতে উঠে মা আর ছেলেতে। রিকশা চলতে থাকে। মা আর ছেলের কথা ও চলতে অরিত্র  এর স্বপ্ন, পরিকল্পনা । টুংটাং রিকশার হর্ন বাজে।    

-বলে মা আমারে ছাইড়া থাকতে পারবা তো? কিছুদিন। তোমারে  নিয়ে যাব ।

-নারে আমারে নিয়ে ভাবিস না। ৫ বছর ত। দেখতে দেখতে চলে যাবে। শুধু এই মাটিতে ফিরে আসিস।  অইখানে থাকিস না। কত কষ্টের এই দেশ। তোর বাবার কত স্বপ্নের দেশ।

-রুমানা রে  নিয়ে আস মা তোমার কাছে। হলেইতো থাকে । অনেক ভালো মেয়ে।

-নারে আমি একাই পারব । তুই থাকতে পারবি তো? দেখিস আবার কান্নাকাটি লাগাইস না।

অরিত্র মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। ওর দুই চোখে শ্রাবণ এর ঢল নামে।



                                  ********************

অনেক অনেকদিন চলে গেছে তারপর। আজকেও সন্ধ্যা নেমেছে। বসুন্ধারার ১০ নম্বর সড়কে ১১২ নং ছিমছাম দোতালা বাড়ীটিতে। সোনা সোনা রঙের আলোয় আলোকিত চারিদিক।

মিতু কাঁদছে।  এপোলো হসপিটাল এর শিশু বিশেষজ্ঞ মিতু। অরিত্রর ঘরনি।

- মিতু মিতু কাঁদছ কেন?

-কি জানি কাঁদি নাতো।

 -এই যে চোখে পানি। স্কলারশিপ পাওয়ার দিনটার কথা শুনতে চাইলা তাই না বললাম।

-না মা এর কথা যত শুনি ততই কেমন অস্থির লাগে...  ক বছর পরে ফিরলা তুমি?

-৫বছর।

-মা কেমনে ছিল!    

-মারে চিননা তুমি... সব পারে মা। ফোনে এ আমি কাঁদতাম। মা কাঁদত না।

অনিন্দ্য সুন্দর চোখ দুটি তুলে হাসে মিতু...  তাইত মায়েরা অনেক কিছু পারে। না পারলেও পারতে হয়।

-হু

মিতু উঠে। তার গহন মায়াবি চোখ  দুটো তখনো ভিজা।

-কই যাও

-যাই দেখি মা কি করে। বারান্দা তে আসবানা? একসাথে চা খাই।

মমতা  বসে ছিলেন ছোট্ট আনুশকে কোলে নিয়ে। লনে। অনেক ফুল ফুলে ভরা বাসার  সামনের লন। মিতুর হাতের অনবদ্য সৃষ্টি। এই মিতু নামক মেয়েটা যেন তার জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি কে ভুলিয়ে দিতে তার জীবনে পা রেখেছে। আর এই যে আনুশ।রেশম কাল চুল আর বরফ সাদা গায়ের রঙ । কি মায়া আর কি তৃপ্তি। তার বুকের উত্তাপ এ মিশে অনর্গল তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে ৩ বছর বয়সী আনুশকা।  মিতু পিছনে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে মমতার মাথায় হাত রাখে। নিবিড় কোমল সেই স্পর্শ। মনে মনে বলে মা আমি যেন আপনার মত হই। দোয়া করবেন।  

                                     *************


লেখকের কথাঃ পৃথিবীর সকল মাকে আমার অসীম শ্রদ্ধা।   


আমার যেন কখনই আমাদের মা আর মাটিকে ভুলে না যাই।



--------------------------------------------------------------------------



লিখেছেন-Sakiba Ferdousy



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)





গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/আনন্দ-বেদনার-কাব্য/209767732436717 


"অনিঃশেষ অনির্বাণ" [ Collection of Love Stories -11 ]






আজকাল যখন তখন চোখ চলে যায় আংটিটার দিকে।আংটিটা অনির্বাণের দেওয়া,আমাদের বিয়ের।আংটির দিকে চোখ যায় আর কিছুক্ষন পর তা ঝাপসা হয়ে ওঠে ,জলটা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ার পর আবার আংটিটাকে দেখতে পাই আমি। চোখটায় এতো জ্বালা কেন ?আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই তখন রঙহীন সাদা শাড়িতে চোখটা জ্বালা করে,যখন অনুভূতিশুন্য মুখটা দেখতে পাই,তখন ও মনে পড়ে অনির্বাণকে । দোষটা কার? আমার,আয়নার নাকি চোখের ?



অনির্বাণ আমাকে বিয়েতে এই আংটিটাই দিতে পেরেছিলো।তার যে এই এতটুকুই সামর্থ ছিলো। আমরা বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে,আমার পরিবার রাজি ছিলোনা এতে। যেদিন অনির্বাণের হাত ধরে চলে আসি,পরিবারের ভালোবাসার দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে যায় । হ্যাঁ, সব দরজাই খোলে,সে কথায় পরে আসছি ।আর অনির্বাণের পরিবার ? সে কথা বলতে গেলে, সে বড় হয় এতিমখানায়,তাঁর পরিচয় সে একজন পাকিস্তানির সন্তান,একজন যুদ্ধশিশু । তার মা জগতের নিষ্ঠুরতায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো । মাকে চিনলে ও তাকে অজানা করে রেখেছিলো সে।



আমার সাথে অনির্বাণের পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। একদিন দেখি, এক উচ্ছ্বল এলোমেলো চুলের ছেলে, কতগুলো গরীব ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে,হাতে তাদের বিরিয়ানীর প্যাকেট,সবাই একসাথে খাচ্ছে। এতিমখানায় ছিলো বলেই অনির্বাণ তাদের ভালোবাসত খুব। তাদের খাওয়া দেখে অনির্বাণের মুখে দেখেছিলাম সেই জগত আপন করা হাসি,যা মৃত্যু ও কেড়ে নিতে পারেনি। সেদিন ও যেন জগতের সবাইকে হাসিতে আপন করে অনির্বাণ বলে উঠেছিলো- "আসি তবে" !



সেই অনির্বাণের সেদিনের কান্ড দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। অনির্বাণ জানতো না,প্রায়ই আমি নানান কাজের অজুহাতে তাকে দেখতে যেতাম। একদিন দেখতে পেলাম ছেলেটা অনেকগুলো ফুল কিনছে,সেদিন ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারী। দেখতে পাই রাস্তার সেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের অনির্বাণ ফুলের সাথে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। কি যেন হয়ে হয়ে যায় আমার মাঝে।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাই তার দিকে,হাত বাড়িয়ে বলে উঠি- "আমি?" অনির্বাণ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে,তারপর একটা ফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে । জানিনা কি হয়েছিলো সেদিন আমাদের।



তারপর থেকে প্রায়ই যেতাম অনির্বাণের কাছে,মিশতে থাকি, তার সাথে আমি ও এমনটাই করতে থাকি আর অগোচরে তাকে ভালোবাসতে থাকি।শুনতে পাই তার জন্ম ইতিহাস-তা আমাকে একটু ও বদলায় না,আমি তাকে ভালবাসতেই থাকি। অনির্বাণ বলতো,"আমাকে কী ভাবে বলতে হবে আমি এই দেশের একজন,এই দেশের আলো হাওয়ায় আমি বড় হয়েছি,এই দেশের মাটিতে আমার নাড়ি পোঁতা,এই দেশেকে ভালোবাসি অনেক,আর কত প্রমাণ করে যেতে হবে আমি এই দেশের?"

অনির্বাণ আমার সামনে এক বঞ্চিত অথচ দৃঢ় মানুষের প্রতিনিধি। তাই আমার ভালোবাসা গোপনে বাড়তেই থাকে। অনির্বাণ হয়ত বুঝতো সবই কিন্তু সে নিজেকে বঞ্চিতই করে রেখেছিল,আমার থেকে ও!



হয়তো যুদ্ধশিশুর আবেগ থেকেই এই দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো অনির্বাণ,অন্যয়ের বিরুদ্ধে ছিলো উচ্চকণ্ঠ আর সব বঞ্চিত শিশু ছিলো তার আপনজন। " অনির্বাণ কি করে বলি,আমি তো এত মহান ছিলাম না।আমি ভাবতাম তোমাকে নিয়ে শুধু তোমাকে নিয়ে"।

আমার ৩ বছর আগে তুমি আইন নিয়ে পড়ে কাজে ঢুকলে,নিজেকে প্রমাণ করলে,সবকিছুর পর ও তুমি প্রতিষ্ঠিত হলে,হার মানলে না। কিন্তু তোমার কাজই ছিলো অপরাধ নিয়ে,তাই ভয় হতো আমার বড় ভয় !



এদিকে বাসায় আমার বিয়ের তোড়জোর চলছিলো। আমি তখন ও অনির্বাণকে বলিনি কিছুই। এক বিকেলে আমি হাজির হয়ে যাই অনির্বাণের ছোট্ট বাসায়,বলে উঠি- অনির্বাণ,এই পৃথিবীত মানুষ জন্মেই তোমাকে যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে,আমি তা দূর করতে পারবো না,কিন্তু তোমাকে দিবো সুন্দর আগামী। অনির্বাণ মেলাবে তোমার জগত আমার জগতে ?" অনির্বাণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো আমার দিকে,জানিনা আমার চোখে কী ছিলো সেদিন,সে আমাকে আর ফেরাতে পারেনি।

আমাদের বিয়ে হয় অনির্বাণের বন্ধুদের নিয়ে,বিয়ের পর আমি উঠি অনির্বানের সেই ছোট্ট বাসায়। সৃষ্টি করি ভালোবাসার এক বিশাল জগত। সেই জগতে আমরা কষ্টকে স্থান দেইনি কখন ও। সেই জগতে ছিলো আমাদের ভালবাসার এক বিশাল দিঘী,যাতে ফুটেছিলো ভালোবাসার নীলপদ্ম।



অনির্বাণের কাজের জন্য প্রায়ই নানান হুমকি আসতো,হুমকি আসতো আমার বাবার ও। আমি বড় ভয় পেতাম। অনির্বাণ হেসে বলতো," কিছু হবে না !"

"কই অনির্বাণ হলো তো,কিছু তো হলো। তুমি তো হারিয়ে গেলে!" বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করলেন, তোমাকে ও । তুমি হারিয়ে গেলে। বিয়ের সবে ১ মাস পার হয়েছিলো! সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিলো, বৃষ্টির ধারা রাস্তায় তোমার লাশের রক্ত ধুয়ে মুছে হয়তো শোক কাটাবার চেষ্টা করছিলো। তোমার মুখে কেন যেন হাসি ছিলো মৃত্যুর সময়ে ও! "কাকে দেখেছিলে? কী বুঝছিলে ? কী ভেবেছিলে তুমি ?" তোমার লাশের মুখের সেই হাসি দেখে আমি ঠিক ছিলাম না,অনির্বাণ। কিভাবে শোকে দুঃখে যে দিন কেটে গেলো,আমি বুঝতে পারিনি ।



আমার বাসার বন্ধ দরজা আমার জন্য খুলে গেলো আবার। সবাই বলতে লাগলো,"সেই জাতচুলোহীন ছেলেটা মরেছে,আর তুমি বেঁচেছো।" আমি নাকি বেঁচে গেছি অনির্বাণ! জীবন নিয়ে থেকেও ,যে জীবন আমার নয়,আমি তো মৃত ! তুমি আমায় কী করে গেলে অনির্বাণ ! আমার বাসায় কেউ তোমাকে দেখতে পেত না,তারাই,যারা পৃথিবীর আর সব মানুষের মতো তোমাকে বঞ্চিত করেছিলো।

আমাকে বোঝানোর পালা শুরু হলো,শুরু হলো বিয়ের তোড়জোড়। এবার আর প্রকাশ্যে নয়,গোপনে। যেন কেউ জানতে না পারে । আমার মুখ থেকে কথা বের হতো না,আমি নিঃচ্চুপ থাকতাম। একদিন মা বলে, " হাতের এই আংটিটা খুলে রাখো মীরা,তার আর প্রয়োজন নেই।" আমি মেনে নেই,হাতে রয়ে যায় আংটির ছাপ।

হঠাৎ ওইদিন রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে স্বপ্ন দেখে। আমার অনির্বাণ এসেছিলো স্বপ্নে !! সে এসে একটু হেসে,আমার হাতে পড়িয়ে দিয়ে যায় সেই আংটিটা। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কেঁদে উঠি,ছুটে গিয়ে আংটিটা বের করে পড়ে নেই,হঠাৎই মাথা ঘুরে উঠে আমার ,তারপর আর কিছু মনে নেই ।



আজ ৭-৮ মাস পার হয়েছে। আমি আমার মাঝে ধারণ করেছি নতুন প্রাণ। কী এক অজানা শক্তিতে সবার বিরুদ্ধে যেয়ে এই প্রাণকে আপন করেছি। আজকাল অনির্বাণ প্রায়ই আমার কাছে আসে। সূর্যের আলো যখন আমার গায়ে পড়ে,তখন সে আসে । জানালার গ্রীলের ফাঁকে পর্দা কাঁপিয়ে যে বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায় তাতে অনির্বানের স্পর্শ থাকে,বৃষ্টির ফোঁটায় অনির্বাণের ভালোবাসা আমাকে ভিজিয়ে যায়।



অনির্বাণ, তুমি গভীর দুঃখে বলতে,একজন পাকিস্তানির সন্তান ও কী পাকিস্তানি হবে? যদি সে এ দেশকে নিজেরই ভাবে ! এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানিনা। শুধু জানি তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর যে সংগ্রামের তোরণ আমার সামনে,তা আমি পার করবো। তোমার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা করবো অধিকারের পথে,সত্যের পথে। তুমি তো আবার ফিরে এসেছ অনির্বাণ। তোমার ছেলে ও কী তবে পরিচিত হবে একজন যুদ্ধশিশুর সন্তান অথবা জাতচুলোহীন হয়ে ? জানি না। অনির্বাণ তুমি কীভাবে আমাকে দ্রোহের মন্ত্রে জাগিয়েছো। তোমার সন্তানকে আমি পরিচয় দিবো। সে এদেশেরই সন্তান। সে হবে তোমার মত- শোষিত,বঞ্চিত মানুষের কাছের একজন।

অনির্বাণ,তোমার নামেই তোমার পরিচয় কারণ অনির্বাণরা কখনো হারিয়ে যায় না ।

------------------------------------------------------------------


লিখেছেন- প্রাচীন



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প
লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/অনিঃশেষ-অনির্বাণ/209895625757261 

শীতের সকালে [ Collection of Love Stories -10 ]



হাঁটতে হাঁটতে অদূরে থাকা পার্কটার কাছে চলে এলো আবির। শীতের সকালে প্রায়ই সে একা একা হাঁটতে বের হয়। কুয়াশায় ঢাকা ভোরবেলা সবাই যখন লেপের ভিতর আরামসে ঘুমে মগ্ন তখন সে সুয়েটার, কেডস আর মাফলার গলায় পেঁচিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্যান্টের পকেটের ভিতর দুই হাত ঢুকিয়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটলেও টের পায় না সে। শুরুতে একটু কষ্ট হলে আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তার।

রাস্তার পাশে টঙ চায়ের দোকান খোলা পেলে ওখানেই বসে পড়ে। ধোঁয়া ওড়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে থাকে। ঐ মুহুর্তের মতো এতো আনন্দ সে আর কখনো উপলব্ধি করতে পারে না। আনন্দের ঐ মুহুর্তের টানেই মনে হয় তার এই প্রায়শ বেড়িয়ে পড়া।



প্রায় ২০ মিনিট একটানা হাঁটার পর সম্মুখেই পার্কের ঢোকার প্রবেশ মুখ। পার্কের সবুজ ঘাসে ভোরের শিশির বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। খালি পায়ে শিশিরে ভেজা এই ঘাসের উপর হাঁটতে অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়।



পার্কের ভিতর মানুষের সমাগম খুবই কম। বিকেল বেলা তো জনসমুদ্র হয়ে যায়। কংক্রিট আর বিশাল বিল্ডিং-এ চারদিক ঢাকা এই শহরে পার্কের সবুজ ছায়ায় একটু শান্তির জন্য মানুষ এসে ভিড় করে। এখন যারাই আছে তারা কেউ কেউ জগিং করছে, আবার কেউ ব্যায়াম করছে। কেউবা সিমেন্টের বেঞ্চিটায় বসে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে।

অনেকক্ষণ থেকে হাঁটার ফলে একটু ক্লান্তি লাগছিল আবিরের। পার্কের ভিতর ঢুকে একটা বেঞ্চির উপর বসলো সে। মাথাটা উপরের দিকে দিয়ে চোখটা বন্ধ করলো একটু জিরিয়ে নিবে বলে।



ভাইজান ভাইজান ! হঠাৎ এই শব্দে আবিরের চেতন হল। এতক্ষন চোখটা বন্ধ করে প্রায় ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছিল সে।

চোখ খুলেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ১৩-১৪ বছরের একটি ছেলে। কাঁধে তার ঝুলানো একটি বস্তা। পরনে শুধুমাত্র একটি ময়লা হাফপ্যান্ট। এতো ঠাণ্ডার মধ্যেও খালি গায়ে টায় দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এসবে সে অনেক অভ্যস্ত। চেহারাটা দেখে অনেক নিস্পাপ মনে হয়।



-ভাইজান,দুইটা টাকা দেন। ছেলেটা আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল।

-দুই টাকা দিয়ে কি করবে?

-আপনে দুই টেকা দিলে আমার কাছে আরও দুই টেকা আরও এক টেকা কারও কাছ থাইকা নিয়া বন (বাটার পাউরুটি)খামু।

-আপনার কাছে ৩ টেকা চাইলে তো আর দিবেন না তাই দুই টেকা চাইলাম। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল ছেলেটা।

-আচ্ছা দিবো। তা তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?

-আমাগো আবার কিসের ঠাণ্ডা? আমাগো লাইগা ঠাণ্ডা-গরম সবই সমান।

-তা নাম কি তোমার?

-আমার কিছু বন্ধু আছে তারা আমারে বইল্যা নামে ডাকে। আর আম পাবলিকে ডাকে টোকাইকয়া।

-তোমার বাবা -মা আছে ?

-না ভাইজান বাবা-মারে কোনদিন দেখিই নাই। বুঝ হওয়ার পর থাইকা বস্তির আজম চাচার কাছে বড় হইছি। আজম চাচায়ও মারা গেল দুই বছর হইয়া গেছে। এরপর থাইকা রাস্তায় রাস্তায়। কোনসময় রাস্তায় আবার কোন সময় পার্কে শুইয়া রাইত পার কইরা দেই। যেখানে রাইত সেইখানে কাইত হইয়া যাই। তাও পুলিশে মাঝে মইদ্ধে বিরক্ত করলে ঐ রাইত আর ঘুমই অয় না।



ছেলেটার কথা শুনে কেমন যেন মায়া লাগলো আবিরের। তারও ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট একটা ভাই আছে। ওর মুখটার কথা কেন জানি ভেসে উঠলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখে।



- খিদা লাগছে তোমার? জিজ্ঞেস করলো আবির।

- খিদা তো ভাইজান অলটাইমই থাকে। খিদা লাগছে দেইখা তো আপনের কাছে দুই টেকা খুঁজলাম।

-বাহ ইংরেজিও জানো দেখছ। পড়ালেখা করো?

-হাসল বইল্যা। না ভাইজান পড়ালেখা করি না। আপনারদের মতো কিছু শিক্ষিত মানুষের কথা শুইনা শুইনা শিইখা ফালাইচি।

খিদা আমারও লাগছে। চলো ঐ দিকে একটা রেস্টুরেন্টে আছে ঐখানে যাই।

বইল্যা সন্দেহের চাহনি নিয়ে বলল, ভাইজান আপনি ছেলেধরা-টেলেধরা না তো ?

আবির হাসলো। আরে না আমি এসব কিছু না। তোমার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। তাছাড়া তুমিও ক্ষুধার্ত আমি ক্ষুধার্ত তাই বললাম আর কি। এখন তুমি চাইলে আসতে পারো, তোমার ইচ্ছা।

-হুম তাইলে চলেন। তাছাড়া আপনেরে দেখে এই সব মনেও অয় না।

আবির হাসল।



রেস্টুরেন্টে এসে ওয়েটারকে ডাক দিয়ে নাস্তার অর্ডার দিল আবির। ওয়েটারটা যাবার সময় বাঁকা চোখে চেয়ে গেলো বইল্যার দিকে।

-তা বইল্যা। রাতে তো প্রচণ্ড শীত থাকে ঘুমাও কিভাবে?

বইল্যা কোন কথা না বলে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে টেবিলের উপর রেখে বসল।

-এই যে ব্লেড দেখতাসেন ভাইজান এইটা দিয়া ব্যানার কাটি।

-ব্যানার কাটো মানে ? অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো আবির।

-রাতে বেশি ঠাডা পড়া শীত পড়ে। আর সামনে তো আরও বেশি শীত পরবো। তাই ব্যানার কাইটা শরিলে জড়াইয়া ঘুমাইলে ঠাণ্ডা একটু কমই লাগবো।





কথাগুলো শুনে এতোটাই খারাপ লাগলো আবিরের যে নিজের অজান্তেই মনের কোণ থেকে কখন একবিন্দু অশ্রু জড়িয়ে পরলো সে তা টেরই পেল না। এত কম বয়সে এই সব ছেলেরা এতো অবহেলিত? এতো কষ্টে দিন যাপন করে এরা ? আমরা কি কিছুই করতে পারি না এদের জন্য ?

মানুষ হিসেবে দাম দিলে কোন মানুষের জন্য কিছু করতে মন চায়। কিন্তু আমরা তো এদের মানুষই মনে করি না। কাছে এসে এক টাকা দুই টাকা খুঁজলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই, সাথে দেই কয়েকটা গালি। কবে যে এদের এই দুঃখের দিন শেষ হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন।

এরই মধ্যে ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। খাবার দেখে বইল্যার চোখে মুখে খুশির ছটা ফুটে উঠলো।



-ভাইজান, এইসব খাবার এর আগে অনেক দেখছি কিন্তু কখনো খাওয়া হয় নাই।

-তাহলে এবার যত খুশি খাও।



খুব তাড়াতাড়িই খাওয়া শেষ হয়ে গেল দুজনের। ঢেকুর তুলতে তুলতে বইল্যা বলল,

-ভাইজান আজকে আর খাওয়া লাগব না। যে খাওয়া খাইছি তাতে আইজ পার হইয়া যাইব। আপনারে অনেক ধইন্যবাদ ভাইজান। এরকম করে কেউ কোনদিন খাওয়ায় নাই।

-আরে ধন্যবাদ কিসের?

-তোমাকে খাওয়াতে পেরে অনেক ভালো লাগছে আমার।

-ভাইজান এবার আমাকে যেতে হবে না হলে সিটি কর্পোর গাড়ি সব ময়লা নিয়া গেলে শেষে কিছুই পামু না আমি। বইল্যা যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো।



একটু দাঁড়াও বইল্যা। আবির তার পড়নের সুয়েটারটা খুলে বইল্যাকে দিয়ে বলল, এটা রাখ তুমি। তোমার শীত কিছুটা হলেও কম লাগবে হয়তোবা রাতে আরামে ঘুমাতেও পারবে।

বইল্যা খুব বেশি অবাক হল।

-ভাইজান,আপনার তো এখন ঠাণ্ডা লাগবো।

-আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি বাসায় চলে যাব একটু পরে। তখন আরেকটা পড়ে নিবো। এটা তুমিই রাখো।

-ভাইজান,আমি আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়াতে আরেকটা দেখি নাই। দুনিয়াতে আপনি অনেক বড় হবেন। চোখ দুটি ছল ছল হয়ে উঠলো বইল্যার।

-লজ্জা দিও না আমাকে বইল্যা। ভালো থেকো।

-না ভাইজান আপনে হাছাই খুব ভালা মানুষ। আপনেও ভালো থাকেন ভাইজান।

চোখ মুছতে মুছতে বইল্যা রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। সুয়েটারটা এক হাতে আর আরেক হাতে বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল পার্কের মধ্যে। আবিরও উঠতে যাবে এমন সময় দেখে বইল্যার ব্লেডটা টেবিলের উপর পড়ে আছে।

আবির ব্লেডটা হাতে নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল-ব্লেডটার কি আর দরকার আছে??



******************************************************************





শেষকথাঃ এই গল্পটার স্থান এবং চরিত্র কাল্পনিক হলেও শীতের এক সকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা হয়েছে।

আমাদের চোখের আশেপাশে কত বইল্যারা এভাবে দিন যাপন করছে তার খোঁজ আমরা কখনই রাখি না।

অবহেলিত আর কষ্টে জর্জরিত জীবনে তাদের ক্ষীণ পাওয়া সুখ ঐ কষ্টের মধ্যেই আবার মিলিয়ে যায় যা আমরা দেখতে পারি না। এই বইল্যারা সঠিক পথের অভাবে আজ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রভুদের ডান আর বাম হাত !

এদের ছোটবেলাই কাটে অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যে বয়সে এদের খেলার কথা,পড়ার কথা সেই বয়সে তারা জীবন যুদ্ধের কাজে লিপ্ত। তাদের সঠিক পথে আনার কোন মাথা ব্যাথাই যেন নেই প্রভুদের।

তাদের মাথা ব্যাথাটা না থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ এই সব বইল্যাদের দিয়েই তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করে।



লিখেছেন- ফারহান খান

FB ID- Farhan Khan





গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/শীতের-সকালে/210922285654595