Monday, June 11, 2012

চতুরঙ্গ – প্রথম পর্ব [Ghost Stories -p1 ]



চতুরঙ্গ প্রথম পর্ব
মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব
[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ] 

ডাঃ এমরান তাঁর ইলেক্ট্রিক হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার দিকে চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন। ভ্রুঁ জোড়া কাছাকাছি হল তাঁর। হাল্কা নীলচে চোখ। সচরাচর বাঙ্গালীদের মাঝে এমন চোখ দেখা যায় না। হঠাৎ করে এভাবে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। আমি নড়ে চড়ে বসলাম চেয়ারটায়। সামনা সামনি বসেছি দুজন। মাঝখানে টি টেবিল। টি টেবিলের ওপর একটা ফ্লাওয়ার ভাস, একটা ডায়েরী আর আমার ফাইল। ফ্লাওয়ার ভাসটা এক নজর দেখেই বলে দেয়া যায় অ্যানটিক মূল্য অনেক হবে। নঁকশা কাটা কাঁসার ফ্লাওয়ার ভাস। কবেকার আর কোথাকার বুঝতে পারলাম না। তবে খুব দামী জিনিস সেটা বোঝা গেল।




যে ঘরটায় বসে আছি, সেটা প্রায় একটা হল রুমের মত বিশাল ঘর। অনেকটা চার্চের বিশাল প্রার্থনা ঘরের সমান। মাথার ওপরের ছাদটা প্রায় চার তলা উঁচুতে। ছাদ কিম্বা সিলিং যাই বলি না কেন বেশ অদ্ভূত। যেন বিশাল কোনো দাবার বোর্ড ছাদটা। সাদা কালো ঘর কাটা। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান ঘরে উলটো ভাবে বিশাল বিশাল একেকটা ঘুটি ঝুলছে! প্রত্যেক ঘুটিই মানুষের সমান কিন্তু বর্ম পরা, অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত। হঠাৎ করে ছাদময় বিশাল দাবার বোর্ড আর উলটো ভাবে ঝুলে থাকা মূর্তি গুলোকে দেখলে ভয় লাগে। আধো অন্ধকারে কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছে অত উঁচু ছাদময় দাবার বোর্ডটাকে। ছাদটা হল রুম পেরিয়ে অন্যদিকে বাঁক নিয়েছে। হল রুমটা বেশ বড় বোঝাই যাচ্ছে, কয়েকটা মোড় ঘুরে চলে গেছে আরেকদিকে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না ওদিকটা। ছাদটাও সেভাবেই চলে গেছে। দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে অন্য দিকেও ছড়ানো এরকম হল রুম, জিনিস পত্রে ঠাসা, এবং দাবার বোর্ডে ঝুলন্ত মূর্তিতে ভরা সেদিকের ছাদটাও।

নিচ তলা থেকে শুরু করে একেবারে চার তলা পর্যন্ত কুন্ডলী পাঁকিয়ে উঠে গেছে একটা ধাতব সিঁড়ি। সেটা হল রুমের এক পাশে। ওপরে বোধ হয় থাকার ঘর। কারণ দেখলাম একপাশে ছোট একটা লিফটও রয়েছে। ডাঃ এমরানের জন্য নিশ্চই। হুইল চেয়ার নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা পর্যন্ত পুরো হল রুমের মত ঘরটার চার দেয়াল জুড়ে শুধু বই আর বই। বুক শেলফ উঠে গেছে চার তলা উঁচু ছাদ পর্যন্ত! আমি আমার জীবনে এত উঁচু বুক শেলফ দেখিনি, শেলফ গুলোর পাশে অনেক বড় মুভিং লেডার। মইটা একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। কিন্তু ডাঃ এমরান কিভাবে বই নামান? কেউ নামিয়ে দেয় হয়ত। সারা ঘর জুড়ে ঠাসা সব অ্যানটিক্সের জিনিস পত্র। পেইন্টিং , মূর্তি, কাস্কেট, স্টাফ করা জন্তু জানোয়ার, শো পিস- কি নেই। হাটা যায় না ঠিক মত। হল রুম বোঝাই করে ফেলেছেন এসব দিয়ে। গলা খাকারি দিলেন ডাঃ এমরান। আমি আবার তাঁর দিকে তাকালাম।

তো মিস নোভেরা হঠাৎ কেন আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার কিউরেটরহতে আগ্রহী হলেন?” অদ্ভূত কন্ঠস্বর ডাঃ এমরানের। কেমন যেন কম্পনহীন শব্দ। ভারী আর ভরাট একটা গলা।

অস্বস্তিটা দূর করতে হাসার চেষ্টা করলাম, “ স্যার ছোট থেকে আপনাকে ঘিরে আমার বিরাট একটা আগ্রহ। আপনার লেখা বই যেখানে যখন পেয়েছি তখনি পড়েছি। এক রকম পাগল ছিলাম আপনার বইয়ের জন্য। আপনাকে দেখার জন্য বহুবার আপনার গেটের সামনে এসেছিলাম। ছোট বলে ঢুকতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি লেখা লেখি ছেড়ে দেয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তার ওপর যখন আপনার দূর্ঘটনা ঘটল আমি মেনে নিতে পারিনি।

আবেগ...... আবেগ......হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালেন, “ আবেগের চোখে দুনিয়া দেখার বয়স আপনার এখন। তাই খুব স্বাভাবিক জিনিস গুলোকে অনেক বড় করে দেখছেন।

স্যার, প্লিজ আমাকে আপনিকরে বলবেন না। আমি আপনার অনেক ছোট।ক্রমশ অস্বস্তিটা বাড়ছে। যার লেখার জন্য এত পাগল ছিলাম সে মানুষটাকে সামনে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।

হুম......চশমাটা চোখ থেকে খুলে আমার ফাইলটা ইঙ্গিত করলেন, “ তোমার ফাইলে দেখলাম তুমি ডাক্তারি পাস করেছো। ডাক্তারি বাদ দিয়ে হঠাৎ আমার এখানে আসাটা ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

পত্রিকায় দেখলাম কিউরেটর চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। আর স্যার আমি শুনেছি আপনার ২৪ ঘন্টা একজন ডাক্তার দরকার পরে। তাই ভাবলাম আমিই যাই। আপনার কিউরেটর কাজের পাশাপাশি ডাক্তারিটাও চলল।

কিঊরেটর হতে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার, হুট করে চাইলেই সেটা সম্ভব না।

আমি জানি স্যার, আমার বাবা ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিলেন। ছোট থেকেই তাই এসব জিনিসের প্রতি একটা আগ্রহ ছিল।

উনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন, “ বাবা-মা কি বলে তোমার?”

এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম, “ নেই। দু বছর আগে কার একসিডেন্টে মারা গেছেন।

স্যাড...... আর কে কে আছে তোমার?”

আমার খালা আর আমার ছোট বোন।

বোন কতটুকু? মানে বেশি ছোট? নাকি পড়াশোনা করে?”

দু বছরের ছোট আমার থেকে। পড়াশোনা করছে এখনো।

আর খালা?”

ওনার আর কেউ নেই। বিয়ের পরেই স্বামী মারা যান লিভার সিরোসিস হয়ে। তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে আছেন।

খুব একটা ভাল হল না তাহলে। তোমার কোনো হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করা উচিত। পঙ্গু বুড়ো মানুষের পেছনে ডাক্তারি বিদ্যা খরচ করে লাভ নেই।হুইল চেয়ারটা আপনা আপনি নড়া শুরু করল। অন্য দিকে চলে যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে কথা বলা শেষ আমি যেতে পারি এখন এ রকম ইঙ্গিত করলেন যেন।

আমি ভাবতেই পারিনি এভাবে হুট করে নাকরে বসবেন। ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে মড়িয়া হয়ে বললাম, “প্লিজ স্যার, এটা আমার স্বপ্ন আমি আপনার সাথে কাজ করবো, আপনার দেখাশোনা করবো।

একটা বুক শেলফ থেকে বসে বসে বই নামাতে নামাতে আমার দিকে পেছন ফিরে বললেন, “ তোমার ফাইলটা হাতে নাও, এন্ড জাষ্ট গেট আউট। উনিশ বছরের পড়াশোনা পানিতে ফেলার কোনো অর্থ হয় না।

স্যার প্লিজ......চোখে পানি এসে গেল, ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না ঠেকালাম।

অযথা কান্না কাটি করে লাভ নেই।আমার দিকে না তাকিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলেন, “ আমার বয়েস হয়েছে। যখন তখন মরে যেতে পারি। ঝামেলা সামলাতে কোনো শক্ত সামর্থ ছেলের দরকার। তুমি পারবে না।

আমি চোখের পানি মুছে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা হলুদাভ কাগজ বের করে বাড়িয়ে ধরলাম, “ আমি যখন ছোট ছিলাম আপনাকে প্রায়ই চিঠিতে লিখতাম আমি বড় হয়ে আপনার মত ডাক্তার হবো, বই লিখতে না পারি আপনার সাথে সাথে থাকবো। আপনার লেখা পান্ডুলিপি সবার আগে পড়বো। আর হাসপাতালে আপনার সাথেই প্র্যাক্টিস করবো। আপনি বহুদিন পর একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কি লিখেছিলেন জানেন?”

বেশ অবাক হয়ে ঘুরে তাকালেন ডাঃ এমরান আমার দিকে। আমার হাতে ধরা কাগজটার দিকে কৌতুহলি চোখে তাকালেন।

আপনি লিখেছিলেন মা, দোয়া করি তুমি বড় হয়ে অনেক বড় ডাক্তার হও। কথা দিলাম তোমার সাথে কাজ না করতে পারি তোমার রুগী অবশ্যই হব!পড়ে শোনালাম চোখের পানি মুছতে মুছতে। এভাবে যে চোখে পানি চলে আসবে ভাবিনি। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম ওনার সামনে।

ডাঃ এমরান তাঁর জট পাঁকা দাড়িতে আঙ্গুল বুলালেন বিভ্রান্ত মুখে, বিড়বিড় করলেন, “ আমি লিখেছিলাম? কবে?......... মনে পড়ছে না তো......

চোখের পানি মুছে জেদ চেপে ফাইলটা তুলে নিলাম, “ মনে থাকবে কিভাবে? বয়স তো আর কম হয়নি আপনার। তার ওপর লাখ লাখ পাঠক পাঠিকা। আমার কথা আর মনে থাকে?” আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে বের হয়ে এলাম ডাঃ এমরানের বিশাল দূর্গ রুপি মিউজিয়াম থেকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরলাম। সারা পথ একটু পর পর আপনা আপনি দু চোখ ভরে যেতে থাকল পানিতে। বোধ হয় খুব বেশি আশা করেছিলাম। সেটা ভেঙ্গে যাওয়ায় নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

ট্যাক্সি থেকে নেমে যখন ভাড়া দিচ্ছিলাম, হাত থেকে ফাইলটা পড়ে গেল বেখেয়ালে। লাইট পোষ্টের আলোয় তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়া কাগজ গুলো তুলতে লাগলাম। কাগজ তুলতে গিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম সেখানে হলুদ একটা খাম; ভেতরে চিঠি! আমার না এটা, আমি রাখিনি। ল্যাম্প পোষ্টের পোঁকা ওড়া আলোতে চিঠিটা খাম থেকে বের করতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। গুটিগুটি হাতের লেখা

নোভেরা,

আশা করছি সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ চাকরিটা করতে গিয়ে হাফিয়ে উঠবে না। আমি সময়ানুবর্তিতা পছন্দ করি।

ডাঃ এমরান চৌধুরী

কখন দিলেন এটা? সারাক্ষণ তো হুইল চেয়ারেই ছিলেন আমার সামনে! বিমূঢ়ের মত লাইট পোষ্টের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রাতের বেলা খবরটা জাহিদকে ফোন করে জানালাম। বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারছিলাম না চাকরি পাওয়ার কথাটা। রীতিমত হড়বড়িয়ে সব বলে ফেললাম, “ জাহিদ তুমি বিলিভ করতে পারবে না! ডাঃ এমরানের চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি! কাল থেকে যাবো!

জাহিদ ঘুমের ঘোরে হাই তুলতে তুলতে কেবল বলল, “ বুড়োকে বেশি ভাও দিও না। লেখক মানুষ, তাদের আদি অন্ত - অনন্ত যৌবন। শেষ মেষ আমার কপাল ফাটিয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছে শুনবো!

আমি হাসতে লাগলাম।

ওই আমি রাখি। ঘুমের জন্য দুই চোখের পাতায় দশ কুইন্টল পাত্থর চেপে আছে।জাহিদ ফোন রেখে দিল।

আমি ঘুমাতে পারলাম না। সারা রাত এপাশ ওপাশ করলাম কেবল। তখনো জানতাম না যেচে পড়ে গিয়ে চাকরিটা নিয়ে কত বড় ভূল করে ফেলেছি.........

শেষ রাতের দিকে ঘুমের মধ্যে দেখলাম আমি সেই বিশাল হল রুমটায়। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বাহিরে। কাঁচের জানালা দিয়ে লম্বা আলো-ছায়া সৃষ্টি হয়েছে হল রুমের দেয়ালে। আমি ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছি সেই বিশাল দাবা বোর্ডের দিকে। অন্ধকারের মধ্যেও মনে হচ্ছে মূর্তি গুলো নড়ছে...... জীবন্ত মানুষের মত হাটাহাটি করছে......

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ডাঃ এমরানের দূর্গ রুপি ব্যক্তিগত মিউজিয়ামের দায়িত্য বুঝে নিতে চার দিন লেগে গেল আমার। একজন মানুষ এক জীবনে এত বিশাল সংগ্রহ শালা কি করে তৈরি করেন আমাকে বারবার বিষ্মিত করল। পৈতৃক সূত্রেই ডাঃ এমরানের পরিবারটা দেশের সবচেয়ে ধনী পরিবার গুলোর মধ্যে একটা ছিল। আর কর্ম জীবনেও ডাঃ এমরান তাঁর পূর্ব পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন। তাই এরকম মিউজিয়াম তৈরি করা খুব একটা অসম্ভব না তাঁর জন্য।

ডাঃ এমরানের বিশাল মিউজিয়াম তুল্য বাড়িতে মানুষ বলতে ছিলাম কেবল আমি, ডাঃ এমরান আর তিন জন কর্মচারী। তাদের একজন হলেন রাধুনী কাম হাউস মেড। নার্গিস নাম। মধ্যবয়সী, শান্ত স্বভাবের এক মহিলা। আরেক জন হলেন ড্রাইভার আবু নাসের। তার বয়স প্রায় ষাটের ঘরে। অন্য জন ওয়াচ ম্যান, সোলেমান আলী। চল্লিশের মত বয়স। পাহাড়-পর্বতের কথা মনে আসে তাকে দেখলেই। মোটামুটি এ কয়েকজন মানুষ ডাঃ এমরানের দূর্গের বাসিন্দা।

আমি চাকর্রিটা শুরু করার পর থেকেই দেখতাম ডাঃ এমরান দিন রাত তাঁর দোতলার ঘরে শুয়ে বই পড়েন আর একা একা দাবা খেলেন বিছানায় বোর্ড রেখে। আর নামাযের সময় হলে হুইল চেয়ার ছেড়ে অন্য একটা কাঠের চেয়ারে বসে নামায পড়েন নিজের ঘরের ভেতর। কথা বার্তা একেবারে দরকার না পরলে বলেন না। আমি তাঁর বি.পি. একদিন চেক করার সময় কেবল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন নিজে থেকে, “ দাবা খেলতে পারো?”

খুব একটা না। নিয়ম মনে থাকে না কোন ঘুটি কত ঘর চলে।স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে হাতের পালস ধরার চেষ্টা করলাম, শুকিয়ে গেছেন খুব, যদিও হাত গুলো জোয়ান মানুষের মত মোটা এখনো। পালস পাওয়া যায় না। সেটা খোঁজার চেষ্টা করছি টিপেটিপে।

দাবা ইংরেজী জানো?”

হুম। CHESS?”

সমার্থক শব্দ?”

দাবার আবার সমার্থক শব্দ আছে নাকি?” পালসটা পেতেই স্বস্তি পেলাম।

আছে। চতুরঙ্গ।বিড়বিড় করলেন তিনি।

আমি ঠিক মত খেয়াল করলাম না তাঁর কথাটা।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

আমি এখানে আসার পর প্রথম যেদিন এই দূর্গের রহস্যের সাথে জড়ানো শুরু করি সেটা প্রায় এক মাস পরের কথা।

সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। থেকে থেকে কান ফাটানো বজ্রপাতের শব্দ। তার ওপর দূর্গের দেয়াল গুলো মিলে সেই শব্দকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণ। ডাঃ এমরানের জ্বর গত রাত থেকে। তাই বাসায় যাইনি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন। আমি তাঁকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলাম।

সন্ধ্যার দিকে যখন তাঁকে দেখতে গেলাম তখন জ্বর আরো বেড়েছে। নিজের দেয়া হাসপাতাল আছে তাঁর, অথচ হাসপাতালে বিচিত্র কোনো কারণে যেতেই চান না তিনি। কিন্তু এ অবস্থা চলতে থাকলে হস্পিটালাইজড করা ছাড়া উপায় থাকবে না। নার্গিসকে নিয়ে ওনার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করলাম। ভেজা কাপড় দিয়ে সারা শরীর মুছে দিলাম। তাতে অবস্থার একটু উন্নতি হল। নার্গিসকে পানি আনতে যখন পাঠিয়েছি তখন হঠাৎ ডাঃ এমরান কথা বলা শুরু করলেন, “ নামায পড়ো?” বেশ পরিষ্কার কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন। হাতের ইসারায় তাঁর পাশে বসতে বললেন।

আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম, “ মিস্ যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায বোধ হয় রোজা ছাড়া আর কখনো পড়া হয়নি।

তোমার বয়সে আমিও নামায খুব একটা পড়তাম না। তবে বিয়ের পরে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে হতো। আমার স্ত্রী জয়নাব খুব ধার্মীক স্বভাবের মেয়ে ছিল। জোর করেই ঠেলে, ধমকে নামায পড়তে পাঠাতো মসজিদে। মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে নামাযের অভ্যাসটা পেয়ে গেল। বলতে পারো নেশার মত। নেশা খারাপ অর্থে বোঝাচ্ছি না জাস্ট অবস্থাটা বোঝাচ্ছি।দম নিলেন।

আমি চুপ করে বসে আছি। একবার ভাবলাম বলি এ অবস্থায় কথা না বলার জন্য। কিন্তু বললাম না। তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ খুব কম মেলে।

আবার বলা শুরু করলেন, “ এক ওয়াক্ত নামায না পড়লে সারা দিন অশান্তিতে কাটত। যে কোনো অপারেশন করতে O.T. তে ঢোকবার আগে সব সময় নফল নামায পড়ে নিতাম। একবার সে রকমই একটা মেজর অপারেশনের আগে নামায পড়ছিলাম নিজের চেম্বারে। খুব আশ্চর্যের বিষয় আমি প্রথমবার যখন রুকু করার জন্য হাটুতে দুহাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকেছি কেন যেন হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমার চেম্বারে কেউ না জিজ্ঞেস করে ঢুকবে না। আপনা আপনি সেজদার দিক থেকে চোখ চলে গেল দু পায়ের মাঝ দিয়ে পেছনের দিকে। মধ্য বয়সী কোনো পুরুষ লোকের পা, আর সাদা পাজামার অংশ বিশেষ দেখা যাচ্ছে। অনেকটা জামাতে নামাযে দাঁড়ালে ইমামের পেছনের জন যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবে। এবং মনে হল একজন নয়, আরো কয়েকজন।

নামাযের এ অবস্থায় নামায ভাঙ্গার প্রশ্নই আসে না। তাই নামাযটা শেষ করে যখন সালাম ফেরালাম, অবাক হয়ে দেখলাম আমার পেছনে কেউ নেই। তার থেকেও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার আমার পেছনে যদি কেঊ নামায পড়ে তার সেজদা যেখানে হবে- সেই জায়গা গুলোতে নির্দিষ্ট দুরুত্ব পরপর পাশাপাশি কয়েক ফোঁটা করে পানি। ঠিক যেন তিন জন লোক সেজদায় গিয়ে চোখের পানি ফেলেছে! আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।

সেদিনের অপারেশনে রোগীটাকে বাঁচাতে পারিনি আমি। থামলেন। হাঁফাচ্ছেন কথা বলতে গিয়ে।

আমি তাঁর কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলাম একবার। বাহিরে বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছেই। আজকে বাড়ি যাওয়া কপালে আছে কিনা কে জানে। ফোন করে দিতে হবে নয়তো।

সেদিনের যে রোগীটাকে আমি বাঁচাতে পারিনি, সে ছিল খুব বৃদ্ধ লোক। তোরাব আলী নাম। অপারেশনের আগের দিন গুলোতে একা একা দাবা খেলতেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে। দাবা খেলাটা আমার নেশা ছিল ছোট থেকেই। আমার নেশা দেখে আব্বা এই বাড়ির পুরো ভেতরের ছাদ জুড়ে উলটো ভাবে বিচিত্র দাবার বোর্ডের ডিজাইন করিয়েছিলেন। হাসপাতালের কাজের ফাঁকে দুএক দান খেলে ফেলতাম তোরাব চাচার সঙ্গে। কোনো দিনই হারাতে পারিনি। জেতার পর উনি হাসতে হাসতে বলতেন, “ বাজান, আমার দেখা সব চাইতে ভালা ছেলেটা হইলা তুমি। রুগির সাথে ডাক্তারেরা যে কত খারাপ ব্যবহার করে এই জীবনে কম দেখি নাই। কিন্তু তুমি পুরা অন্যরকম। আমি খাস দিলে দোয়া করি আল্লাহ্ পাক তোমারে দেইখা রাখবো। আর যদি আমি মইরা যাই কখনো- সেই দিন থেকে তোমারে আর কেউ হারাইতে পারবো না।

কথাটা কতটুকু ফলেছে জানি না। তবে সত্যি সত্যি তার মৃত্যুর পর আমি দাবা খেলায় কারো কাছে হারিনি আজ পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশের গ্রান্ড মাষ্টারদের সঙ্গে খেলেছি, দাওয়াত দিয়েও এনেছিলাম এখানে। অদ্ভূত কোনো কারণে কেউই আমাকে হারাতে পারেনি।আবার থামলেন।

আমি লাইটের দিকে তাকালাম। যেভাবে মিটমিটিয়ে আসছে- তাতে কারেন্ট চলে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। চার্জার দরকার নেই। জেনারেটর আছে। কারেন্ট গেলেই সোলেমান আলী সেটা চালু করে দেবে। আমি মোম বাতি আর ম্যাচ বের করে রাখলাম তাও। যেন আমার মোম বাতি বের করার অপেক্ষাতেই ছিল, বের করার সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেল। আমি অন্ধকার খুব ভয় পাই। তাড়াতাড়ি মোম জ্বালিয়ে ফেললাম। বাহিরে ব্জ্রপাত আর ঝড় যেন মহা প্রলয় লাগিয়ে দিয়েছে।

তোরাব চাচা মারা যায় যে বিকালে, সে রাতটা এ রকমই ঝড় বৃষ্টির ছিল। জয়নাবকে নিয়ে ঘুমিয়েছি। তাহাজ্জুদের নামায পড়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সে রাতে খুব ক্লান্ত থাকায় তাহাজ্জুদের নামায পড়বো না ভেবেছিলাম। খুব বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল সেই রাতে। আমি মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভূত জিনিষটা দেখলাম। প্রথমে মনে হল বিশাল কোনো দাবার বোর্ডে শুয়ে আছি! তারপরেই উঠে বসার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম হল রুমের ছাদের সেই বিশাল দাবার বোর্ডে! বাদুরের মত উলটো হয়ে ঝুলে আছি! এবং আশ্চর্যের বিষয় হল আমার গ্রাভিটেশন ঠিক বোর্ডের দিকে! আমি অবলীলায় সেখানে উলটো ভাবে দাঁড়িয়ে আছি! আমার মাথার দিকে পুরো হল রুমের বিছিয়া থাকা অসংখ্য জিনিস পত্র, লাইব্রেরী! আমার আশে পাশে সেই বিশাল মানব আকৃতির দাবার মূর্তি গুলো। এবং বজ্রপাতের ক্ষণিক আলোয় দেখতে পেলাম আমার ঠিক সামনের দিকে বড় বড় দাবার চারটা ঘরে চারজন সাদা কাপড় পরা মানুষ নামায পড়ছেন আমার মত উলটো ভাবে! একজন ইমাম এবং বাকি তিন জনের জামাত!

আমি প্রচন্ড ভয় পেলেও ধীরে ধীরে হাটতে লাগলাম তাদের দিকে। আমি পড়ে যাচ্ছি না! অনায়াসে হেটে যাচ্ছি উলটো ভাবে ছাদে পা রেখে! মুর্তি গুলোর আড়াল থেকে ব্জ্রপাতের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম জামাতের ইমাম হলেন তোরাব চাচা! যিনি আজ বিকেলে অপারেশন থিয়েটারে আমার সামনে মারা গেছেন!

আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হল রুমের একটা সোফার ওপর আবিষ্কার করি। বলার অপেক্ষা রাখেনা আমার কোমরে তখন মারাত্মক ব্যথা। যেন আমি খুব ওপর থেকে পড়ে গেছি।আবার থামলেন ডাঃ এমরান। হাঁফাচ্ছেন খুব।

আমি তাঁর কথা গুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জ্বরের ঘোরে মানুষ কত কথাই বলে। তার ওপর সে যদি হয় লেখক মানুষ তাহলে তো কথাই নেই। আমি তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কথা বলে অবস্থা খারাপ করে ফেলছেন তাই।

সে রাতে চলে আসার সময় ঘটল ঘটনাটা। রাত দশটা বাজে। বৃষ্টি থেমেছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ট্যাক্সি পাবো না বলে ড্রাইভার আবু নাসের গাড়ি বের করলেন আমাকে পৌছে দেয়ার জন্য। আমি হল রুমের তালা লাগিয়ে দেবো- শেষ বারের মত সব কিছু দেখে নিচ্ছি। এমন সময় আরবী সুরা পড়ার শব্দ পেলাম হল রুমে। লাইট প্রায় সব নিভিয়ে দিয়েছি। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকালাম, সুরা কে পড়ছে? ক্রমশ সুরটা চড়ছে। কেন যেন মনে হল শব্দটা ওপর দিক থেকে হচ্ছে। ওপরে অন্ধকার ছাদের দিকে তাকিয়েছি সবে জমে গেলাম বরফের মত। হাত থেকে তালা চাবির থোকাটা খসে পড়ল শব্দ করে। তীব্র একটা ভয় আমার মাথা থেকে দৌড়ে যেন পায়ের দিকে চলে গেল!

বজ্রপাতের সাদাটে আলোতে ছাদের বিশাল দাবা বোর্ডের মূর্তি গুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে বোর্ডের ঘর গুলোতে। তার মাঝেই একটা ফাঁকা জায়গায় জায়নামায বিছিয়ে উল্টো ভাবে কেউ নামায পড়ছে! এবং এত নিচ থেকেও তাঁকে স্পষ্ট চেনা গেল ডাঃ এমরান!

চতুরঙ্গ – পঞ্চম পর্ব [Ghost Stories -p5 ]



চতুরঙ্গ পঞ্চম পর্ব
মোঃ ফরহাদ চৌধুরী ( শিহাব )


[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে  ]  


স্যার আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো আমি। প্লিজ জবাবটা দেবেন।
কি প্রশ্ন?” নামায পড়ার কাঠের চেয়ারটায় বসেছিলেন। অবাক হয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখলেন। নামায শেষ হয়েছে। এতক্ষণ নামায পড়ছিলেন দেখে বাহিরে করিডোরে পায়চারি করছিলাম অস্থির ভাবে। বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলাম নামায শেষ হয়েছে কিনা। গত রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি আমার। সারা রাত মিথিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অজানা একটা ভয়ে সারাক্ষণ কাঁপছিলাম। দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি এক মুহূর্তের জন্য।
ডাঃ এমরান দাঁড়িতে আঙ্গুল বুলালেন কৌতুহলি মুখে, আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ কি প্রশ্ন? এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
স্যার, আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা সম্পর্কে বলুন প্লিজ। জয়নাব আরার মৃত্যু সম্পর্কে জানা ভীষণ প্রয়োজন আমার।রীতিমত অনুনয় মেশানো গলায় বললাম।
ডাঃ এমরান গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রশ্নটা শুনে। আর চোখে দেয়ালে ঝোলানো তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকালেন, কাঁশলেন, “ হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
স্যার প্লিজ বলুন। আমি নয়ত পাগল হয়ে যাব!মিনতি ভরা কন্ঠে বললাম। আমার ধারণা আমি তাঁকে দেখেছি গতকাল সন্ধ্যায়।
আমার কথা শুনে সামান্য তম চমকালেন না তিনি। কেবল গম্ভীর মুখে হাতের নখ দেখতে লাগলেন।
“ It was just an ordinary road accident. nothing to explain. গাড়ি আমি ড্রাইভ করছিলাম সেদিন। নাসের অসুস্থ ছিল। তাই গাড়ি আমাকেই ড্রাইভ করতে হয়েছিল। সেটাই কাল হল। সঙ্গে ছিল জয়নাব। একটা ব্রীজ পাড় করার সময় অন্য দিক থেকে আসা কারের হেড লাইটের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আমি ড্রাইভিং-এ কাঁচা ছিলাম। ব্যস, যা হবার হয়ে গেল। ফলাফল তোমার সামনেই দেখতে পাচ্ছো। আমি হুইল চেয়ারে বন্দী, জয়নাব দেয়ালে ফ্রেমে বন্দী।ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
ব্যস? এটুকুই?” আমি নিজের পায়ের ওপর ভর রাখতে পারছিলাম না, একটা টুল টেনে বসে পরলাম।
হুম। আর কিছুই নেই।টেবিল থেকে একটা কোরআনের তাফসির বই তুলে নিলেন। স্পষ্ট বোঝা গেল আমাকে চলে যেতে ইঙ্গিত করছেন। আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম, মুখের ওপর এসে পরা চুল গুলোকে কানের পেছনে পাঠিয়ে দিলাম, “ স্যার, আমি প্রচন্ড মানসিক সমস্যায় ভূগছি মে বি। আমি জানি না এর থেকে পরিত্রাণের উপায়টা কি।দরজার দিকে হাটা লাগালাম।
হঠাৎ শুনলাম পেছন থেকে ডাঃ এমরান বলছেন, “ আচ্ছা নোভেরা, বলতে পারো ধর্মের উৎপত্তি কোত্থেকে?”
ফিরে তাকালাম অবাক হয়ে, মাথা নাড়ালাম, “ জানি না স্যার।
যেখানে বিজ্ঞানের সমাপ্তি, সেখান থেকেই ধর্মের শুরু। তুমি বিজ্ঞাকে স্বীকৃতি দিতে পারো, অথচ ধর্মকে কেন নয়? তুমি প্রাইমারি স্কুল পড়বে অথচ হাই স্কুলে যাবে না- কেমন দেখাবে? ইদানীং কালে চারপাশে খুব বেশি নাস্তিক ছেলে মেয়েদের দেখা যাচ্ছে- কেন বলতে পারো?”
জানি না স্যার।বিমূঢ়ের মত একই উত্তর দিলাম।
জ্ঞান অর্ধেক কিংবা অপূর্ণ থাকায়। স্বল্প জ্ঞান নিয়ে এরা ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে যায়- এবং ব্যাখ্যা করতে না পেরে স্রষ্টা ও ধর্ম- দুটোকেই অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়। এরা নিজেরাই বিভ্রান্ত এদের স্বল্প জ্ঞান নিয়ে। যার কারণে সরল অংক করতে গিয়ে এরা মাঝ পথে আটকে যায় এবং বলে অংকে ভূল আছে। তার যোগ বিয়োগ জানায় যে ভূল আছে সেটাই বোঝে না। সেটাকে ঢাকতেই নাস্তিকতা বাদের এত চর্চা। দুনিয়াতে সব বড় বড় বিজ্ঞানীদের তুমি আস্তিক হিসেবে পাবে। কিন্তু বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখবে কট্টর নাস্তিক হিসেবে। যারা নিজেদের অজান্তেই তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু নাস্তিক ছাত্র-ছাত্রী প্রসব করছে। বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? বর্তমানে গ্লোবাল ভিলেজ র্যািভুলিউশনের মত এটাও গ্লোবালাইজেশনের পর্যায়ে পড়ে গেছে। তাতে বোঝা যাছে শূণ্য কলস বিদ্যাধারী স্টুডেন্টদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বিজ্ঞানের অক্ষমতাকে এরা অস্ত্র বানিয়ে ধর্মকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছে- কিন্তু সেটা কতটুকু যৌক্তিক?”
আমি হঠাৎ করেই হেসে ফেললাম।
ডাঃ এমরান ভ্রুঁ কোঁচকালেন, “ হাসছো কেন?”
আপনাকে দেখে হঠাৎ ডাঃ জাকির নায়েকের কথা মনে পরে গেল। ওনার কথা বলার ধরনটা অনেকটা আপনার মত।



হাতের বইটা টেবিলের ওপর রেখে হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালেন ডাঃ এমরান, “ সিরিয়াস কথার মাঝ খানে তোমরা যে কিভাবে হাসতে পারো!
স্যরি স্যার।অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
হুম........ বসো।টুলটা ইঙ্গিত করলেন। আমি এসে বসার পর উনি বলা শুরু করলেন-
তোমাকে কথা গুলো বলার পেছনে কারণ ছিল। তাই বলেছি। কারণ তুমি দুনিয়াতে খুব অদ্ভূত কিছু কিছু জিনিস দেখবে- যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে পাবে না। কিন্তু বিজ্ঞান তোমাকে ব্যাখ্যা না দিতে পারলেও ধর্ম তোমাকে সেটার ব্যাখ্যা এনে দেবে। আমার জীবনে সেরকম কিছু ঘটনা ঘটেছিল যার ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ করার মত ইচ্ছা জাগেনি মনে। সব কিছুর ব্যাখ্যা থাকতে হবে- এটা দাবি করা অন্যায়। যদি না সে ব্যাখ্যাটা গ্রহণ করার মত পূর্ণ জ্ঞান তোমার থাকে। জগতের স্রোত খুব বিচিত্র।দম নিলেন। কাঠের চেয়ারটায় বসে থাকায় হেলান দিয়ে বসছেন না। পিঠ সোজা করে বসে আছেন।
আমার স্ত্রী জয়নাব খুব ধার্মীক মেয়ে ছিল এটা তো আগেই বলেছি। বিয়ের দীর্ঘ দশটা বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো সন্তান হয়নি আমাদের। সমস্যাটা জয়নাবের ছিল, ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।মৃদু কাঁশলেন খুঁক খুঁক করে।
সন্তান না হওয়ার কারণে জয়নাব সারাক্ষণই মন মরা হয়ে থাকতো। একা একা এই বিশাল বাড়িতে ঘুরে বেড়াত। এটা সেটা গুছিয়ে সময় কাটাবার চেষ্টা কবত। কিন্তু কখনো আমাকে ওর দঃখটা মুখ ফুটে বলেনি। সারাদিন নামায আর কোরআন নিয়ে পড়ে থাকত। দেখতে দেখতে কোরআন হেফয করে ফেলল। বিড়বিড় করে অন্ধকারের মধ্যে প্রায় রাতেই শুনতাম কোনো না কোনো সুরা পড়ছে আমার পাশে শুয়ে। ভাবতাম জেগে আছে, কিন্তু পরে একদিন দেখলাম ঘুমের মধ্যেই ওভাবে সুরা গুলো পড়ে যায় জয়নাব।
তোরাব চাচা মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন পর্যন্ত আমি কোমরের ব্যথার জন্য বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। সে সময়টা জয়নাব সারাক্ষণ আমার পাশে থেকেছিল। রাতে ভয় পেতাম বলে সারা রাত জেগে আমার মাথার কাছে বসে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করত। আমি কখনো ওর কাছে কিছু লুকাইনি। তাই সেই রাতে দাবার বোর্ডে তোরাব চাচাকে দেখার ঘটনা ও জানত। অবিশ্বাস করেনি আমাকে। আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিল, “ ভাল মানুষের সাথে আল্লাহ সব সময় ভালই করে। তুমি চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তোরাব চাচা মারা যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরের কথা। জয়নাব বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। কথা বলে খুব কম। কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যা-না বলে উত্তর দেয়। রাত জেগে আমার মাথার কাছে বসে থাকে। ঘুমাতে বললেও ঘুমায় না। আমি জানতাম না মানুষের মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে টের পাওয়া যায় নাকি- কিন্তু জয়নাব বোধ হয় টের পেত। প্রায়ই আমাকে বলত, “ এ বাড়ির সব আয়না গুলোতে কোনো সমস্যা হয়েছে এমরান। আমি সামনে দিয়ে হাটলেই দেখি আমার শাড়ি, স্কার্ফ- সব সাদা রঙের।আমি ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ওর যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ও মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্টের আগের রাতের কথা-
জয়নাব আমার পাশে সুরা বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমিও অঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ। খুব অদ্ভুত স্বপ্ন! দেখলাম যে আমি ছাদের সেই দাবা বোর্ডে উল্টো হয়ে একটা চেয়ারে বসে আছি। সামনে একটা টেবিল, টেবিলের অন্যপাশে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে। নয়-দশ বছর বয়স হবে। নীল শার্ট পরা। আমার সঙ্গে দাবা খেলছে। আমাদের মাথার দিকে পুরো হল রুম, মিউজিয়াম। আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাচ্চাটার সাথে দাবা খেলছি। বাচ্চাটা অসম্ভব ভাল খেলে। মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সব ঘুটি গায়েব করে দিল। ষোল চালে নেমে এল খেলা! আমি হারার ভয়ে রীতিমত ঘামছি। কিন্তু ছেলেটার সেদিকে ভ্রুঁক্ষেপ নেই। গম্ভীর মুখে খেলে যাচ্ছে। আমি হারতে হারতে খেলাটা ড্র করলাম কোনোমতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখি দুষ্টু একটা হাসি ফুটেছে চোখের তারায়। মুখে চাপা হাসি।
হাসছো কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
আপনাকে হারানো নিষেধ। তাই।হাসতে লাগল ছেলেটা। হাসিটা এত নিষ্পাপ যে বুকের ভেতর কেমন যেন ব্যথা জাগে। দেখলাম হাসির চোটে চোখে পানি এসে গেছে বাচ্চাটার।
কে নিষেধ করেছে আমাকে হারাতে?” অবাক চোখে তাকালাম।
দাদু।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। কালো হাফ প্যান্ট আর নীল শার্ট গায়ে। খালি পা। আমার দিকে না তাকিয়ে ছাদের বোর্ডের বিশাল বিশাল মূর্তি গুলোর দিকে হাত তুলে বলল, “ এখানে তো শুধু এক সেট ঘুটি। কালো। সাদা নাই?”
আমি মাথা নাড়ালাম, “নাহ।
আমি বড় হলে একদিন এই বোর্ডে খেলবো। সেদিন হারাতে পারবেন না আমাকে। ড্র-ও করতে পারবেন না।
তোমার দাদুর নাম কি?” পেছন থেকে বললাম।
জবাব দিল না বাচ্চাটা। দেখলাম মহাশূণ্যের নভোচারীদের মত ধীর গতিতে ওপর দিকে উড়ে যাচ্ছে! বোর্ড ছেড়ে হল রুমের ফ্লোরের দিকে উঠে যাচ্ছে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে! মাঝামাঝি গিয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে পা চলে গেল হল রুমের দিকে, মাথা বোর্ডের দিকে। অন্ধকারের মাঝে মিউজিয়ামে হারিয়ে গেল।
আমার ঘুম ভাঙ্গল তখন। কিছু বলার আগেই জয়নাব অন্ধকারের মধ্যে অদ্ভূত কন্ঠে বলে উঠল, “ বাচ্চাটা তোরাব চাচার নাতি। সাভারের একটা অনাথ আশ্রমে আছে।
আমি কোনো কথা বললাম না। বিয়ের পর থেকেই জয়নাব আমার কাছে একটা বিষ্ময় ছিল, আজ নতুন না যে অবাক হতে হবে।
পরদিন গাড়ি নিয়ে সাভারের সেই অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলাম আমি আর জয়নাব। কিন্তু গিয়ে লাভ হয়নি। শুনলাম তোরাব চাচার নাতি গত কয়দিন আগে পালিয়ে গেছে আশ্রম ছেড়ে। থানায় জি.ডি. করা হয়েছে। আমার খুব অবাক লাগল। অপারেশনের আগে কিন্তু একবারও তোরাব চাচাকে তাঁর নাতির কথা বলতে শুনিনি। এমন কি বাচ্চাটাকে কেউ হাসপাতালেও নিয়ে আসেনি। রেজিষ্ট্রার কাগজ ঘেটে ছেলেটার ছবি বার করলাম। নীল শার্ট পরা সেই বাচ্চাটাই- যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম! নামটা দেখলাম- মোঃ জহুরুল ইসলাম জাহিদ।থামলেন ডাঃ এমরান। একটানা কথা বলে হাফিয়ে গেছেন। টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিলেন। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন সবটা।
আমি বজ্রাহতের মত বসে আছি। কারণ আমার জাহিদের পুরো নাম মোঃ জহুরুল ইসলাম জাহিদ”! কিন্তু জাহিদ তো অনাথ না। ওর মা বাবা আছে, বড় ভাই, ভাবী- সবাই আছে। খুব বেশি কাকতালীয় হয়ে গেছে যেন নামের ব্যাপারটা।
শূণ্য গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে ডাঃ এমরান বললেন, “ সাভার থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তখনই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অ্যাক্সিডেন্ট........শেষ কথাটা বিড়বিড় করে আপন মনেই বললেন। খেয়াল করলাম ওনার মুখে তীব্র একটা কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে হঠাৎ করে। কি বললেন বুঝতে পারলাম না। এক মুহূর্ত বিরতী নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, “বিচিত্র কোনো কারণে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আমার কাছে লাগছিল আমাদের পেছনের সিটে মধ্যবয়স্ক সাদা পাঞ্জাবী পরা একটা লোক বসে আছে। কড়া মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছি লোকটার গা থেকে। আমি তিনবার রিয়ার ভিউ মিররে দেখলাম লোকটাকে পেছনের দিকে ফিরে ব্যাক সিটে অন্ধকারে কাউকে দেখলাম না! জয়নাব সাবধান করে দিল, “ কি হল? গাড়ি চালাতে চালাতে এতবার পেছনে তাকাচ্ছো কেন?”
আমি দুবার সামনের দিক থেকে আসা দুটো গাড়িকে ঠুকে দিতে দিতে কোনো মতে সামলে নিলাম। জয়নাব ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ তুমি ঠিক আছো তো এমরান? এরকম করছো কেন?”
আমি জবাব না দিয়ে আবার তাকালাম মিররে। বিস্ফোরিত চোখে আয়নাতে এবারে দেখলাম পেছনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না! তার বদলে দেখা যাচ্ছে আমার বাড়ির ছাদের দাবার বোর্ডটা! সোজা হয়ে আছে বোর্ডটা। মূর্তি গুলো ঢাল তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বোর্ডের ঘর গুলোয়! হঠাৎ শুনলাম জয়নাব চিৎকার দিল, “ এমরান! গাড়ি সামলাও!একটা ব্রীজ পার করছিলাম নদীর ওপর দিয়ে। আমি চমকে সামনে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল! সামনের দিক থেকে আসা কোনো গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু গাড়িটা কিছুতে বাড়ি খাওয়ার বদলে অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল-
কিছু বোঝার আগেই আমাদের গাড়িটা আলোক উৎসটা ভেদ করে লাফ দিয়ে এসে পড়ল বিশাল একটা দাবা বোর্ডের ওপর! আমাদের বাড়ির ছাদের সেই দাবা বোর্ডটায়! গাড়ি উল্টো ভাবে ছুটছে বোর্ডের ওপর দিয়ে! মধ্যাকর্ষণ যেন বোর্ডের দিকে! জয়নাব আতংকিত গলায় চিৎকার দিল। আমি পাগলের মত স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে কয়েকটা মূর্তির সাথে বাড়ি খেতে খেতে সামলে নিলাম। ছাদটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেড লাইটের আলোই যা ভরসা। ব্রেকটাও কাজ করছে না ঠিক মত। তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে নিয়ন্ত্রনহীন গাড়িটা। মনে হচ্ছে অন্য কেউ একজন চালাচ্ছে সেটা! স্টিয়ারিং পর্যন্ত ঘুরিয়ে সোজা করা যাচ্ছে না! নিজে থেকেই ঘুরছে! তার মাঝ দিয়েই আমি ঢাল তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো মূর্তি গুলোকে বাঁচিয়ে, পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কোনোমতে।
কিন্তু এত চেষ্টার পরও দূর্ঘটনা এড়াতে পারলাম না। আমি খেয়াল করিনি যে সামনের দিকে একটা বড় মূর্তি বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যখন দেখলাম চিৎকার দিয়ে ব্রেক কষলাম। ব্রেক লাগল এবারে। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পেতেই পাশে তাকালাম। জয়নাব মূর্তির মত বসে আছে আমার পাশে। ওর ডান হাতটা দিয়ে কাঁপা কাঁপা ভাবে আমার মুখটা স্পর্শ্ব করল। এই অন্ধকারের মাঝেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর দুচোখ বেয়ে হীরের মত দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ফিস ফিস করে বলল, “ খুব ইচ্ছে ছিল এই বাড়িতে মারা যাবো। ভাল থেকো এমরান। তুমি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষটা। আমি খুব ভাগ্যবতী পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষটাকে ছুঁয়ে বিদায় নিতে পারছি.....আমি কাঁপা হাতে ওর হাতটা আমার মুখে ধরে রাখলাম। জয়নাব অস্ফূট একটা শব্দ করল।
উইন্ডশীল্ডের কাঁচ ভেঙ্গে সামনের দাঁড়ানো মূর্তিটার হাতের বর্শাটা ঢুকে গেছে জয়নাবের বুকের বাম পাশে। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে কেবল অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রনায়........
আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল, ফিসফিস করে বললাম, “ তোমার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা কেটেছে জয়নাব। I think I’ll miss you rest of my life.”
জয়নাব হাসার চেষ্টা করল। আরো দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর চোখের কোন বেয়ে। চোখের পাঁপড়ি গুলো ভিজে কাঁটার মত হয়ে আছে। একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে?
অনুভব করলাম গাড়িটা ছাদ থেকে খসে পড়ার মত প্রচন্ড গতিতে নিচের হল রুমের দিকে পড়ছে। কিন্তু আমার কোনো ভয়, আতংক কিছুই হচ্ছে না.......
প্রচন্ড শব্দ আর ঝাঁকুনি দিয়ে সুইমিং পুলের নীলচে পানি ভেদ করে ডুবে গেলো গাড়িটা। আমার পাশে জয়নাব হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেখছে, মুখে একটুকরো নিষ্পাপ হাসি........ ওর বুকের বাম পাশ থেকে বর্শার ভাঙ্গা অংশ বিশেষ বেরিয়ে আছে...... রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীরটা ওর। উইন্ডশীল্ডের ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে সজোরে পানি ঢুকছে গাড়ির ভেতর।
আমার দুপায়ে ভয়ংকর একটা ব্যথা টের পেলাম। গাড়ির কিছু একটা বেঁকে আমার দু পায়ে এসে চেপে ধরেছে......
কিন্তু জয়নাবের দিকে তাকিয়ে রয়েছি মুগ্ধ চোখে...... আহা! এই মুখটা যদি চিরকাল এভাবে দেখতে পারতাম.....চুপ হয়ে গেলেন ডাঃ এমরান। অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম চোখে পানি এসে গেছে তাঁর। সেটা আড়াল করতেই অন্য দিকে তাকিয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ সুইমিং পুলের নিচ থেকে বের হলেন কি করে? গাড়ি নিয়ে ডোবার পরও ইনজুরড অবস্থায়....বুঝতে পারলাম বিষ্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেছে আমার।
ডাঃ এমরান চোখের কোন ডললেন আঙ্গুল দিয়ে, “ পানির নিচে দম আটকে মারা যাওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল তখন। গাড়ির ভেতর ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড দিয়ে পানি ঢুকে আমার নিঃশ্বাস আটকে গেছে- হঠাৎ দেখলাম পানির নিচের নীলচে জগৎটা দাবা বোর্ডের মত হয়ে যাচ্ছে। সুইমিং পুলের তলদেশটা সাদা কালো ছক কাটা দাবা বোর্ডের মত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যতদূর চোখ যায়। তার মাঝ দিয়ে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে সাদা কত গুলো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে একেকটা ঘরে। তুমি হয়ত খেয়াল করেছো এ বাড়ির ছাদের চারটা মূর্তি বাদে সব গুলোই কিন্তু কালো পক্ষের ঘুটি। সাদা ঘুটি না। কিন্তু পানির নিচের ঘুটি গুলো সব সাদা। আমি দম যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছি চারটা সাদা বর্ম পরা বিশাল দেহী মূর্তি আমার গাড়ির চার কোনার মাটি ফুঁড়ে যেন গজিয়ে উঠল। খুব আশ্চর্যের বিষয় চার জনের একটা করে হাত আমার গাড়িটার চার কোনায় ধরা! কিছু বোঝার আগেই তীব্র গতিতে পানি ফুঁড়ে মূর্তি গুলো গাড়িটাকে নিয়ে উঠে গেল সুইমিং পুলের ওপর দিকে। সোজা ছাদের দিকে উঠে যেতে লাগল। মাঝা মাঝি উচ্চতায় এসে গাড়িসহ চার মূর্তিই উল্টে গেল। চাকা চলে গেল ছাদের দিকে, সুইমিং পুল চলে এল মাথার ওপর দিকে। গাড়িটা নিয়ে নামল ছাদের বোর্ডে। আমি তখন পাগলের মত নিঃশ্বাস নিচ্ছি বাতাস পেয়ে। তার মাঝেই দেখলাম সাদা মূর্তি চারটা গাড়ির চারপাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীক পুরাণের যোদ্ধাদের মত মূর্তি।
আমি আমার দুই পা নাড়াতে পারছি না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এর মাঝেই আবিষ্কার করলাম আমি দরজা খুলে দাবার বোর্ডে নেমেছি। আমার দুই পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে সাদা দাবার ঘর ভেসে যাচ্ছে লাল হয়ে। অথচ আমি আমার দুই পায়ে অদ্ভূত একটা শক্তি অনুভব করছি। নিজের অজান্তেই মাথার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম হল রুমের নানান জিনিস পত্র, সুইমিং পুলের পানি, নতুন মূর্তি সব কিছু নড়ছে! যেন বৃষ্টির মত নেমে আছড়ে পড়বে এই বোর্ডের ওপর। কিন্তু আমি তাকানো মাত্রই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যার যার স্থানে বসে গেল! আমি বাদূরের মত ঝুলে আছি, আমার গাড়িটাও। তার ভেতরে জয়নাবের লাশ। আধ খোলা চোখে ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মিষ্টি একটা হাসি ফুঁটে আছে ওর ঠোঁটের কোনায়।
সে রাতেই ছাদে চারটা নতুন সাদা মূর্তি যোগ হয়। যে গুলোর কারিগর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য স্রষ্টা অদ্ভূত সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা পুরণের ব্যবস্থাটার মাঝে জয়নাবের সহযাত্রীও পড়ে গিয়েছিল সেদিন।শেষের কথা গুলো বিড়বিড় করে আপন মনে বললেন। চোখে পানি জমে উঠেছে তাঁর।
মানে?” আমি বুঝতে পারলাম না।
বিচিত্র ভাবে হাসলেন, “ বুঝবে না এখন। বয়স বাড়ুক তোমার। একদিন বুঝে যাবে।দেয়ালে ঝোলানো জয়নাব আরার ছবিটার দিকে তাকালেন।
আমি বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলাম, “ আপনি আসলে সে রাতেই আবিষ্কার করেন যে আপনি উল্টো হয়ে ছাদ থেকে ঝুলে থাকতে পারেন? শুধু নিজের না, অনেক কিছুর গ্র্যাভিটির দিক বদলে ফেলতেও পারেন- তাই না?”
ফিরে তাকালেন অবাক হয়ে ডাঃ এমরান। আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বিষ্ময়ের সাথে দেখলাম ডাঃ এমরানের অশ্রু জমে ওঠা দুচোখে অদ্ভূত একটা হাসি ফুটে উঠেছে। রহস্যময় একটা হাসি।

চতুরঙ্গ – দ্বিতীয় পর্ব [Ghost Stories -p2 ]


চতুরঙ্গ দ্বিতীয় পর্ব
মোঃ ফরহাদ চৌধুরী

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

( পেজ - ১ )
আলু-ছিলে-ছুইন...... না, কি একটা বল না? কি ওটা?” জাহিদ মাথা চুলকালো।
হ্যালুসিন্যাসন?” তাকালাম ওর দিকে।
হ্যা! ওইটা! ওটা দেখেছো।যেন বিশাল এক আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন ভাবে রায় দিল।
রাম ছাগল। হ্যালুসিন্যাসন ছাড়া আর কোনো যুক্তি কি মাথায় আসে না? ভিজুয়্যাল আর অডিটরি- দুই হ্যালুসিন্যাসন এক সাথে হয়েছে আমার?”
এর থেকে ভাল কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলাম না। আমার স্বল্প বুদ্ধিতে আলু ছিলে ছুইন-ই বড় ব্যাখ্যা। তুমি আলু ছিলার সময় ডাঃ এমরানকে দেখেছো তিনি হুইল চেয়ার ছাড়াই দাঁড়িয়ে উলটো ভাবে ছাদ থেকে ঝুলে ঝুলে নামায পড়ছেন।উদাস ভাবে গাছের গায়ে হেলান দিল। বসেছি পার্কের একটা গাছের নিচে।
গত রাতের ঘটনাটা কাউকে বলতে না পেরে জাহিদকে বলার জন্য ডেকে এনেছি। কিন্তু ছাগলটা তার হাটুর মগজ দিয়ে চিন্তা করা শুরু করেছে।



বিরক্ত গলায় বললাম, “ রাখো তো! তোমার সব কিছু নিয়ে ফাজলামি! আমার হয়েছে আমি বুঝেছি, তুমি হলে বুঝতে কেমন লাগে।কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম দুজনে। তারপর আবার বলে উঠলাম, “ একটা ব্যাপার জানো- উনি নাকি কখনো দাবায় হারেননি তোরাব আলী মারা যাবার পর থেকে।
তাই নাকি! দুই দান খেলা দরকার তো তাহলে! আমিও জীবনে কখনো হারি নাই এই খেলায়। অবশ্য দাবাই খেলি নাই এখনো, তাই হারার সুযোগ হয় নাই!
ধুর! তোমার সাথে কথা বলাটাই আমার ভূল হয়েছে!রাগ লাগলো।
জাহিদ উদার ভাবে হাসতে লাগল, “ হয়েছে বাবা! এখন মাফ কর। এই উদ্ভূট্টু কান্ড কারখানা শুনে দিনের বেলাতেই হাটুতে নোকিয়া ভাইব্রেশন ধরেছে, রাতের বেলা ঘুম হারাম হবে। এখন সাবজেক্টটা বাদ দাও। আসো, প্রেমালাপ করি বেগাম।হঠাৎ যেন মনে পরতেই বলে উঠলো, “ ওউ! তোমাকে তো শুভ সংবাদটা দিতেই ভূলে গেছি বেগাম! শুভ সংবাদটা হল গিয়ে আমার টিউশ্যনিটা চলে গেছে।
কি! এটাও?” আৎকে উঠলাম। কি ছাত্র পড়াও যে টিউশ্যনি চলে যায়?”
আমার মত ছাত্র আর কি। যারা সারা বছর ফেল মেরে বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হয়, কিন্তু এভারেজে গিয়ে প্রমশন জোটে না।উদাস মুখে আমার দিকে তাকাল।
চাকরি বাকরি ধরবে? নাকি গাছ তলায় সংসার পাতবে বলে ঠিক করেছো?” বিরক্ত হলাম।
জাহিদ গাছটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “ খারাপ বল নাই তো! সংসার পাতার জন্য গাছতলাই উত্তম। যাও সপ্তাহে তিন দিন মশারী আমি লাগায় দিবো। বাকি কয়দিন তোমার পালা।
উফ! অসহ্য!রাগতে গিয়েও হেসে ফেললাম শেষ মুহূর্তে। জাহিদও হাসতে লাগল। ও হাসলে ওর চোখে পানি চলে আসে। খুব মায়া লাগে কেন জানি তখন।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

সে রাতের ঘটনার কথা অবশ্য ডাঃ এমরানকে জিজ্ঞেস করলাম না। জাহিদের সাথে কথা বলার পর নিজের ভেতরেই সন্দেহ হচ্ছে কে জানে হয়ত চোখের ধাঁধাঁ ছিল পুরো ব্যাপারটা। দিনের আলোতে পুরো ঘটনাটা অবাস্তব লাগল যত বার ভাবলাম। শেষে বেশি চিন্তা করা বাদ দিয়ে কাজে মন দিলাম। ডাঃ এমরান আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলেন। আমি প্রতিদিন তাঁর মিউজিয়াম কাম বাড়িতে যাই। মাঝে মাঝে দু চার জন বিদেশী পর্যটক আসেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ শালা দেখতে। ডাঃ এমরান মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে দেখান। কখনো আমি। কেউ কেউ বই লেখার জন্য এখান কার অ্যানটিক্সের সম্পর্কে জানতে এলে আমি নয়ত ডাঃ এমরান ছোট খাট ক্লাস নিয়ে ফেলি। প্রায় সময় নানান স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা আসে তাঁর মিউজিয়াম দেখতে। ডাঃ এমরান তখন মহা উৎসাহ নিয়ে তাদের সব ঘুরিয়ে দেখান। নানান গল্প শোনান কোথায়, কিভাবে এসব পেয়েছেন। শুনতে ভালই লাগে। শিক্ষক হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কারণ হঠাৎ হঠাৎ উনি আমার কার্ড একজাম নেয়ার মত করে প্রশ্ন করা শুরু করেন। শুরুতে সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরে বুঝে গিয়েছিলাম উনি কেন এটা করেন। আমি হাসপাতাল, প্র্যাক্টিস সব বাদ দিয়ে তাঁর সাথে পড়ে আছি এটা তাঁকে খুব বিব্রত করত। তাই নিজের জ্ঞান দিয়ে আমার জ্ঞানটাকে ঝালিয়ে নিতেন। যাতে আমি আবার চার্চার অভাবে সব ভূলে না যাই। তাঁর একরকম জোর পূর্বক জারি করা আইনের ফাঁদে পরে আমাকে সপ্তাহে দুই দিন তাঁর নিজের দেয়া নতুন হাসপাতালটায় গিয়ে রোগী দেখে আসতে হত। তাঁর বদ্ধমূল ধারনা আমি তাঁর সাথে থেকে থেকে সব ভূলে যাচ্ছি এত দিন যা শিখেছি। কিন্তু ওনাকে এটা বোঝাতে পারিনি ওনার এহেন আইটেম, কার্ড, প্রফ লেগে থাকলে কারো পক্ষে একটা চ্যাপ্টারও ভোলা সম্ভব না।
মাঝে মাঝে মিউজিয়ামে নানান জায়গা থেকে মালপত্র আসে। ডাঃ এমরানের কথা মত আমাকে প্রায়ই অনেক জায়গায় গিয়ে নিলাম থেকে অনেক জিনিস কিনে আনতে হয়। ব্যাপারটা দারুন লাগে। প্রথম প্রথম উনি আমাকে নিয়ে যেতেন কিভাবে নিলাম থেকে কিনতে হয় শেখাতে। এখন আমি একাই যাই। উনি বলে রাখেন কত থেকে কতর মধে্য হলে কিনবো। আমি সে রকমই করি। খুব অল্প দিনে বেশ কয়েকটা দেশ ঘোরা হয়ে গেল ডাঃ এমরানের সঙ্গে। কখনো বা কুরিয়ারে অ্যানটিক্স এলে আমাকে মালপত্র মিলিয়ে রাখতে হয়। এভাবেই বেশ নির্বিঘ্নে কেটে গেল দুই মাস। কাজটার প্রতি কেমন যেন নেশা ধরে গেল। ডাঃ এমরান প্রতি মাসের প্রথম দিন একটা সাদা খামে আমার সেলারী তুলে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না চোখ কপালে ওঠার মত মতই টাকার অংক। যে কোনো হাসপাতাল থেকে তিন গুণ বেশিই দিচ্ছেন আমাকে। জাহিদ তো প্রথম মাসের টাকা দেখেই শিস দিয়ে উঠেছে, “ তোমার চাকরিটা আমাকে দিয়ে দেও বেগাম। তোমার এত কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। মাস শেষে যে টাকা দিতেছে- আমারে দশ বার ধোলাই খালে বেঁচলেও আসবে না! আমি বেকার পোলা, একটা চাকরি ধরায় দেও ওই বাড়িতে। মালি হলেও চলবে।
কাজের প্রতি অনিহা কখনই ছিল না আমার। তার ওপর ডাঃ এমরানের দেয়া এত সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পর কাজের প্রতি একটা দায়ভারও জন্ম নিলো। গত কয়েকদিন হল ডাঃ এমরান একটা অক্টোপাস কিনেছেন। মিউজিয়ামের হল রুমটা মোড় নিয়েছে এদিক সেদিক। একটা অংশে বিশাল এক ইনডোর সুইমিং পুল। যদিও এখন কেউ নামে না সেখানে। ওখানেই অক্টোপাসটাকে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমি। সাইড গুলো উঁচু রেলিং দিয়ে ইলেক্ট্রিফায়েড করা। যাতে অক্টোপাসটা উঠে আসতে না পারে। ডাঃ এমরান প্রায়ই এখানে এসে সময় কাটান। একা থাকেন বেশির ভাগ সময়। মাঝে মধ্যে আমার ভাইবা নেয়া ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথাই বলেন না দিনের পর দিন।
উনি তাঁর স্ত্রী জয়নাব আরার প্রতি ভীষণ দূর্বল ছিলেন সেটা বুঝতে পারলাম দু মাসের মাথায় এসে। সেদিন রাতে আমি চেক আপ শেষে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো- এমন সময় হ্যান্ড ব্যাগের ধাক্কা লেগে দরজার পাশে ঝোলানো একটা বিরাট ঝিনুকের ডোরবেল মাটিতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় আৎকে উঠি। কিন্তু আমার থেকে শত গুণ বেশি আহত হলেন ডাঃ এমরান। বিছানায় শুয়েই পাগলের মত বলে উঠলেন, “ হায় হায়! এটা কি করলে তুমি? ওটা জয়নাবের কত পছন্দের ছিল জানো? ও নিজ হাতে ওখানে লাগিয়েছিল ডোর বেলটা।কান্না সামলাতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
আমি অপ্রস্তুত ভাবে বললাম, “ আ-আমি ইচ্ছা করে করিনি স্যার...... আমি খুবই স্যরি......কি করবো বুঝতে পারলাম না। তাকিয়ে দেখলাম তিনি বিছানার কিনারে হেচড়ে চলে এসেছেন মরিয়া হয়ে। বিছানা থেকে ঝুঁকে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ঝিনুকের একটা টুকরা তুলে নিলেন। চোখে ভূলও দেখতে পারি- এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তাঁর গাল বেয়ে। আমি অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
ডাঃ এমরান সঙ্গে সঙ্গে খুব অসুস্থ হয়ে পরলেন। এভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে পরবেন কল্পনাও করিনি। দেখতে দেখতে জ্বর উঠে গেল একশো তিন ডিগ্রী। কাঁপতে লাগলেন বিছানায় শুয়ে। আমার বাসায় যাওয়া হল না। থেকে যেতে হল। ওনার এ অবস্থায় বাসায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জ্বরের ঘোরে উনি বারবার বলতে লাগলেন, “ তুমি এখনি বাসায় চলে যাও। আমি ঠিক আছি।
কিন্তু সেটা আমি করতে পারি না। থেকে গেলাম। খারাপ লাগছিল খুব ওনার জন্য। আমার কারণে হল এসব।
রাত দুটার দিকে ওনার জ্বর আরো বাড়ল। আমি উপায় না দেখে হল রুমে নেমে এলাম, হাসপাতালে ফোন করা দরকার। এখানেই শুধু ফোন রাখা। ডাঃ এমরান ফোনের শব্দ একেবারেই সহ্য করতে পারেন না বলে তাঁর ঘরে ফোন নেই।
আমি হল রুমে আসা মাত্র বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করেই প্রচন্ড ঘুম এসে ভর করল আমার দু চোখে। মাতালের মত টলতে লাগলাম। টেলিফোন পর্যন্ত পৌছাতে পারলাম না। সফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম মুহূর্তের মধ্যে.........

চোখ মেলার পর বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। ঘুমিয়ে ছিলাম তো সোফার ওপর। কিন্তু এখন শক্ত কোথাও শুয়ে আছি। চোখ কোচলে উঠে বসলাম। ফ্লোরে বসে আছি। আবছা অন্ধকারে বেশ অবাক হলাম। সোফা থেকে পড়ে গেলে তো নরম-গোড়ালি ডুবে যাওয়া কার্পেটের ওপর পড়তাম। কিন্তু যেখানে আছি সেটা টাইলসের মত ফ্লোর। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকালাম। ধীরে ধীরে চোখে অন্ধকার সয়ে এল। চমকে উঠলাম। বিশাল কোনো দাবার বোর্ডে বসে আছি আমি! বিরাট বিরাট সব সাদা কালো দাবার ঘর, আমার চারপাশে আধো অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে বর্ম পরা অনেক গুলো মূর্তি! নড়ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে এখনি নড়ে উঠবে। আমি টের পেলাম আমার দু কানের পাশ দিয়ে যেন আগুণের হল্কা ছুটে গেল। উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেল মাথা থেকে পায়ের দিকে। আমি কম্পিত মুখে ধীরে ধীরে মাথার ওপরের দিকে তাকাতেই তীব্র একটা ভয় চেপে ধরল আমাকে! আমার মাথার ওপর দিকে ডাঃ এমরানের সেই হল রুম, হাজার হাজার অ্যানটিক্স আর বিশাল বিশাল বুক শেলফ! আমি ছাদ থেকে উল্টো হয়ে ঝুলে আছি! নিজের অজান্তেই একটা চিৎকার দিয়ে উঠে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু দৌড়ে কোথায় যাবো? মাটিতে একটা মানুষ যে ভাবে দৌড়ায়- আমি সেভাবে ছাদময় দৌড়াচ্ছি! আমার মধ্যাকর্ষন বল যেন ছাদের দিকে! ভয়ার্ত চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ডাঃ এমরানের পুরো মিউজিয়ামের হাজার হাজার জিনিস পত্র উড়ে ছুটে আসছে এই বিশাল দাবার বোর্ডের দিকে! যেন এই বিশাল বাড়িটাকে কেউ উল্টো করে বসিয়ে দিয়েছে। ছাদ নিচে, ফ্লোর ওপরে! ফ্লোরের দিক থেকে ছুটে আসা জিনিস পত্র গুলো বৃষ্টির মত আমার চারপাশে আছড়ে পড়া শুরু করল। প্রচন্ড শব্দ করে কাঁচের জিনিস গুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকল। লাইব্রেরীর বই গুলো শেল্ফ থেকে উড়ে এসে পড়তে লাগল মূর্তি গুলোর ওপর। আমি আতংকে দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগলাম। আমার গায়েও এসে পড়ল দু একটা অ্যানটিক্স। তবে খুব ভারী না হওয়ায় বেশি কিছু হল না, কেবল ব্যথা পেয়ে পড়ে গেলাম। আবারও হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পাগলের মত ছাদময় দৌড়ে বেরাতে লাগলাম। ডাঃ এমরানের হল রুমটা কয়েকটা বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে। ছাদটাও তাই। আমি বাঁক গুলো হয়ে হল রুমের অন্য দিকে ছুটলাম। হল রুমের কয়েকটা মোড় ঘুরতেই বিশাল ইনডোর সুইমিং পুলটা। যেখানে অক্টোপাসটা পোষেন ডাঃ এমরান। আমি বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে দেখলাম সুইমিং পুলের পানি সোজা উড়ে আসছে দাবার বোর্ডের দিকে! ছাদের এ অংশে মূর্তির ঘনত্ব বেশি। মূর্তি গুলোর ওপর রীতিমত সমুদ্রের গর্জন হেনে আছড়ে পড়ল সুইমিং পুলের টন খানেক পানি! পানির তোড়ে আমি খড় কুটোর মত ছিটকে গেলাম একদিকে! ভেসে যেতে যেতে একটা মূর্তির পা ধরে আটকে ফেললাম নিজেকে। আতংকিত হয়ে দেখলাম বিশাল মাকড়শার মত অক্টোপাসটাও উড়ে নেমে আসছে ছাদের দিকে! আমার নাকে মুখে পানি ঢুকেছে। বেদম জোরে কাঁশতে কাঁশতে উঠে দৌড়াতে লাগলাম। টাইলসে পানি পড়ায় পা পিছলে গেল হঠাৎ। দড়াম করে আছাড় খেতেই মাথার একপাশে একটা ভয়ংকর বাড়ি খেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় কোনো শব্দই বেরুল না মুখ দিয়ে। জ্ঞান হারালাম।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
( পেজ - ২ )
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আমার।
জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতে জাহিদের মুখটা চোখে পড়ল। উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে ছিল, আমাকে চোখ খুলতে দেখেই দাঁত বের করে হাসল, “ এখন কেমন আছো বেগাম?”
আমি সামান্য নড়াতেই মাথার একপাশে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করলাম। মাথাটা যেন ছিঁড়েই যাবে! ব্যথায় মুখ বাঁকিয়ে ফেললাম, “ উফ! মাথাটা শেষ! ফেটে চার টুকরা হয়ে গেছে!
সমস্যা নেই। ডাক্তারেরা সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। এখন রোদে শুকাতে হবে। আর বলেছে এরপর যেন আর সোফায় শুয়ে ঘুমালে যেন সিট বেল্ট বেঁধে দেয়া হয়। তুমি তো ট্রাক ড্রাইভারের মত সোফায় ঘুমাও। ওখান থেকে পড়েই এই অবস্থা। আল্লায় বাঁচাইছে আরেকটু ওপর থেকে পড়ো নাই!
আমি দূর্বল গলায় বললাম, “ আমি সোফা থেকে পড়িনি জাহিদ। পা পিছলে ছাদে পড়েছি। আমি চার তলা উঁচু ছাদের সেই দাবার বোর্ডে ছিলাম উল্টো ভাবে।
জাহিদের মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল। থমথমে মুখে বলল, “ ডাক্তার মাথাটা জোড়া দেয়ার সময় নাট-বল্টু যে খুলে রেখে দেবে ভাবিনি। এতদিন জানতাম টি.ভি. মেকানিকরা এই কাজ করে। ডাক্তাররাও যে করে এই প্রথম জানলাম।ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল, “ তুমি ঘুমাবার চেষ্টা কর। নড়া চড়া একদম করবে না। আমি আছি এখানে।
আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না আমি এখানে কিভাবে এলাম? ডাঃ এমরান কি জানেন আমার এ অবস্থা কিভাবে হয়েছে? আর তিনিই বা কেমন আছেন এখন?

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের অবস্থা কি হয়েছে সেটা দেখতে যাওয়ার মত সুস্থ হতে হতে দশ দিন লেগে গেল। শুনলাম তিনি নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই কথা হয়নি। জাহিদের সঙ্গেই তাঁর আলাপ হয়েছে। অনেক্ষণ কথা বলেছে তারা শুনলাম মিথিলার কাছে। জাহিদ যে কি এত বকবক করতে পারে বুঝি না! হাসপাতালে এ কয়দিন জাহিদ, খালা আর মিথিলা ছিল আমার সঙ্গে প্রায় সারাক্ষণ। জাহিদের স্বরচিত অখাদ্য কবিতা শুনে শুনে কানের পোঁকা বেরিয়ে যাবে এমন যখন অবস্থা- তখন হাসপাতাল থেকে ডিকসাস করে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কাজে ফেরার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম।
মিথিলা ব্যাগ গোছাচ্ছিল হাসপাতাল ছাড়ার আগে। আমি জামা পালতে সবে ওড়না দিয়েছি, এমন সময় কেবিনের দরজায় নক করার শব্দ হল। ফিরে তাকালাম।
কে?” মিথিলা জিজ্ঞেস করল।
ছোট বেগাম, আমি।জাহিদের গলা শোনা গেল।
, ভাইয়া ভেতরে এসো।গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে এসে মিথিলা ব্যাগ গোছানয় মন দিল। জাহিদ দরজা খুলে মুখ ঢুকিয়ে উঁকি দিল। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিল, “ ডার্লিং ভাল আছো?”
ভেতরে ঢোকো।হাত নেড়ে বললাম।
উঁহু! চোক্ষু বন্ধ করো গো বেগাম! সারপ্রাইজ গিফট এনেছি তোমার লাগি।
তোমার এত ঢং করার এনার্জি আসে কোত্থেকে?” বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ খুলে মিথিলার দিকে তাকালাম, মিটিমিটি হাসছে, মুখে হাত চেপে হাসি আটকাবার চেষ্টা করছে। ধমক দিলাম আমি, “ হাসবি না ফ্যাঁক ফ্যাঁক করে।আবার চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম।
শুনলাম জাহিদ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আমার সামনে এসে বোধ হয় হাটু গেড়ে বসল।
বেগাম, তোমার জন্য দুনিয়া তন্য তন্য করে একশো আটটা নীল পদ্ম না আনতে পারি। এই অধম প্রেমিক তার নতুন টিউশ্যনির জোরে একশো আটটা সিঙ্গারা ঠিকি আনতে পেরেছে! চোখ খুলো বেগাম, দেখে ধন্য হও!
আমি চোখ খুলে ছানা বাড়া হয়ে গেলাম। জাহিদ বড় একটা কাটুনে করে একগাদা সিঙ্গারা নিয়ে এসেছে! গরম সিঙ্গারার ঘ্রানে কেবিনের বাতাস মোঁ মোঁ করছে!
দাড়াজ হাসি হেসে বলল জাহিদ, “ একটা কবিতাও লিখেছি বেগাম। তোমার শুভ মুক্তি উপলক্ষে – ” কেঁশে গলা পরিষ্কার করল

মনে পড়ে আমার দিকে
তাকিয়ে ছিলে ভীরু চোখে?
প্রহর শুরুর ক্ষুদ্র ক্ষণে
স্বপ্ন দেখা সপ্তালোকে?
পথটা যখন শুরুয় ছিল
রঙ্গিন নেশায় ভোর,
তোমার কোমল ভালবাসার
পাইনি সে আদর।
বেলায় কেবল অল্প করে
লাগত রঙের টান,
দূর বহুক্ষণ প্রত্যাশাতেই
প্রেমের আহবান।
প্রহর শেষে তোমার কাছে
এসেছি আজ তাই,
পথের শুরুয় পাইনি তো কি?
পথের শেষে চাই!

ভ্রুঁ নাচাল, “ কেমন হয়েছে বেগাম?”
আমি কিছু বলার আগেই মিথিলা জোরে হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল, “ ওয়াও জিজু! চো চুইট! ইস ক্যামেরা থাকলে ভিডিও করতাম।
ওর দিকে তাকিয়ে এক হাতে বাক্সটা ধরে বাউ করার মত করল জাহিদ, “ শুকরিয়া, শুকরিয়া ছোট বেগাম!
আমি কোমরে দু হাত দিয়ে নাকের পাটা ফুলিয়ে বললাম, “ এই টন খানেক সিঙ্গারা কে খাবে? টাকা হাতে পেলে ওড়াতে ইচ্ছা করে? ভাল একটা শার্ট কিনতে পারো না? একটা নীল শার্টে কি দশ বছর চালাবে?”
বিন্দু মাত্র মলিন হল না জাহিদের হাসি, “ ওটা যৌতুকের খাতায় জমা আছে। বিয়ের আগে এই এক শার্টে পার করে দেবো।বাক্সটা হাতে উঠে দাঁড়াল, “ তোমার শুভ মুক্তি পাওয়া উপলক্ষে মিষ্টি কেনা ঠিক হবে না। তাই ঝাল জিনিস বিলাবো ভেবেছি। ছোট বেগাম- মিথিলার দিকে তাকাল, “ চল সারা হাসপাতালে এগুলো বিলিয়ে আসি।
মিথিলা ফিঁক করে হেসে দিল। আমি রেগে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাত ধরে, নাহ- কনুইয়ে কনুই ধরে বেরিয়ে গেল সিঙ্গারা বিলাতে!
বিরক্ত হলাম খুব। ঘুরে ব্যাগটা গোছাতে লাগলাম। জাহিদের কবিতাটার শেষ লাইন দুটো মাথায় ঘুরছে কেন জানি। খারাপ লেখেনি। কিন্তু প্রশংসা করলে পেয়ে বসবে। থাক। যেমন আছে থাকুক। আপন মনে হাসলাম ওর পাগলামীর কথা ভেবে।
সেন্ডেল নিতে ঝুঁকেছি মেঝেতে হঠাৎ জমে গেলাম বরফের মত। ভয়ংকর একটা ভয় মাথা থেকে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। রুমের লাইট জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, তার ছায়া পড়েছে মেঝেতে। আমি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম ফ্যানের ছায়ার সঙ্গে একটা মানুষের উল্টো ছায়া! সিলিং থেকে কেউ ঝুলে থাকলে যেমন হবে- ঠিক তেমন! আমি কাঁপতে লাগলাম আতংকে। খুব ধীরে ধীরে ঘুরলাম। রুমের সিলিংটা ঠিক সেই দাবার বোর্ডের মত হয়ে গেছে!
সেখান থেকে গম্ভীর মুখে ঝুলে আছেন ডাঃ এমরান! তাকিয়ে রয়েছেন সরাসরি আমার দিকে!

দ্রষ্টব্যঃ "চতুরঙ্গ" কোনও সত্য ঘটনার উপর নির্মিত নয়।। লেখক মূলত ঘটনাটি সপ্নে দেখেন এবং পরবর্তীতে সেটাকে গল্পে রূপান্তরিত করেন।।