Thursday, March 14, 2024

হায়েয সংক্রান্ত নারীদের প্রয়োজনীয় ফাতাওয়া-মাসায়েল

হায়েয সংক্রান্ত নারীদের প্রয়োজনীয় ফাতাওয়া-মাসায়েল

আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের দ্বীনি ভাইদের পাশাপাশি জেনারেল বোনরাও অত্যান্ত আগ্রহের সাথে দ্বীন চর্চা করতেছেন,এবং বাস্তব জিবনে আমলের মাধ্যমে নিজেদের কে সত্যিকার একজন মু'মিন হিসাবে পরিচয় দিচ্ছেন। মাশাআল্লাহ 

তবে দ্বীনি বোনেরা যেহুতু জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করেছেন সে কারণে হয়তো নারী সংক্রান্ত অনেক মাসআলা-মাসায়েল জানার তেমন সুযোগ হয়ে উঠেনি।অথচ এমন কিছু জরুরি বিষয় রয়েছে যা শুধুমাত্র নারীদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যা জানা একান্ত অপরিহার্যও বটে।

অনেক বোন হয়তো লজ্জার কারণে সেগুলো জিজ্ঞাসা করার সাহসও করেন না,যদিও দ্বীনি বিষয়ে লজ্জা করা কাম্য নয়। আবার অনেক বোন জানার জন্য আমলের নিয়তে আমাদের হানাফী ফিকহ (Hanafi Fiqh) গ্রুপে প্রশ্ন করেন এবং অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ইনবক্সও করেন। তাই হানাফী ফিকহ-Hanafi Fiqh পরিবারের একজন দায়িত্বশীল হিসাবে সেই মাসায়িলগুলো আপনাদের জানানো দ্বীনি জিম্মাদারী সহ একান্ত কর্তব্যও বটে। জাযাকুমুল্লাহ

বালেগ হওয়ার পর থেকে একজন মহিলার জরায়ু হতে সাধারণত যে রক্ত নির্গত হয় তা তিন প্রকার: যথা- হায়েয, নিফাস ও ইস্তেহাযা। আজকের শুধু হায়েয সংক্রান্ত আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ
পরবর্তীতে সময়-সুযোগ বুঝে বাকীগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আর্টিকেল আসবে। 

হায়েযের পরিচয়: হায়েয বা ঋতুস্রাব বলা হয় এমন রক্তকে যা একজন সুস্থ সাবালিকা মেয়ের জরায়ু থেকে স্বাভাবিকভাবে যৌনাঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা রোগ বা সন্তান প্রসবের কারণে বের হয় না। এবং যে "সন্নে ইয়াস' বা (যে বয়সে বাচ্ছা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না) সে বয়সেও উপনীত হয়নি। [নুরুল ইযাহ ৫২ পৃ.]

 কুরআনে হায়েয সম্পর্কে বলা হয়েছে—

“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে; হায়েয সম্পর্কে নির্দেশ কি? তুমি বল, সেটা একটা অপবিত্র ও ময়লাযুক্ত অবস্থা। কাজেই তখন স্ত্রীদের থেকে দূর থাকবে এবং তাদের কাছে গমন করবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়। অতঃপর তারা যখন পবিত্র হবে, তখন তাদের কাছে গমন করবে ঠিক সেভাবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন। যারা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।”—(সূরা- আল-বাক্বারাঃ ২২২)

আল্লাহ তা’আলা হায়েয কে মেয়েদের প্রকৃতিগত করে দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) বলেন,

“এটা এমন এক বস্তু যা আল্লাহ তা’আলা আদমের কন্যাদের উপর নির্ধারিত করে দিয়েছেন।” 

إن هذا أمر كتبه الله على بنات آدم فاقضي ما يقضي الحاج غير أن لا تطوفي بالبيت قالت وضحى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن نسائه بالبقر [بخاری . رقم الحدیث٢٩٠ ]

হায়েযের সুচনার ব্যাপারে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে যে,
হায়েযের সুচনা হযরত হাওয়া আ.এর মাধ্যমে হয়। হযরত হাওয়া আ.যখন নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন তখন থেকেই হায়েয নামক এই রোগ মেয়েদের
সাথে লেগে যায়। আর আল্লাহ তা’আলা এটাকে আদমের সকল কন্যাদের উপর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। [দুররে মুখতার ১/২৮৩]

 
الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (1/ 283):

"وسببه ابتداء ابتلاء الله لحواء لأكل الشجرة".

"(قوله: ابتلاء الله لحواء إلخ) أي وبقي في بناتها إلى يوم القيامة، وما قيل: إنه أول ما أرسل الحيض على بني إسرائيل فقد رده البخاري بقوله: و حديث النبي صلى الله عليه وسلم أكبر، وهو ما رواه عن عائشة -رضي الله عنها- قالت: «قال رسول الله صلى الله عليه وسلم في الحيض: هذا شيء كتبه الله على بنات آدم». قال النووي: أي إنه عام في جميع بنات آدم".

হায়েযের সময়সীমা: হায়েযের সময়সীমা সর্বনিম্ন ৩ দিন ৩ রাত। আর সর্বোচ্চ ১০ দিন ১০ রাত। তিনদিনের কম ও দশদিনের বেশি রক্তস্রাব হলে সেটা হায়েয বলে গন্য হবে না। সেটা হবে ইস্তেহাযা। এই অবস্থায় তিনদিনের কম হলে ছেড়ে দেয়া নামাজ কাযা করতে হবে। আর দশদিনের বেশি হলে এরপর থেকে নামাজ পড়তে হবে। (তবে এখানে আদত তথা অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে দশদিনের আগে থেকেও নামাজ পড়তে হতে পারে)
[আশরাফুল হিদায়া ১/২১৪]

হায়েযের রং: হায়েযের সর্বোচ্চ সময়সীমা ১০দিন। এ ১০দিনের ভিতর লাল,হলুদ,সবুজ,লাল মিশ্রিত কালো বা নিখুত কালো যে কালারের-ই পানি বের হোক না কেন তা হায়েয হিসেবেই গণ্য হবে। যতক্ষণ না নেপকিন সাদা নজরে আসবে। তথা সাদা রং ব্যতীত সকলপ্রকার রং ই হায়েযের অন্তর্ভুক্ত। [বেহেশতী জেওর-১/২০৬]

হায়েযের অভ্যাসের দিনগুলিতে বাদামী দাগগুলিও ঋতুস্রাব হিসাবে বিবেচিত হবে। ঋতুস্রাবের সময় যে কাপড় বা প্যাড রাখা হয় তা পুরোপুরি সাদা না হওয়া পর্যন্ত ঋতুস্রাব বলেই গণ্য হবে এবং নামায এবং রোজা রাখা জায়েয হবে না। এবং যখন প্যাড বা কাপড় পুরোপুরি পরিষ্কার দেখাবে, তখন ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত বলে বিবেচিত হবে। [দুররে মুখতার ১/২৮৮]

 الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (1/ 288):
 "(وما تراه) من لون ككدرة وتربية (في مدته) المعتادة (سوى بياض خالص) قيل: هو شيء يشبه الخيط الأبيض

পবিত্রতার সময়: দুই হায়েযের মধ্যবর্তী পবিত্রতার সর্বনিম্ন সময় ১৫ দিন। আর সর্বোচ্চ কোনো সময়সীমা নেই। মাসের পর মাসও কেউ পবিত্র থাকতে পারে। পনের দিনের মধ্যে কোনো রক্ত আসলে সেটি হায়েজ নয়,বরং সেটি ইস্তেহাজা তথা অসুস্থতা।
এই সময়ে নামাজ-রোযা আদায় করতে হবে।    

হজরত হান্নাদ [রহ] আম্মাজান আয়েশা [রা]-এর হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, ফাতিমা বিনতে হুবাইশ নামক এক নারী একবার রাসুল [সা]-এর সমীপে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমি একজন ইস্তেহাযাগ্রস্ত মেয়ে। আমি তো পবিত্র হয় না। তাই আমি কি নামাজ পড়া ছেড়ে দেবো? রাসুল [সা] বললেন, না, কারণ এ রক্ত হায়েযের নয়; বরং এ হলো শিরা থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত। সুতরাং যখন তোমার হায়েযের নির্ধারিত দিনগুলি আসে তখন সে দিনগুলি নামাজ ছেড়ে দেবে। আর হায়েযের দিন চলে গেলে তোমার রক্ত ধুয়ে নেবে এবং নামাজ আদায় করবে। [তিরমিজি, হাদিস-১২৫]
     
ইমাম আলা উদ্দিন হাসকাফি রহ.বলেন,

لما قال الحصکفیؒ: واقل الطہر بین الحیضتین او النفاس والحیض خمسۃ عشر یومًا ولیالیھا اجماعًا۔[ الدرالمختارعلی صدر ردّالمحتار:ج؍۱،ص؍۲۸۵، باب الحیض]

 দুই হায়েজ বা নিফাস ও হায়েজের মধ্যে   
পবিত্রতার সর্বনিম্ন সীমা সর্বসম্মতিক্রমে পনেরো দিন ও পনেরো রাত।

হায়েযের অভ্যাস সংক্রান্ত মাসআলা:

মাসআলা- ১: কারো জীবনের প্রথম রক্তস্রাব শুরু হয়েই ১০ দিনের বেশি হলে, ১০ দিন ১০ রাত হায়েয ধরবে, বাকি দিন ইস্তেহাযা ধরবে। আর প্রতিমাসে এমন হলে প্রতিমাসেই একই নিয়ম মেনে চলবে।

মাসআলা- ২: যদি কারো ৩ দিন ৩ রাত রক্ত দেখা দেয় তারপর ১৫ দিন পবিত্র থাকে, তারপর আবার তিন দিন তিন রাত হায়েয দেখা দেয়, তবে পূর্বের ৩ ও পরের ৩ দিন হায়েয ধরে ১৫ দিন পবিত্রতা ধরবে। [তুহফায়ে খাওয়াতিন]

মাসআলা- ৩: কারো ১ অথবা ২ দিন রক্ত দেখা দিলে তারপর ১৫ দিনের কম সময় রক্ত বন্ধ রইলো, ধরুন দশ বারোদিন পবিত্র রইলো তারপর আবার রক্ত দেখা গেল, তখন সে রক্ত দেখা যাওয়ার প্রথমদিন থেকে গুণে তার অভ্যাসের দিন পর্যন্ত হায়েয ধরবে এবং বাকি দিনগুলো ইস্তেহাযা ধরবে।

মাসআলা- ৪: যদি কারো হায়েয শেষ হওয়ার পর ১৫ দিন পবিত্র থাকে তারপর রক্ত দেখা দেয় এবং ৩ দিন ৩ রাত পূর্ণ হওয়ার আগেই রক্ত বন্ধ হয়ে যায়, এরপর পুনরায় ১৫ দিনের বেশি পবিত্র থাকে তাহলে আগের রক্ত ইস্তেহাযা ধরবে এবং ছেড়ে দেয়া নামাজ কাযা করবে। কারণ তিনদিনের কম হায়েয হয় না।

মাসআলা-৫ যদি কোন মহিলার হায়েজের নির্দিষ্ট কোন অভ্যাস না থাকে, অর্থাৎ কোন মাসে ৭ দিন, কোন মাসে ৮ দিন, আবার কোন মাসে ৯ দিন হায়েজের রক্ত নির্গত হয়। এমন মহিলার কোন মাসে যদি ১০ দিনের বেশি রক্ত আসে, সেক্ষেত্রে করণীয় হল, পূর্বের মাসে (১০ দিনের কম) যত দিন রক্ত এসেছে, সেটাকে অভ্যাস ধরে নিয়ে ঐ পরিমান দিনগুলোকে হায়েয গণ্য করা হবে। আর অতিরিক্ত বাকী দিনগুলোতে নির্গত হওয়া রক্ত ইস্তেহাযা গণ্য হবে। [ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৪৭৭]

মাসআলা-৬ যদি কেউ পূর্ববর্তী হায়েযের অভ্যাস শেষ হওয়ার পর গোসল করে,অতঃপর হায়েযের সর্বোচ্চ সময় দশ দিনের মধ্যে পুনরাই হায়েয আসে,তাহলে উল্লেখিত সব দিনগুলো হায়েয বলেই গণ্য হবে এবং এর ভিতরে যে সকল নামায পড়েছে তা ধর্তব্য হবে না, এবং সেগুলোর কাযাও আদায় করতে হবে না।[কিতাবুন নাওয়াযেল ৩/১৭২]

মাসআলা-৭ যদি কারো ৫ দিন রক্ত আসার অভ্যাস ছিল অতঃপর ঘটনাক্রমে কোনো মাসে চার দিন রক্ত আসার পর বন্ধ হয়ে যায়,তাহলে এই অবস্থায় রক্ত বন্ধ হওয়ার পর নামাযের শেষ ওয়াক্তে গোসল করে নামায পড়বে। আর যদি রমযান মাস হয় তাহলে সতর্কতা হিসাবে রোযা রাখা ফরজ। তবে পাচঁ দিন পূর্ণ হওয়ার আগে সহবাস করা জায়েয হবে না। [কিতাবুন নাওয়াযেল ১/১৭৮]

হায়েয চলাকালিন বিধি-নিষেধ:

মাসআলা-৮ নারীরা মাসিক ও প্রসবজনিত বিশেষ দিনগুলোতে নামাজ-রোজা পালন করতে পারবে না। পরে এসব নামাজের কাজাও নেই, তবে রোজা কাজা করে নিতে হবে। 
[সহিহ বুখারি ৩/৩৫ হাদিস নং১৯৫১; সুনানে তিরমিযী হাদিস নং ৭৮৭;মাবসুতে সারাখসি : ৩/১৫৪-১৫৫]

মাসআলা-৯ হায়েযের বিশেষ দিনগুলোতে কোরআন শরিফ পড়া এবং গিলাফ ব্যতীত স্পর্শ করা জায়েজ নেই। [ফাতহুল কাদির : ১/১৬৮]

ঋতুমতী মহিলার জন্য কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ। এ সময়ে কাউকে শিখানোর উদ্দেশ্যেও তা পড়া যাবে না। এক্ষেত্রে শেখানোর জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা উচিত। অবশ্য ভিন্ন ব্যবস্থা না থাকলে একটি করে শব্দ বলে দিবে এবং প্রত্যেক শব্দের পর ওয়াকফ করবে। এছাড়া বানান করেও পড়া বলে দিতে পারবে।

উল্লেখ্য, ঋতুমতী মহিলার জন্য কুরআন শ্রবণ করা জায়েয, তাই এ অবস্থায় ছাত্রীদের পড়া শুনতে কোনো অসুবিধা নেই।

-জামে তিরমিযী ১/৩৪; আলমুহীতুল বুরহানী ১/৪০৩; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৩০; আদ্দুররুল মুখতার ১/২৯৩

মাসআলা-১০ কুরআন শরীফ শিক্ষাদান কারী মহিলা এবং ছাত্রী উভয়ের জন্যই মাসিকের বিশেষ দিনগুলোতে কুরআন স্পর্শ করা,তেলাওয়াত করা জায়েয নেই। তবে কুরআন শিক্ষার ধারাবাহিতা ধরে রাখার পদ্ধতি এই যে, সে কুরআনের আয়াত পরিপূর্ণ ভাবে পড়বে না,বরং একটি করে শব্দ বলে দিবে এবং প্রত্যেক শব্দের পর ওয়াকফ করবে। এছাড়া বানান করেও পড়া বলে দিতে পারবে।
যেমন,
  الحمد۔۔۔۔ للہ۔۔۔۔ رب۔۔۔ العالمین

মাসিকের বিশেষ দিনগুলোতে মহিলাদের জন্য শব্দ শব্দ করে পড়া জায়েয, তবে পরিপূর্ণ আয়াত পাঠ করা জায়েয হবে না। এই বিধান ছাত্রি-শিক্ষিকা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। 
 
তবে এ কথা স্মরণ রাখা উচিৎ এ বিশেষ দিনগুলোতে গিলাফ ব্যতিত কোরআন স্পর্শ করা,ধরা জায়েয নেই।
তবে হ্যাঁ কায়েদা এবং দ্বীনি অন্যান্য কিতাবাদি স্পর্শ করা এবং পড়া যাবে। যেমন তাফসীরের কিতাব,যাতে তাফসির বেশী হয় আয়াতের তুলনায়,হাদিসের গ্রন্থসামগ্রি এবং ফিকহের কিতাবাদি ইত্যাদি স্পর্শ করা এবং পড়া যাবে। আর এক্ষেত্রেও যেখানে আয়াত লেখা থাকবে তা স্পর্শ এবং পড়া জায়েয হবে না।

যদি শিক্ষিকা ঋতুমতী হয় তাহলে তার জন্য ছাত্রীদের থেকে কুরআন শ্রবণ করা জায়েয, তাই এ অবস্থায় ছাত্রীদের পড়া শুনতে কোনো অসুবিধা নেই।

এমনিভাবে ছাত্রীরা কোরআন ধরে রাখবে,আর শিক্ষিকা তা দেখে দেখে পড়া শুনবে তাহলে এটারও সুযোগ রয়েছে।

এমনিভাবে যদি হেফজ ভুলে যাওয়ার আশংকা হয় তাহলে ফুকাহায়ে কেরাম এ পদ্ধতির কথা বলেন যে, হাফেজা মহিলা কোনো পবিত্র কাপড় ইত্যাদি দ্বারা কোরআন কে ধরে সেখানে দেখে মনে মনে পুনরাবৃত্তি করতে পারবে। এর সুযোগ রয়েছে এবং তাতে মুখস্থ করার জরুরতও পূর্ণ হবে।তবে মুখে একেবারে উচ্ছারণ করতে পারবে না।

মাসআলা-১১ অনুরূপ হায়েজ-নেফাস অবস্থায় সহবাস থেকে বিরত থাকা একান্ত অপরিহার্য। তবে অপারগতাবশত গুনাহ থেকে বাঁচার মানসে হাঁটু থেকে নাভির মধ্যবর্তী অংশ বাদ দিয়ে অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা যৌনস্পৃহা নিবারণ করা যায়। (আদ্দুররুল মুখতার : ১/২৯২)

মাসআলা-১২ এমনিভাবে হায়েয চলাকালিন সময়ে তাওয়াফ করা,মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ। [কিতাবুন নাওয়াযেল ১/১৮১]

 মাসআলা-১৩ বই-পুস্তক বা দ্বীনি কিতাবাদি, যেখানে কোরআন শরিফের আয়াতও লিখা থাকে, এ অবস্থায় পড়া বা স্পর্শ করা জায়েজ। তবে কোরআনের আয়াত পড়া বা স্পর্শ করা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার : ১/১৭৬)

মাসআলা-১৪ তদ্রূপ ওই সময়ে দোয়ার অর্থবহ আয়াত বা সুরা দোয়ার নিয়তে পড়া জায়েজ। যেমন দোয়ার নিয়তে আয়াতুল কুরসি বা সুরায়ে নাস ও ফালাক ইত্যাদি পড়া জায়েজ হবে দোয়া হিসাবে,তেলাওয়াত হিসাবে নয়। তবে নিয়মিত আমল হিসেবেও সূরা ইয়াসিন, ওয়াকিয়া ইত্যাদি পড়া যাবে না। [ফাতহুল কাদির : ১/১৬৮, রদ্দুল মুহতার : ১/১৭২, আহসানুল ফাতাওয়া : ২/৭১]

মাসআলা-১৫ ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়াতে রয়েছে হায়েযগ্রস্থ নারীর জন্য মুস্তাহাব হলো,যখন নামাযের সময় হয় তখন সে অজু করবে এবং নিজ ঘরে নামাযের জায়গায় বসে থাকবে। পবিত্র থাকাকালিন যতটুকু সময় লাগত তার নামায পড়তে এ পরিমাণ সময় বসে থাকবে এবং তাসবিহ-তাহলিল পড়বে। যাতে ইবাদতের অভ্যাস চলে না যায়। [১/৪৭৮]

মাসআলা-১৬ হায়েয-নেফাস কোনো রোগ নয়,বরং প্রাকৃতিক নিয়ম। হায়েয-নেফাস না হওয়াই রোগ। ইচ্ছা করে বন্ধ করলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাই ওষুধ খেয়ে হায়েয-নেফাস বন্ধ করা নিষিদ্ধ। [ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া ৬/৪০৪]

মাসআলা-১৭ হায়েয-নেফাস শুরু হওয়ার পূর্বেই যদি ওষুধ সেবন করে বা কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে হায়েয-নেফাস বন্ধ করে দেওয়া হয়,তাহলে সংশ্লিষ্ট মহিলা ঋতুমুক্ত হিসাবে গণ্য হবে এবং যথারীতি নামায-রোজা আদায় করতে হবে। পক্ষান্তরে হায়েয-নেফাস শুরু হওয়ার পর যদি বন্ধ করা হয়,তাহলে দেখতে হবে হায়েযের ক্ষেত্রে দশ দিনের ভেতর এবং নেফাসের ক্ষেত্রে চল্লিশ দিনের ভেতর পুনরাই রক্ত দেখা দিয়েছে কি-না। যদি দেখা দিয়ে থাকে তাহলে সেই মহিলা হায়েযগগ্রস্থা(ঋতুবর্তী হিসাবে
গণ্য হবে,অন্যথায় ঋতুমুক্ত বলে গণ্য হবে।
[ফাতাওয়ায়ে শামি ১/৩০৮; বাদায়েস সানায়ে ১/৩৯

মাসআলা-১৮ হায়েজের সর্বোচ্চ সীমা ১০ দিনের মাথায় এসে যদি হায়েজ বন্ধ হয়,তাহলে গোসল ব্যতিতই সহবাস জায়েজ আছে।
তবে সহবাস গোসল করার পরেই উত্তম।
 আর যদি ১০ দিনের কম তবে মহিলার স্বাভাবিক অভ্যাস অনুযায়ী ৬/৭ দিনে হায়েয বন্ধ হয় তাহলে সহবাস তখন জায়েয হবে যখন গোসল করবে অথবা এতটুকু সময় অপেক্ষা করবে,যার মধ্যে গোসল করে কাপড় পরিধান করে নামাজ শুরু করতে পারে। বা হায়েজে শেষ হওয়ার পর নামাজের ওয়াক্ত চলে যায়,আর নামাজ তার যিম্মায় লাযেম তথা আবশ্যকীয় হয়ে যায়।[ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ১/২১১]
[ফাতাওয়ায়ে শামি ১/২৯২]

মাসআলা-১৯ যদি কারো ১০দিন এর কম স্রাব হয় এবং এমন সময়ে গিয়ে রক্ত বন্ধ হয় যে খুব তাড়াতাড়ি গোসল করে নেয়ার পর একবার আল্লাহু আকবর বলার সময় থাকে, তবে সেই ওয়াক্তের নামাজ পড়তে হবে। এমন অবস্থায় নামাজ শুরু করার পর ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেলেও নামাজ শেষ করতে হবে। তবে ফজরের ওয়াক্ত হলে যদি নামাজ শুরু করার পর সূর্য উদিত হয়ে যায় তবে সে নামাজ কাজা করতে হবে। [ হেদায়া, হায়েজ অধ্যায়।]

মাসআলা-২০ হায়েয অবস্থায় পবিত্র কোরআনের আয়াত লেখা থেকে বিরত থাকা জরুরি। তবে একান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে আয়াতের লিখিত অংশে হাত না লাগিয়ে লেখা যেতে পারে। [ফাতহুল কাদীর, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া]

মাসআলা-২১ মাসিক চলাকলীন সময় জিকির-আযকার করা, দরুদ শরীফ পড়া, ওযীফা পড়া, বিভিন্ন দোয়া পড়া যায়। এমনকি এসময় পবিত্র কোরআনে কারীমের দোয়ার আয়াতগুলোও দোয়া হিসেবে পড়া যাবে। পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত হিসেবে পড়া যাবে না। এক বর্ণনায় এসেছে, মা‘মার (রাহ.) বলেন, আমি যুহরী (রাহ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ঋতুমতী নারী ও যার ওপর গোসল ফরজ হয়েছে সে আল্লাহর যিকির করতে পারবে? তিনি বললেন, হাঁ, পারবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারবে? তিনি বললেন, না। [মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৩০২]

ইবরাহীম নাখায়ী (রাহ.) বলেন, ঋতুমতী নারী ও যার ওপর গোসল ফরজ হয়েছে সে আল্লাহর যিকির করতে পারবে এবং বিসমিল্লাহও পড়তে পারবে। [মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৩০৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৩৮; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/১৬৫]

মাসআলা-২২ হায়েয অবস্থায় তাওয়াফে জিয়ারত জায়েজ নেই। এমনকি তাওয়াফের জন্য মসজিদে হারামের ভিতরে প্রবেশ করাও জায়েজ নেই। যদি তাওয়াফ করাবস্থায় হায়েজ শুরু হয়ে যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাওয়াফ বন্ধ করে দেবে এবং পরবর্তীতে পবিত্র হওয়ার পর কাজা করবে। [কিতাবুল মাসায়েল : ৩ : ৪০৩]

রাসূলুল্লাহ (সা.) মা আয়েশা (রা:)-কে বলেছিলেন, ‘হজ্জ সম্পাদনকারী একজন ব্যক্তি যা করে তুমিও তা করতে থাক। তবে পবিত্রতা অর্জন পর্যন্ত পবিত্র ঘর কাবার তওয়াফ থেকে বিরত থাকবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

মাসআলা-২৩ হায়েয অবস্থায় মসজিদেও গমন করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘কোন ঋতুবতী এবং নাপাক ব্যক্তির জন্য (যার ওপর গোসল ফরজ) মসজিদে অবস্থান করা আমি বৈধ করিনি। [আবু দাউদ]

মাসআলা-২৪ তাওয়াফে যিয়ারতের সময় যদি হায়েয শুরু হয়ে যায় তাহলে সে অবস্থায় ইস্তেগফার করত তাওয়াফে যিয়ারত সম্পন্ন করবে এবং হেরেমের সীমানার ভেতরে একটি পশু(উট,গাভী,মহিষ ইত্যাদি) যবেহ করে ফেলবে। [গানিয়াতুন নাসেক ২৭২]

মাসআলা-২৫ হায়েযের দিন সমূহ গণনা করা নারীদের উপর আবশ্যক,যাতে পবিত্র-অপবিত্র বিধানের লক্ষ্য রেখে যে সময় গোসল ফরজ হয় তার প্রতি গুরুত্ব দিতে পারে। এবং এ গণনার উপরই নারীদের নামায আদায় করা না করার ভিত্তি।

মাসআলা-২৬ যদি কোনো নারীর ফরজ নামায আদায়রত অবস্থায় মাসিক শুরু হয়ে যায়,তাহলে তার জন্য সে নামায মাফ। ওই সময়ই সে নামায পূর্ণ না করে শেষ করে দেবে। উক্ত অবস্থায় নামায অব্যাহত রাখা জায়েয নেই। এবং পবিত্র হওয়ার পর সে নামাযের কাজাও আবশ্যক নয়।

মাসআলা-২৭ আর যদি নফল বা সুন্নত নামায আদায়রত অবস্থায় মাসিক শুরু হয়ে যায়,তাহলে ওই সময়ই সে নামায পূর্ণ না করে শেষ করে দেবে। তবে পবিত্র হওয়ার সে নামায কাজা করা আবশ্যক।
[ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি ১/৩৮; ফাতাওয়ায়ে শামি ১/২৯১]

মাসআলা-২৮ হায়েয অবস্থায় নাভির নিচের চুল কাটা মাকরুহ।[ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি ৫/৩১৪]

বি:দ্র:পরবর্তী পোস্টে থাকবে ধারাবাহিকক্রমে নেফাস,ইস্তেহাযা সংক্রান্ত ফাতাওয়া-মাসায়েল ইনশাআল্লাহ।

Khairul Islam 29/7/2021
হানাফী ফিকহ-Hanafi Fiqh


Wednesday, March 13, 2024

ফরজ ইলম অর্জন উপায়

জেনারেল শিক্ষিত প্র্যাকটিসিং ভাইবোনেরা কীভাবে ধারাবাহিকভাবে ইলম শিখবেন, দ্বীনি বিষয়ে পড়াশোনা করবেন, তার একটা সিলেবাস চেয়েছেন অনেকে।

প্রথম কথা হলো, যখন কেউ ইসলামি বইয়ের সাজেশন চায় কিংবা ভালো একটি বইয়ের নাম জানতে চায়, তখন কতিপয় লোক 'কুরআন পড়ুন' লিখে দেয়। তাদের কথায় ভুল নেই, কিন্তু এই জায়গায় তাদের মন্তব্যটা ভুল। কীভাবে? 

আমরা জানি, কুরআন-হাদিস হলো শরিয়তের মূল উৎস বা কাঁচামাল; এখান থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধানাবলীর জন্ম। কিন্তু এই কাঁচামালকে উপযুক্ত পন্থায় পরিবেশন করার জন্য ইলমের প্রয়োজন। ঠিক যেমন বাসায় মেহমান এলে তার সামনে আস্ত মুরগি রেখে দিলেই হয় না; বরং যোগ্য রাঁধুনী নিয়ে সেটাকে খাওয়ার উপযোগী করে পরিবেশন করতে হয়।

কুরআন-হাদিস আমাদের সামনেই আছে। কিন্তু সেখান থেকে নিজে নিজে মাসায়েল বের করে আমল করা কিংবা সরাসরি তা থেকে উপকৃত হওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই। এজন্যই ইলম আহরণ করতে হয় কুরআন-হাদিসের নির্যাসরূপে প্রস্তুতকৃত ও সরাসরি পরিবেশনযোগ্য 'ইসলামি কিতাবাদি' থেকে, যা সম্মানিত আলিমরা রচনা করে গেছেন।

এবার ইলম অর্জনের ধারাবাহিকতা বলার আগে আরেকটা কথা বলি। ইলম অর্জন করতে হয় বিষয়ভিত্তিক ভাবে। এলোপাতাড়ি পড়াশোনা করলে দিনশেষে তেমন কিছুই মনে থাকে না, হৃদয়ঙ্গম হয় না। যাইহোক। 

১. সবার আগে শিখতে হবে আকিদা। ওজু ও নামাজ ভঙ্গের কারণগুলোর চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে শিখতে হবে ঈমান ভঙ্গের কারণগুলো। জানতে হবে তাওহিদ, রিসালাত ও আরকানুল ঈমান প্রভৃতি। নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের কাছে আকিদার ওপর পড়াশোনা করুন। 'ঈমান সবার আগে' 'তাওহিদের মূলনীতি' 'ঈমান ভঙ্গের কারণ' 'আকিদাতুত তহাবি' 'প্রচলিত ভুল' এসব বই পড়ুন।

২. এরপর ইবাদাত, মুআমালাত তথা ব্যবসা ও লেনদেন, মুআশারাত তথা শিষ্টাচার ও বান্দার হক এবং হালাল-হারাম টপিকের ওপর পড়াশোনা করুন। 
'নবীজীর নামায' ও যাকাত-সিয়াম ও হজ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য আলিমদের লেখা ভালো বইগুলো পড়তে পারেন। ব্যবসা, লেনদেন ও ইসলামি অর্থনীতি সম্পর্কে জানতে তাকি উসমানি সাহেবের বইগুলো পড়া যায়। মুআশারাত তথা শিষ্টাচার বিষয়ে 'আদাবুল মুআশারাত' বইসহ অন্যান্য বই পড়তে পারেন। আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য পড়তে পারেন 'তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধি' বইটি।
পাশাপাশি পড়াশোনা করুন হালাল-হারাম বিষয়ে। সমকালীন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত 'হালাল-হারামের বিধান' বইটি পড়তে পারেন।
আর এই সবগুলো বিষয় সংক্ষেপে একসাথে পেতে পড়তে পারেন 'ফরজে আইন' বইটি।

৩. ধারাবাহিকভাবে পুরো কুরআনের অনুবাদ ও যেকোনো একটি ভালো তাফসির পড়ুন। 'তাওযীহুল কুরআন' ও 'তাফসীরে উসমানী' পড়তে পারেন। এই পড়াশোনা হবে কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে, কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করতে ও ভাবতে, কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে।

৪. বিষয়ভিত্তিক হাদিস পড়ুন। 'রিয়াজুস সালিহিন' 'আদাবুল মুফরাদ' ও প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের নির্যাস 'বিষয়ভিত্তিক বিশুদ্ধ হাদিস সংকলন' বইটি পড়তে পারেন।

৫. নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা করতে কোনো একাডেমীতে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। যেখানে কুরআন-হাদিস বুঝতে আরবি ভাষা, নাহু-সরফ, বালাগাত ইত্যাদি শিখবেন। ফিকহের কিতাবাদি পড়বেন। হাদিস ও হাদিসের মূলনীতি শিখবেন। তাফসিরের ইলম আহরণ করবেন। সম্ভব হলে এই ধারাবাহিকতায় আলিম হবেন, ইনশাআল্লাহ।

মুফতি আবুল হাসানাত কাসিম (হাফি.)