Monday, May 6, 2013

।। ছায়া ।। [Ghost stories -28]


।। ছায়া ।।


আমার কাজিনরা যখন বাসায় আসতো তখন দিন নেই রাত নেই যখন তখন আমরা সবাই মিলে ছাদে চলে যেতাম আড্ডা দিতে। আসলে আমাদের বাসাটা একটু ছোট ছিল, তাই অনেকে একসাথে বসে আড্ডা জমাতে কষ্ট হতো। তো, জুলাই মাসের পরীক্ষা শেষ হবার পর আমার ৪টা কাজিন বাসায় চলে আসে। ১০ দিন থাকবে। ঘুরাফেরা, আড্ডাবাজি করে সময় কাটাবো। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। রাত ১১ টার দিকে হটাত কারেন্ট চলে যায়। বিকেল বেলা বৃষ্টি হয়েছে। তারপরও গরম খুব একটা কমেনি। হটাত সিহাব(আমার মামাত ভাই) প্রস্তাব দিলো ছাদে গিয়ে গল্প করার। কারেন্ট আসলে নেমে পড়বো। আমিও ভেবে দেখলাম প্রস্তাবটা। মন্দ না। এখানে বসে গরমে সিদ্ধ হবার চেয়ে উপরে গিয়ে ঘুরে আশা যায়। ৫ ভাই-বোন (আমি আর আমার ৪ কাজিন) মিলে পাটি নিয়ে উঠে গেলাম ছাদে। উদ্দেশ্য, গা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করা। আমা ছাদে উঠার প্রায় মিনিট দশেক পর হটাত "ধুপ" করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হল। শিপন উঠে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরে উঁকি দিয়ে দিলো। কিছু পড়লো, টরলো নাকি বুঝার জন্য। বাড়ির পাশেই একটি গলির মতো। সেখানে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না ভালো মতো। যাই হোক, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলে গিয়ে আবারো আড্ডায় মন দিলাম আমরা।

এইবার আমাদের পাশের বাড়ির ছাদ থেকে কেমন অদ্ভুত একটা শব্দ হল। সেই শব্দটা বর্ণনা করতে পারবো না আমি। কিন্তু, সেইরাতে আমরা সবাই শুনেছিলাম শব্দটি। সিহাব বসা থেকে উঠে বলল, আমি দেখে আসছি। আমরা ছাদের একপাশে বসেছিলাম। আর যেই ছাদ থেকে শব্দটি আসে সেই ছাদটা অপর পাশে ছিল। সিহাব যাওয়ার সাথে সাথে দিগুন বেগে ফিরে এলো। বলল, ঐ বাড়ির ছাদে যেনও কে আছে। আমি বললাম, হয়তো ঐ বাড়ির কেউ উঠেছে। বাদ দে! সিহাব বলল, বুঝলাম না। আমার কাছে কেমন যেনও অদ্ভুত লাগলো। যেনও কোনও মানুষ না, শুধু একটা কালো ছায়া। প্রথমে আমি পাত্তা দিলাম না। কিন্তু মৌ কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে গেলো। বলল, এতো রাতে ছাদে না থাকলেই ভালো। চলো নিচে চলে যাই।

নামার পথে পাশের বাড়ির ছাদটা চোখে পড়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সাড়া গায়ে যেনও একটা কালো চাদর জড়ানো। আমাদের বাড়ির ছাদে একটি মার্কেটিং বোর্ড লাগানো। কারেন্ট না থাকলেও তা সন্ধ্যার পর সবসময় জ্বলে। তা থেকে আলোর প্রতিফলনের ফলে আমাদের ছাদের ঢোকার রাস্তা এবং আশেপাশের জায়গা একটু আলকিত হয়। তবে তাতে ঠিক আঁধার কাটে না। তবে কোন কিছুর অস্তিত্ব বুঝা যায়। যাই হোক সেই কালো মূর্তি দেখে আসলেই ভয় পেলাম। একে তো অন্ধকার তার উপর কালো চাদরে ঢাকা কেউ একজন, ব্যাপারটাকে ভূতুড়ে করে ফেলল। আমার দেখাদেখি বাকিরাও এসে পাশে দাঁড়ালো। সবার চোখেই বিস্ময়। মৌ ফিসফিস করে বলল, ঐটা কে রে আপুনি? আমি বললাম, বুঝতে পারছি না। ঐ বাসায় তো শুধু হাকিম চাচ্চুরা থাকেন। উপরের ২ তলা ফাঁকা, ভাড়াটিয়া নেই। আর এতো রাতে হাকিম চাচ্চুর ছাদে আসার কথা নয়।

তখনো অনেক কিছু ঘটা বাকি ছিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সেই মূর্তির পাশে আর একটা মূর্তি এসে দাঁড়ালো। ২টা ছায়া। এবং ২টাই কালো চাদরে ঢাকা। খানিকবাদে দেখলাম ৩টা হয়ে গেলো। ভয়ে তখন যার যার জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হটাত শিপন ফিসফিস করে বলল, আমার কাছে ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। চলো, নিচে চলে যাই।

সবাই নিচে নামার জন্য রাজি। সিঁড়ি দিকে পা বাড়াতে যাবো, এমন সময় কারেন্ট চলে এলো। সাথে সাথে তাকিয়ে দেখলাম পাশের ছাদের দিকে। কেউ নেই! ৩টা ছায়া তো দূরের কথা! কাউকেই দেখতে পেলাম না। অথচ হাকিম চাচ্চুদের ছাদের পুরো অংশ দেখা যায় আমাদের ছাদে উঠার রাস্তা থেকে। এবার আর দেরি করলাম না। দ্রুত নেমে পড়লাম।

মনের মধ্যে কেমন যেনও উসখুস করতে লাগলো। কিন্তু তবুও আম্মু আব্বুকে কিছু জানলাম না সেই রাতে। পরের দিন, কৌশলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, হাকিম চাচ্চুদের বাসায় কোনো ভাড়াটিয়া আসছে কিনা। আম্মুর উত্তর শুনে চমকে উঠলাম। হাকিম চাচ্চুদের বাসায় ভাড়াটিয়া তো দূরের কথা, এমনকি উনারাও নেই। চাচ্চু কি একটা কারনে দেশের বাইরে গেছে এবং উনার ওয়াইফও সাথে গেছেন। ৩ তলা বাড়িটা পুরোটাই এখন খালি!



# বীভৎস নারী # [Ghost Stories -27]


# বীভৎস নারী #


ঘটনাটি খুব ছোট। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তা আমার জীবনের কয়েকটা কাজকর্ম আমূল পাল্টে দেয়।

আমি গ্রামের ছেলে। মফঃস্বল শহরে একটা কলেজে পড়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে মফঃস্বলে চলে আসি। এখানে আমার এক কাকার বাসায় থাকতাম।

যাই হোক, ছুটি ফাটা বা বৃহস্পতিবার কলেজ শেষে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম। একদিন থেকে পরের দিন সকালে চলে আসতাম ক্লাস ধরার জন্য।

তেমনি করে এক বৃহস্পতিবার আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। কলেজে ব্যাবহারিক ক্লাসের কিছু কাজ থাকায় বের হতে একটু দেরি হয়ে যায়। ঠিক ৫ টার দিকে বাসে উঠি আমি। বাড়ি ১ ঘণ্টার রাস্তা। অর্থাৎ, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আমি ৬ টার দিকেই গ্রামের রাস্তায় পৌঁছে যাবো।

বলে রাখা দরকার, তখন শীতকাল ছিল। যারা গ্রামে থাকেন তারা জানেন যে, শীতকালে গ্রামে-হাটে যাত্রাপালা, নাটক ফাটক বেশি হয়। আমি যখন গিয়ে বাস থেকে নামি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতের আলোতে দেখলাম গ্রামের বাজারে শহর থেকে একদল নাট্যকর্মী গেছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতি ছোট বেলা থেকেই আমার বেজায় ঝোঁক। অনুষ্ঠান দেখলাম প্রায় ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রাত তখন সাড়ে ৮টা বাজে প্রায়। আর দেরি করলে মা চিন্তা করবে। এখানে বলে রাখা ভালো, তখনো আমার গ্রামে মোবাইল এতো একটা জনপ্রিয় ছিল না। তাই চাইলেও আমি মাকে ফোন করে জানাতে পারছিলাম না। অগত্যা বাড়ির দিকে রওনা হই।

বাজারের সব মানুষই তখন নাটক দেখতে ব্যাস্ত। পথে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম, প্রায় সব দোকানই বন্ধ করে দোকানিরা গেছে নাটক দেখতে। এমনকি হাঁটার পথে কারো সাথে যাবো এমন মানুষও দেখলাম না। মাথার উপর বিরাট থালা আকৃতির চাঁদ। বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা দিলাম।

আমাদের বাজার থেকে বাড়ি প্রায় মাইলখানেক। হেঁটে যেতে ২০ মিনিটের মতো লাগে। আমি নিজের মনে গুনগুন করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক হেঁটেছি, এমন সময় রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে খসখস আওয়াজ পেলাম। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল। পাত্তা না দিয়ে হেঁটে এগুতে লাগলাম। মিনিটখানেক সব চুপচাপ। এরপর আবার রাস্তার পাশে কেমন যেনও খসখস শব্দ হলো। এবার খানিকটা ভয় পেলাম। রাতের বেলা গ্রামের পথে শেয়াল চলাচল করে। একা মানুষ পেলে নাকি মাঝে মাঝে আক্রমণ করে বসে। শেয়াল তাড়ানোর জন্য গ্রামের মানুষ লাইট, টর্চ লাইট, নিদেনপক্ষে আগুন নিয়ে ঘুরে। আমার কাছে তার কিছুই নেই। কি করা যায় ভাবছি। এই অবস্থায় যথা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। সাহস হারানো মানে ক্ষতি হবার সম্ভবনা। মনের সব জোর একত্রে করে বলাম, হুর হুর হুস হুস! একটা-দুটো হলে হয়তো গলা শুনেই চলে যাবে। এই ভেবে এমন করা। ঝোপের পাশের আওয়াজ থেমে গেলো একবারে। হটাত করে চারপাশে নেমে এলো সুনসান নীরবতা।

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই ক্ষণটা। ঝোপের পাশ থেকে সাদা কাপড় পড়া একটা মহিলা মতন কে যেনও বের হয়ে এলো। তার উচ্চতা সাধারন মানুষের দ্বিগুণ হবে কমপক্ষে। প্রথমে ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি। কিন্তু চেহারার দিকে তাকাতেই মনের ভুল ভেঙ্গে গেলো।

চাঁদের আলোতে চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই আলোয় দেখলাম, বীভৎস এক মুখ। চোখের জায়গাটা গর্ত, কিন্তু কোনও মণি নেই। কপালের মাঝখান বরাবর এক দগদগে ঘায়ের মতো। সেখান থেকে একটি চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাতগুলো শরীরের দিকে কেমন যেনও বাকা হয়ে আছে। অনেকটা পোলিও আক্রান্ত মানুষদের মতো। চিকন চিকন হাত। মুখ ঘুরে আমার চোখ আসলো সেই মহিলার পায়ের দিকে। দেখলাম পায়ের পাতা পিছন দিকে বাঁকানো। আমার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে আমি কিসের পাল্লায় পড়েছি। যেনও আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই আমার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত একটা হাসি দিলো সেই মহিলা। এরপর মাথাটা নিচের দিকে দিয়ে পা শরীরটাকে হেঁচড়ে হেঁচড়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। আমার এদিকে ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার দশা। প্রানপনে চেষ্টা করছি সুরা কালাম পড়ার। কারণ মা বলতো, এসব আসে পাশে আসলে বা উপস্থিতি টের পাওয়া গেলে সুরা পড়তে হয়। সুরা পড়লে এগুলো চলে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, অজানা এক ভয়ে আমার তখন বেহুশ হবার অবস্থা। কোনও সুরা তো মনে পড়ছেই না উল্টা চিৎকার করার শক্তিও যেনও হারিয়ে ফেলছি। নিজেকে বাঁচানোর কোনও আশা দেখছিলাম না।

মহিলাটা এগিয়ে এসে এক হাতে আমাকে ধরতে নিলো। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমাকে ধরার সাথে সাথে ঘুত টাইপের একটা আওয়াজ করে ছিটকে পিছিয়ে গেলো। আমি কিছু বুঝে পেলাম না। দেখলাম, সেই মহিলা আতঙ্কিত হয়ে আমার গোলার কাছের আল্লাহু লেখা তাবিজটির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনা বুঝতে আমার ২ সেকেন্ড সময় লাগলো। বুঝতে পারলাম, আল্লাহর নাম দেখে সে আমাকে ধরতে পারছে না। মনে মনে মাকে ধন্যবাদ দিলাম। মা বলতো ছোট বেলায় একবার আমাকে নাকি নিয়ে যাওয়ার জন্য জীন এসেছিলো। তার পর থেকে আমার গলায় এই তাবিজটা থাকতো। আমি কখনো খুলতাম না।



এই ফাঁকে হটাত দূরে কিছু মানুষের আসার আওয়াজ শোনা গেলো। তাকিয়ে দেখলাম হাতে টর্চ লাইট নিয়ে কারা যেনও আসছে। আমি লোকগুলোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে মহিলাটির দিকে তাকালাম। আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে সেই মহিলা বলল, আজকে বেঁচে গেলি। পরেরদিন দেখবো তোকে কে বাঁচায়!

এই বলে আমার চোখের সামনে সেটি কুণ্ডলী পাকিয়ে একটি সাদা ধোঁয়ায় পরিণত হল। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। জ্ঞান হারালাম।

যতদূর শুনেছিলাম, বাজার থেকে নাটক দেখে ফেরার পথে কিছু লোক আমাকে পেয়ে সেই রাতে বাসায় পৌঁছে দেয়। আমি প্রায় ৪-৫ দিন অচেতন হয়ে বাসায় পরে ছিলাম। সেই সময় নাকি প্রতি রাতেই আমাদের বাসার চালে প্রচুর পরিমাণ ঢিলের আওয়াজ হতো। কে বা কারা একনাগাড়ে ঢিল দিতো, বাড়ির পাশের বাগানে গাছপালা ভাঙার শব্দ পাওয়া যেত। আমি এইসময়ে খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। স্বাস্থ্য ফিরে পেতে আমার প্রায় ২ মাস সময় লাগে।

ঘটনাটি জানিয়েছেনঃ আহসান সেলিম অরণ্য (Ahsan Selim Oronno)