Monday, May 6, 2013

::রক্তখেকো মানুষ :: [Ghost Stories-37]


::রক্তখেকো মানুষ ::


______________
শফিক শাহীন
------------------------


আমাদের বাসাটা গ্রামের এক বিশাল মাঠের পাশেই। আমাদের সাথে থাকতো আমারএক কাকা আর তার পরিবার। মাঠটা অনেক বড় বিধায় আসে পাশে তেমন কোনও বাড়িঘর ছিল না। ওহ, মাঠের ঠিক মাঝখানটায় একটা বড় বট গাছ ছিল। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এসে কিছু  ব্যাবসায়ী সেখানে অস্থায়ী দোকান গড়ত। তখন আমাদের জন্য খুব খারাপ হতো। কারণ আমরা তখন সেই গাছের নিচে খেলতে পারতাম না। 

ওহ, বলা হয় নি। গাছটা ছিল আমাদের খেলাধুলার এক প্রধান জায়গা। স্কুল থেকে দৌড়ে এসেই সেই গাছের নিচে চলে যেতাম। বয়স তখন ১৪-১৫ হবে। মাঠের নিচ থেকে টিম বানানো হতোএরপর মাঠে নেমে ক্রিকেট। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস লাগলে বসে জিরিয়ে নিতাম। সেবার এক বৃদ্ধ বয়স্ক লোক শহর থেকে আশ্চর্য রঙের এক পানীয় নিয়ে আমাদের গ্রামে ব্যাবসা করতে আসলো। তার ব্যাবসার মন্ত্র ছিল এমন, এই পানি পান করিলেশরীরে বল অটুট থাকিবে। সাথে আসিবে নতুন উদ্যম।” সেই পানিতে কি ছিল তা আমি জানি না। তবে অল্প কয়েকদিনেই তার নামডাক ছড়িয়ে পড়লো। দূরের গ্রাম থেকে মানুষ এসে জড় হতে লাগলো পানির জন্য। এদিকে আমরা পড়লাম বিপাকে। মাঠের মধ্যে যেনও একটা মেলা বসে গিয়েছিলো। আমাদের খেলাধুলা চাঙ্গে উঠলো। আমাদের গ্রুপের দলনেতা ছিলেন শিহাব ভাই।

তিনি আমাদের ডেকে বললেনএভাবে চলতে দেয়া যায় না। কিছু একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনও এক রাতে গিয়ে উনার সব কিছু চুরি করে নিয়ে আসবো। বিশ্বাস করুন, সেই কাজ আমাদের টাকার লোভে ছিল না। ছিল নিজেদের স্বাধীনতা, আর খেলার মাঠটা ফিরে পাবারজন্য। রাতে অনেকেই থাকতে পারবে না। তাই শুধু যারা থাকতে পারবে তাদেরকেই ডাকা হল। সিদ্ধান্ত হল, সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর আমরা যাবো এবং যেহেতু লোকটি রাত্রিতে তার দোকানেই থাকে তাই দরকার হয় তাকে ভয় দেখিয়ে হলেও আজকেই কাজ সাধন করবো। রাত ১০ টার কিছু সময় পড়ে আমরা বের হলাম। সবার বাড়ি মাঠ থেকে একটু দূরে হওয়ায় তারাআমার বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিলো। চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা। যারা গ্রামে কখনো থাকেন নি তাদের বলে রাখি, বেশিরভাগ গ্রামই রাত ৮টার পরে নিরব হয়ে যায়। সেখানেআমাদের গ্রামকে তো অজ পাড়াগাঁ বলা যায়। যাইহোক,
আমরা সংখ্যায় ৫ জনছিলাম। যথারীতি শিহাব ভাই আমাদের লিড দিচ্ছিলেন। আমরা অনেকদুর থেকেই দেখতে পেলাম, মাঠের মধ্যখানেরসেই দোকানদারের ঘর থেকেমোমবাতির আলোর মতো কিছুজ্বলছে।ভাবলাম, একা মানুষ, ভয় পায় তাই হয়তো মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘুমায়।

লোকটি একটি তাবুর মধ্যেদোকান দিয়েছিলো। সেই তাবুতেই রাতের বেলা থাকতো। আমরা তাবুর  কাছেপৌঁছাতেই একটা অদ্ভুত গুনগুন আওয়াজ পেলাম। আওয়াজটা অনেকটা সুর করে কোনও কিছু পড়ার মতো। আমাদের চমকে দিয়েএকটা বিড়াল হটাত করে ডেকে উঠলো। আমি আরেকটু হলে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ফেলছিলাম। সময় মতো আমার বন্ধু নাফিস আমার মুখ চেপে ধরায় রক্ষা পাই।

আমাদের আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে একটা কালো কুচকুচে বেরাল আড়াল ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। মিথ্যে বলবো না, কিন্তু আমার জীবনে আমি কোনও বিড়ালের চোখ এমন সাদা হতে দেখিনি।  ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। মণির অস্তিত্ব
খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঠিক তখনই একটু বাতাসে সেই তাবুর দরজা হিসেবে ব্যাবহার করা কাপড়টা একটু নড়ে গেলো। সাথে সাথে আমাদেরদৃষ্টি ঘুরে গেলো সেইদিকে ভিতরে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম ঘরের মাঝে একটা চক্র কেটে একজন মাঝবয়সী লোক বসে আছে। লোকটার চোখ বন্ধ এবং একমনে বিড়বিড় করে কি যেনও পড়ছে। তার সামনে একটা কাঁচের বাতি, সেই বাটিতে রক্তের মতো কোনওতরল পদার্থ। ঠিক সামনেইমেঝেতে একটা শিয়ালএকটা কালো বিড়াল, এবং একটা ছোট বাচ্চার লাশ। লোকটা মনে হয় আমাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করে নি, তাই তখনো এক মনে বিড়বিড় করছিলো। শিহাব ভাই, আমাদের সকলকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে চুপ করে থাকতে বললেন।

বলতে ভুলেগেছি, আমাদের গ্রামে আশা সেই লোকের সাথে  লোকের চেহারার অসম্ভব মিল ছিল। যেনও যুবক বয়সের ঐ লোকটাই এখন আমাদের সামনে বসে আছে। আমরা দম বন্ধ করে দেখছিলাম কি ঘটে। এমন সময় লোকটা আমাদের অবাককরে দিয়ে নড়ে উঠলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই একটা হাত বাড়িয়ে বিড়ালের লাশটা নিলো। নিয়ে মুখের সামনে এনে কি যেনও আবারো বিড়বিড় করলো। তারপর দাঁত দিয়েবড় করে কামড় বসাল। লোকটি যখন হা করলো, তখন মোমবাতির আলোয় দেখতে পেলাম সেই দাঁতে তাজা রক্ত লেগে আছে। (বলা হয় নিপুরো ঘরে লোকটাকে ঘিরে অনেকগুলো মোমবাতি গলার মধ্য দিয়ে বমি ঠেলে বের হতে চাচ্ছিল। শিহাব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনাকে দেখেও সুবিধার মনে হল না। কিছু বলতে যাবো তার আগেই লোকটি বিড়ালের বিচ্ছিন দেহটা পাশে নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে শিশুর লাশটা নিলো। এরপর আমাদের ভয়ের মাত্রা তুঙ্গে উঠিয়ে কামড় বশিয়ে দিলো সেই শিশুটার পায়ে।আর সহ্য করতে পারলাম না। আমার পাশেই ছিল হাবিবুর। ও এই দৃশ্য দেখেই চিৎকার করে পিছনেদৌড় মারল। সাথে সাথে লোকটা চোখ মেলল। সেই চোখের বর্ণনা দেয়ার মতো কোনও ভাষা আমার জানা নেই। অনেকেই হয়তোরক্তচক্ষুর কথা শুনেছেন, কিন্তু আমি সেদিনই প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম ব্যাপারটা। লোকটার চোখ
দেখে মনে হচ্ছিল চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।

আমি কিছুক্ষণের জন্য জমে গেলাম জায়গায়। এমন সময় শিহাব ভাই আমাকে হাতে ধরে, প্রায় টেনে নিয়ে দৌড় দিলেন। পেছন থেকে লোকটার তারা করার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু বাসা বেশি দূরে না থাকায় নিরাপদেই বাসায় আসলাম। অবশেষেঃ সেদিন সকালে হটাত সবাই দেখে মাঠের মধ্য থেকে দোকানটি হাওয়া হয়ে গেছে। শুধুতাই নয়যারা সেই লোকেরদেয়া পানীয় খেয়েছিল তাদের প্রত্যেকে অসুস্থ হয়ে পরে। রক্তবমি করে মারা যায় কয়েকজন। আমরা যারা সেদিন গিয়েছিলাম রাতে,তাদের মাঝে ২ জন ভয়ঙ্কর অসুখে পরে মারাযায়। আর আমি? আমি একটা স্বপ্ন তখন থেকেই দেখিযে লোকটা আমাকে তারা করছে। একপর্যায়ে লোকটা আমাকে ধরে ফেলে এবং আম হাতে কামড় দিয়ে শিরা ছিঁড়ে ফেলে। ঐ সময়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই স্বপ্নটি আমি প্রায়ই দেখি।

সমাপ্ত


** অমীমাংসিত কাহিনী ** [Ghost Stories-36]


** অমীমাংসিত কাহিনী **


মাঝ রাতে দরজায় কড়া নারার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি বিরক্ত ভাব নিয়ে দরজা খুললাম। দরজা খুলেই বিস্মিত কণ্ঠে বললাম- আরে তুই? এতো রাতে?
আকাশ একগাল হেসে বললো- দোস্ত অনেকদিন তোকে দেখি না। তোকে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই চলে আসলাম।... আজ রাতটা তোর সাথেই কাটাবো।
আকাশ আমার ছোট কালের বন্ধু। আমরা একই সাথে বড়হয়েছি। আমার বাসা থেকে ওর বাসা প্রায় দু-কিলোমিটার দূরে। অনেকদিন তার সাথে বিভিন্ন ব্যস্ততার জন্য দেখা করতে পারি নাই।প্রায় এক মাস হতে যাচ্ছে। আমার সাথে শুধু মাত্র দেখা করবার জন্য এতো রাতে সে চলে আসবে বাসায় তা ভাবতেই পারছি না। এই না হলে বন্ধুত্ব।
তুই কি বাহিরেই দাড়িয়ে থাকবি? ভিতরে আস? গল্পকরি দুই বন্ধু মিলে সারারাত।
নারে দোস্ত ঘরে বসবো না। চল বাহির থেকে ঘুরে আসি।
আমি অবাক হয়ে বললাম- সে কিরে! এতো রাতে কোথায় যাবি? আর তুই এতো সাহসী হলী কবে থেকে? কিছুদিন আগেও না সন্ধ্যার পর তুই ভূতের ভয়ে বাসার বাহির হতি না?
এখন কি আর সেই দিন আছে! চল বাহিরে চল। আকাশ একগাল হেসে উত্তর দিলো।
আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে তাই নারে আকাশ?
হু
আচ্ছা তোর হয়েছি কি বলতো? আসবার পর থেকেই এতোচুপচাপ কেন?
আকাশ মৃদু হেসে বললো- না এমনিতেই। এখন থেকে ভাবছি একাই থাকবো। সন্ধ্যার সময় ডিসিশন নিয়েছিলাম। সারারাত ছিলামও একা। কিন্তু এখন খুব বেশি ভয় করছিলো তাই তোকে ডেকে নিয়ে আসলাম।
আমি আবারো অবাক হয়ে বললাম- একা ছিলি, ভয় করছিলো এগুলোর মানে কি? তুই সারারাত কোথায় ছিলি?
বাড়ির বাহিরে।
কেন? বাসা থেকে কি তোকে বের করে দিয়েছে?
নারে বাহির করে নাই। আর বাহির করবে কেন? আমি নিজেই বের হয়ে এসেছি।
কেন?
আকাশ আমার হাত ধরে বললো- দোস্ত আমার বাসায় একটু যাবি? আম্মু আমার জন্য খুব কাঁদছে। আম্মুকে একটু বলে দিয়ে আসবি আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। আমার জন্য যেন কান্নাকাটি না করে।
আমি অবাক হয়ে বললাম- আমিতো তোর কথাবার্তা কিছুই বুঝতেছি না। কি সব বলছিস? বাসা থেকে কেন বের হয়ে এসেছিস। কি হয়েছে? চল তোকে বাসায়দিয়ে আসি?
নারে দোস্ত আজকে আর বাসায় যাবো না। পরে আরেকদিন বাসায় যাবো। তুই একটু যাবি দোস্ত। আম্মু খুব কান্নাকাটি করছে। বলেই আকাশ আমাকেজরিয়ে ধরে কাদা শুরু করলো।
এখন রাত সারে তিনটা। আমি আকাশের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। আকাশকে কিছুতেই আনা যায় নি। ওকে বলেছিলাম তুই গিয়ে আমার রুমে বস আমি খালাম্মাকে বলে দিয়ে আসছি তুই আমার কাছে আছিস এবং ভালো আছিস। সে তাও করে নাই। রাস্তায়ই দারিয়ে আছে। আমি খালাম্মার সাথে কথা বলে বাহির হবার পর নাকি আমার সাথে আমার বাসায় যাবে। কি ঘটেছে কিছুই বুঝছি না। আকাশের কান্নার জন্য বাধ্য হয়েই এতো রাতে আকাশের বাসায় আমার আসতে হয়েছে।
আমি নিথর পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছি। খালাম্মা আমাকে জরিয়ে ধরে অজর ধারায় কাঁদছেন। আমি খালাম্মাকে কি ভাবে শান্তনা দেব বুঝতে পারছিনা। আমার কাছে সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। পুরো বাড়ি জুরেই কান্নার শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে অনেক মানুষ। পুলিস এসে আকাশের লাশ নিয়ে যাচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় আকাশ তার রুমে গলায় ফাঁস আটকিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
আমার আস্তে আস্তে বোধশক্তি লোপ পাচ্ছে। এ আমি কি শুনছি। আমি তাহলে এতক্ষণ কার সাথে ছিলাম? আকাশই তো তার বাসায় আমাকে আসতে বললো। আকাশের লাশটি পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে। শেষ বারের মতো আকাশকে দেখলাম আমি। আমার সমস্ত পৃথিবী দুলো উঠলো। মনে হচ্ছে সবকিছু দুলছে। চোখ এর সামনে থেকে সবাই আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি আসতে আসতে অন্ধকার একটা জগতে হারিয়ে যাচ্ছি। দূরে কে যেন কান্না করছে। তার মাঝে কে যেন বলছে- আম্মুকে বলিস, আমি ভালো আছি।

** কাহিনীটি শেয়ার করেছেন-- পলাশ মাহমুদ **