Saturday, April 24, 2021

ইদ্দত

 

স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী ইদ্দত পালন না করে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে না। এতে স্বামী-স্ত্রীকে বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করতে সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে সেই সুযোগে স্ত্রী প্রত্যানীতা করতে পারে। তাছাড়া ইদ্দত বিধিবদ্ধ করায় এ কথার ইঙ্গিত রয়েছে যে, বিবাহ কোন ছেলেখেলার বিষয় নয়। এর আগে-পিছে রয়েছে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি ও সীমা-সময়।

পরন্তু ইদ্দতের মাঝে নারীর গর্ভাশয় পরীক্ষা হয়। যাতে দুই স্বামীর তরফ থেকে বংশের সংমিশ্রণ না ঘটে।

তালাকপ্রাপ্ত নারী যদি অরমিতা হয় বা তার বাসরই না হয়ে থাকে, তবে তার কোন ইদ্দত নেই।[1]

রমিতা মহিলা যদি ঋতুমতী হয়, তবে তার ইদ্দত তিন মাসিক; তিন মাস নয়। সুতরাং সন্তানকে দুধ পান করাবার সময় যদি ২/৩ বছরও মাসিক না হয়, তবে তিন মাসিক না হওয়া পর্যন্ত সে ইদ্দতেই থাকবে।[2]

ঋতুহীনা কিশোরী বা বৃদ্ধা হলে তার ইদ্দত তিন মাস।[3]

কিন্তু ইদ্দত শুরু করে কিছু দিন পরে তার ঋতু শুরু হলে, ঋতু হিসাবেই তাকে তিন ইদ্দত পালন করতে হবে।[4]

কোন জানা কারণে মাসিক বন্ধ থাকলে বা হবার সম্ভাবনা না থাকলে তার ইদ্দতও তিন মাস। কিন্তু হবার র্সম্ভাবনা থাকলে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তিন মাসিক ইদ্দত পালন করবে। অবশ্য যদি অজানা কারণে মাসিক বন্ধ থাকে তাহলে ১ বছর অর্থাৎ গর্ভের ৯ মাস এবং ইদ্দতের তিন মাস অপেক্ষা করে তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারবে।[5]

গর্ভবতীর ইদ্দত প্রসবকাল পর্যন্ত।[6]

মাস অথবা মাসিক হিসাবে ইদ্দত শুরু করার কিছু দিন পর গর্ভ প্রকাশ পেলে প্রসবকাল পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে।

তালাকপ্রাপ্ত মহিলা তার তালাকের খবর তিন মাসিক পর পেলে তার ইদ্দত শেষ। আর নতুন করে ইদ্দত নেই।[7]

খোলা তালাকের ইদ্দত এক মাসিক। মাসিকের পর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে।[8]

অনুরূপ স্বামী মারা গেলে বিরহবিধুরা বিধবা স্ত্রীকেও ইদ্দত ও শোকপালন করতে হবে। (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৪)

এতে স্ত্রীর গর্ভাশয় গর্ভ থেকে খালি কি না তা পরীক্ষা হবে; যাতে বংশে সংমিশ্রণ না ঘটে। তাছাড়া এতে স্ত্রীর নিকট স্বামীর যে মর্যাদা ও অধিকার তার অভিব্যক্তি ঘটে।

সুতরাং বিধবা গর্ভবতী হলে প্রসবকাল পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। (আর তা ২/১ ঘন্টাও হতে পারে।) অতঃপর সে ভিন্ন স্বামী গ্রহণ করতে পারে। তবে গর্ভবতী না হলে ৪ মাস ১০ দিন অপেক্ষা করে ইদ্দত পালন করবে।[9]

বিধবার বিবাহের পর বাসর না হয়ে থাকলেও ঐ ইদ্দত পালন করবে। যেমন, নাবালিকা কিশোরী অথবা অতিবৃদ্ধা হলেও ইদ্দত পালন করতে হবে।[10]

রজয়ী তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী (ইদ্দতে থাকলে; যাকে স্বামী ফিরিয়ে নিতে পারে) তার স্বামী মারা গেলে নতুন করে স্বামী-মৃত্যুর ইদ্দত পালন করবে।[11]

কোনও কারণে ইদ্দতের সময় পিছিয়ে দেওয়া যায় না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই ইদ্দত পালন শুরু করতে হবে।[12]

স্বামীর মৃত্যুর খবর ৪ মাস পর জানলে তার ইদ্দত মাত্র ঐ বাকী ১০দিন। ৪ মাস দশ দিন পর জানলে আর কোন ইদ্দত নেই।[13]

ইদ্দতের ভিতরে বিধবার শোকপালন ওয়াজেব। এই শোক পালনে বিধবা ত্যাগ করবেঃ-

- প্রত্যেক সুন্দর পোশাক। তবে এর জন্য কোন নির্দিষ্ট ধরনের বা রঙের কাপড় নেই। যে কাপড়ে সৌন্দর্য নেই সেই কাপড় পরিধান করবে। সাদা কাপড়ে সৌন্দর্য থাকলে তাও ব্যবহার নিষিদ্ধ।[14] নির্দিষ্টভাবে কালো পোষাক ব্যবহারও বিধিসম্মত নয়।[15]

- সর্বপ্রকার অলঙ্কার। অবশ্য সময় দেখার জন্য হাতে ঘড়ি বাঁধায় দোষ নেই।[16] হ্যাঁ, তবে বাইরে গেলে টাইম দেখার জন্য প্রয়োজন না হলে বা রাখার মত পকেট বা ব্যাগ থাকলে হাতে বাঁধবে না। কারণ, ঘড়িতেও সৌন্দর্য আনে।

- সর্বপ্রকার প্রসাধন ও অঙ্গরাগ; সুরমা, কাজল, যে কোন রং ইত্যাদি।

- সর্বপ্রকার সুগন্ধি; সুবাসিত সাবান বা তৈলাদি ব্যবহার নিষিদ্ধ।[17]

এমন কি নিজের ছেলেমেয়ে বা অন্য কাউকে সেন্ট জাতীয় কিছু লাগিয়ে দিতেও পারে না। যেহেতু সুগন্ধি হাতে এসে যাবে তাই।[18]

অবশ্য মাসিক থেকে পবিত্রতার সময় দুর্গন্ধ দূরীকরণার্থে কিছু সেন্ট লজ্জাস্থানে ব্যবহার করতে পারে।[19]

- স্বামীগৃহের বাইরে যাওয়া। যেহেতু স্বামীগৃহেই ইদ্দত পালন ওয়াজেব। তবে একান্ত প্রয়োজন বা অগত্যায় (পর্দার সাথে) বাইরে যাওয়া বৈধ। যেমন, ছাত্রী বা শিক্ষিকা হলে স্কুল-কলেজ যেতে পারে।[20] কেউ না থাকলে গরু-ছাগল, ফসলাদির দেখাশোনা করতে পারে ইত্যাদি।

অনুরূপ স্বামীর বাসস্থানে কোন আত্মীয় না থাকলে ভয়ের কারণে কোন অন্য আত্মীয়র বাড়িতে ইদ্দত পালন করা যায়।[21]

এ ছাড়া কুটুমবাড়ি, সখীর বাড়ি বা আর কারো বাড়ি বেড়াতে যাওয়া নিষিদ্ধ।[22] এমনকি হজ্জও করতে পারে না। অবশ্য মায়ের বাড়িতে থাকা অবস্থায় স্বামীর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছলে স্ত্রী সেখানেই ইদ্দত পালন করবে।

ইদ্দতের সময় অতিবাহিত হলে এসব বিধি-নিষেধ শেষ হয়ে যাবে। এর পর রীতিমত সব কিছু ব্যবহার করতে পারে এবং বিবাহও করতে পারে। বরং যারা ধৈর্যহারা হয়ে ব্যভিচারের পথে পা বাড়িয়ে ‘রাঁড়ের ঘরে ষাঁড়ের বাসা’ করে তাদের পক্ষে বিবাহ ফরয।

ইদ্দতের মাঝে বোগল ও গুপ্তাঙ্গের লোম এবং নখাদি কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, মাছ-গোশত, ফল ইত্যাদি উত্তম খাদ্য খাওয়া দূষণীয় নয়। যেমন চাঁদের মুখ দেখতে নেই, বিয়ের কনে স্পর্শ করতে নেই প্রভৃতি ধারণা ও আচার কুসংস্কার।[23]

এই বিধবা স্বামীর ওয়ারেস হবে। রজয়ী তালাকপ্রাপ্তা হলে এবং ইদ্দতের ভিতরে বিধবা হলে ওয়ারেস হবে। বাতিল বিবাহ, খোলা তালাক প্রভৃতির ইদ্দতে ওয়ারেস হবে না। এদের শোক পালনের ইদ্দতও নেই। অনুরূপ তালাকপ্রাপ্তা তার ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর স্বামী মারা গেলে ওয়ারেস হবে না। হ্যাঁ, যদি স্বামী তার মরণ-রোগে স্ত্রীকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে তালাক দিয়েছে বলে জানা যায়, তবে তার ইদ্দত পার হয়ে গেলেও (১ বা ২ তালাকের পর; যাতে পুনর্বিবাহ সম্ভব) ঐ স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ না করে থাকলে ওয়ারেস হবে। যথানিয়মে তিন তালাকপ্রাপ্তা হলে অথবা ইদ্দতের পর বিবাহ করে থাকলে সে আর ওয়ারেস হবে না।[24] মিলন না হয়ে স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী ওয়ারেস হবে।[25]

[1] (সূরা আল-আহযাব (৩৩) : ৪৯)

[2] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২২৮, ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৯৯)

[3] (সূরা আল-আহযাব (৬৫) : ৪)

[4] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২৯৭)

[5] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৯৯)

[6] (সূরা আল-আহযাব (৬৫) : ৪)

[7] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮০৪)

[8] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৯৯)

[9] (আল-বাক্বারা (২) : ২৩৪)

[10] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৬/১১৪,১২০,১৩২)

[11] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/ ৮২০)

[12] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২/৮১৫, ফাতাওয়াল মারআহ ৬৫পৃঃ)

[13] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮০৪)

[14] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৯/১৫৮)

[15] (ফাতাওয়াল মারআহ ৬৫পৃঃ)

[16] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ১৯/১৫৮)

[17] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮১৩)

[18] (কিতাবুদ দাওয়াহ২/১৪৩)

[19] (লিকাউল বা-বিল মাফতুহ, ইবনে উসাইমীন ২৪/১৩)

[20] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৬/১৩১)

[21] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৯/১৬৮)

[22] (তামবীহাতুল মু’মিনাত ১৫৪পৃঃ)

[23] (তামবীহাতুল মু’মিনাত ১৫৪-১৫৫ পৃঃ)

[24] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮২০, কিতাবুদ দাওয়াহ২/২০৫, ফাতাওয়াল মারআহ ৯৭-৯৮)

[25] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮২১)

ত্বালাক্ব - তালাক

 

স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে অথবা পবিত্রা থাকলে এবং ঐ পবিত্রতায় কোন সঙ্গম না করে থাকলে এক তালাক দেবে।[1]

আর এর ব্যাপারে দুই ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখবে।[2]

অতঃপর স্বামী স্ত্রীকে ঘর থেকে যেতে বলবে না এবং স্ত্রীও স্বামী-গৃহ ত্যাগ করবে না। বরং গর্ভকাল বা তিন মাসিক পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এই ইদ্দতের মাঝে স্ত্রী ভরণ-পোষণও পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ لا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلا يَخْرُجْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لا تَدْرِي لَعَلَّ اللهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْراً﴾

‘‘হে নবী! তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে ইচ্ছা কর তখন ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তালাক দিও, ইদ্দতের হিসাব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। তোমরা ওদেরকে সবগৃহ হতে বের করো না এবং ওরাও যেন সে ঘর হতে বের না হয়; যদি না ওরা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। এ হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে, সে নিজেরই উপর অত্যাচার করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এরপর কোন উপায় বের করে দেবেন।’[3]

অতঃপর ভুল বুঝে স্বামীর মন ও মতের পরিবর্তন ঘটলে যদি স্ত্রী ত্যাগ করতে না চায়, তাহলে ইদ্দতের ভিতরেই (তিন মাসিকের পূর্বে পূর্বেই) তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। তবে ফিরিয়ে নেবার সময়ও দুই ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখবে।

উল্লেখ্য যে, স্ত্রী প্রত্যানীতা করার সময় তার সম্মতি জরুরী নয়।[4]

কিন্তু মন বা মতের পরির্বতন না হলে ও স্ত্রীকে তার জীবন থেকে আরো দূর করতে চাইলে দ্বিতীয় পবিত্রতায় দ্বিতীয় তালাক দেবে এবং অনুরূপ সাক্ষী রাখবে। এরপরও স্ত্রী স্বামীগৃহ ত্যাগ করবে না এবং স্বামীও তাকে বের করতে পারবে না। পরন্তু তাকে উত্যক্ত করে সংকটে ফেলাও বৈধ নয়।[5]

এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর উচিৎ, নানা অঙ্গসজ্জা ও বিভিন্ন প্রেম-ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে স্বামীর মনকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করা।

এখনও যদি মত পরিবর্তন হয়, তাহলে স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারে। নচেৎ একেবারে চিরতরে বিদায় করতে চাইলে তৃতীয় পবিত্রতায় তৃতীয় তালাক দিয়ে বিবাহ চিরতরে বিচ্ছেদ করবে এবং যথানিয়মে সাক্ষী রাখবে। এরপর স্ত্রী স্বামীগৃহ ত্যাগ করবে, আর তার জন্য কোন ভরণ-পোষণ নেই।[6]

তৃতীয় তালাকের পর স্বামী চাইলেও স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে আনতে পারে না। নতুন মোহর ও বিবাহ আকদেও নয়। হ্যাঁ, তবে যদি ঐ স্ত্রী সেবচ্ছায় দ্বিতীয় বিবাহ করে, স্বামী-সঙ্গম করে এবং সে স্বামী সেবচ্ছায় তালাক দেয় অথবা মারা যায়, তবে ইদ্দতের পর পুনরায় প্রথম স্বামী নব-বিবাহ-বন্ধনে ঐ স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারে। এর পূর্বে নয়।[7]

এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে যদি কেউ ঐ নারীকে তার স্বামীর জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে বিবাহ ক’রে ২/১ রাত্রি সহবাস ক’রে তালাক দেয়, তবুও পূর্ব স্বামীর জন্য সে বৈধ হবে না। কারণ, এ কাজ পরিকল্পিতভাবেই করা হয় এবং স্ত্রীও অনেক ক্ষেত্রে এ কাজে রাজী থাকে না। পরন্তু হাদীস শরীফে এই হালালকারী দ্বিতীয় স্বামীকে ‘ধার করা ষাঁড় ও অভিশপ্ত বলা হয়েছে।’[8]

পক্ষান্তরে এক অথবা দুই তালাক দেওয়ার পর ফিরিয়ে না নিলে এবং তার বাকী ইদ্দত তালাক না দিয়ে অতিবাহিত হলে স্ত্রী হারাম হয়ে যায় ঠিকই; কিন্তু তারপরেও যদি স্বামী-স্ত্রী পুনরায় সংসার করতে চায়, তবে নতুন মোহর দিয়ে নতুনভাবে বিবাহ (আক্দ) পড়ালে এই পুনর্বিবাহে উভয়ে একত্রিত হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে ঐ শাস্তি নেই।

কিন্তু পূর্বে যে এক অথবা দুই তালাক সে ব্যবহার করেছে, তা ঐ স্ত্রীর পক্ষে সংখ্যায় গণ্য থাকবে। সুতরাং দুই তালাক দেওয়ার পর ফিরিয়ে নিয়ে থাকলে বা ইদ্দত পার হয়ে যাওয়ার পর পুনর্বিবাহ করে থাকলে সে আর একটিমাত্র তালাকের মালিক থাকবে। আর একটিবার তালাক দিলে স্ত্রী এমন হারাম হবে যে, সে দ্বিতীয় বিবাহের স্বামী তাকে সেবচ্ছায় তালাক না দিলে বা মারা না গেলে পূর্ব স্বামী আর তাকে (বিবাহের মাধ্যমে) ফিরে পাবে না।

অতএব সারা জীবনে একটি স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী মাত্র ৩ বার তালাকেরই মালিক হয়। ১০ বছর পর পর ৩ বার তালাক দিলেও শেষ বারে পূর্ব অবস্থা ছাড়া আর ফিরিয়ে নিতে বা পুনর্বিবাহ করতে পারে না।[9]

অবশ্য দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করার পর তালাক বা মৃত্যুর কারণে ইদ্দতের পর প্রথম স্বামী যখন নতুন মোহর সহ পুনর্বিবাহ করে, তখন আবার সে নতুন করে­ই তিন তালাকের মালিক হয়।[10]

তালাকপ্রাপ্তা নারী যদি বিধিমত তার স্বামীকে পুনর্বিবাহ করতে চায় বা অন্য স্বামী গ্রহণ করতে চায়, তবে কোন স্বার্থ, রাগ বা বিদ্বেষবশতঃ তাকে এতে বাধা দেওয়া তার অভিভাবকের জন্য বৈধ নয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلاَ تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنْكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ﴾

‘‘আর তোমরা যখন স্ত্রী বর্জন কর এবং তারা তাদের ইদ্দতকাল অতিবাহিত করে তখন তাদেরকে তাদের স্বামী গ্রহণ করতে বাধা দিও না; যদি তারা আপোসে খুশীমত রাজী হয়ে যায়।’’[11]

স্ত্রীর মাসিকাবস্থায় তালাক দিলে স্বামী গোনাহগার হবে এবং সে তালাক গণ্য হবে না। পবিত্রাবস্থায় তালাক দিলেই তবে তা গণ্য হবে। স্ত্রীর মাসিকের খবর না জেনে তালাক দিলে গোনাহগার হবে না এবং তালাকও নয়। পক্ষান্তরে জেনে-শুনে দিলেই গোনাহগার হবে।[12]

অনুরূপ এক মজলিসে তিন তালাক হারাম। সুতরাং যদি কেউ তার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে ‘তোমাকে তালাক, তালাক, তালাক, অথবা ‘তোমাকে তিন তালাক’ বলে বা এর অধিক সংখ্যা উল্লেখ করে, তবে তা কেবল এক তালাকই গণ্য হবে। এইভাবে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার পর ভুল বুঝে পুনরায় যথারীতি ইদ্দতে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চাইলে বা ইদ্দতের পর যথানিয়মে পুনর্বিবাহ করতে কোন বাধা নেই।[13]

কিন্তু অনুরূপ তিনবার করে থাকলে পূর্বোক্ত নিয়মানুযায়ী চাইলে পুনঃ সংসার করতে পারে। নচেৎ না।

অনিয়মে তালাক দেওয়া আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করার অন্তর্ভুক্ত।[14]

সুতরাং সময় ও সংখ্যা বুঝে তালাক দেওয়া তালাকদাতার জন্য ফরয।

যদি স্বামী তার স্ত্রীকে বলে ‘যদি তুমি অমুক কাজ কর বা অমুক জায়গায় যাও, তাহলে তোমাকে তালাক’ এবং এই বলাতে যদি সত্য সত্যই তালাকের নিয়ত থাকে, তবে এমন লটকিয়ে রাখা তালাক স্ত্রীর ঐ কাজ করার সাথে সাথে গণ্য হয়ে যায়।

অবশ্য তালাকের নিয়ত না থেকে যদি স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে কেবল ঐ কাজে কঠোর নিষেধ করাই উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তালাক গণ্য হবে না। তবে স্ত্রীর ঐ কাজ করার পর স্বামীকে কসমের কাফ্ফারা লাগবে।[15]

অনুরূপ তালাকের উপর কসম খেলেও। যেমন যদি কেউ তার ভাইকে বললে, ‘তুই যদি এই করিস, তাহলে আমার স্ত্রী তালাক’ বা ‘আমি যদি তোর ঘর যাই, তাহলে আমার স্ত্রী তালাক’, তবে এ ক্ষেত্রেও নিয়ত বিচার্য। তালাকের প্রকৃত নিয়ত হলে তালাক হবে; নচেৎ না। তবে কসমের কাফ্ফারা অবশ্যই লাগবে। অনুরূপ তর্কের সময়ও যদি কেউ বলে ‘এই যদি না হয় তবে আমার স্ত্রী তালাক’ অথচ বাস্তব তার প্রতিকূল হয়, তাহলে ঐ একই বিধান প্রযোজ্য। তবে তালাক নিয়ে এ ধরনের খেল খেলা স্বামীর জন্য উচিৎ নয়।[16]

কেউ যদি স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করে, তবে এই জোরপূর্বক অনিচ্ছাকৃত তালাক গণ্য নয়। অনুরূপ নেশাগ্রস্ত মাতালের তালাক।[17]

চরম রেগে হিতাহিত জ্ঞানহীন ক্রুদ্ধ ব্যক্তির তালাক।[18]

ভুল করে তালাক, অতিশয় ভীত-বিহ্বল ব্যক্তির তালাক গণ্য নয়।[19]

মরণ-শয্যায় শায়িত স্বামী তার মীরাস থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে তালাক দিচ্ছে বলে জানা গেলে তাও ধর্তব্য নয়।

সুতরাং সে তার ওয়ারেস হবে এবং স্বামী-মৃত্যুর ইদ্দত পালন করবে।[20]

স্বামী তালাকের ব্যাপারে স্ত্রীকে এখতিয়ার দিলে এবং স্ত্রী তালাক পছন্দ করলে তালাক হয়ে যাবে।

বিবাহ ও তালাক নিয়ে কোন ঠাট্টা-মজাক নেই। মজাক করেও স্ত্রীকে তালাক দিলে তা বাস্তব।[21]

বিবাহ প্রস্তাবের পর কোন মনোমালিন্য হলে স্বামী তার বাগদত্তা স্ত্রীর উদ্দেশ্যে যদি তালাক বা হারাম বলে উল্লেখ করে, তবে তা ধর্তব্য নয়। অবশ্য বিবাহের পর তাকে কসমের কাফ্ফারা লাগবে।[22]

তালাকের খবর স্ত্রী না পেলেও তালাক গণ্য হবে।[23]

আল্লাহ, তাঁর রসূল বা দ্বীনকে স্বামী গালি দিলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। ফিরে নিতে চাইলে তওবা করে নতুন মোহরে পুনর্বিবাহ করতে হবে।[24]

চিঠির মাধ্যমে তালাক দিলে তা গণ্য হবে। অনুরূপ বোবা যদি ইঙ্গিতে তালাক দেয় তবে তাও গণ্য। অবশ্য লিখতে জানলে তার ইঙ্গিত গণ্য নয়।[25]

[1] (বুখারী, মুসলিম)

[2] (সূরা আত্-ত্বলাক (৬৫) : ২, সআবু দাঊদ ১৯১৫নং)

[3] (আলকুরআন কারীম ৬৫/১)

[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৬৬)

[5] (সূরা আত-ত্বলাক্ব (৬৫) : ৬)

[6] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৬৭)

[7] (সূরা আল-বাক্বারা (২ ) : ২৩০)

[8] (ইরঃ ৬/৩০৯, ইবনে মাজাহ ১৯৩৬নং, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৯৬নং)

[9] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২৪৭)

[10] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২৪৯)

[11] (সূরা আল-বাক্বারাহ (২) : ২৩২)

[12] (ফাতাওয়াল মারআহ ৬৩-৬৪ পৃঃ)

[13] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৩/১৭১-১৭৩, ২৬/১৩৩, তুহফাতুল আরূস, ১৪৮ ও ২২৮ পৃঃ)

[14] (সূরা আল-বাক্বারা (২) ; ২২৯, ৬৫/১)

[15] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৫/৯৪)

[16] (কিতাবুদ দাওয়াহ২/২৪২, ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৯১)

[17] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৩২/২৫২)

[18] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৬/৩৪৭, ২৬/১৩৩)

[19] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২২১)

[20] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২৪৯)

[21] (ইরুওয়াউল গালীল ১৮২৬নং)

[22] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৫৮, আল-ফাতাওয়া আল- ইসলামিয়্যাহ ২/৭৮৭)

[23] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৮০৪)

[24] (ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন ২/৭৮৩)

[25] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/২২৯)