Friday, December 16, 2011

স্বপ্ন নয় বাস্তব... [ Collection of Love Stories - 03 ]







প্রায় প্রতি রাতেই একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে। ডিসেম্বর মাস হলে তো কথাই নেই । রাত হলেই এক অজানা আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে ওঠে। স্বপ্নে লাখ লাখ মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে । তাদের অট্টহাসি, আর্তচিৎকার, যেন সব কিছু কাঁপছে । তারা সবাই আমাকে ঘিরে ধরে । ভয়ঙ্কর সে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হঠাৎ কেউ এক জন বলে ওঠে-তোর লজ্জা নেই? তুই এই রকম নির্ভার ঘুমাচ্ছিস কিভাবে? তোর কোনো ভাবান্তর নেই? েখানে ৩০ লাখ শহীদের আত্মা ৩৯ বছর ধরে ঘুমাতে পারে না সেখানে তুই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? তোর কানে কি দুই লক্ষ মা বোনের করুণ আর্তনাদ পৌছে না ? আমাদের রক্তে রন্জিত রাজপথে রাজাকাররা হেঁটে যায় তখন কি তোর আত্মসম্মানে লাগে না ? যেখানে আমরা নয় মাসে পাকিস্তানের চিল শকুনদের কাছ থেকে দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে এনেছি, তোদেরকে যাতে পরাধিনতার শৃঙ্খলে বন্দী হতে না হয় সে জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছি, সেখানে ৩৯ বছরেও তোরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারলি না ? কি রকম জাতি তোরা ? এতো সব প্রশ্ন শুনে ভড়কে যাই । কাঁপা কাঁপা গলায় তাঁদের বলি-শহীদরা তোমরা চিন্তা করো না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করবোই । বুঝতে পারি না আমার কথায় তাঁরা কতোটা আশ্বস্ত হয়। ঘুম ভেঙ্গে যায়। এলোমেলো ভাবে দেখা স্বপ্নের ঘটনাগুলো আমাকে ভাবায়, কখনো উত্তেজিত হয়ে পরি । চরম অপমানবোধের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকি। স্বপ্নরা বারবার ফিরে আসে, আমাকে বিচলিত করে দেয় ।

১৯ নভেম্বর, ২০০৯...
আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পরি। বিশেষ একটা কারণে আজ মনটা খুব ভাল। অপেক্ষা করতে থাকি কখন স্বপ্নে শহীদরা আসবে । হঠাৎ মনে হয় তাঁরা আসছে । আজ তাঁদের কিছু বলার আগেই আমি বলি, দেখলে তো আমরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করেছি, আর বেশি দিন নয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও আমরা করব। তোমরা একটু অপেক্ষা করো। দেখলাম শহীদরাও আজ খুব খুশী। তাঁরা কিছু না বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল
মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করল ।

২০১৫ সাল...
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ।সারা দেশে আজ সাজ সাজ রব, যেন এক নতুন বিজয় দিবস ।এ বিজয় কলঙ্ক মোচনের বিজয়, স্বাধীন দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার বিজয় । আমরা যারা তরুণ প্রজন্ম তাদের আজ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে আজ দীর্ঘ ৪৪ বছর পর একটা যুদ্ধ শেষ করলাম যে যুদ্ধ ছিল আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ, বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ।

আজ ১৬ ডিসেম্বর...
শহীদরা এসে উপস্থিত তাঁরা এসেই অঝোরে কান্না শুরু করলেন, সুখের কান্না। তাঁরা বলতে লাগলেন, তোরাই আমাদের যোগ্য উত্তরসূরি। আমরা তোদের ভুল বুঝেছিলাম। তোরাই পারবি আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে । তোরাই পারবি এই লাল-সবুজ পতাকাকে বুকে আগলে ধরে রাখতে। এই ধর, স্বাধীনতার এই আলোর মশাল আজ তোদের হাতে তুলে দিলাম, কথা দে নিজের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই মানচিত্র কে কোন অশুভ শক্তির হাতে কুক্ষিগত হতে দিবি না। । আমরা এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারব । তোদের জয় হোক, তারুণ্যের জয় হোক । এই বলে তাঁরা চলে গেলেন । হঠাৎ আমি আবিষকার করলাম আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে । আমার মনে হল এটা অশ্রু না, সাদা রক্ত । এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব ।

----Sujoy Subroto
গল্পটি নেয়া :      https://www.facebook.com/abegmoy.valobasha
 

বীরঙ্গনা, শুধু কি গল্পের প্রয়োজনে একটি গল্প? [ Collection of Love Stories -02 ]




আপনি কি কখনো দেখেছেন কিভাবে পাথরের উপরে ইট রেখে হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে ইট ভাঙ্গে?”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম হিমি নামের মেয়েটির দিকে। হিমি মেডিকেল কলেজে পড়ে। সে নাকি আমার গল্পের ফ্যান। আজ তার জন্মদিন। তবে তার জন্ম এমন একটি দিনে, যে দিনে একটি দেশ যুদ্ধে জয় লাভ করে। একটি জাতি লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। হিমি তার জন্মদিনে একটি গল্প শোনাতে এসেছে, আমি পড়ে গেছি ভীষণ লজ্জায়। ঘরে কিছু নেই যে ওকে দেব। চায়ের পাতি শেষ হয়েছে একসপ্তাহ আগে। গত আঠারো ঘণ্টা হলো আমার পকেটে সিগারেট কেনার টাকা নেই। সিগারেট তো দূরের কথা, আমার কাছে এক প্যাকেট আকিজ কিংবা মফিজ বিরি কেনার টাকাও নেই। এক বিদেশি লেখক বলেছিলেন, “লেখকের জীবন হচ্ছে একটি কুকুরের জীবন, সে জীবনেই তার আনন্দ।আমার জীবন অলরেডি কুকুরের জীবনের মত হয়ে গেছে, কিন্তু আনন্দ চোখে পড়ে না। শুধু একটা কথা ভেবেই আনন্দ পাই, সেটা হচ্ছে না লিখলে আমি স্থির থাকতে পারি না। মনে হয় যেদিন থেকে আমি লিখতে পারবো না, সেদিন ধরে নেয়া যাবে আমি মরে গেছি। 


আমি বুঝতে পারলাম না হিমি গল্প বলতে এসে কেন ইট পাথর হাতুরি নিয়ে প্রশ্ন করছে? হাতুরি দিয়ে ইট ভাঙ্গা ঢাকা শহরের একটি ট্রেডিশন বলা যায়। ইদানিং ইট ভাঙ্গার মেশিন চলে আসায় এই দৃশ্যটি চোখে পড়ে না। আগে দেখা যেত ঢাকা শহরের কোন এক রাস্তায় একজন মহিলা একটি পাথরের উপরে ইট রেখে ক্রমাগত হাতুরি চালিয়ে ইট ভাঙছেন। তার হাতের আঙ্গুলে সাইকেলের চাকার লাল কিংবা কালো টিউব পেঁচিয়ে লাগানো থাকে। তারপরেও মাঝে মাঝে দেখা যেত কোন মহিলা হাতের আঙ্গুল মুখে দিয়ে বসে আছে, মানে হাত ছেঁচেছেন। এইসব ইট ভাঙ্গা মহিলাদের আবার দুই তিনটা বাচ্চা থাকা অবধারিত। একটা ইটের ছুরকি নিয়ে আপন মনে খেলে, আরেকটা ছুরকি ছুরে মারে। আর একেবারে ছোটটাকে কোলে নিয়ে মহিলা ইট ভাঙ্গেন। কারো কারো মাথার উপরে কালো উট মার্কা ডান্ডাভাঙ্গা ছাতা লোহার রড আয়রনে বেঁধে ফিট করা থাকে। দেখা যায় যতই ইটা ভাঙছেন ততই তারা ছুরকির উপরে উঠছেন। এই মহান দৃশ্য দেখেনি এমন লোক ঢাকা শহরে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ এই গাধী মেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে আমি কখনো ইট ভাংতে দেখেছি কি না! আমার ফ্যান যে এতবড় গাধী হতে পারে আমি কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছি না। খুব ইচ্ছে করছে হিমি নামের মেয়েটার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিতে। বর্তমানে সরকার ঘোষণা করেছেন ছেলেমেয়ের সমান অধিকার। মেয়ে বলে যে সে চড় খাবে না এটা কেন হবে? তাকে তার অধিকার মত একটা চড় মারতে আমার হাত উশখুশ করছে। 


লেখকদের অনেক কিছুই ইচ্ছে করলেও করা থেকে নাকি বিরত থাকতে হয়। আমি পারি না, সেই হিসেবে আমি নিজেকে লেখক মনে হয় না। হিমিকে চড় মারার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলাম। কিন্তু গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না। যে মেয়ে গল্পের শুরুতে ইট পাথরের কথা টানছে, সেই মেয়ে গল্পের শেষে আমাকে আমাজান জঙ্গলে একা রেখে গল্প শেষ করে চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জঙ্গল আবার আমি ভীষণ ভয় পাই। সারারাত বাঘ ভাল্লুকের সাথে জঙ্গলে ডিসকো কিংবা ক্লাবিং করার কোন সাধ আমার নেই। 

তারপরেও আমি নিজেকে মনে প্রানে লেখক ভাবতে চাচ্ছি। তাই ধৈর্য নিয়ে হিমির গল্প শোনার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু সিগারেট ছারা কিছুতেই ধৈর্য নামের অপ্রাপ্য বস্তু আমার মাঝে আসবে না সেটা আমি ভালো করেই জানি। অনেকদিন আগে একবার হাত পুরাই ফাঁকা, সারাদিনে সিগারেট টানা হয়নি। কারো কাছে ধার চাইতেও লজ্জা করে। শেষে তেঁজপাতা গোল করে পেঁচিয়ে সিগারেটের মত করে আগুন ধরালাম। ভালোই লাগছিল। আমাকে এই পদ্ধতিটি ছোট বেলায় আমার এক হাউজ টিউটর শিখিয়েছিলেন। অনেক পরে বুঝতে পারলাম ছাত্রের বাসায় শিক্ষক হিসেবে তিনি সিগারেট টানতে পারবেন না বলে ঠান্ডার ঔষধ বলে তেঁজপাতার ধুয়া টেনেছেন। আজকে বাসায় তেঁজপাতাও নেই যে ঠান্ডার সেই ঔষধ বানিয়ে টানবো। তারমধ্যে ফাজিল মেয়ে এসেছে গল্প শোনাতে। নিজেকে সত্যিই কুকুর মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করছে কিছুক্ষন ঘেউ ঘেউ করে চমকে দেই মেয়েটিকে। কিন্তু লেখকদের অনেক কিছুই করা থেকে বিরত থাকতে হয়। 


আমি নিজেই চমকে গেলাম যখন হিমি তার হান্ডব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। লজ্জা এবং সঙ্কোচ একই সাথে আমার চেহারায় খেলা করতে শুরু করেছে বলে আমি বুঝতে পারছি, হিমি সামনে না বসে যদি একটি আয়না বসিয়ে রাখতো তাহলে আমি নির্ঘাত দেখতে পেতাম আমার চেহারা লাল নীল আসমানি হচ্ছে। আমি ভদ্রতা বসত বললাম, হিমি, আমি যে সিগারেট খাই এইটা আপনি জানলেন কিভাবে?”

রিক, আপনার সব গল্পই মোটামুটি পড়েছি, তেমন ভালো লিখেন না, তবে একটি কারনে আমি আপনার ফ্যান, সেটা হচ্ছে আপনার গল্প খুব সাধারন বাস্তবতা নিয়ে। গল্প থেকেই বুঝতে পেরেছি আপনি স্মোক করেন। তাই নিয়ে আসলাম। আপনি রাখলে খুশি হব। 
আসলে কি, কারো কাছ থেকে কিছু নেয়ার অভ্যেস আমার নেই। আর মেয়েদের কাছ থেকে তো একেবারেই নেই না।

আপনি তো লেখক, আপনি ছেলে মেয়ে প্রভেদ করেন কেন?”

ইচ্ছে করছিল কষে থাপ্পরটা মেরে বলি, আমি প্রভেদ করি না, আমি আসলেই চাইতাছিলাম তোমারে একটা থাপ্পর দিতে। মনের ইচ্ছে বনে বনবাসে দিলাম, কারন? লেখকদের অনেক ইচ্ছেই পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। অনিচ্ছা স্বত্বেও হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলাম। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। 


আমি প্যাকেট খুলে হিমির সামনেই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। ভদ্রতার খাতিরে বললাম,তারপর হিমি? কি যেন বলছিলেন?”

আপনি সিগারেট শেষ করুণ প্লীজ, আর যে কয়টা সিগারেট টানা দরকার এক্ষুনি টেনে নিবেন। গল্পের মাঝে আপনার সিগারেট টানা চলবে না। আমি এসেছি গল্পটা আপনাকে দিয়ে লেখাতে। আসলে এটা গল্প না। বাস্তব ঘটনা। আমি চাচ্ছি আপনি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাস্তবিক ফ্লেভারে একটি গল্প লিখবেন। সেই গল্প মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি ট্রাষ্টে যাবে। ট্রাষ্টের টাকা ব্যয় করা হবে একাত্তরের যুদ্ধের বীরঙ্গনাদের সাহায্য করতে। সুতরাং গল্পের মাঝে বেয়াদবি আমি সহ্য করবো না।


আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কত বড় বজ্জাত মেয়ে! আমার বাসায় এসে আমাকে বেয়াদব বলে! নিজে যেন কত বড় আদবের কাজ করে ফেলেছে। অন্যের বাড়িতে এসে তাকে বেয়াদব বলাটা যে বেয়াদবির সামিল সেটা তাকে হারে হারে বুঝিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। সমস্যা হলো লেখকদের অনেক ইচ্ছে থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।

আমি আয়োজন করে দুইটা সিগারেট শেষ করে তৃতীয়টা ধরালাম। আমার মাথায় ভূত চেপেছে এই মেয়েকে বেয়াদবির শেষ মাত্রা পর্যন্ত দেখানোর। প্যাকেটে আছে আরও সতেরটা সিগারেট। ডিসিশন নিলাম আমি এই সতেরটা সিগারেট একের পড়ে এক টেনে যাব, দেখি মেয়ের ধৈর্যশক্তি কেমন। তৃতীয় সিগারেটের অর্ধেকটা শেষ হতেই হিমি বললো,আমার মনে হচ্ছে আপনি বাকি সিগারেটগুলাও টানবেন এখন। আপনি আসলে চাচ্ছেন আমার ধৈর্য কতটুক তা পরীক্ষা করতে। আমার ধৈর্য অসীম। আচ্ছা আপনি সিগারেট টানুন সমস্যা নেই। আমি গল্পটা শুরু করছি। গল্পটা একজন বীরঙ্গনাকে নিয়ে, যে বর্তমানে আমাদের কলেজের সামনে ইট ভাঙ্গে।


আমি অর্ধপোড়া সিগারেট হাত থেকে ফেলে দিলাম। আমি বেয়াদব হতে পারি কিন্তু একজন বীরঙ্গনার গল্প শোনার সময়ে বেয়াদবি করতে পারি না। আমি সোফা থেকে পা নামিয়ে বসলাম। হিমি তার গল্প শুরু করলো,


একদিন মেডিকেলের ক্লাস শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কলেজের গেট থেকে বের হয়ে দেখি চারদিক কেমন থমথমে হয়ে আছে। অন্যসব দিনে সামনের দোকানগুলো খোলা থাকে, রাস্তায় রিকশা থকে। সেদিন একেবারেই শান্ত সবকিছু। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে আমার ভয় ভয় করছিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোন রিকশা নেই যে উঠে পড়বো। হঠাত করেই একজন বৃদ্ধা আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, মা, আপনার কি ভয় করছে? চলেন আমি আপনারে এগিয়ে দেই। 

আমি এই বৃদ্ধাকে চিনি। মেডিকেলের থেকে সামান্য দূরেই একটি কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিল। আসা যাওয়ার পথে তাকে ইট ভাংতে দেখেছি। তার কাপরে ইটের ময়লা দাগ লেগে আছে। ভালো করে লক্ষ্য করলাম তার চশমার একটি কাঁচ ভাঙ্গা। চুল এখনো সব পাকেনি। তবে সাদা চুলের সংখ্যাই তুলনামুলক ভাবে বেশি। তাকে পাশে পেয়ে আমার ভয় একটু কমে গেলো। আমি তাকে নিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাটতে শুরু করলাম। কলেজের থেকে বড় রাস্তা হেঁটে প্রায় বিশ মিনিটের পথ। নিঃশব্দে হাটার চাইতে কেন যেন বৃদ্ধার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করলো। আমি তাকে বললাম তার জীবনের একটি গল্প করতে। বৃদ্ধা তার জীবনের গল্প শুরু করলেন,


তখন ১৯৭১ সন। আমার বয়স তখন তোমরার মত। বাপ গরিব বইলা পড়ালেখা শিখতে পারি নাই। তয় আমি তিন ক্লাস পড়ছিলাম। বাপজান আমারে বিয়া দেওনের লাইগা পোলা দেখতাছিল। হেই সময়ে শুর হইল সংগ্রাম। কি যে গোলাগুলি মা বিশ্বাস করতে পারবা না। চাইরদিকে কেমন আজিব অবস্থা। আমরা ঢাকার কমলাপুরের থেইকা পুব দিকে দূরের একটা বাড়িতে থাকতাম। কমলাপুরেও তখন পাক সেনাদের ক্যাম্প। খাল পার হইয়া একটু জঙ্গলের দিকে আমাগর গ্রাম আছিল বইলা সৈন্যরা জানে নাই গ্রামের খোঁজ। রাইতের বেলায় খালি গুল্লির শব্দ হুনতাম। আমরা তিন ভাই বইন বাপজানরে শক্ত কইরা ধইরা বইয়া থাকতাম। 

এপ্রিল মাসের কথা। একদিন হঠাত কইরা দেখি একটা মাইয়া আমাগো বাড়ির দরজার সামনে খাড়ায়া আছে। দেখতে এক্কেরে পরীর লাহান। কি সুন্দর নাক মুখ। আমি সামনে গিয়া কইলাম তুমি কে গো বইন? মনে হইল মাইয়াডা আমার কথা বুঝে নাই, তাকায়া ছিল আমার দিকে। আমারে উর্দুতে কইলো হে নাকি রেডুতে গান গাইতে আসছিল এই দেশে। এর মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। সে কিছুদিন ধইরা পলায়া পলায়া থাকতাছে। আমি তখন উর্দু তেমন বুঝি না। তয় সিনেমা দেইখা একটু একটু বুঝি। আমি তারে কইলাম তোমরার লোক এইদেশে আসছে যুদ্ধ করতে, যাও তাগরে বলো, তারা তোমার একটা ব্যাবস্থা নিবে। হে কইল যে যুদ্ধের মইদ্ধে সৈন্যরা তারে দেশে পাঠাবে না। ক্যাম্পে রাখবে। সেই ভয়েই সে পালিয়ে এসেছে আশ্রয়ের খোঁজে। মাইয়াডা কান্দাকাটি শুরু করলো। আমি পরলাম বিপদে। কি করমু বুঝতে পারলাম না। শেষে মাইয়াডারে আমাগো বাড়িতেই রাখলাম। রাইতে বাপজান আইসা শত্রু পক্ষের একজন মাইয়া দেইখা রাইগা গেলো। হে পারলে রাইতেই মাইয়াডারে বাইত্তে বাইর কইরা দেয়। পড়ে আমি বুঝাইয়া কইলাম মাইয়াডার বিপদের কথা। বাপজান আছিলো দয়ার সাগর। হেয় সায় দিলো মাইয়াডারে রাখার। 


কয়দিনের মধ্যেই আমাগো এইদিকে এইখবর ছরায়া গেলো। আমাগো এইখানে তখন মুক্তিবাহিনীর একটা দল হইল। তারা খাল পার হইয়া শহরের দিকে গিয়া যুদ্ধ কইরা আসতো। হেরা আসার ময় কি যে সুন্দর লাগতো। কাঁধে বন্দুক লইয়া আসতাছে, দেখতেই নয়ন জুড়ায়া যাইত। কয়দিনের মধ্যেই ছরায়া গেলো যে উর্দু একটা মাইয়ারে আমরা বাসায় আশ্রয় দিছি। আমার লগে মাইয়াডার খুব ভাব হইয়া গেলো। হে আমারে গান হুনাইত। কি যে সুন্দর মধুর গলা। মাইয়াডারে শিখাইলাম আমারে বুবু ডাকতে। হের মুখে বুবু শুনতেও ভালো লাগতো। একদিন গ্রামের মাতাব্বর মোতাহার শেখ দলবল লইয়া আমাগো বাড়িত্তে মাইয়াডারে ধইরা লইয়া গেলো। মাইয়াডা নাকি গুপ্তচর। আমার কিন্তু হেইরকম মনে হয় নাই। মাইয়াডা সারাদিন আমাগো লগেই থাকতো, আমরা যা খাইতাম তাই খাইত। মাইয়াডারে যখন ধইরা লইয়া যায়, হেয় বুবু বুবু কইয়া আমারে ডাকতাছিল। আমি কি করমু উপায় না পাইয়া মুক্তিবাহিনীর কাছে গেলাম। হেরার প্রধান শাহিন ভাই আবার শিক্ষিত লোক। আমি তারে যাইয়া কইলাম যে একটা উর্দু মাইয়া আশ্রয় নিছিলো। মাতাব্বর লোকজন লইয়া আইসা ধইরা নিয়া গেছে। শাহিন ভাই সত্যিই ভালা লোক। হেয় রাইতে সবাইরে ঘুম থেইকা উঠাইল মাইয়াটারে উদ্ধার করতে। আমি কইলাম আমিও যামু। আমারেও নিলো লগে। মাতাব্বরের বাড়িতে গিয়া আতাহার আলী ভাই মাতাব্বরের মাথায় রাইফেল ধরলো। শেষে গোয়ালঘরে যাইয়া দেখলাম মাইয়াডা গলায় ফাঁস নিছে। 

তখন থেইকা আমার সাহস হইল। আমিও মুক্তিবাহিনীরে সাহায্য করতে লাগলাম। তারার অস্র আইনা আমাদের বাড়িতে রাখতো। মাঝে মধ্যে আমি খাওন নিয়া যাইতাম তাদের জন্য। শাহিন ভাই আমাদের যুদ্ধ নিয়া বুঝাইতেন। আমাদের নাকি একটা দেশের অধিকার আছে, সেই অধিকারের যুদ্ধ। শাহিন ভাই আমারে বন্দুক চালানো শিখাইলো। তয় আমি যাইতে চাইলেও হেরা আমারে যুদ্ধে নিত না। আমারে কইত বন্দুক চালাইতে পারো, রক্ষা করবা নিজেরে। 

সেইদিন শাহিন ভাই মাতাব্বররে মাফ কইরা দিছিল। ভুল করছিল। কয়দিন পরে মাতাব্বর টুপি মাথায় দিয়া ঘুরাঘুরি করতে লাগলো। পাক বাহিনী আইনা তার বাইত্তে উঠাইলো। মুক্তিবাহিনী গ্রামের থেইকা একটু দূরে সইরা গেলো। নভেম্বার মাসের একদিন রাইতে মাতাব্বর পাক সেনাগোরে লইয়া মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করলো। সেইদিন শাহিন ভাই মারা গেলেন। গ্রামে মাতাব্বর ইচ্ছামতন লুটপাট শুরু কইরা দিলো। 

আমাগর বাড়িতে তখন বেশ কয়েকটা বন্দুক আছিলো। ১৬ তারিখ যুদ্ধ শেষ হইলো। সেইদিন রাইতে মাতাব্বর মইরা গেলো গুল্লি খাইয়া। সেইদিন আমিই মারছিলাম মাতাব্বররে। দুইটা কারনে, এক হইল সে রাজাকার, আর দ্বিতীয়ত সে একটা নিরপরাধ মাইয়ারে ধইরা নিয়া গেছিল। বুঝলা মা, শেষে একটা দেশ পাইলাম, স্বাধীন দেশ। কিন্তু আমরার অবস্থার কোন উন্নতি হয় নাই। জানো মা, অহনো মাঝে মাঝে আমি হেই মাইয়াডার ডাক শুনি, মাইয়াডা বুবু বুবু কইয়া ডাকে আমারে। 

সেদিন সেই বৃদ্ধা আমাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে গেলো। সেদিন আরও জানতে পারি যে, আমাদের যুদ্ধে তার অবদান এখনো কাগজে কলমে স্বীকৃত হয়নি। আমরা বান্ধবীরা মিলে ঠিক করলাম এসব ছিন্নমূল বীরঙ্গনাদের জন্য কিছু করবো। আমরা তাই তাদের জন্য একটি ট্রাস্ট খুলতে চাচ্ছি। আপনার গল্পের পসার বেড়েছে। আমি আজকে এসেছি আপনাকে গল্পটা বলে একটা লেখা আদায় করতে। 
রিক, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?”
হুম, একমিনিট আমি আসছি।

হিমিকে ঘরে রেখে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মেয়েদের কখনো পুরুষের চোখের জল দেখতে দিতে নেই। আমি এমনিতেই একটু বেশি মাত্রার ইমোশনাল। যে কোন গল্প লেখার সময়েই আমি কাঁদি। আর একজন বীরঙ্গনার গল্প শুনে চোখে তো পানি আসবেই। তাদের জন্য কিছু করতে পারা মানে অনেক। আমার মত অপদার্থ লেখক যদি তার লেখা কিছুটা হলেও করতে পারে, খারাপ কি? চোখ মুছে আবার ভিতরে ঢুকে বললাম,
হিমি, কবে নাগাদ গল্পটা লিখে দিলে চলবে?” 








পরিশেষে কিছু বলতে চাই___ 

আমি দেখেছি আমার গল্পগুলো যারা পড়েন অধিকাংশই ছাত্র। আমি নিজেও একজন ছাত্র। আমি জানি আমাদের থেকে বড় শক্তি আর নেই। একটি দেশ সুন্দর করতে একমাত্র আমরাই পারি। আমরাই পারি দরিদ্র মানুষের হাসি দেখতে, শীতার্তকে উষ্ণ আশ্রয় দিতে, দেশের জন্যে কল্যানকর কিছু করতে, তবে অবশ্যই নোংরা রাজনীতির উর্দ্ধে থেকে। দেশকে সবাই ভালবাসুন। পৃথিবীতে এখনো অনেক জাতি স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করে যাচ্ছে। সেই দিক থেকে আমরা নিউ জেনেরেশন অনেক ভাগ্যবান যে আমাদের নিজের বলে একটা দেশ আছে। সবাই অন্তত শততার সাথে একবার চেষ্টা করুণ বদলে দিতে দেশকে। 
আমি লেখকসুলভ মোটা কথা বলছি না। আমার নিজের মধ্যেও বদলে দেয়ার একটা বীজ সুপ্ত আছে। ছোট করে বলি, ইউনিটি ক্যান চেঞ্জ আওয়ার নেশন। 



লিখেছেন-রিয়েল ডেমোন
FB ID-Real Demon



গল্পটি নেয়া :      https://www.facebook.com/notes/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81-%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA/%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%A7%E0%A7%81-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA/211370605609763