Wednesday, May 22, 2013

সওদা- শেষ খন্ড [Ghost stories 47]





*চার*


মেসে ঢুকতেই কাউন্টারে বদরুলকে পেয়ে দোতালায় ডেকে নিয়ে এলাম । দোতায়ায় আমি ছাড়া এখন আর অন্য কোন বোর্ডার নেই । রুমগুলো সব তালা দেয়া । বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই শরীরটা কেমন ছমছম করে উঠল। আমি ধীরে সুস্থে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম । আমার পেছন পেছন ঢুকলো বদরুল । আমি খাটে বসে বদরুলকে চেয়ারে বসতে বললাম, ও বলল, বসতে হবে না রঞ্জু ভাই , কি বলবেন বলেন ? তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ? আমি কোন রকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম । বদরুল কিছু বলল না । মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল । কালকে সকালে বলি রঞ্জু ভাই ?
এখন নয় কেন ?
রাতের বেলায় তেনাদের নিয়ে কোন কথা বলতে হয় না । বদরুল দেখে মনে হলো, ও গুটি চালতে শুরু করেছে ।
তেনারা মানে কারা ? আমি তোমাকে সদু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি । আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম । তেনারা মানে মৃত মানুষদের কথা বলছি । 
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও , তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো ?
জ্বি ,দেখেছি ; বদরুল কিছুক্ষন নীরব থেকে আমতা আমতা করে উত্তর দিল
কবে ?
তিনি ফাঁসি দেবার দুদিন পরে । সন্ধ্যার সময় দোতালায় এসেছিলাম, হঠাৎ দেখি সদু ভাইরুমের লাইট জ্বলছে । দরজা বন্ধ । কে ভেতরে দেখার জন্য দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিতেই দেখি সদু ভাই টেবিলে বসে কি যেন লিখছে । আমার তো জান যায় যায় অবস্থা আমি এক দৌড়ে নিচে গিয়ে বাবুচি তোতারে ডেকে এনে দেখি কেউ নাই । ভেতরের বাতিও নেবানো।
তুমি মিথ্যা বলছো না তো ?
আল্লাহর কিরা, মিথ্যা বলুম ক্যান ।
তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ? আমি সরাসরি বদরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম । বদরুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল । মানুষ সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না । তার বিবেক বাঁধা দেয় । বদরুলের কথা আমার এমনিতেই বিশ্বাস হয় না ।
না, বদরুল মাটির দিকে তাকিয় বলল ।
এবার কিন্তু মিথ্যা বলছ । আমার সঙ্গে ওসির সাহেবের কথা হয়েছে কোন রকম উল্টা
পাল্টা দেখলেই সরাসরি ফোন করতে বলেছেন । তুমি কি চাও আমি তোমার কথাটা ওসি
সাহেবকে বলি । ওসি সাহেবের কথাটা আমি বানিয়ে বললাম । আমার সন্দেহ হচ্ছে বদরুল
এমন কিছু জানে যা আমাকে বলতে চাচ্ছে না ।
ওসির কথা শুনে, বদরুল হঠাৎ খুব ঘাবরে গেল ।
কাচুমাচু হয়ে বলল, রঞ্জু ভাই আমি কিন্তু কিছু করি নাই ।
তুমি কিছু করেছো তা আমি বলিনি । শুধু এইটুকু বলেছি আমার সঙ্গে মিথ্যা বললে ফেসে
যাবে । তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না ?
বদরুল মাথা নাড়ল, আছে ।
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকার ও চেষ্টা করেছো তাই না ।
বদরুল না বলতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেল ।
দেখো মিথ্যা বলোনা, একদম ফেসে যাবে ।
পুরো ঘটনাটা আমাকে খুলে বলো ।
কি ঘটনা ?
তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকেছিলে তাই না ? কোন জিনিষপত্র কি সরিয়েছো ?
আল্লাহর কিরা রঞ্জু ভাই আমি কিছু সড়াইনি ।
তারমানে তুমি সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকছিলে ?
জ্বি ?
কেন ?
ঝারপোছ করতে ।
ঝারপোছ করেছো ?
না,
না কেন ?
ভয়ে চলে এসেছি ?
ভয় ? কিসের ভয়ে ?
সদু ভাইয়ের ।
সদু ভাইয়ের মানে ?
আমি সকাল বেলা সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকে জানালাগুলো খুলছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে সদু
ভাইয়ের গলা শুনে চমকে পেছন ফিরে দেখি সদু ভাই টেবিলের উপড়ে বসে আছে , আমি
তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, বদরুল দরজা খুলিস না রে রোদ আসে । আমি
দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে আসি । পরে তোতার ডেকে এনে দরজা বন্ধ করেছি । বিশ্বাস
করেন রঞ্জু ভাই এর মধ্যে এক বিন্দু মিথ্যা নাই ।
চাবিটা তোমার সঙ্গে আছে ?
জ্বি , বলে বদরুল এক গোছা চাবি বের করে তার মধ্যে থেকে পিতলের একটা চাবি দেখাল।
চাবিটা আমারে খুলে দাও ।
বদরুল চাবিটা খুলে আমাকে দিয়ে বলল, রঞ্জু ভাই একটু সাবধানে থাকবেন । দোতালায়
কিন্তু এখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই ।
ঠিক আছে , তুমি এখন যাও ।
খাবেন না ? খাবার দেবো ?
না, খাবো না । তুমি পারলে এক ফ্লাক্স চা পাঠাও । রাতে লেখালেখি করতে হবে ।
কোন কিছুর দরকার হলে আমারে আওয়াজ দিয়েন । আমি জেগে থাকবো ।
ঠিক আছে,দরকার হলো ডাকবো । তুমি এখন যাও ।


বদরুল দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল , রঞ্জু ভাই ?
কি ?
আজ আপনার খোঁজে একটা মেয়ে এসেছিল ।
মেয়ে ? আমি বেশ অবাক হলাম । কেননা ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নেই কখন ?
দুপুরের দিকে ?
কিছু বলেছে ?
না , বলেছে আবার আসবে ?
ঠিক আছে তুমি যাও ।
বদরুল চলে যেতে জামাকাপড় পাল্টে চা খেয়ে লিখতে বসলাম । একটানা অনেকক্ষন লেখার
পর হঠাৎ লেখার খেই হারিয়ে ফেললাম । কিছুতেই যেন মাথা থেকে কিছু বের হচ্ছিল না
একজন লেখকের জন্য এটা বুঝি সবচাইতে বেশি কস্টের বিষয় । খুব গরম লাগছে ।
টেবিলের পাশের জানলাটা খুলে দিয়ে আমি আবারও লিখতে চেস্টা করে ব্যর্থ হলাম । না,
আজ আর হবে না। লেখা বন্ধ করে যতোটুকু লেখা হয়েছে । তা নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
পড়তে লাগলাম । ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় রাত ৩টা বেজে ২ মিনিট । হঠাৎ বাইরে দুপ
করে কোথাও শব্দ হলো । সঙ্গে সঙ্গে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো । আমি দ্বিতীয় বার শব্দটা শুনার জন্য কান খাড়া করে ফেললাম । আবারও হলো শব্দটা । এবার বেশ স্পর্স্ট ভাবেই শুনা গেল। আমার ডান পাশ থেকে আসছে শব্দটা অথাৎ সদু ভাইয়ের রুমের দিক থেকে । টের পাচ্ছি মাথার চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি শোয়া থেকে উঠে দাড়ালাম । আমার কাছে মনে হলো,কেউ যেন দরজা খুলে বাহীরে আসলো। বারান্দায় হাঁটার শব্দ শুনা যাচ্ছে । আমার একটা রুমের পরেই সদু ভাইয়ের রুম । দরজা
খুললে শব্দটা শোনা যাবার কথা । আমি আস্তে আস্তে আমার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছে এসে আবার সদু ভাইয়ের রুমের দিকে ফিরে গিয়ে আবার ফিরে আসছে । পায়ের শব্দটা আমার দরজার কাছাকাছি আসতেই আমি একটানে দরজাটা খুলে ফেললাম । পুরো বারান্দা অন্ধকার । কোন আলো নেই । অন্ধাকারে কাউকে দেখতে পেলাম না । আন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দেখলাম শুন্য বারান্দা খাঁ খাঁ করছে । আমি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম । কাউকে না দেখে যেন হাফ ছেড়ে
বাঁচলাম । কেননা বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গেছে । টেবিলের উপড় রাখা বোতল থেকে
ঢকঢক করে পানি খেলাম । বিছানায় বসতেই দরজায় পরপর তিনটা টোকার শব্দ হলো ।
আমি চমকে উঠলাম । আমি দাঁড়িয়ে গেছি । ভয়ে ঘামতে শুরু করেছি । মাথার চুলগুলো
আবারও একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কে ? কে ?
কেউ উত্তর দিল না । আমি দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
না, আর কোন শব্দ নেই । হয়তো মনের ভুল , অতিরিক্ত উত্তেজনায় এলোমেলো শুনছি । বেশ
কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আবারও বিছানায় এসে বসলাম । নিজেকে শান্তনা
দিচ্ছি ভয় পাবার কিছু নেই । সব মনের ভুল হবে । মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না
বিছানায় শুয়ে আবারও যেই লেখাটা পড়তে শুরু করেছি । ওমনি দরজায় শব্দ হলো। সঙ্গে
সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম । ছুটে গেলাম দরজার কাছে । একটানে খুলে ফেললাম দরজা ।
তারপর যা দেখলাম তাতে আমার পুরো শরীর কেপে উঠল । আমি হিস্টিরিয়ার রুগির মতো
চিৎকার করে উঠলাম কে ? কে ? দরজায় দাঁড়িয়ে আছে; সদু ভাই । মুখটা কেমন শুকিয়ে
গেছে । চোখ দুটো গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে । আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম ।
সদু ভাই বললেন, রাইটার সাব, একটা কাঁথা দিবা ? আমার খুব শীত করতাছে । এখানে
এখানে খুব খুব শীত । দাওনা একটা কাঁথা । আমি দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম ।
প্রচন্ড ভয়ে পিপাষায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি । কানের
ভেতরে ভো ভো শব্দ শুনছি । চোখে কিছু দেখছি বলে মনে হলো না । হঠাৎ ওমর ফারুক
সাহেবর কথা মনে হলো, বুঝতে পারলাম কি দেখে ভদ্রলোক ভয় পেয়েছেন । আমি বড় করে
হা করে শ্বাস নিয়ে ছাড়তে লাগলাম । বাকি রাতটুকু দরজায় হেলান দিয়ে কাটিয়ে দিলাম ।


*পাঁচ*


ফজরের আযানের পর বিছানায় শুতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো । কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । প্রথমে চোখ খুলে বুঝলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে ।
দ্বিতীয় বার শব্দ হতেই বুঝলাম প্রচন্ড জোড়ে কেউ দরজায় আঘাত করছে । ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখি পৌনে ছয়টা বাজে । এক ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি । এলোমেলো পা ফেলে
দরজা খুলতেই দেখি পুলিশের সেই এসআই দাঁড়িয়ে আছে । পুলিশ দেখে আমি চমকে উঠলাম ।
কি ব্যাপার ? কোন রকম নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলাম । কেননা আমি ভাল করে তাকাতে
পারছিনা । মনে হচ্ছে চোখের ভেতর অসংখ্যা সূঁচ ফুটছে । দু হাত দিয়ে চোখ কচলাতে
কচলাতে এসআইয়ের দিকে তাকালাম ।
আপনিই তো রঞ্জু সাহেব ?
জ্বি বলেন ।
দূঃখিত আপনাকে বিরক্ত করতে হলো । একটু নীচে চলুন ।
কেন কি হয়েছে ?
আসুন না, গেলেই তো দেখতে পাবেন । কোথায় যেন পড়েছিলাম রিকশা চালক আর পুলিশের
সঙ্গে তর্ক করতে নেই ,তাতে সন্মানহানির আশংন্কা থাকে । সেই বাক্যটা মনে করে একটা
সার্ট টেনে গায়ে দিয়ে এসআইয়ের পিছু পিছু হাটতে শুরু করলাম । সিঁড়ির কাছে অনেক
লোকের ভীড় চোখে পরল। কয়েকজন পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে । ভীড়ের মধ্যে এফডিসির সামনে
দেখা লোকটাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । সেই হলুদ চোখ, বিশাল মাথাওয়ালা লোকটাকে
খুব সহজেই চিনতে পারলাম । কেমন হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । আমি সিড়ির রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম । এসআই
বললেন, কি হলো ? আমি কয়েক মুহুর্ত কোন কথা বলতে পারলাম না । নিজেকে কোন রকম
সামলে নিয়ে আবারও নিচে তাকাতে কাউকে দেখতে পেলাম না । মনে মনে বললাম, আমি
বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
সিঁড়ির নীচে মেঝেতে কেউ একজন উপুর হয়ে পরে আছে । ঘারটা বিশ্রী ভাবে ডানপাশে
মোচড়ানো । রক্তের দুটো ধারা গড়িয়ে মেঝেতে নেমে গেছে । উপড় থেকে এক নজর দেখেই
বুঝলাম বেঁচে নেই। ওটা কে ? কে ওখানে পরে আছে ? কথাটা বলে আমি দ্রুত পা ফেলে
নীচের নেমে গেলাম । কাছে গিয়ে বদরুলকে চিনতে মোটেই বেগ পেতে হলো না ।
বদরুলকে এভাবে অপঘাতে মরতে দেখে আমি খুব ঘাবরে গেলাম। পরপর দুটো মৃত্যু আমাকে
হতবিহম্বল করে দিলো । আমার মুখ দিয়ে উহু একটা শব্দ বের হয়ে এলো । এসআই আমাকে
ধরে কাউন্টারের সামনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । আমি এসআইয়ের দিকে
তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে ?
সেটাইতো আমরা জানতে চেস্টা করছি । তবে প্রার্থমিক ভাবে মনে হচ্ছে পেছন থেকে
কেউ খুব জোড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে । তারপর কি একটা চিন্তা করে আমার দিকে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও তো দোতালাতেই থাকেন , তাই না ?
আমি মাথা নাড়ালাম , হা ।
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আপনার কখন শেষ দেখা হয়েছে ?
গতকাল রাতে ।
কখন ?
রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে । আমি এসআইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
কি নিয়ে কথা হয়েছে ?
আমার কিছু বিষয় জানার ছিল তাই বদরুলের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম ।
কি জানতে চেয়েছিলেন, তা কি আমি জানতে পারি ?
আমার গতরাতে দেখা সদুভাই এর মুখটা মনে পরে গেল । আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে
বললাম, পারেন ।
তা হলে বলে ফেলুন । দয়া করে মিথ্যা কিছু বলবেন না ।
অনেকেই নাকি সদু ভাইকে মেসের এখানে সেখানে ঘুরে বড়োতে দেখেছে । আমার কাছে মনে
হচ্ছিল ব্যাপারটা বানোয়াট । তাই বদরুলকে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আসলে
ব্যাপারটা কি ?
তা, কি জানতে পারলেন ?
বদরুলও বলল ও নিজেও নাকি সদু ভাইকে দেখেছে ।
কবে , কোথায় দেখেছে ? এসআই অত্যান্ত শান্তু সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ।
সদু ভাইয়ের মৃর্ত্যুর দুদিন পরে । তার রুমে ।
এসব মিথ্যে কথা । যতোসব গাল গপ্প । একজন মৃর্ত মানুষ কি করে দেখা দেয় ?
আমিও প্রথমে তাই ই মনে করেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্য ……আমি গতরাতে ঘটে
যাওয়া ঘটনাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ।
কি সত্যি ? সদু সাহেবকে দেখার ব্যাপারটা ?
জ্বি ।
আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ বলছেন এ কথা ?
জ্বি, কেননা কেননা আমিও গতরাতে সদু ভাইকে দেখেছি । আমি এসআইকে সদু ভাইকে দেখার
পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম ।
সব শুনে এসআই সাহেব বললেন, এ্যস্ট্রেন্জ । এতো দেখছি সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার । আমি
কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম ।


মেসে পরপর দুটো মৃর্ত্য ঘটায় পুরো শহরে হৈ চৈ পরে গেছে । প্রতিদিন অনেক লোক আসছে
মেসটাকে দেখতে । পরের দিন সবকটি জাতীয় পত্রিকায় লাল কালিতে বড় বড় করে ছবি সহ
হেডলাইন ছাপা হলো, মেস মালিকের আত্মহত্যার পর এবার কর্মচারীর রহস্যজনক মৃর্ত্যু ।
এলাকা বাসি বলছে, ভৌতিক ঘটনা
অন্য একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছ, পুলিশের নাকের ডোগায় ঘটে চলেছ একের পর এক
ভৌতিক হত্যাকান্ড, তবুও পুলিশ রহস্যের কোন কূল কিনারা করতে পারছে না । মেসের
লোকজন বলছে, ভূতুরে কান্ড।


মেসের উঠানের মাঝখানে বিশাল একটা আম আছে । যার গোরাটা গোল করে বাঁধানো ।
দুজন পুলিশ পালা করে সেখানে বসতে শুরু করেছে । আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি মেস
ছেড়ে দেবো । এহতে সামস্ সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে দুদিন ফোনে কথা হয়েছে । তিনি
স্বাভাবিক খোজ খবর নিয়ে আরেক জন পরিচালকের খোঁজ দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি একটা
ভাল চিত্রনাট্য খুঁজছেন । তিনি ঐ পরিচালকে আমার কথা বলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন ,
ভদ্রলোক যে কোন দিন আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে । নিজের ভাগ্যের এ পরিবর্তনে
আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছি । বারংবার চোখের সামনে ভেসে
উঠছে, সেই হলুদ দুটো চোখ, আর বিশ্রী মুখের হাসি ।


সদু ভাইকে দেখার পর থেকে আমার চারপাশে অদ্ভূত সব ব্যাপার ঘটছে । প্রায় রাতেই
বারান্দায় কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যেও কার যেন
উপস্থিতি টের পাচ্ছি । লেখালেখি নিয়েও চলছে তুগলগি কারবার । কোন একটি কাহিনী
চিন্তা করে লেখা শুরু করলেই প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যায়, আর তখন লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পরি
সকালে উঠে নিজেকে হয় বিছানায় নয়তো মেঝেতে আবিস্কার করি । সব চেয়ে আশ্চর্য্যের
বিষয় হচ্ছে, যে লেখাটা লিখতে শুরু করে ছিলাম সেটা পুরোপুরি শেষ করা অবস্থায় পাই ।
একরাতে একটা কাহিনী শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু হাতের লেখা হুবুহু আমার।
আমার লেখাতে এমনিতে অনেক কাটাছেড়া হয় । কিন্তু এ লেখাগুলো একেবারে নিক্ষুত । এ
রকম অদ্ভুত ঘটনায় আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি ।
গভীর রাতের দিকে মাঝে মাঝে মনে হয় সদু ভাইয়ের রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
খুবই করুন সে কান্নার শব্দ। আমি ভয়ে আর দরজা খুলি না । তার উপড় আবার ক্ষুধা মন্দা
দেখা দিয়েছে । স্বাস্থ্য দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আয়নার সামনে দাঁড়ালে বেশ বুঝতে
পারি চোখ মুখ ভেতরে বসে যাচ্ছে । কোন কিছু খেতে ভাল লাগে না । ক্যামন জানি সব
সময় একটা অস্থির ভাব কাজ করে। কোন কাজই মন দিয়ে করতে পারছি না। একটার পর
একটা সিগারেট টেনে চলি । কোন কোন রাতে দেখা যায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই
ঘুমিয়ে পরছি ।


*ছয়*


ইতি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । এহতে সামস্ সাহেব আমার যে কাহিনীটা
নিয়ে ছবি বানাবে সেটার নায়িকা । আমার কাছে পাঠিয়েছেন ওর চরিত্রটি ভাল ভাবে
বুঝিয়ে দেবার জন্য । আনার্স পড়ছে । মেয়েটা একবার এলে আর সহজে উঠতে চায় না ।
ঘরদোর নিজের মতো করে গুজগাছ করে ফেলে । ছোটবেলা থেকেই আমি নারী সঙ্গ বঞ্চিত ।
এখনও বুঝতে পারিনা মেয়েদের সঙ্গে ঠিক কিভাবে কথা বলতে হয়,মিশতে হয় । মেয়েটাকে
এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি । একেবারে নাছোড়বান্দা । প্রথম প্রথম
ভেবেছিলাম ওর চরিত্রটা বুঝিয়ে দিলেই কেটে পরবে । কিন্তু সেটা নিয়ে ওর সঙ্গে
একদিনও বসতে পারিনি । আমি যখনই বলেছি চলো তোমার চরিত্রটি বুঝিয়ে দেই, তখনি ও
বলেছে, রাখেন তো , আপনি তো আর উড়ে যাচ্ছেন না, পরেও এ নিয়ে বসা যাবে ।
চরিত্রটি বুঝে নেবার কোন আগ্রহ মেয়েটার মধ্যে আছে বলেও মনে হয় না । ওর ভাষায়
কাহেনীকারকে বুঝতে পারলে নাকি অতি সহজেই তার রচিত যে,কোন চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ
করা যায়। তাই ও এখন আমাকে বোঝার চেস্টা করছে ।


আমার বর্তমান অসস্থা দেখে ইতি একদিন এসআইকে ফরহাদকে ডেকে নিয়ে আসল । আমি তাকে
এক এক করে সব খুলে বললাম । এফডিসির সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বাদ গেল না ।
এসআই ফরহাদ আমার সদ্য সমাপ্ত চিত্রনাট্যটি যেটার শুরুটা করেছি আমি আর বাকিটা
করেছে অন্য কেউ, নেড়েচেড়ে দেখে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন । তারপর একদিন বিকেল
বেলা এসে বললেন, রন্জু সাহেব এটা আমি পরপর তিনজন হ্যান্ড রাইটিং এক্সাপাট কে
দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি, এবং তারা সবাই মোটামুটি একই কথা বলেছে, যে এটা একই
হাতের লেখা । সুতারাং আপনার এ কথাটা ঠিক নয় যে এ পুরোটা আপনি লিখেননি । আমি
কিছুতেই আর তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, লেখাটি আমি শেষ করিনি । উল্টো
এসআই আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, কোথাও থেকে সপ্তাহ খানেক ঘুরে আসুন, দেখবেন সব
ঠিক হয়ে যাবে । সত্যি বলতে কি, আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনার উপড়ে
বেশ চাপ ফেলেছে । কোথাও থেকে ঘুরে আসলে মাথাটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে তখন দেখবেন
আর এমন মনে হবে না ।
আমি ইতির অনুরোধে এসআইয়ের কথা মতো কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলাম । কিন্তু তাতে
সমস্যার কোন হেরফের হলো না। বরং নতুন এক উপদ্রোপের উপস্থিতি টের পেলাম । তা
হলো, সারাক্ষন মাথার ভেতর ক্যামন সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করলেই মনে
হয়, আমি সমুদ্রের মধ্যে পরে গেছি আর চারিদিক থেকে রাশি রাশি জল এসে আমাকে টেনে
নিয়ে যাচ্ছে ।


দিনের পর দিন আমার সমস্যা আরো বাড়তে থাকায় ইতি একদিন আমাকে পরানো ঢাকায় ওর
এক স্যারের বাসায় নিয়ে গেল । ভদ্রলোক একজন সাইকিয়াটিস্ট । নাম মোস্তফা মল্লিক।
শরীরের গরন হালকা পাতলা। ঠোটের উপর মস্ত একজোড়া গোফ। দুগালে কয়েক দিনের না
কাটা দাঁড়িতে ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না তিনি একজন সাইকিয়াটিস্ট বা মনোবিজ্ঞানি
মধ্যবয়স্ক শরীরটা ধনুকের মতো সোজা, মাথার চুল সব এলোমেলো। দেখলে যাযাবর বলে
মনে হয় । আমরা রিকশায় থাকতেই প্রচন্ড ঝড় হলো । পরিস্কার আকাশ বলা নেই কওয়া নেই
হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হলো। আমরা যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । পুরো
এলাকায় বিদ্যূত নেই । অনেকক্ষন দরজায় কড়া নাড়ার পর কালো রঙের লুঙ্গি পরা উদম
শরীরে মোস্তফা মল্লিক সাহেব দরজা খুলে দিয়ে ইতিকে দেখে বলে উঠলেন, ও তুমি ।
রান্না ঘরে ছিলাম তো তাই দেরি হয়ে গেছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়েই যেন থমকে
গেলেন । যেন আমি মস্ত কোন অপকর্ম করে এসেছি এমন করে পলকহীন ভাবে আমার মুখের
দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি প্রচন্ড রকমের অসুস্থিতে পরে গেলাম । একজন মানুষের দৃস্টি
অন্য একজন মানুষের কাছে যে কি পরিমানে অসুস্থিকর হতে পারে তা হারে হারে টের
পেলাম । একসময় মনে হলো, ভদ্রলোকের দৃস্টি আমার অস্থি মজ্জা ভেদ করে শরীরের রন্দে
রন্দে পৌছে যাচ্ছে । হঠাৎ করে আমার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো । মনে হলো,
লোকের কাছ থেকে যতো দ্রুত পালিয়ে যাবো ততোই মঙ্গল । আমি ইতির দিকে তাকিয়ে চলে
যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে কোন রকম বললাম; ইতি চলো ।
ঠিক তখনি ভদ্রলোক খুব দ্রুত ছোবল মারার মতো খপ করে থাবা দিয়ে আমার ডান হাতটা
ধরে ফেললেন, তারপর অত্যান্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভেতরে আসো, এখানে তোমার কোন
ভয় নেই । তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো


মল্লিক সাহেব আমার হাত ধরে ভেতরের নিয়ে গেলেন । দরজা বন্ধ করা একটা ঘরের
সামনে নিয়ে এসে তার অন্য হাতটা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন । দ্রুত
ঘরের ভেতর ঢুকে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, ওখানে বস। আমি
পুরো ঘরটার দিকে একবার তাকালাম , ঘরটা বলতে গেলে একেবারে আসবারপত্র শুন্য । এক
কর্নারে মাটিতে জাজিম আর তোশক দিয়ে একটা বিছানা পাতা । তাতে কালো রং একটা
চাদর আর দুটো বালিশ দেওয়া । তারপাশেই বড় একটা কাঠের আলমিরা দাঁড় করানো । ঘরের
ঠিক মাঝখানে সাদা রং দিয়ে বড় একটা বৃত্ত আঁকা । বৃত্তের ভেতর হিজিবিজি করে আরো
অনেক কিছুর ছবি আঁকা । ঘরের জানালাগুলো সব ভেতর থেকে বন্ধ । তবুও ঘরটার ভেতরে
ভেতর পা দিতেই আমার মনে হলো, আমি যেন ফ্রিজের ভেতর প্রবেশ করেছি । হঠাৎ তীব্র
শীতে আমার পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল । আমি উহু করে কুঁকড়ে যাবার ভঙ্গি করলাম ।
লোকটা তখন দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তো মা,
বেডরুম থেকে একটা চাঁদর এনে ওকে দে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আমার
দুহাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বলল, এখানে বসো । আমার নাম মোস্তফা মল্লিক । আমি
ইতির কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়াই । আমার কাছে তোমার কোন ভয় নেই । তুমি এখানে
নিশ্চিন্তে থাকো । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
ইতি একটা চাঁদর এনে আমার শরীরে পেচিয়ে দিল । ততোক্ষনে ঠকঠক করে আমার দাঁতের
সঙ্গে দাঁতে বারি খাচ্ছে । মৌল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কাকি
গ্রামের বাড়িতে গেছে । আমি রান্না বসিয়েছি । তুই রান্নাটা দেখ। আমি ওকে নিয়ে
বসছি । ওর অবস্থা ভাল না । এতোটা খারাপ আশা করিনি । আরো আগে নিয়ে আসা উচিত
ছিল । হঠাৎ ইতির পেছনে আমার চোখ যেতেই আমি চমকে উঠলাম । কেননা ইতির পেছনে
দাঁড়িয়ে আছে এফডিসির সামনে দাঁড়ানো সেই লোকটা । চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের
হচ্ছে । লোকটা তীব্র ভয়ন্কর দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে, এখানে
আসার জন্য সে আমার উপড় চরম অসুন্তস্ট । সুযোগে পেলেই আমাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে
ফেলবে। আমি লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । বড় বড় দৃস্টিতে ওর দিকে
তাকিয়ে মুখ দিয়ে গোৎ গোৎ শব্দ করতে করতে কাঁপতে লাগলাম । ইতি আমার এমন আচড়নে
ভয় পেয়ে গেল । দৌড়ে এসে আমার দুকাধ ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, রন্জু ভাই, এ্যই
রঞ্জু ভাই, কি হয়েছে ? কি হয়েছে আপনার ? আমি একটা আঙুল তুলে দরজার বাইরে
দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখালাম । কুৎসিত লোকটার দৃস্টির কোন পরিবর্তন হয়নি । সেই
একই দৃস্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মল্লিক সাহেব আমার আঙুল বরাবর তাকিয়ে কি
দেখলেন বুঝলাম না । সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গেলের আলমিরার কাছে, একটানে
আলমিরাটার খুলে তার ভেতর থেকে একটা শিশি বের করে ভেতরে থাকা একটা তরল পদার্থ
ছুরে দিলেন দরজার বাইরে । সঙ্গে সঙ্গে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার শরীর
মুচড়ে উঠল । এবং সাথে সাথে মিলিয়ে গেল । মৌল্লিক সাহেব আমার শরীরে শিশিটা
থেকে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ছুড়ে মারলেন । আতরের সুগন্ধিতে পুরো ঘর যেন মৌ মৌ করে
উঠল । হঠাৎ শীতটা চলে গেল আমি আরাম বোধ করায় বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলাম ।


মল্লিক সাহেব ইতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও এখন ঘুমাবে । আমার কিছু জরুরী কাজ এর
মধ্যে সেরে নিতে হবে । তুমি রান্না ঘরে গিয়ে গরম পানি বসাও ।


*সাত*


স্বপ্নে কুচকুচে কালো বিষাক্ত একটা সাপ দেখে প্রচন্ড ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখলাম;
দীর্ঘ একটা সাপ আমার ঘরের মেঝেতে কুন্ডুলি পাকিয়ে ফর্ণা তুলে বসে আছে ছোবল মারার
জন্য। আমি হাত পা গুটিয়ে বিছানায় বসে চিৎকার করছি । সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে
তার লম্বা কালো কুচকুচে জ্বিবটা বারংবার বের করছে আর ভেতরে নিচ্ছে । সাপটা আমার
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাকে নড়াচড়া করতে না দেখে যেন অস্থির হয়ে উঠল ।
তারপর খুব ধীরেধীরে বিছানা বেয়ে উঠতে উঠতে আমার মুখে বিষ ছুড়ে মারল । প্রচন্ড
আতন্কে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম ।


চোখ খুলে বুঝতে বেশ কস্ট হলো আমি কোথায় আছি । ঘরে অল্প আলোর একটা বাতি জ্বলছে ।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ । হঠাৎ মনে পরে গেল সব । আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ইতিকে
খুঁজতে লাগলাম । ঘরের মেঝেতে আঁকা বৃত্তটার মধ্যে গোল হয়ে তিনজন লোক আসন ঘেরে
অনেকটা ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে আছে । সবার হাটুর উপর দুহাত রাখা ।
একজন বিরবির করে কিছু একটা মন্ত্র পড়ছে আর পাশে রাখা একটা বোতল থেকে পানি
জাতীয় কিছু একটা একটু পর পর ছিটিয়ে দিচ্ছে । ভাল করে তাকাতেই মল্লিক সাহেবকে
চিনতে পারলাম । আমাকে উঠে বসতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার দিকে একটা হাত বারিয়ে
দিয়ে বললেন, এসো, আমার কাছে এসো । আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । হঠাৎ মনে
হলো, মাথার ভেতটা ক্যামন শূণ্য হয়ে গেছে । আমি আমার অতীত,বর্তমান কিছুই মনে করতে
পারছি না। মাথার ভেতরে ভোতা একটা যন্ত্রনা হচ্ছে । আমি আবারও ইতিকে দেখার জন্য
এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । মল্লিক সাহেব আবার ডাকতেই আমি তার দিকে তাকিয়ে
বললাম, পানি খাব। তিনি তার সামনে বসা একজনের দিকে তাকাতেই লোকটা উঠে এক
গ্লাস পানি এনে দিল । আমি পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চমকে উঠে ছুড়ে ফেলে দিয়ে
ভয়ে কাঁপতে লাগলাম । আমার কাছে মনে হলো লোকটা এক গ্লাস তাজা রক্ত আমার হাতে
দিল । এবার মল্লিক সাহেব উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বৃত্তের মাঝে নিয়ে বসিয়ে
দিয়ে বললেন, তোমার কোন ভয় নেই । তোমার ভালর জন্যই আমরা এসব করছি। তারপর একটু
থেমে আমাকে ভালকরে দেখে নিয়ে বললেন, রন্জু তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ?
মল্লিক সাহেব কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর আমার মনে হলো আমি মাথা নাড়ালাম যে, হ্যা
আমি ওনার কথা বুঝতে পারছি ।
গুড, এখন আমি তোমাকে কয়েটা কথা বলবো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে । আমি আবারও মাথা
নাড়ালাম । মল্লিক সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন, আমাদের চারপাশে
প্রতিনিয়ত পার্থিব অপার্থিব অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায় । তাদের মধ্যে কোনটা ভাল আবার
কোনটা খারাপ । আমাদের জীবনে তাদের কোন ভূমিকা না থাকলেও কখনও সখনও আমাদের
উপড় কিছু খারাপ আত্মাদের দৃস্টি পরেতখন তারা আমাদের ক্ষতি করার চেস্টা করে ।
তোমার উপরেও ঠিক তেমনি একটি আত্মার দৃস্টি পরেছে । সে এখন তোমার চারপাশের
সবকিছু বিনিস্ট করে চলেছে । মাঝে মাঝে তুমি তাকে দেখতে পাও । ভয়ন্কর সে আত্মা
তোমাকে এখন মৃর্ত্যুর খুব কাছা কাছি নিয়ে এসেছে ।
রন্জু, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো ?
আমি ঘন ঘন মাথা নাড়লাম হ্যা, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি । সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়াল
চোখ দুটোর কথা আমার মনে পরে গেল । আমি ভয়ার্ত চোখে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালাম
আমাকে কেপে উঠতে দেখে মল্লিক সাহেব আমার কাধে একটা হাত রেখে আবারও বলতে
লাগলেন, আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি তোমার জন্য । তোমার কাছ থেকে সে অশুভ আত্মাকে
তাড়িয়ে দিতে । তোমার সাহায়্য দরকার । তুমি কি আমাদের সহায়তা করবে ? আমি আবারও
মাথা নাড়লাম, হ্যা আমি সহায়তা করবো ।
তোমার সঙ্গে অশুভ আত্মাটা আছে সে তৈরি হচ্ছে তোমার উপড় চুড়ান্ত আঘাত হানার জন্য ।
যে কোন সময় সে তোমার উপড় আঘাত হানবে । তবে তোমার ভয় নেই । আমরা আছি । তোমার
হয়ে এখন আমরা তার মোকাবেলা করবো । আর এর জন্য চাই তোমার সাহস এবং সহযোগীতা ।
আমি রাজি কি করতে হবে বলুন, আমি অনেকটা ধাতস্ত হয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে
বললাম ।
আমি যা বলব তা হুবুহু পালন করে যাবে । কিছুতেই এ বৃত্ত থেকে আমার নির্দেশ ছাড়া বের
হবে না । মনে রাখবে বৃত্ত থেকে বের হওয়া মনেই হচ্ছে তোমার মৃত্যু । মনে থাকবে
আমার কথা ?
জ্বি মনে থাকবে ,বলে আমি মাথা নাড়ালাম ।
আত্মাটা তোমাকে অনেক প্রলভন দেখাবে, আকুতি মিনতি করবে ভয় দেখাবে,তোমাকে এ বৃত্ত
থেকে বের করে নিতে চাইবে কিন্তু তুমি ভয় পাবে না । বৃত্ত থেকে কিছুতেই বের হবেনা
বুঝতে পেরেছো ? হঠাৎ আমার মনে পরলো ইতির কথা, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইতি কোথায়
? মল্লিক সাহেবকে মনে হলো একটু হাসলেন । তারপর আস্তে করে বললেন, ও বাসায় চলে
গেছে । ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না । ও ভাল আছে । আমি খুব শান্ত ভাবে
মাথা নাড়লাম । তারপর কি মনে করে মল্লিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঐ আত্মাটা
যদি ওকেও মেরে ফেলে ?
না, সে ভয় নেই । ইতি জানে কি ভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয় । তুমি এ পানিটুকু খেয়ে
চোখ বন্ধ করে থাকো । মল্লিক সাহেব ছোট একটা বোতল আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন ।
আমি বোতলটা হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটা ফেরত দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
মল্লিক সাহেব আবার ও মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন । এভাবে অনেকক্ষন কেটে গেল । আমার
কাছে মনে হলো আমি অনাধী অনন্ত কাল এভাবে বসে আছি । একসময় হঠাৎ মনে হলো,এসব
আমি কি করছি ? কাদের পাল্লায় পরলাম । আমি উঠে যাবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম ।
ঠিক সে সময়ই তীব্র শীতে আমার শরীর আবারও কেঁপে উঠল । আমি চোখ খুলে দেখি বৃত্তটার
মাঝখানে মাত্র একটা মোম বাতি জ্বলছে । দরজাটা হাট করে খোলা । দরজার বাইরে
দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়াল লোকটা । চোখ দু,টো থেকে আগের মতো আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে ।
আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, তুই এখানে ? উঠে আয় উঠে আয় বলছি ।
মল্লিক সাহেব আমার একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় পেয়ো না । ও এ বৃত্তর মধ্যে
আসতে পারবে না । আমি লোকটার উপড় থেকে চোখ সরাতে পারলাম না লোকটা মুখ বিকৃত
করে বলল, ভুলে গেছিস সওদার কথা ? আয়, চলে আয় বলছি । হঠাৎ মল্লিক সাহেব বলে
উঠলেন, যা ভাগ,ভাগ এখান থেকে । দূর হয়ে যা শয়তান ।
তুই, শয়তান, তুই দূর হয়ে যা । তুই মর । আমি তোর মাথা চিবিয়ে খাবো । দরজার কাছে
দাঁড়ানো লোকটা ভয়ন্কর ভাবে বলে উঠল । মল্লিক সাহেব কিছু না বলে আরো জোড়ে জোড়ে
মন্ত্র পড়তে লাগলেন । লোকট চলে যাবার পরিবর্তে বাতাসে ভেসে ঘরের ভেতর চলে এলো
তারপর বৃত্তটাকে এক নজর দেখে বিকট ভাবে হেসে উঠে বলল, ভেবেছিস এটা তোদের
রক্ষা করবে ? আয় আমার দলে যোগ দে , আমি তোদের তামাম পৃথিবী দিয়ে দেবো। আয়
আমার কাছে আয় । আমার কাছে সব আছে নিয়ে নে । নিয়ে নে । বলে লোকটা আবারও
হাসতে লাগল । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম । মনে হলো, উঠে এক দৌড়ৈ ঘর থেকে বের
হয়ে যাই । মল্লিক সাহেব আমার মনোভাব বুঝতে পেরে আবারও আমার হাত চেপে ধরে
বললেন, ভয় নেই , ওকে ভয় পাবার কিছু নেই । ও আমাদের একটা চুলও বাঁকা করতে পারবেনা ।
তাহলে দেখ, আমি কি পারি । বলেই লোকটা বৃত্তের ভেতর ঢুকার জন্য এগিয়ে এলো এবং
বৃত্তের উপড় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পেছনে পরে গেল । এবার মল্লিক সাহেব হেসে
উঠে বললেন, দেখলি দেখলি তোর দৌড় কতোখানি দেখলি ?
লোকটা কয়েক মূহুর্ত মাটিতে থম মেরে বসে রইল, তারপর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে
বলল, বা: বেশ জাল পেতেছিস তো ? বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার আকৃতি পরিবর্তন হয়ে
গেলো, লোকটা মুর্হুত্যের মধ্যে সদু ভাইয়ের রুপ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পরিস্কার শুদ্ব
ভায়ায় বলে উঠল, কি রাইটার সাব, আমার সঙ্গে আসবা না । আস; উঠে আস বলছি । এরা
তোমাকে মেরে ফেলবে আসো চলে আস । বলে সদু ভাই দুহাত বাড়ালেন । আমি মল্লিক
সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বোতল থেকে পানি ছুড়ে মারলেন । সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই
গুমরে কেদে উঠলেন । তারপর কান্না থামিয়ে গালাগালি করতে লাগলেন । আমি চোখ বন্ধ
করে ফেললাম । হঠাৎ ইতির কন্ঠ শুনে চোখ খুললাম । দরজাটা বাহীর থেকে ইতি ভেতরে
ঢোকার জন্য দরজাটা প্রচন্ড জোরে ধাক্কাচ্চে আর বলছে, রঞ্জু ভাই দরজা খুলুন, এ্যই রঞ্জু
ভাই দরজাটা খুলুন না । কোথাও সদু ভাই কিংবা লোকটাকে দেখতে পেলাম না । আমি দরজা
খোলার জন্য উঠতে যাচ্ছিলাম, মল্লিক সাহেব আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ওটা ইতি না
তুমি এখানেই বসে থাকো । আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম , মল্লিক সাহেব আমার
কানরে কাছে মুখ এনে বললেন , ওটা ইতি না । ইতি ভাল আছে ।
না , ওটা ইতির গলা দয়া করে ওকে ভেতরে আসতে দিন । শয়তানটা ওকে মেরে ফেলবে ।
আমি হাত ঝাড়া দিয়ে মল্লিক সাহেবের হাতটা ছাড়িয়ে দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দরজা
খুলে দিলাম। দরজায় ইতি দাড়িয়ে আছে । আমাকে দরজা খুলতে দেখেই হেসে বলল, আমার
প্রিয়, আমি জানতাম তুমি আমার ডাকে সারা দেবে । এসো আমার সঙ্গে । বলে, ইতি আমার
একটা হাত ধরল । আমার কাছে মনে হলো, আমার হাতে কেউ আগুনের ছেকা দিয়েছে আমি
আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলাম । ইতি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হলো ? ভয় পেয়েছো ?
এসো এসো আমার সঙ্গে । আমি দুপা পিছিয়ে এলাম । হঠাৎ আমার মনে হলো, এটা ইতি না
সেই লোকটা । আমি মল্লিক সাহেবের কাছে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমার গলাটা
প্রচন্ড জোড়ে চেপে ধরল ইতি । আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল । আমি দুচোখে অন্ধকার
দেখতে লাগলাম । এমন সময় পেছেন থেকে মল্লিক সাহেব পানি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এসে
বললেন, ছাড় ছাড় বলছি । ছেড়ে দে শয়তান । ছেড়ে দে ।
মুহুর্তে ইতির রুপ পরিবর্তন হয়ে গেল । আবার সেই আগের রুপ ধরে লোকটা আমাকে ছেড়ে
দিয়ে মল্লিক সাহেবের দিকে ছুটে গেল । বৃত্তের ভেতরে থাকা লোক দুটো আমাকে টেনে
বৃত্তের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে । লোকটা মল্লিক সাহেবকে মাটিতে ফেলে তার
বুকের উপড় চেপে বসেছে । আমাকে বৃত্তের ভেতর বসিয়ে দিয়েই লোক দুজন হাতে দুটো
লম্বা শাবল জাতীয় কিছু নিয়ে পেছন থেকে মল্লিক সাহেবর উপড় বসে থাকা লোকটা পিঠে
ঢুকিয়ে দিল । তারপর টান দিয়ে মাটিতে ফেলে শাবল দিয়ে মাটির সঙ্গে চেপে রাখল ।
মল্লিক সাহেব চোখের পলক উঠে বসে হাতের বোতলের পুরো পানিটা লোকটার শরীরের উড়র
ছিটিয়ে দিতে দিতে মন্ত্র পড়তে লাগলেন । আমি নিজের অজান্তেই আল্লাহু আকবর , আল্লাহু
আকবর; বলে চিৎকার করতে করতে উঠে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম । 

 ..::THE END::..


রাতের সিনেমা… (রোমাঞ্চকর অনুগল্প) [Ghost stories 46]




*লেখক নাম প্রকাশে আগ্রহী নন *

ছোটবেলা থেকেই আমার সিনেমা দেখার নেশা খুবই মারাত্মক। অজপাড়াগায়ে জন্ম। স্কুলে
যেতে হলে দু গাঁ ডিঙ্গিয়ে যেতে হয়। সবে মাত্র হাই ইস্কুলে উঠেছি। গাঁয়ের সিনিয়র
ছেলে পিলে যারা কলেজে গেছে তাদের কাছে সিনেমার গল্প শুনি। কোথায় কোন নায়ক কোন
নায়িকাকে নিয়ে পালিয়ে গেল, কোথায় কোন ভাঁড় কি বলে হাসালো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি
আর গোগ্রাসে গিলি। থাকি কাচারি ঘরে। সন্ধ্যের পর হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি।


রাতের গ্রাম। আটটা বাজতেই গভীর রাত নেমে আসে। আর তখন মনের ভেতর জেঁকে বসে
অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্ল্যান। কার গাছের নারকেল চুরি করব, অথবা কার খোয়াড়ের মুরগি,
তারপর এ নিয়ে পরদিন বন্ধুদের মাঝে কেমন করে বাহাদুরি দেখাব তা নিয়ে যত সব অদ্ভুত
চিন্তা।


শীতকাল এলে মাথা আরো খারাপ হয়ে যেত। চারদিকে তখন যাত্রাপালার আয়োজন। রাতে
দুরের কোন গাঁয়ে যাত্রা পালার খবর পেলে বাবা মাকে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি কাচারি
ঘরে বালিশ দিয়ে মানুষ বানিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে প্রক্সি দেয়ানো আর দলবেঁধে
রহিম-রুপবান, ভেলুয়া সুন্দরী বা একটি পয়সা জাতীয় যাত্রা পালা দেখা, তারপর কুয়াশা
ভেজা নাড়া ভরা মাঠের ওপর দিয়ে বিবেকের গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরায় ছিল অদ্ভুত
আকর্ষণ।


পাঠক বন্ধুরা ভাবছেন আমি কোন শতাব্দীর গল্প বলছি। আসলে আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর
আগের গ্রাম বাংলার কথাই বলছি, যা আজকের কম্পিউটার যুগে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে।
যা হোক আমার বাঁদরামোতে অস্থির হয়ে এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কাকাদের
প্রেরণায় বাবা মনস্থির করলেন আমাকে ঢাকায় রেখে ভাল হাইস্কুলে পড়াবেন।


যথাসময়ে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো পুরনো ঢাকার এক বনেদী স্কুলে।
পড়াশোনার সুবিধার্থে আমাকে রাখা হলো স্কুল হোস্টেলে। সুন্দর চারতলা হোস্টেল বিল্ডিং।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হোস্টেল সুপার স্যার অনেক রাশভারী এবং কড়া মেজাজের। প্রতিদিন
সন্ধ্যার পর একবার আসেন হোস্টেল ভিজিটে। ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ খবর নেন প্রতিটা
কামরার সামনে গিয়ে। সঙ্গি থাকেন ইয়া গোঁফ ওয়ালা দারোয়ান-মন্ত্রীকাকা। কে কবে কি
কারণে তার নাম মন্ত্রী রেখেছিল তা প্রত্নতাত্বিক গবেষনার বিষয়। তবে সুপার স্যারের
নির্দেশ পালনে সে ছিল স্যারের চেয়েও এক ডিগ্রী ওপরে। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যার
পর কোন ছাত্রের পক্ষে হোস্টেলের বাইরে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।


হোস্টেলে এসে সুপার স্যার আর মন্ত্রীকাকার কড়া তত্বাবধানে আমার নৈশ বিহারে পুরা
ভাটা পড়ল। তার ওপর স্কুলের পড়াশোনার চাপে অনেকটা সুবোধ গৃহপালিত বালকে পরিণত
হলাম। শুধু প্রতিদিন হোস্টেল থেকে স্কুলে রিক্সায় যাবার পথে সিনেমা হলের সামনে
দিয়ে যেতাম। খুব ইচ্ছে হত হূট করে নামে পড়ি। একটা হাল্কা দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে
চেপে ক্লাশে চলে যেতাম।


এর মাঝে রোজার ঈদের ছুটি এলো। স্কুল বন্ধ। হোস্টেলের আশেপাশের রুমের অনেকেই চলে
গেছে গ্রামের বাড়ি। আমিও যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সমস্যা বাধাল আমার সহযাত্রী আমার
জ্ঞাতি সম্পর্কের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কাকা। তার কি যেন কাজ পড়েছে, যেতে দু এক
দিন দেরি হবে। অতএব না চাইলেও অপেক্ষা। হাতে কোন কাজ নেই। পড়াশোনার ও চাপ
নেই। মনে মনে বুদ্ধি আঁটলাম সিনেমা দেখব। স্থির করলাম রাতের বেলা যখন মন্ত্রীকাকা
হোস্টেলের সামনের চা দোকানে চা খেতে যাবে তখন হোস্টেলের পেছনের দেয়াল টপকে
বের হয়ে যাব। সিনেমা শেষ হলে পেছন দিকের দেয়াল টপকে আবার ঢুকে পড়ব।


যেমন ভাবনা তেমন কাজ। রাত পৌনে নটার দিক পেছনের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বের হয়ে
পড়লাম। খুব সম্ভবতঃ কৃষ্ণপক্ষের কোন এক রাত। পা টিপে টিপে পেছনের গলি দিয়ে বড়
রাস্তার মুখে এসে রিক্সা নিলাম।একটু দুরের মহল্লার সিনেমা হলে এলাম যাতে পরিচিত
কারো নজরে না পড়ি। হলের সামনে এসে কি শান্তি। আহ! এতদিন পর সিনেমা দেখার
সুযোগ পেলাম! যাক এবার ঈদের ছুটিতে গিয়ে গ্রামের সহপাঠী বন্ধু বান্ধবদের কাছে
রাজা উজির মারা যাবে। বেশ খোশ মেজাজে নাইট শোর টিকেট কাটলাম। বেশ রোমান্টিক
একটা সিনেমা। ভালই লাগল। একটা ঘোরের মধ্যে সিনেমা দেখা শেষ করলাম।


শো শেষ হল। বেরিয়ে আশে পাশের রিক্সাওলাদের সাথে খোঁজ খবর নিলাম কেউ আমার
হোস্টেল অব্দি যাবে কিনা। কিন্তু বিধি বাম। কেউ ই ওদিকে যেতে রাজী হলনা। অনেক
খোঁজাখুঁজি করে হতাশ হয়ে অগত্যা শ্রীচরণ ভরসা করেই রওয়ানা দিলাম হোস্টেলের দিকে।
সুনশান রাস্তা। মাঝে মাঝে দু একটা রিক্সা টুং টাং বেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। আর
আমিএর মাঝে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের বিভিন্ন দৃশ্য ভাবতে ভাবতে আনমনে হাঁটছি।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় হোস্টেলে কাছাকাছি এসে গেছি। ঘোর কাটল হল্ট! আওয়াজে। চমকে
তাকিয়ে দেখি ট্রাফিক আইল্যান্ডটার ওপর সাদা পোষাক পরা ট্রাফিক আমার দিকে হাত
বাড়িয়ে থামার নির্দেশ দিচ্ছে।


অবাক হলাম এই মধ্যরাতে ট্রাফিক পুলিশ দেখে। ভাল করে দেখার জন্য আবার তাকালাম।
দেখি সত্যি ট্রাফিক পুলিশ। কিন্তু তার হাতের পাঁচটা আঙুল ইয়া মোটা মোটা। ভয় পেয়ে
গেলাম। ও মাগো! মনে হয় ভুত! চোখ বন্ধ করে উর্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম হোস্টেলের দিকে।
কি ভাবে দৌড়ে যে হোস্টেল গেটে পৌছালাম বলতে পারবো না।


গেটের সামনে এসে আতংকে জোরে জোরে গেট ঝাকাতে লাগলাম, মন্ত্রী কাকা! ও মন্ত্রী
কাকা! গেট খোলো!
এতরাতে আমাকে দেখে মন্ত্রীকাকা কিছুটা বিরক্ত হয়ে গেট খুললো। জিজ্ঞেস করল, এত
চেঁচামেচি করছ কেন?
বললাম, মন্ত্রী কাকা, এই মাত্র মোড়ের অই ট্রাফিক সিগনালে একটা ট্রাফিক ভুত
দেখলাম। হাতের পাঁচটা আঙুল ইয়া মোটা মোটা!
মন্ত্রী কাকা আমার মুখের সামনে তার হাত মেলে ধরে বললেন, দ্যাখ তো, এই পাঁচটা আঙুল
কিনা?
অবাক হয়ে দেখলাম মন্ত্রীকাকার পাঁচটা আঙুল ও ইয়া মোটা মোটা। চিৎকার দিয়ে জ্ঞান
হারালাম।


জ্ঞান যখন ফিরল দেখি আমি আমার বেডে। পাশে বসে আমার জ্ঞাতিকাকা। আমার জ্ঞান
ফিরেছে দেখে বললেন, কিরে অনিন্দ্য! কি হয়েছিল তোর। কাল রাতে নাকি তুই হোস্টেলের
গেটের কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি।
আমি তাকে সব কথা খুলে বললাম। সব শুনে তিনি বললেন, হ্যালুসিনেশন।
মন্ত্রী কাকা বললেন, আমি তো গেট ই খুলিনি। আমি গল্পটা সবার কাছে চেপে গেলাম। শুধু
মনে মনে বললাম যা দেখেছি তা আমি ই শুধু জানি। যদি সব হ্যালুসিনেশন ই হবে তাহলে
সিনেমা দেখলাম কিভাবে? আর হোস্টেলের গেট ই বা খুলে দিল কে? আজো ভাবি। কিন্তু
কোন হদিস পাইনা।
(পুনশ্চঃ গল্পটা এক বন্ধুর কাছে আংশিক শোনা বাকিটা কল্পনার রঙ মাখানো- লেখক)