*লেখক
–নাম
প্রকাশে আগ্রহী নন *
ছোটবেলা
থেকেই আমার সিনেমা দেখার নেশা
খুবই মারাত্মক। অজপাড়াগায়ে
জন্ম। স্কুলে
যেতে
হলে দু’
গাঁ
ডিঙ্গিয়ে যেতে হয়। সবে মাত্র
হাই ইস্কুলে উঠেছি। গাঁয়ের
সিনিয়র
ছেলে
পিলে যারা কলেজে গেছে তাদের
কাছে সিনেমার গল্প শুনি। কোথায়
কোন নায়ক কোন
নায়িকাকে
নিয়ে পালিয়ে গেল,
কোথায়
কোন ভাঁড় কি বলে হাসালো
মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি
আর
গোগ্রাসে গিলি। থাকি কাচারি
ঘরে। সন্ধ্যের পর হ্যারিকেন
জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি।
রাতের
গ্রাম। আটটা বাজতেই গভীর রাত
নেমে আসে। আর তখন মনের ভেতর
জেঁকে বসে
অদ্ভুত
অদ্ভুত সব প্ল্যান। কার গাছের
নারকেল চুরি করব,
অথবা
কার খোয়াড়ের মুরগি,
তারপর
এ নিয়ে পরদিন বন্ধুদের মাঝে
কেমন করে বাহাদুরি দেখাব তা
নিয়ে যত সব অদ্ভুত
চিন্তা।
শীতকাল
এলে মাথা আরো খারাপ হয়ে যেত।
চারদিকে তখন যাত্রাপালার
আয়োজন। রাতে
দুরের
কোন গাঁয়ে যাত্রা পালার খবর
পেলে বাবা মাকে ফাঁকি দিয়ে
চুপি চুপি কাচারি
ঘরে
বালিশ দিয়ে মানুষ বানিয়ে কাঁথা
মুড়ি দিয়ে প্রক্সি দেয়ানো আর
দলবেঁধে
রহিম-রুপবান,
ভেলুয়া
সুন্দরী বা একটি পয়সা জাতীয়
যাত্রা পালা দেখা,
তারপর
কুয়াশা
ভেজা
নাড়া ভরা মাঠের ওপর দিয়ে বিবেকের
গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরায়
ছিল অদ্ভুত
আকর্ষণ।
পাঠক
বন্ধুরা ভাবছেন আমি কোন শতাব্দীর
গল্প বলছি। আসলে আজ থেকে কুড়ি
পঁচিশ বছর
আগের
গ্রাম বাংলার কথাই বলছি,
যা
আজকের কম্পিউটার যুগে অবিশ্বাস্য
বলে মনে হবে।
যা
হোক আমার বাঁদরামোতে অস্থির
হয়ে এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়
পড়ুয়া কাকাদের
প্রেরণায়
বাবা মনস্থির করলেন আমাকে
ঢাকায় রেখে ভাল হাইস্কুলে
পড়াবেন।
যথাসময়ে
আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো
পুরনো ঢাকার এক বনেদী স্কুলে।
পড়াশোনার
সুবিধার্থে আমাকে রাখা হলো
স্কুল হোস্টেলে। সুন্দর চারতলা
হোস্টেল বিল্ডিং।
পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন। হোস্টেল সুপার
স্যার অনেক রাশভারী এবং কড়া
মেজাজের। প্রতিদিন
সন্ধ্যার
পর একবার আসেন হোস্টেল ভিজিটে।
ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ খবর নেন
প্রতিটা
কামরার
সামনে গিয়ে। সঙ্গি থাকেন ইয়া
গোঁফ ওয়ালা দারোয়ান-মন্ত্রীকাকা।
কে কবে কি
কারণে
তার নাম মন্ত্রী রেখেছিল তা
প্রত্নতাত্বিক গবেষনার বিষয়।
তবে সুপার স্যারের
নির্দেশ
পালনে সে ছিল স্যারের চেয়েও
এক ডিগ্রী ওপরে। তার চোখ ফাঁকি
দিয়ে সন্ধ্যার
পর
কোন ছাত্রের পক্ষে হোস্টেলের
বাইরে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।
হোস্টেলে
এসে সুপার স্যার আর মন্ত্রীকাকার
কড়া তত্বাবধানে আমার নৈশ
বিহারে পুরা
ভাটা
পড়ল। তার ওপর স্কুলের পড়াশোনার
চাপে অনেকটা সুবোধ গৃহপালিত
বালকে পরিণত
হলাম।
শুধু প্রতিদিন হোস্টেল থেকে
স্কুলে রিক্সায় যাবার পথে
সিনেমা হলের সামনে
দিয়ে
যেতাম। খুব ইচ্ছে হত হূট করে
নামে পড়ি। একটা হাল্কা দীর্ঘশ্বাস
বুকের মাঝে
চেপে
ক্লাশে চলে যেতাম।
এর
মাঝে রোজার ঈদের ছুটি এলো।
স্কুল বন্ধ। হোস্টেলের আশেপাশের
রুমের অনেকেই চলে
গেছে
গ্রামের বাড়ি। আমিও যাবার
প্রস্তুতি নিচ্ছি। সমস্যা
বাধাল আমার সহযাত্রী আমার
জ্ঞাতি
সম্পর্কের বিশ্ববিদ্যালয়
পড়ুয়া কাকা। তার কি যেন কাজ
পড়েছে,
যেতে
দু’
এক
দিন
দেরি হবে। অতএব না চাইলেও
অপেক্ষা। হাতে কোন কাজ নেই।
পড়াশোনার ও চাপ
নেই।
মনে মনে বুদ্ধি আঁটলাম সিনেমা
দেখব। স্থির করলাম রাতের বেলা
যখন মন্ত্রীকাকা
হোস্টেলের
সামনের চা দোকানে চা খেতে যাবে
তখন হোস্টেলের পেছনের দেয়াল
টপকে
বের
হয়ে যাব। সিনেমা শেষ হলে পেছন
দিকের দেয়াল টপকে আবার ঢুকে
পড়ব।
যেমন
ভাবনা তেমন কাজ। রাত পৌনে
ন’টার
দিক পেছনের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে
বের হয়ে
পড়লাম।
খুব সম্ভবতঃ কৃষ্ণপক্ষের কোন
এক রাত। পা টিপে টিপে পেছনের
গলি দিয়ে বড়
রাস্তার
মুখে এসে রিক্সা নিলাম।একটু
দুরের মহল্লার সিনেমা হলে
এলাম যাতে পরিচিত
কারো
নজরে না পড়ি। হলের সামনে এসে
কি শান্তি। আহ!
এতদিন
পর সিনেমা দেখার
সুযোগ
পেলাম!
যাক
এবার ঈদের ছুটিতে গিয়ে গ্রামের
সহপাঠী বন্ধু বান্ধবদের কাছে
রাজা
উজির মারা যাবে। বেশ খোশ মেজাজে
নাইট শো’র
টিকেট কাটলাম। বেশ রোমান্টিক
একটা
সিনেমা। ভালই লাগল। একটা ঘোরের
মধ্যে সিনেমা দেখা শেষ করলাম।
শো
শেষ হল। বেরিয়ে আশে পাশের
রিক্সাওলাদের সাথে খোঁজ খবর
নিলাম কেউ আমার
হোস্টেল
অব্দি যাবে কিনা। কিন্তু বিধি
বাম। কেউ ই ওদিকে যেতে রাজী
হলনা। অনেক
খোঁজাখুঁজি
করে হতাশ হয়ে অগত্যা শ্রীচরণ
ভরসা করেই রওয়ানা দিলাম
হোস্টেলের দিকে।
সুনশান
রাস্তা। মাঝে মাঝে দু’
একটা
রিক্সা টুং টাং বেল বাজিয়ে
চলে যাচ্ছে। আর
আমিএর
মাঝে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের
বিভিন্ন দৃশ্য ভাবতে ভাবতে
আনমনে হাঁটছি।
হাঁটতে
হাঁটতে প্রায় হোস্টেলে কাছাকাছি
এসে গেছি। ঘোর কাটল “হল্ট!”
আওয়াজে।
চমকে
তাকিয়ে
দেখি ট্রাফিক আইল্যান্ডটার
ওপর সাদা পোষাক পরা ট্রাফিক
আমার দিকে হাত
বাড়িয়ে
থামার নির্দেশ দিচ্ছে।
অবাক
হলাম এই মধ্যরাতে ট্রাফিক
পুলিশ দেখে। ভাল করে দেখার
জন্য আবার তাকালাম।
দেখি
সত্যি ট্রাফিক পুলিশ। কিন্তু
তার হাতের পাঁচটা আঙুল ইয়া
মোটা মোটা। ভয় পেয়ে
গেলাম।
ও মাগো!
মনে
হয় ভুত!
চোখ
বন্ধ করে উর্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম
হোস্টেলের দিকে।
কি
ভাবে দৌড়ে যে হোস্টেল গেটে
পৌছালাম বলতে পারবো না।
গেটের
সামনে এসে আতংকে জোরে জোরে
গেট ঝাকাতে লাগলাম,
মন্ত্রী
কাকা!
ও
মন্ত্রী
কাকা!
গেট
খোলো!
এতরাতে
আমাকে দেখে মন্ত্রীকাকা কিছুটা
বিরক্ত হয়ে গেট খুললো। জিজ্ঞেস
করল,
এত
চেঁচামেচি
করছ কেন?
বললাম,
মন্ত্রী
কাকা,
এই
মাত্র মোড়ের অই ট্রাফিক সিগনালে
একটা ট্রাফিক ভুত
দেখলাম।
হাতের পাঁচটা আঙুল ইয়া মোটা
মোটা!
মন্ত্রী
কাকা আমার মুখের সামনে তার
হাত মেলে ধরে বললেন,
দ্যাখ
তো,
এই
পাঁচটা আঙুল
কিনা?
অবাক
হয়ে দেখলাম মন্ত্রীকাকার
পাঁচটা আঙুল ও ইয়া মোটা মোটা।
চিৎকার দিয়ে জ্ঞান
হারালাম।
জ্ঞান
যখন ফিরল দেখি আমি আমার বেডে।
পাশে বসে আমার জ্ঞাতিকাকা।
আমার জ্ঞান
ফিরেছে
দেখে বললেন,
কিরে
অনিন্দ্য!
কি
হয়েছিল তোর। কাল রাতে নাকি
তুই হোস্টেলের
গেটের
কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি।
আমি
তাকে সব কথা খুলে বললাম। সব
শুনে তিনি বললেন,
হ্যালুসিনেশন।
মন্ত্রী
কাকা বললেন,
আমি
তো গেট ই খুলিনি। আমি গল্পটা
সবার কাছে চেপে গেলাম। শুধু
মনে
মনে বললাম যা দেখেছি তা আমি
ই শুধু জানি। যদি সব হ্যালুসিনেশন
ই হবে তাহলে
সিনেমা
দেখলাম কিভাবে?
আর
হোস্টেলের গেট ই বা খুলে দিল
কে?
আজো
ভাবি। কিন্তু
কোন
হদিস পাইনা।
(পুনশ্চঃ
গল্পটা এক বন্ধুর কাছে আংশিক
শোনা বাকিটা কল্পনার রঙ মাখানো-
লেখক)
No comments:
Post a Comment