Sunday, June 10, 2012

চতুরঙ্গ-(১০ম পর্ব) [Ghost Stories - p10 ]




চতুরঙ্গ-(১০ম পর্ব)

লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]


আমি আতংকে পিছিয়ে ট্যাক্সির দরজায় সেঁটে গেলাম। দরজা খুলে যে পালাবো সে কথাও মনে পড়ল না।
জয়নাব আরা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, “ কি ব্যাপার? ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। জমে গেছি যেন।
একটা হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরলেন, বরফের মত ঠান্ডা। হাসলেন, “ আমাকে ভয় পেও না। স্বাভাবিক হও।
আমি এতই ভয় পেয়েছি যে ওনার হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়াতেও পারলাম না।
সামনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই এত জ্যাম।বাহিরের বৃষ্টি হতে থাকা বিশাল জ্যামটার দিকে তাকালেন, “ তুমি ঘুমিয়ে পড়ছিলে দেখে চিন্তা হল। একা একা এভাবে বের হওয়া ঠিক না।জয়নাব আরা ফিরলেন আমার দিকে, “ ভিজে গেছো দেখি। ঠান্ডা বাঁধবে তো!আমি ভয় এবং বিষ্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম উনি ওনার শাড়ির আচোঁলের এক প্রান্ত দিয়ে আমার হাত, মুখ, মাথা মুছে দিতে লাগলেন...... যেন কোনো মা তার ছোট বাচ্চাকে বৃষ্টিতে ভেজার পর আচোঁল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন......
হীম শীতল হাত গুলোর স্পর্শ্বটুকু বাদ দিলে আমার ভয় পাওয়ার মত কিছুই ছিল না। উনি আমার আমার মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন, “ এত বড় একটা মেয়েকে কোন আক্কেলে এই ঝড় বাদলের রাতে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছে এমরান? ওর কান্ড জ্ঞান দেখি দিন দিন লোপ পাচ্ছে! ড্রাইভার দিয়ে বাড়ি পৌছে দেয়া যেত না? নাসের ভাই তো সারাদিন বেকার বসেই থাকেন। আমি নেই, এমরানেরও বোধ বুদ্ধি কমা শুরু করেছে!
আমি ঘোরের মধ্যে ডুবে আছি। আতংক আর মমতা- এ দুটোকে আলাদা করে চেনার মত ক্ষমতাটুকু কাজ করছে না। প্যারালাইজড রোগীর মত দরজার গায়ে এলিয়ে আছি স্পন্দনহীনভাবে।
এমরানকে বলবে আমি বলেছি যে তোমাকে বিকেল পাঁচটার পর ছুটি দিয়ে দিতে। রাত আটটা পর্যন্ত কিসের এত কাজ?” কঠোর গলায় বললেন জয়নাব আরা।
জ্যামের মধ্যে গাড়িটা নড়তে শুরু করেছে। খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে শামুকের মত গতিতে। বড় সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সামনে। আমাদের গাড়িটা সেটার পাশ কাটানোর সময় দেখলাম একটা মাইক্রোবাস পুরো থ্যাঁতলে গেছে একটা ট্রাকের বাড়ি খেয়ে। কেউ বাঁচেনি মনে হচ্ছে। দেখলাম অ্যাম্বুল্যান্সে লাশ তোলা হচ্ছে সাদা কপড়ে ঢেকে। বৃষ্টি হচ্ছে খুব।ড্রাইভারকে বলতে শুনলাম, “ ইসসিরে! দুইটা ছোট বাচ্চাও মরছে! আল্লায় যে কারে কখন তুইল্যা নেয়।
জয়নাব আরা কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি ঢোক গিললাম। ড্রাইভার কি জয়নাব আরাকে দেখতে পাচ্ছে?
রাতের নিকশ কালো অন্ধকারের মাঝ দিয়ে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গাড়িটা ছুটে চলেছে। অজানা একটা ভয় আর বোধহীন শূণ্যতা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার ভেতরটায়।
আমাদের এলাকাটার সামনে এসে যখন ট্যাক্সিটা থামল জয়নাব আরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বললেন, “ যাও। তোমার বাসায় ফেরাটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। সন্ধ্যার পর বাহিরে থেকো না।কেমন?”
আমি যন্ত্রের মত দরজা খুলে নেমে গেলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়ে হাত গুলো কাঁপছিল। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আবার। পেছনের জানালাটার দিকে তাকালাম। জয়নাব আরা এখনো বসে আছেন, স্নেহ ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন; আমি তাকানো মাত্র আবার বলে উঠলেন, “ ভিজে যাচ্ছো তো! তাড়াতাড়ি যাও!
আমি মাথায় ওড়না দিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। চাবি দেয়া পুতুলের মত বাসার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। পেছন দিকে ফিরে তাকাবার সাহস আমি হারিয়ে ফেলেছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
বাসায় যেতে দুটো গলি পরে রাস্তায়।
মাত্র একটা গলি ঘুরেছি সামনে দেখলাম একটা ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ লাইটের নিচে নীল শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা গেল জাহিদ।
আমাকে দেখেই দাঁতগুলো সব বের করে হাসল, “ বাসায় ঠিক মত এসেছো কিনা দেখতে এলাম। টিউশ্যনি শেষ হতেই এক দৌড়ে এখানে।বৃষ্টিতে অনেক্ষণ ধরেই ভিজছে, শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে ওর।
জাহিদকে হঠাৎ এখানে দেখে যতটা না অবাক হলাম, তার চেয়ে খুশি হলাম অনেক বেশি। প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু ওকে দেখা মাত্র ভয়টা দূর হয়ে গেল মুহূর্তেই। যদিও কোনো কথা বলতে পারলাম না, কেবল বললাম, “ভাল করেছো।
হাটতে লাগলাম দুজন। জাহিদ বলল, “ ফোনে তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছিল খুব টেনস্ড তুমি।তাই ভাবলাম দেখে যাই। তোমার জে.এম.বি. খালা তো আর এত রাতে ঘরে ঢুকতে দেবে না, তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
সাবধানে হাটো। এখানে জায়গায় জায়গায় ম্যানহলের ঢাকনা নেই। চোরে নিয়ে যায়।ল্যাম্প পোষ্টের লাইটও চুরি যায় লাগাতে না লাগাতেই।
এক গাল হেসে আমার হাত ধরল জাহিদ, “ অসুবিধা নাই। ম্যানহলে পড়লে তুমি ওম্যান আছো, টেনে তুলবে।
আমার অত শক্তি নেই যে তোমার মত হাতি টেনে ম্যানহল থেকে বের করবো।কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু ম্যানহলে পড়ে যাবে এইভয়ে ওর শার্টের একটা অংশ মুঠো করে ধরে রাখলাম। সেটা দেখে জাহিদ উদাস গলায় ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ বাল্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ বেগাম, জগতের শেষ ল্যাম্প পোষ্টের বাল্বটা চুরি যাওয়ার পরেও আমি হারিকেন জ্বালিয়ে তোমার পাশে পাশে এভাবে শার্ট ধরিয়ে হাটবো...... কারণ, তোমার পাশে হাটতে আমার বড় ভাল লাগে! মনে হয় যেন বয়সটা একুশের ঘরে আটকে আছে এখনো!
আমি অন্য সময় হলে হাসতাম, আজ হাসতে পারলাম না।

¤¤ চলবে ¤¤

চতুরঙ্গ-(১১তম পর্ব) [Ghost Stories -p11 ]



চতুরঙ্গ-(১১তম পর্ব)

লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

স্যার আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো আমি। প্লিজ জবাবটা দেবেন।
কি প্রশ্ন?” নামায পড়ার কাঠের চেয়ারটায় বসেছিলেন। অবাক হয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখলেন। নামায শেষ হয়েছে। এতক্ষণ
 নামায পড়ছিলেন দেখে বাহিরে করিডোরে পায়চারি করছিলাম অস্থির ভাবে। বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলাম নামায শেষ হয়েছে কিনা। গত রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি আমার। সারা রাত মিথিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অজানা একটা ভয়ে সারাক্ষণ কাঁপছিলাম। দুচোখের পাতা এককরতে পারিনি এক মুহূর্তের জন্য।
ডাঃ এমরান দাঁড়িতে আঙ্গুল বুলালেন কৌতুহলি মুখে, আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ কি প্রশ্ন? এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
স্যার, আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা সম্পর্কে বলুন প্লিজ। জয়নাব আরার মৃত্যু সম্পর্কে জানা ভীষণ প্রয়োজন আমার।রীতিমত অনুনয়মেশানো গলায় বললাম।
ডাঃ এমরান গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রশ্নটা শুনে। আর চোখে দেয়ালে ঝোলানো তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকালেন, কাঁশলেন, “ হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
স্যার প্লিজ বলুন। আমি নয়ত পাগল হয়ে যাব!মিনতি ভরা কন্ঠে বললাম। আমার ধারণা আমি তাঁকে দেখেছি গতকাল সন্ধ্যায়।
আমার কথা শুনে সামান্য তম চমকালেন না তিনি। কেবল গম্ভীর মুখে হাতের নখ দেখতে লাগলেন।
“ It was just an ordinary road accident. nothing to explain. গাড়ি আমি ড্রাইভ করছিলাম সেদিন। নাসের অসুস্থ ছিল। তাই গাড়ি আমাকেইড্রাইভ করতে হয়েছিল। সেটাই কাল হল। সঙ্গে ছিল জয়নাব। একটা ব্রীজ পাড় করার সময় অন্য দিক থেকে আসা কারের হেড লাইটের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আমি ড্রাইভিং-এ কাঁচা ছিলাম। ব্যস, যা হবার হয়ে গেল। ফলাফল তোমার সামনেইদেখতে পাচ্ছো। আমি হুইল চেয়ারে বন্দী, জয়নাব দেয়ালে ফ্রেমে বন্দী।ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।
ব্যস? এটুকুই?” আমি নিজের পায়ের ওপর ভর রাখতে পারছিলামনা, একটা টুল টেনে বসে পরলাম।
হুম। আর কিছুই নেই।টেবিল থেকে একটা কোরআনের তাফসির বইতুলে নিলেন। স্পষ্ট বোঝা গেলআমাকে চলে যেতে ইঙ্গিত করছেন।আমি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালাম, মুখের ওপর এসে পরা চুল গুলোকে কানের পেছনে পাঠিয়ে দিলাম, “ স্যার, আমি প্রচন্ড মানসিক সমস্যায় ভূগছি মে বি। আমি জানি না এর থেকে পরিত্রাণের উপায়টা কি।দরজার দিকে হাটা লাগালাম।
হঠাৎ শুনলাম পেছন থেকে ডাঃ এমরান বলছেন, “ আচ্ছা নোভেরা, বলতে পারো ধর্মের উৎপত্তি কোত্থেকে?”
ফিরে তাকালাম অবাক হয়ে, মাথা নাড়ালাম, “ জানি না স্যার।
যেখানে বিজ্ঞানের সমাপ্তি, সেখান থেকেই ধর্মের শুরু। তুমি বিজ্ঞাকে স্বীকৃতি দিতে পারো, অথচ ধর্মকে কেন নয়? তুমি প্রাইমারি স্কুল পড়বে অথচ হাই স্কুলে যাবে না-কেমন দেখাবে? ইদানীং কালে চারপাশে খুব বেশি নাস্তিক ছেলে মেয়েদের দেখা যাচ্ছে- কেন বলতে পারো?”
জানি না স্যার।বিমূঢ়ের মতএকই উত্তর দিলাম।
জ্ঞান অর্ধেক কিংবা অপূর্ণথাকায়। স্বল্প জ্ঞান নিয়ে এরা ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে যায়- এবং ব্যাখ্যা করতে না পেরে স্রষ্টা ও ধর্ম- দুটোকেই অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়। এরা নিজেরাই বিভ্রান্ত এদের স্বল্প জ্ঞান নিয়ে। যারকারণে সরল অংক করতে গিয়ে এরা মাঝ পথে আটকে যায় এবং বলে অংকে ভূল আছে। তার যোগ বিয়োগ জানায় যে ভূল আছে সেটাই বোঝে না। সেটাকে ঢাকতেই নাস্তিকতা বাদের এত চর্চা। দুনিয়াতে সব বড় বড় বিজ্ঞানীদের তুমি আস্তিক হিসেবে পাবে। কিন্তু বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখবে কট্টর নাস্তিক হিসেবে। যারা নিজেদের অজান্তেই তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু নাস্তিক ছাত্র-ছাত্রী প্রসব করছে। বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? বর্তমানে গ্লোবাল ভিলেজ র‍্যাভুলিউশনের মত এটাও গ্লোবালাইজেশনের পর্যায়ে পড়ে গেছে। তাতে বোঝা যাছে শূণ্য কলস বিদ্যাধারী স্টুডেন্টদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বিজ্ঞানের অক্ষমতাকে এরা অস্ত্র বানিয়ে ধর্মকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছে-কিন্তু সেটা কতটুকু যৌক্তিক?”
আমি হঠাৎ করেই হেসে ফেললাম।
ডাঃ এমরান ভ্রুঁ কোঁচকালেন, “হাসছো কেন?”
আপনাকে দেখে হঠাৎ ডাঃ জাকির নায়েকের কথা মনে পরে গেল। ওনার কথা বলার ধরনটা অনেকটা আপনার মত।
হাতের বইটা টেবিলের ওপর রেখেহতাশ ভাবে মাথা নাড়ালেন ডাঃ এমরান, “ সিরিয়াস কথার মাঝ খানে তোমরা যে কিভাবে হাসতে পারো!
স্যরি স্যার।অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।হুম........ বসো।টুলটা ইঙ্গিতকরলেন। আমি এসে বসার পর উনি বলা শুরু করলেন-
তোমাকে কথা গুলো বলার পেছনে কারণ ছিল। তাই বলেছি। কারণ তুমি দুনিয়াতে খুব অদ্ভূত কিছু কিছু জিনিস দেখবে- যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে পাবে না। কিন্তু বিজ্ঞান তোমাকে ব্যাখ্যা না দিতে পারলেও ধর্ম তোমাকে সেটার ব্যাখ্যা এনে দেবে। আমার জীবনে সেরকম কিছু ঘটনা ঘটেছিল যার ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ করার মত ইচ্ছা জাগেনি মনে। সব কিছুর ব্যাখ্যা থাকতে হবে- এটা দাবি করা অন্যায়। যদি না সে ব্যাখ্যাটা গ্রহণ করার মত পূর্ণ জ্ঞান তোমার থাকে। জগতের স্রোত খুব বিচিত্র।দম নিলেন। কাঠের চেয়ারটায় বসে থাকায় হেলান দিয়ে বসছেন না। পিঠ সোজা করে বসে আছেন।

( চলবে )