চতুরঙ্গ-(১০ম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব
[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]
আমি আতংকে পিছিয়ে ট্যাক্সির দরজায় সেঁটে গেলাম। দরজা খুলে যে পালাবো সে কথাও মনে পড়ল না।
জয়নাব আরা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, “ কি ব্যাপার? ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। জমে গেছি যেন।
একটা হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরলেন, বরফের মত ঠান্ডা। হাসলেন, “ আমাকে ভয় পেও না। স্বাভাবিক হও।”
আমি এতই ভয় পেয়েছি যে ওনার হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়াতেও পারলাম না।
“ সামনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই এত জ্যাম।” বাহিরের বৃষ্টি হতে থাকা বিশাল জ্যামটার দিকে তাকালেন, “ তুমি ঘুমিয়ে পড়ছিলে দেখে চিন্তা হল। একা একা এভাবে বের হওয়া ঠিক না।” জয়নাব আরা ফিরলেন আমার দিকে, “ ভিজে গেছো দেখি। ঠান্ডা বাঁধবে তো!” আমি ভয় এবং বিষ্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম উনি ওনার শাড়ির আচোঁলের এক প্রান্ত দিয়ে আমার হাত, মুখ, মাথা মুছে দিতে লাগলেন...... যেন কোনো মা তার ছোট বাচ্চাকে বৃষ্টিতে ভেজার পর আচোঁল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন......
হীম শীতল হাত গুলোর স্পর্শ্বটুকু বাদ দিলে আমার ভয় পাওয়ার মত কিছুই ছিল না। উনি আমার আমার মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন, “ এত বড় একটা মেয়েকে কোন আক্কেলে এই ঝড় বাদলের রাতে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছে এমরান? ওর কান্ড জ্ঞান দেখি দিন দিন লোপ পাচ্ছে! ড্রাইভার দিয়ে বাড়ি পৌছে দেয়া যেত না? নাসের ভাই তো সারাদিন বেকার বসেই থাকেন। আমি নেই, এমরানেরও বোধ বুদ্ধি কমা শুরু করেছে!”
আমি ঘোরের মধ্যে ডুবে আছি। আতংক আর মমতা- এ দুটোকে আলাদা করে চেনার মত ক্ষমতাটুকু কাজ করছে না। প্যারালাইজড রোগীর মত দরজার গায়ে এলিয়ে আছি স্পন্দনহীনভাবে।
“ এমরানকে বলবে আমি বলেছি যে তোমাকে বিকেল পাঁচটার পর ছুটি দিয়ে দিতে। রাত আটটা পর্যন্ত কিসের এত কাজ?” কঠোর গলায় বললেন জয়নাব আরা।
জ্যামের মধ্যে গাড়িটা নড়তে শুরু করেছে। খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে শামুকের মত গতিতে। বড় সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সামনে। আমাদের গাড়িটা সেটার পাশ কাটানোর সময় দেখলাম একটা মাইক্রোবাস পুরো থ্যাঁতলে গেছে একটা ট্রাকের বাড়ি খেয়ে। কেউ বাঁচেনি মনে হচ্ছে। দেখলাম অ্যাম্বুল্যান্সে লাশ তোলা হচ্ছে সাদা কপড়ে ঢেকে। বৃষ্টি হচ্ছে খুব।ড্রাইভারকে বলতে শুনলাম, “ ইসসিরে! দুইটা ছোট বাচ্চাও মরছে! আল্লায় যে কারে কখন তুইল্যা নেয়।”
জয়নাব আরা কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি ঢোক গিললাম। ড্রাইভার কি জয়নাব আরাকে দেখতে পাচ্ছে?
রাতের নিকশ কালো অন্ধকারের মাঝ দিয়ে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গাড়িটা ছুটে চলেছে। অজানা একটা ভয় আর বোধহীন শূণ্যতা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার ভেতরটায়।
আমাদের এলাকাটার সামনে এসে যখন ট্যাক্সিটা থামল জয়নাব আরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বললেন, “ যাও। তোমার বাসায় ফেরাটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। সন্ধ্যার পর বাহিরে থেকো না।কেমন?”
আমি যন্ত্রের মত দরজা খুলে নেমে গেলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়ে হাত গুলো কাঁপছিল। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আবার। পেছনের জানালাটার দিকে তাকালাম। জয়নাব আরা এখনো বসে আছেন, স্নেহ ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন; আমি তাকানো মাত্র আবার বলে উঠলেন, “ ভিজে যাচ্ছো তো! তাড়াতাড়ি যাও!”
আমি মাথায় ওড়না দিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। চাবি দেয়া পুতুলের মত বাসার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। পেছন দিকে ফিরে তাকাবার সাহস আমি হারিয়ে ফেলেছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
বাসায় যেতে দুটো গলি পরে রাস্তায়।
মাত্র একটা গলি ঘুরেছি – সামনে দেখলাম একটা ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ লাইটের নিচে নীল শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা গেল – জাহিদ।
আমাকে দেখেই দাঁতগুলো সব বের করে হাসল, “ বাসায় ঠিক মত এসেছো কিনা দেখতে এলাম। টিউশ্যনি শেষ হতেই এক দৌড়ে এখানে।” বৃষ্টিতে অনেক্ষণ ধরেই ভিজছে, শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে ওর।
জাহিদকে হঠাৎ এখানে দেখে যতটা না অবাক হলাম, তার চেয়ে খুশি হলাম অনেক বেশি। প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু ওকে দেখা মাত্র ভয়টা দূর হয়ে গেল মুহূর্তেই। যদিও কোনো কথা বলতে পারলাম না, কেবল বললাম, “ভাল করেছো।”
হাটতে লাগলাম দুজন। জাহিদ বলল, “ ফোনে তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছিল খুব টেনস্ড তুমি।তাই ভাবলাম দেখে যাই। তোমার জে.এম.বি. খালা তো আর এত রাতে ঘরে ঢুকতে দেবে না, তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“ সাবধানে হাটো। এখানে জায়গায় জায়গায় ম্যানহলের ঢাকনা নেই। চোরে নিয়ে যায়।ল্যাম্প পোষ্টের লাইটও চুরি যায় লাগাতে না লাগাতেই।”
এক গাল হেসে আমার হাত ধরল জাহিদ, “ অসুবিধা নাই। ম্যানহলে পড়লে তুমি ওম্যান আছো, টেনে তুলবে।”
“ আমার অত শক্তি নেই যে তোমার মত হাতি টেনে ম্যানহল থেকে বের করবো।” কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু ম্যানহলে পড়ে যাবে এইভয়ে ওর শার্টের একটা অংশ মুঠো করে ধরে রাখলাম। সেটা দেখে জাহিদ উদাস গলায় ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ বাল্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ বেগাম, জগতের শেষ ল্যাম্প পোষ্টের বাল্বটা চুরি যাওয়ার পরেও আমি হারিকেন জ্বালিয়ে তোমার পাশে পাশে এভাবে শার্ট ধরিয়ে হাটবো...... কারণ, তোমার পাশে হাটতে আমার বড় ভাল লাগে! মনে হয় যেন বয়সটা একুশের ঘরে আটকে আছে এখনো!”
আমি অন্য সময় হলে হাসতাম, আজ হাসতে পারলাম না।
¤¤ চলবে ¤¤
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব
[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]
আমি আতংকে পিছিয়ে ট্যাক্সির দরজায় সেঁটে গেলাম। দরজা খুলে যে পালাবো সে কথাও মনে পড়ল না।
জয়নাব আরা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, “ কি ব্যাপার? ভয় পাচ্ছো আমাকে?”
আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। জমে গেছি যেন।
একটা হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরলেন, বরফের মত ঠান্ডা। হাসলেন, “ আমাকে ভয় পেও না। স্বাভাবিক হও।”
আমি এতই ভয় পেয়েছি যে ওনার হাত থেকে আমার হাতটা ছাড়াতেও পারলাম না।
“ সামনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই এত জ্যাম।” বাহিরের বৃষ্টি হতে থাকা বিশাল জ্যামটার দিকে তাকালেন, “ তুমি ঘুমিয়ে পড়ছিলে দেখে চিন্তা হল। একা একা এভাবে বের হওয়া ঠিক না।” জয়নাব আরা ফিরলেন আমার দিকে, “ ভিজে গেছো দেখি। ঠান্ডা বাঁধবে তো!” আমি ভয় এবং বিষ্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম উনি ওনার শাড়ির আচোঁলের এক প্রান্ত দিয়ে আমার হাত, মুখ, মাথা মুছে দিতে লাগলেন...... যেন কোনো মা তার ছোট বাচ্চাকে বৃষ্টিতে ভেজার পর আচোঁল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন......
হীম শীতল হাত গুলোর স্পর্শ্বটুকু বাদ দিলে আমার ভয় পাওয়ার মত কিছুই ছিল না। উনি আমার আমার মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন, “ এত বড় একটা মেয়েকে কোন আক্কেলে এই ঝড় বাদলের রাতে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছে এমরান? ওর কান্ড জ্ঞান দেখি দিন দিন লোপ পাচ্ছে! ড্রাইভার দিয়ে বাড়ি পৌছে দেয়া যেত না? নাসের ভাই তো সারাদিন বেকার বসেই থাকেন। আমি নেই, এমরানেরও বোধ বুদ্ধি কমা শুরু করেছে!”
আমি ঘোরের মধ্যে ডুবে আছি। আতংক আর মমতা- এ দুটোকে আলাদা করে চেনার মত ক্ষমতাটুকু কাজ করছে না। প্যারালাইজড রোগীর মত দরজার গায়ে এলিয়ে আছি স্পন্দনহীনভাবে।
“ এমরানকে বলবে আমি বলেছি যে তোমাকে বিকেল পাঁচটার পর ছুটি দিয়ে দিতে। রাত আটটা পর্যন্ত কিসের এত কাজ?” কঠোর গলায় বললেন জয়নাব আরা।
জ্যামের মধ্যে গাড়িটা নড়তে শুরু করেছে। খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে শামুকের মত গতিতে। বড় সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সামনে। আমাদের গাড়িটা সেটার পাশ কাটানোর সময় দেখলাম একটা মাইক্রোবাস পুরো থ্যাঁতলে গেছে একটা ট্রাকের বাড়ি খেয়ে। কেউ বাঁচেনি মনে হচ্ছে। দেখলাম অ্যাম্বুল্যান্সে লাশ তোলা হচ্ছে সাদা কপড়ে ঢেকে। বৃষ্টি হচ্ছে খুব।ড্রাইভারকে বলতে শুনলাম, “ ইসসিরে! দুইটা ছোট বাচ্চাও মরছে! আল্লায় যে কারে কখন তুইল্যা নেয়।”
জয়নাব আরা কথাটা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি ঢোক গিললাম। ড্রাইভার কি জয়নাব আরাকে দেখতে পাচ্ছে?
রাতের নিকশ কালো অন্ধকারের মাঝ দিয়ে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গাড়িটা ছুটে চলেছে। অজানা একটা ভয় আর বোধহীন শূণ্যতা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার ভেতরটায়।
আমাদের এলাকাটার সামনে এসে যখন ট্যাক্সিটা থামল জয়নাব আরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বললেন, “ যাও। তোমার বাসায় ফেরাটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। সন্ধ্যার পর বাহিরে থেকো না।কেমন?”
আমি যন্ত্রের মত দরজা খুলে নেমে গেলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়ে হাত গুলো কাঁপছিল। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আবার। পেছনের জানালাটার দিকে তাকালাম। জয়নাব আরা এখনো বসে আছেন, স্নেহ ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন; আমি তাকানো মাত্র আবার বলে উঠলেন, “ ভিজে যাচ্ছো তো! তাড়াতাড়ি যাও!”
আমি মাথায় ওড়না দিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম। চাবি দেয়া পুতুলের মত বাসার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। পেছন দিকে ফিরে তাকাবার সাহস আমি হারিয়ে ফেলেছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
বাসায় যেতে দুটো গলি পরে রাস্তায়।
মাত্র একটা গলি ঘুরেছি – সামনে দেখলাম একটা ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ লাইটের নিচে নীল শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখেই বোঝা গেল – জাহিদ।
আমাকে দেখেই দাঁতগুলো সব বের করে হাসল, “ বাসায় ঠিক মত এসেছো কিনা দেখতে এলাম। টিউশ্যনি শেষ হতেই এক দৌড়ে এখানে।” বৃষ্টিতে অনেক্ষণ ধরেই ভিজছে, শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে ওর।
জাহিদকে হঠাৎ এখানে দেখে যতটা না অবাক হলাম, তার চেয়ে খুশি হলাম অনেক বেশি। প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু ওকে দেখা মাত্র ভয়টা দূর হয়ে গেল মুহূর্তেই। যদিও কোনো কথা বলতে পারলাম না, কেবল বললাম, “ভাল করেছো।”
হাটতে লাগলাম দুজন। জাহিদ বলল, “ ফোনে তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছিল খুব টেনস্ড তুমি।তাই ভাবলাম দেখে যাই। তোমার জে.এম.বি. খালা তো আর এত রাতে ঘরে ঢুকতে দেবে না, তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“ সাবধানে হাটো। এখানে জায়গায় জায়গায় ম্যানহলের ঢাকনা নেই। চোরে নিয়ে যায়।ল্যাম্প পোষ্টের লাইটও চুরি যায় লাগাতে না লাগাতেই।”
এক গাল হেসে আমার হাত ধরল জাহিদ, “ অসুবিধা নাই। ম্যানহলে পড়লে তুমি ওম্যান আছো, টেনে তুলবে।”
“ আমার অত শক্তি নেই যে তোমার মত হাতি টেনে ম্যানহল থেকে বের করবো।” কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু ম্যানহলে পড়ে যাবে এইভয়ে ওর শার্টের একটা অংশ মুঠো করে ধরে রাখলাম। সেটা দেখে জাহিদ উদাস গলায় ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ বাল্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ বেগাম, জগতের শেষ ল্যাম্প পোষ্টের বাল্বটা চুরি যাওয়ার পরেও আমি হারিকেন জ্বালিয়ে তোমার পাশে পাশে এভাবে শার্ট ধরিয়ে হাটবো...... কারণ, তোমার পাশে হাটতে আমার বড় ভাল লাগে! মনে হয় যেন বয়সটা একুশের ঘরে আটকে আছে এখনো!”
আমি অন্য সময় হলে হাসতাম, আজ হাসতে পারলাম না।
¤¤ চলবে ¤¤