Sunday, June 10, 2012

চতুরঙ্গ-(১২তম পর্ব) [Ghost Stories -p12 ]



চতুরঙ্গ-(১২তম পর্ব)

লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

আমার স্ত্রী জয়নাব খুব ধার্মীক মেয়ে ছিল এটা তো আগেই বলেছি।এ বাড়ির চারপাশে আর ছাদের মূর্তিগুলো নিয়ে ওর তীব্র আপত্তি ছিল সব সময়। কিন্তু বাবার শেষ স্মৃতি বলে আমি এগুলোকে সরাইনি। রেখে দিয়েছিলাম। মিউজিয়ামটাও বাবা অনেক দূর করে দিয়েছিলেন। আমি কেবল বাড়িয়েছি। যাহোক মূর্তি বিষয়ক আপত্তি থাকার কারণে বাড়ির অন্যান্য রূমগুলোতে মূর্তি রাখা হয়নি। বিশেষ করে নামাযের জন্য এই রূমেও কোনো মূর্তি রাখতে দেয়নি জয়নাব। এখানেই ও নামায আর কোরআন পড়ত সব সময়। বিয়ের দীর্ঘ দশটা বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো সন্তান হয়নি আমাদের। সমস্যাটা জয়নাবের ছিল, ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।মৃদু কাঁশলেন খুঁকখুঁক করে।
সন্তান না হওয়ার কারণে জয়নাব সারাক্ষণই মন মরা হয়ে থাকতো। একা একা এই বিশাল বাড়িতে ঘুরে বেড়াত। এটা সেটা গুছিয়ে সময় কাটাবার চেষ্টা কবত। কিন্তু কখনো আমাকে ওর দুঃখটা মুখ ফুটে বলেনি। সারাদিন নামায আর কোরআন নিয়ে পড়ে থাকত। দেখতে দেখতে কোরআন হাফেয করে ফেলল। বিড়বিড় করে অন্ধকারের মধ্যে প্রায় রাতেই শুনতাম কোনো না কোনো সুরা পড়ছে আমার পাশে শুয়ে। ভাবতাম জেগে আছে, কিন্তু পরে একদিন দেখলাম ঘুমের মধ্যেই ওভাবে সূরাগুলো পড়ে যায় জয়নাব।
তোরাব চাচা মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন পর্যন্ত আমি কোমরের ব্যথার জন্য বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। সে সময়টা জয়নাব সারাক্ষণ আমার পাশে থেকেছিল। রাতে ভয় পেতাম বলে সারা রাত জেগে আমার মাথার কাছে বসে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করত। আমি কখনো ওর কাছে কিছু লুকাইনি। তাই সেই রাতে দাবার বোর্ডে তোরাব চাচাকে দেখার ঘটনা ও জানত। অবিশ্বাস করেনি আমাকে। আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেছিল, “ভাল মানুষের সাথে আল্লাহ সব সময় ভালই করে। তুমি চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তোরাব চাচা মারা যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরের কথা। জয়নাব বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। কথা বলে খুব কম। কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যা-না বলে উত্তর দেয়। রাত জেগে আমার মাথার কাছে বসে থাকে। ঘুমাতে বললেও ঘুমায় না। আমি জানতাম না মানুষের মৃত্যু ঘনিয়ে আসলে টের পাওয়া যায় নাকি- কিন্তু জয়নাব বোধ হয় টের পেত। প্রায়ই আমাকে বলত, “ এ বাড়ির সব আয়না গুলোতে কোনো সমস্যা হয়েছে এমরান। আমি সামনে দিয়ে হাটলেই দেখি আমার শাড়ি, স্কার্ফ- সব সাদা রঙের।আমি ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ওর যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।ও মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্টের আগের রাতের কথা-
জয়নাব আমার পাশে সূরা বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমিও অঘোরে ঘুমাচ্ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ। খুব অদ্ভুত স্বপ্ন! দেখলাম যে আমি ছাদের সেই দাবা বোর্ডে উল্টো হয়ে একটা চেয়ারে বসে আছি। সামনে একটা টেবিল, টেবিলের অন্যপাশে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে। নয়-দশ বছর বয়স হবে। নীল শার্ট পরা। আমার সঙ্গে দাবা খেলছে। আমাদের মাথার দিকে পুরো হল রুম, মিউজিয়াম। আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাচ্চাটার সাথে দাবা খেলছি। বাচ্চাটা অসম্ভব ভাল খেলে। মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সব ঘুটি গায়েব করে দিল। ষোল চালে নেমে এল খেলা! আমি হারার ভয়ে রীতিমত ঘামছি। কিন্তু ছেলেটার সেদিকে ভ্রুঁক্ষেপ নেই। গম্ভীর মুখে খেলে যাচ্ছে। আমি হারতে হারতে খেলাটা ড্র করলাম কোনোমতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখি দুষ্টু একটা হাসি ফুটেছে চোখের তারায়। মুখে চাপা হাসি।
হাসছো কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
আপনাকে হারানো নিষেধ। তাই।হাসতে লাগল ছেলেটা। হাসিটা এত নিষ্পাপ যে বুকের ভেতর কেমন যেন ব্যথা জাগে। দেখলাম হাসির চোটে চোখে পানি এসে গেছে বাচ্চাটার।
কে নিষেধ করেছে আমাকে হারাতে?” অবাক চোখে তাকালাম।
দাদু।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। কালো হাফ প্যান্ট আর নীল শার্ট গায়ে। খালি পা। আমার দিকে না তাকিয়ে ছাদের বোর্ডের বিশাল বিশাল মূর্তি গুলোর দিকে হাত তুলে বলল, “ এখানে তো শুধু এক সেট ঘুটি। কালো। সাদা নাই?”
আমি মাথা নাড়ালাম, “নাহ।
আমি বড় হলে একদিন এই বোর্ডে খেলবো। সেদিন হারাতে পারবেন না আমাকে। ড্র-ও করতে পারবেন না।
তোমার দাদুর নাম কি?” পেছন থেকে বললাম।
জবাব দিল না বাচ্চাটা। দেখলাম মহাশূণ্যের নভোচারীদের মত ধীর গতিতে ওপরদিকে উড়ে যাচ্ছে! বোর্ড ছেড়ে হল রুমের ফ্লোরের দিকে উঠে যাচ্ছে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে! মাঝামাঝি গিয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে পা চলে গেল হল রুমের দিকে, মাথা বোর্ডের দিকে। অন্ধকারের মাঝে মিউজিয়ামে হারিয়ে গেল।
আমার ঘুম ভাঙ্গল তখন। কিছু বলার আগেই জয়নাব অন্ধকারের মধ্যে অদ্ভূত কন্ঠে বলে উঠল, “ বাচ্চাটা তোরাব চাচার নাতি। সাভারের একটা অনাথ আশ্রমে আছে।আমি কোনো কথা বললাম না। বিয়ের পর থেকেই জয়নাব আমার কাছে একটা বিস্ময় ছিল, আজ নতুন না যে অবাক হতে হবে।
পরদিন গাড়ি নিয়ে সাভারের সেই অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলাম আমি আর জয়নাব। কিন্তু গিয়ে লাভ হয়নি। শুনলাম তোরাব চাচার নাতি গত কয়দিন আগে পালিয়ে গেছে আশ্রম ছেড়ে। থানায় জি.ডি. করা হয়েছে। আমার খুব অবাক লাগল। অপারেশনের আগে কিন্তু একবারও তোরাব চাচাকে তাঁর নাতির কথা বলতে শুনিনি।এমন কি বাচ্চাটাকে কেউ হাসপাতালেও নিয়ে আসেনি। রেজিষ্ট্রার কাগজ ঘেটে ছেলেটার ছবি বার করলাম। নীল শার্ট পরা সেই বাচ্চাটাই- যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম!নামটা দেখলাম- মোঃ জহুরুল ইসলাম জাহিদ।থামলেন ডাঃ এমরান। একটানা কথা বলে হাফিয়ে গেছেন। টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিলেন। ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন সবটা।
আমি বজ্রাহতের মত বসে আছি। কারণ আমার জাহিদের পুরো নাম মোঃ জহুরুল ইসলাম জাহিদ”! কিন্তু জাহিদ তো অনাথ না। ওর মা বাবা আছে, বড় ভাই, ভাবী- সবাই আছে। খুব বেশি কাকতালীয় হয়ে গেছে যেন নামের ব্যাপারটা।

¤¤ চলবে ¤¤

চতুরঙ্গ-(১৩তম পর্ব) [Ghost Stories -p13 ]



চতুরঙ্গ-(১৩তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]



শূণ্য গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে ডাঃ এমরান
বললেন, “ সাভার থেকে ফিরতে ফিরতে রাত
হয়ে গিয়েছিল। তখনই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। আমার
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অ্যাক্সিডেন্ট........শেষ
কথাটা বিড়বিড় করে আপন মনেই বললেন। খেয়াল
করলাম ওনার মুখে তীব্র একটা কষ্টের ছাপ
ফুটে উঠেছে হঠাৎ করে। কি বললেন বুঝতে পারলাম না।
এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন,
বিচিত্র কোনো কারণে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আমার
কাছে লাগছিল আমাদের পেছনের সিটে মধ্যবয়স্ক
সাদা পাঞ্জাবী পরা একটা লোক বসে আছে।
কড়া মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছি লোকটার গা থেকে।
আমি তিনবার রিয়ার ভিউ মিররে দেখলাম
লোকটাকে পেছনের দিকে ফিরে ব্যাক
সিটে অন্ধকারে কাউকে দেখলাম না! জয়নাব সাবধান
করে দিল, “ কি হল? গাড়ি চালাতে চালাতে এতবার
পেছনে তাকাচ্ছো কেন?”
আমি দুবার সামনের দিক
থেকে আসা দুটো গাড়িকে ঠুকে দিতে দিতে কোনো মতে সামলে নিলাম।
জয়নাব ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ তুমি ঠিক
আছো তো এমরান? এরকম করছো কেন?”
আমি জবাব না দিয়ে আবার তাকালাম মিররে।
বিস্ফোরিত চোখে আয়নাতে এবারে দেখলাম পেছনের
কিছুই দেখা যাচ্ছে না! তার
বদলে দেখা যাচ্ছে আমার বাড়ির ছাদের দাবার
বোর্ডটা! সোজা হয়ে আছে বোর্ডটা। মূর্তি গুলো ঢাল
তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বোর্ডের ঘরগুলোয়! হঠাৎ
শুনলাম জয়নাব চিৎকার দিল, “ এমরান!
গাড়ি সামলাও!একটা ব্রীজ পার করছিলাম নদীর
ওপর দিয়ে। আমি চমকে সামনে তাকাতেই চোখ
ধাঁধিয়ে গেল! সামনের দিক থেকে আসা কোনো গাড়ির
হেডলাইটের আলোয় আমি কিছুই দেখতে পেলাম না।
কিন্তু গাড়িটা কিছুতে বাড়ি খাওয়ার বদলে অদ্ভূত
একটা ঘটনা ঘটল-
কিছু বোঝার আগেই আমাদের গাড়িটা আলোক
উৎসটা ভেদ করে লাফ দিয়ে এসে পড়ল বিশাল
একটা দাবা বোর্ডের ওপর! আমাদের বাড়ির ছাদের
সেই দাবা বোর্ডটায়!
গাড়ি উল্টো ভাবে ছুটছে বোর্ডের ওপর দিয়ে!
মধ্যাকর্ষণ যেন বোর্ডের দিকে! জয়নাব আতংকিত
গলায় চিৎকার দিল। আমি পাগলের মত স্টিয়ারিং হুইল
ঘুরিয়ে কয়েকটা মূর্তির
সাথে বাড়ি খেতে খেতে সামলে নিলাম। ছাদটা ঘুট
ঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেড লাইটের আলোই যা ভরসা।
ব্রেকটাও কাজ করছে না ঠিকমত। তীব্র
গতিতে ছুটে চলেছে নিয়ন্ত্রনহীন গাড়িটা।
মনে হচ্ছে অন্য কেউ একজন চালাচ্ছে সেটা!
স্টিয়ারিং পর্যন্ত ঘুরিয়ে সোজা করা যাচ্ছে না!
নিজে থেকেই ঘুরছে!তার মাঝ দিয়েই আমি ঢাল
তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো মূর্তিগুলোকে বাঁচিয়ে, পাশ
কাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি কোনোমতে।
কিন্তু এত চেষ্টার পরও দূর্ঘটনা এড়াতে পারলাম না।
আমি খেয়াল করিনি যে সামনের দিকে একটা বড়
মূর্তি বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যখন দেখলাম
চিৎকার দিয়ে ব্রেক কষলাম। ব্রেক লাগল এবারে।
কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পেতেই পাশে তাকালাম। জয়নাব
মূর্তির মত বসে আছে আমার পাশে। ওর ডান
হাতটা দিয়ে কাঁপা কাঁপা ভাবে আমার মুখটা স্পর্শ
করল। এই অন্ধকারের মাঝেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর
দুচোখ বেয়ে হীরের মত দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
ফিস ফিস করে বলল, “ খুব ইচ্ছে ছিল এই
বাড়িতে মারা যাবো। ভাল থেকো এমরান। তুমি আমার
দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষটা। আমি খুব
ভাগ্যবতী পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল
মানুষটাকে ছুঁয়ে বিদায় নিতে পারছি.....
আমি কাঁপা হাতে ওর হাতটা আমার মুখে ধরে রাখলাম।
জয়নাব অস্ফূট একটা শব্দ করল।
উইন্ডশীল্ডের কাঁচ ভেঙ্গে সামনে দাঁড়ানো মূর্তিটার
হাতের বর্শাটা ঢুকে গেছে জয়নাবের বুকের বাম
পাশে। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে কেবল অসহ্য মৃত্যু
যন্ত্রনায়........
আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল, ফিসফিস করে বললাম, “
তোমার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর
সময়টা কেটেছে জয়নাব। I think I’ll miss you rest
of my life.”
জয়নাব হাসার চেষ্টা করল। আরো দুফোঁটা অশ্রু
গড়িয়ে পড়ল ওর চোখের কোণ বেয়ে। চোখের
পাঁপড়িগুলো ভিজে কাঁটার মত হয়ে আছে। একটা মানুষ
এত সুন্দর হয় কি করে?
অনুভব করলাম গাড়িটা ছাদ থেকে খসে পড়ার মত
প্রচন্ড গতিতে নিচের হল রুমের দিকে পড়ছে। কিন্তু
আমার কোনো ভয়, আতংক কিছুই হচ্ছে না.......
প্রচন্ড শব্দ আর ঝাঁকুনি দিয়ে সুইমিং পুলের
নীলচে পানি ভেদ করে ডুবে গেলো গাড়িটা। আমার
পাশে জয়নাব হাতবাড়িয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেখছে,
মুখে একটুকরো নিষ্পাপ হাসি........ ওর বুকের বাম পাশ
থেকে বর্শার ভাঙ্গা অংশ বিশেষ বেরিয়ে আছে......
রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীরটা ওর। উইন্ডশীল্ডের
ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে সজোরে পানি ঢুকছে গাড়ির ভেতর।
আমার দুপায়ে ভয়ংকর একটা ব্যথা টের পেলাম।
গাড়ির কিছু একটা বেঁকে আমার দু
পায়ে এসে চেপে ধরেছে......কিন্তু জয়নাবের
দিকে তাকিয়ে রয়েছি মুগ্ধ চোখে...... আহা! এই
মুখটা যদি চিরকাল এভাবে দেখতে পারতাম.....চুপ
হয়ে গেলেন ডাঃ এমরান। অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।
বুঝতে পারলাম চোখে পানি এসে গেছে তাঁর।
সেটা আড়াল করতেই অন্য দিকে তাকিয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ সুইমিংপুলের নিচ থেকে বের
হলেন কি করে? গাড়ি নিয়ে ডোবার পরও ইনজুরড
অবস্থায়....বুঝতে পারলাম
বিষ্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেছে আমার।
ডাঃ এমরান চোখের কোণ ডললেন আঙ্গুল দিয়ে, “ পানির
নিচে দম আটকে মারা যাওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু
অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল তখন। গাড়ির ভেতর
ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড দিয়ে পানি ঢুকে আমার নিঃশ্বাস
আটকে গেছে- হঠাৎ দেখলাম পানির নিচের
নীলচে জগৎটা দাবা বোর্ডের মত হয়ে যাচ্ছে।
সুইমিং পুলের তলদেশটা সাদা কালো ছক
কাটা দাবা বোর্ডের মত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যতদূর চোখ
যায়। তার মাঝ
দিয়ে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে সাদা কতগুলো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে একেকটা ঘরে।
তুমি হয়ত খেয়াল করেছো এ বাড়ির ছাদের
চারটা মূর্তি বাদে সবগুলোই কিন্তু কালো পহ্মের ঘুটি।
সাদা ঘুটি না। কিন্তু পানির নিচের ঘুটিগুলো সব
সাদা। আমার দম
যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছি চারটা সাদা বর্ম
পরা বিশাল দেহী মূর্তি আমার গাড়ির চার কোণার
মাটি ফুঁড়ে যেন গজিয়ে উঠল। খুব আশ্চর্যের বিষয় চার
জনের একটা করে হাত আমার গাড়িটার চার কোণায়
ধরা! কিছু বোঝার আগেই তীব্র
গতিতে পানি ফুঁড়ে মূর্তিগুলো গাড়িটাকে নিয়ে উঠে গেল
সুইমিং পুলের ওপর দিকে।
( চলবে )


চতুরঙ্গ -(১৪তম পর্ব) [Ghost Stories - p14 ]



চতুরঙ্গ -(১৪তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব



[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

সোজা ছাদের দিকে উঠে যেতে লাগল।
মাঝামাঝি উচ্চতায় এসে গাড়িসহ চার মূর্তিই
উল্টে গেল। চাকা চলে গেল ছাদের দিকে, সুইমিং পুল
চলে এল মাথার ওপর দিকে। গাড়িটা নিয়ে নামল
ছাদের বোর্ডে। আমি তখন পাগলের মত নিঃশ্বাস
নিচ্ছি বাতাস পেয়ে। তার মাঝেই দেখলাম
সাদামূর্তি চারটা গাড়ির চারপাশে স্থির
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীক পুরাণের যোদ্ধাদের মত
মূর্তি।
আমি আমার দুই পা নাড়াতে পারছি না।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এর মাঝেই আবিষ্কার করলাম
আমি দরজা খুলে দাবার বোর্ডে নেমেছি। আমার দুই
পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে সাদা দাবার
ঘর ভেসে যাচ্ছে লাল হয়ে। অথচ আমি আমার দুই
পায়ে অদ্ভূত একটা শক্তি অনুভব করছি। নিজের
অজান্তেই মাথার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম হল
রুমের নানান জিনিস পত্র, সুইমিং পুলের পানি, নতুন
মূর্তি সব কিছু নড়ছে! যেন বৃষ্টির মত
নেমে আছড়ে পড়বে এই বোর্ডের ওপর। কিন্তু
আমি তাকানো মাত্রই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যার
যার স্থানে বসে গেল! আমি বাদুরের মত ঝুলে আছি,
আমার গাড়িটাও। তার ভেতরে জয়নাবের লাশ।
আধখোলা চোখে ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড
দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
মিষ্টি একটা হাসি ফুঁটে আছে ওর ঠোঁটের কোণায়।
সে রাতেই ছাদে চারটা নতুন সাদা মূর্তি যোগ হয়।
যেগুলোর কারিগর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য স্রষ্টা অদ্ভুত সব
ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা পুরণের
ব্যবস্থাটার মাঝে জয়নাবের সহযাত্রীও
পড়ে গিয়েছিল সেদিন।শেষের কথাগুলো বিড়বিড়
করে আপন মনে বললেন। চোখে পানি জমে উঠেছে তাঁর।
মানে?” আমি বুঝতে পারলাম না।
বিচিত্র ভাবে হাসলেন, “ বুঝবেনা এখন। বয়স বাড়ুক
তোমার। একদিন বুঝে যাবে।দেয়ালে ঝোলানো জয়নাব
আরার ছবিটার দিকে তাকালেন।
আমি বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলাম, “
আপনি আসলে সে রাতেই আবিষ্কার করেন
যে আপনি উল্টো হয়ে ছাদ থেকে ঝুলে থাকতে পারেন?
শুধু নিজের না, অনেক কিছুর গ্র্যাভিটির দিক
বদলে ফেলতেও পারেন- তাই না?”
ফিরে তাকালেন অবাক হয়ে ডাঃ এমরান।
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বিস্ময়ের
সাথে দেখলাম ডাঃ এমরানের অশ্রু
জমে ওঠা দুচোখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠেছে।
রহস্যময় একটা হাসি।জাহিদকে আমি আপনার
সাথে দাবা খেলতে দেখেছি স্যার। ছাদে,
উল্টো ভাবে......। আপনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন
আমি কাকে বোঝাচ্ছি। আমার খুব কাছের বন্ধু।
হাসপাতালে আপনারা মিট করেছিলেন......
জানি। তোরাব চাচার নাতি সে-ই।
হাসপাতালে ওকে পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম আমাকে চিনবে ও। কিন্তু একেবারেই
চিনতে পারেনি। একটা নতুন ফ্যামিলিতে অ্যাডপ্ট
করা হয়েছিল বোধ হয় ওকে। কারণ আমার
জানা মতে অনাথ ছিল ছেলেটা।কপাল ডললেন
চিন্তিতভাবে।
আপনাকে চিনতে পারেনি ঠিক আছে। কিন্তু ছাদ
থেকে ঝুলে আপনার সাথে দাবা খেলার
ব্যাপারটা বুঝলাম না। এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটার
সাথে জাহিদ জড়াচ্ছে কি করে?
আমি যতটা ওকে চিনি- ও অনেক সহজ সরল একটা ছেলে।
পড়া শোনা আর কবিতা লেখা-
লেখি ছাড়া জীবনে ওকে আর অন্য কিছু করতে দেখিনি।
দাবা খেলা তো দূরের কথা।ভ্রুঁ কুটি করলাম।
ডাঃ এমরান দুহাতের আঙ্গুলগুলো এক
সাথে লাগিয়ে মোচার মত করে সেটার
দিকে তাকালেন, “তুমি তো বুঝেই গেছো আমি ছোট
খাটো একটা হ্মমতা হঠাৎ করেই পেয়ে গেছি।
এটা হ্মমতা না অভিশাপ সেটাই জানি না......একটু
থামলেন। আমি কিছু বললাম না, কেবল
কৌতূহলি চোখে তাকিয়ে রইলাম।
হ্মমতাটা পাওয়ার অল্প কিছুদিন পরের কথা,
তখনো আমি হ্মমতার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস
করতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন লহ্ম্য করলাম
আমার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে ভিন্ন ভিন্ন হাতের
লেখা।
আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ঘটনাটা কি ঘটেছে।
আমি ভেবেছি কেউ আমার অগোচরে আমার
ডায়েরী খুলে তাতে হাবি জাবি সব অংক, ফিজিক্স
এসব লিখে ভরিয়ে দিয়েছে। যেগুলোর
আগা মাথা আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু কার এমন
ঠেকা পড়ল যে আমার ডায়েরীতে এসে অংক
নিয়ে গবেষণা পত্র লেখতে যাবে? খুব অবাক হলাম।
এরকম ঘটনা পর পর তিন দিন ঘটল।দাঁড়িতে আঙ্গুল
চালালেন অস্বস্তি নিয়ে।বুঝলাম না! আপনার
ডায়েরীতে অন্য মানুষ লিখবে কেন?” আমি অবাক গলায়
বললাম।
কথাটা সেখানেই। আমার খঁটকা লাগল। এই বিশাল
বাড়িতে কাজের মানুষ তিন জন ছাড়া আর কেউ
থাকে না। আর তারাও সবাই বিশ্বস্ত। বহু দিন
ধরে এখানে আছে। আমার অজান্তে এসে আমার
ডায়েরীতে লিখবে- এটা পুরোপুরি অসম্ভব! তার ওপর
ডায়েরীটা থাকে আমার বালিশের নিচে। কেউ
এসে যে ওটা নেবে- সেটাও সম্ভব না। তাই পরের
রেতে জেগে রইলাম সারা রাত। সারা রাতে কেউ এল
না আমার ঘরে। শেষ রাতে তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল।
অল্প সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলাম। হঠাৎ চোখ
মেলতেই দেখলাম বিছানার ওপর
ডায়েরীটা পড়ে আছে, খোলা- তাতে নতুন নতুন সব
ফিজিক্সের আংক!
( চলবে )

চতুরঙ্গ -(১৫তম পর্ব) [Ghost Stories-p15]


চতুরঙ্গ -(১৫তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত কম সময়ে কে এল!আর
লেখলোই বা কি এসব? ব্যাপারটা নিয়ে আমি এত
চিন্তায় পড়ে গেলাম যে আমার এক প্রফেসর
বন্ধুকে ডায়েরীটার লেখাগুলো পাঠিয়ে দিলাম
ফ্যাক্স করে। ফিজিক্সের টিচার ও,
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটেতে পড়ায়- ড.
নিকোলাস অগাস্টাস। সে তো ফ্যাক্স পেয়ে পরের
ফ্লাইটেই বাংলাদেশে এসে হাজির!
আমি তো তাকে দেখে অবাক! আমার বাড়িতে এসেই
আমাকে বলে বসল, “ কে লিখেছে এটা?
যে লিখেছে তাকে আমার সামনে হাজির করো!
তাকে আমার চাই! সে সায়েন্সের কি বিশাল বিপ্লব
ঘটাতে যাচ্ছে নিজেও জানে না।
আমি তার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষন
পর একটু ধাতস্থ
হয়ে আমাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে লাগল
নিকোলাস। যা বোঝালো তার সারমর্ম হলঃ সেই
ডায়েরীতে লেখা অংক গুলো হল স্পেস
টাইমিং এবং গ্র্যাভিটি বিষয়ক
একটা ম্যানুস্ক্রিপ্টপ্যাপার, গবেষণা পত্র। যদিও
অর্ধেক, কিন্তু সায়েন্স ওয়ার্ল্ডে হূল স্থূল
ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এক বস্তু এক
জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে মুহূর্তেই
চলে যাবে, এবং তার গ্র্যাভিটিকে কিভাবে সেই
হাইপার ডাইভের জ্বালানি কিংবা বল রুপে ব্যবহার
করবে- তার বিশাল বর্ণনা। আমি নিজে ডাক্তার মানুষ,
এক সময় আগ্রহ করে এইচ.জি.ওয়েলসের বই পড়ার সময়
ঝোঁকের বশে ফিজিক্স নিয়ে এক আধটু
নাড়াচাড়া করেছিলাম। টুকটাক লেখালেখি করতাম
বলে পড়তে হত। ব্যস এটুকুই। কিন্তু এত কঠিন ফিজিক্স
বোঝার মত জ্ঞান আমার নেই। তাই নিকোলাসের সব
কথা বুঝতে পারলাম না।
নিকোলাস আমাকে জিজ্ঞেস করল কে লিখেছে এটা?
আমি কিছুই চাপলাম না। বলে দিলাম সব। খুব অবাক হল
নিকোলাস। কি যেন ভাবল অনেকহ্মণ ধরে। তারপর বলল
রাতে সে আমার বাড়িতেই থাকবে।কে এসে লেখে যায়
বের করা দরকার। আমিও তাই চাচ্ছিলাম। বলার
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
সেদিন বিকালেই সারা বাড়িতে দশ বারোটা ক্লোসড
সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে দিল নিকোলাস।
বিজ্ঞানী ভদ্রলোক আসলেও
ক্যামেরা এড়িয়ে আসতে পারবে না। ধরা পড়তেই
হবে ক্যামেরার চোখে।
সব ঠিক করে রাতে খাওয়ার পর
অপেক্ষা করতে লাগলাম দুজনে।বসে আছি তো আছিই।
কোনো কিছুই হল না। নিকোলাস
লম্বা জার্নি করে এসেছিল। তাই ক্লান্ত ছিল।
জেগে থাকতে পারল না।ঘুমিয়ে পড়ল খুব তাড়াতাড়ি।
আমিও বসে বসে ঢুলতে লাগলাম ঘুমে।দম নেয়ার জন্য
থামলেন।
আমি বসে আছি। অপেহ্মা করছি ওনার
বাকি কথাগুলো শোনার জন্য। জাহিদের প্রসঙ্গ
থেকে এই প্রসঙ্গে চলে আসার
ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছি না। কিন্তু চুপ
থাকলাম।
ডাঃ এমরান বলা শুরু করলেন আবার, “ পরদিন
সকালে নিকোলাসকে হিষ্টোরিয়া রোগীরমত
কাঁপতে কাঁপতে পাগলের প্রলাপ বকতে দেখা গেল।
রীতিমত উন্মাদ হয়ে গেছে! দু-তিন জন মিলেও
ধরে রাখা যাচ্ছে না। বারবার
আমাকে দেখিয়ে বলছে, “ He's not a human!
something else! I saw him that he was
walking on the roof of the hall room! It seems
like - he was hanging from the roof!”

আমি তো হতবাক ওর কথা শুনে। কি বলে এসব?
কোনো মতে ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সি.সি.
ক্যামেরাগুলোর ভিডিও দেখতে বসে গেলাম। কি এমন
দেখেছে ও যে এরকম ভয় পেল?
ভিডিও দেখতে গিয়ে আমি নিজেই স্তম্ভিত
হয়ে গেলাম। মনিটরের মধ্যে আটটা ভাগ, আমার
পুরো বাড়িটার ভেতর বাহির সব দেখা যাচ্ছে।
আবছা অন্ধকার। ভিডিওর প্রথম কয়েক ঘন্টা সব কিছু
স্বাভাবিক, স্থির, চুপচাপ। তার পরেই ঘটনাটার শুরু।
আবছা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে রাত প্রায় আড়াইটার
দিকে আমার দোতলার রুমের
দরজা খুলে ভাসতে ভাসতে আমি ঘর
থেকে বেরিয়ে এসেছি। হাতে কলম আর ডায়েরীটা।
নভোচারীদের মত
শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে সোজা হলরুমের ছাদের
দাবা বোর্ডের দিকে উঠতে লাগলাম।
গিয়ে ঝুলে পড়লাম উল্টো ভাবে। গম্ভীর
মুখে হাটতে হাটতে ডায়েরীতে লিখে যাচ্ছি কি যেন!
এবং লিখছি আমার বাম হাত দিয়ে! যদিও আমি রাইট
হ্যান্ডেড!
আমি বজ্রাহতের মত বসে রইলাম।নিকোলাস
সরাসরি আমাকে এ অবস্থায় দেখেছে কাল রাতে! কারণ
আমি ভিডিওতেই দেখতে পেলাম নিকোলাসের ভয়ার্ত
চিৎকার- হল রুমের নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। আর
ছাদে ঝুলে থাকা আমিখুব বিরক্ত হয়ে নিকোলাসের
দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ইশারা করতেই নিকোলাস
শুন্যে উঠে ঝুলতে থাকল বিচিত্র ভঙ্গিতে!
চেঁচাচ্ছে সে অবস্থাতেই!
আমি সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করি আমার Split
personality বা দ্বৈত সত্ত্বা রয়েছে।
রোগটা কবে থেকে হয়েছে আমি নিজেও জানি না।
যেখানে নিজের ভেতরেই আরো একটা অস্তিত্ব
সৃষ্টি হয়েছে! আমি ঘুমিয়ে পড়লেই ওটা জেগে ওঠে।
সেই অস্তিত্বটাই এতদিন বাম হাতে আমার অজান্তেই
ডায়েরীতে এসব লিখে এসেছে!
( চলবে )


Saturday, June 9, 2012

চতুরঙ্গ (১৬তম পর্ব) [Ghost Stories - p16 ]



চতুরঙ্গ -(১৬তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব


[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

আমি প্রায় শোনা যায়
না এমনভাবে আস্তে আস্তে বললাম, “অ্যাক্সিডেন্টট
া আসলে আপনার Split personality’র ঐ
অংশটা ঘটিয়েছে- তাই না স্যার?” গলার স্বরই
বলে দিলো আমি ভয় পাচ্ছি।
ডাঃ এমরান কাঁশলেন খুঁক খুঁক করে, “ দুঃখজনক হলেও
ব্যাপারটা সত্যি। সেরাতে আমি তোমাকে বারবার
চলে যেতে বলেছিলাম, ভয় পাচ্ছিলাম রাতে আমার ওই
অংশটা জেগে উঠলে তোমার হ্মতি করতে পারে। তাই।
কিন্তু তুমিই শুনলে না কথাটা।
আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম তাঁর দিকে, “ অন্যদিন
হ্মতি না করে সে রাতেই করতে গেলেন কেন?” নিজের
কাছেই নিজের কন্ঠটা কেমন বেখাপ্পা শোনালো।
সে রাতে জয়নাবের ডোর বেলটা ভেঙ্গেছিলে তুমি,
আর আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তখন-তাই।নির্লিপ্ত গলায়
বললেন।
আমি ঢোক গিললাম, “
তাহলে আমাকে মিথ্যা বলেছিলেন
কেন,যে আমি সম্মোহিত হয়েছি?”
ভয় পাবে তাই বলতে চাই নি।পানির গ্লাসটার
দিকে হাত বাড়ালেন। খালি ছিল সেটা।
আমি উঠে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দিলাম তাঁকে।
এসে আবার বসলাম টুলে, “ আর জাহিদের
ব্যাপারটা কি?” জিজ্ঞেস করলাম।
পানি খেতে খেতেই বললেন, “ এখনো বোঝোনি? ওর-ও
একই সমস্যা আছে। স্প্লিট
পারসোন্যালিটি ডিসওর্ডার। বিচিত্র
কোনো কারণে ওর অন্য অস্তিত্বটা আমার
সঙ্গে দাবা খেলে। মানে আমার অন্য অস্তিত্বের
সাথে দাবা খেলে। হারানোর জন্য। সেদিন
হাসপাতালে পরিচয়ের সময়েই বোধ হয় ওর অন্য
সত্ত্বাটা আমাকে চিনেছিল।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না স্যার।
বিভ্রান্ত গলায় বললাম।
জাহিদের অন্য সত্ত্বাটা অসম্ভব স্ট্রং।
বলতে পারো ওর হ্মমতাটার সামনে আমার
কোনো শক্তিই নেই। গ্র্যাভিটিকে ফোর্স
বানিয়ে হাইপার ডাইভ দেয়ায় রীতিমত ওস্তাদ
জাহিদের অন্য অস্তিত্বটা। এ জন্যই ওকে হঠাৎ করেই
এখানে সেখানে চলে আসতে দেখা যায়। নিজের
অজান্তেই করে। অবশ্য
তুমি দেখেছো কিনা সেটা জানি না।এক মুহূর্ত
থামলেন। ছাদের বিশাল দাবা বোর্ডে ওর
সঙ্গে খেলা হওয়ার কথা ছিল। অনেক ছোট বেলা থেকে।
ওর দাদুই সেটা বলে গিয়েছিলেন। কখন,
কিভাবে বলেছেন জানি না। জাহিদ ভুলে গেলেও ওর
অন্য অস্তিত্বটা ভোলেনি। সেটাই খেলবে জাহিদ।
কবে?”
আজ রাতেই হওয়ার কথা ছিল। অন্তত আমার
ডায়েরীতে আমার অন্য অস্তিত্বটা সে কথাই
লিখে গেছে।টেবিলের ওপর থেকে তাঁর
ডায়েরীটা তুলে একটা পাতা খুলে দেখালেন।
দেখতে পাচ্ছি এখান থেকেই, সেখানে অন্য
কারো হাতের লেখাঃ
২৬ আগস্ট রাত সাড়ে আটটায় জাহিদের সঙ্গে বড়
বোর্ডে দাবা খেলা হবে।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ এটা আপনার অন্য অংশের
লেখা?”
হ্যা।হাসতে লাগলেন হঠাৎ, চিকচিক করে উঠল
ডাঃ এমরানের চোখ।
আমি মূর্তির মত বসে রয়েছি। মাথা কাজ
করছে না আমার। আবার বিড়বিড় করলাম, এসব কেন
হচ্ছে স্যার?”
হাসতে লাগলেন মিটিমিটি। চোখের দৃষ্টিটা কেমন
যেন রহস্যময়। আমি টুল
ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মাথা ঘুরছে,
অসুস্থ গলায় বললাম, “ আপনি এর ব্যাখ্যাটাও
জানেন?”
উনি জবাব না দিয়ে বসে রইলেন কাঠের চেয়ারে।
চোখে রহস্যময় সেই হাসি।
স্যার প্লিজ?” অনুনয় করে বললাম,
চোখে পানি এসে গেল।
সব কটা জিনিসের ব্যাখ্যা জানতে নেই নোভেরা।
মানুষকে তার জ্ঞান আর
মেধা খাঁটিয়ে সেটা আবিষ্কার করার সুযোগ
দেয়া উচিত। তুমি আসতে পারো- আমার নামাযের সময়
হয়ে গেছে।
আমি নিজের অজান্তেই ঠোঁট
কামড়ে কান্না আটকে দৌড়ে চলে এলাম।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
সে রাতে হল রুমে তালা লাগিয়ে যখন চলে আসবো-
ছাদের দিক থেকেই একামাত দেয়ার শব্দ শোনা গেল।
কন্ঠটা খুব পরিচিত লাগলো। কিন্তু কার মনে পড়ল না।
আমি ফিরে তাকালাম। অন্ধকারের মাঝে দেখা যাচ্ছে,
ছাদের দাবা বোর্ডে উল্টো হয়ে অসংখ্য সাদা পোশাক
পরা মানুষ জামাতে নামাযে দাঁড়িয়েছে! কোথাও
কোনো মূর্তি নেই! ইমামের পেছনে নীল শার্ট
পরা কেউ একজন দাঁড়িয়েছে, নিচ থেকেও
চিনতে পারলাম- জাহিদ! এবং ইমাম আর কেউ নন-
ডাঃ এমরান!
আমি জানি নামাযের পরেই হয়ত সেই বড় খেলাটা শুরু
হবে...... আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছে।
দেখতে পাচ্ছি লম্বা নামাযটা শেষে সাদা পোশাক
পরা মানুষগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে..... দাবা বোর্ডে আগের
মূর্তিগুলো একে একে ফিরে আসছে...... যেন বোর্ড
ফূঁড়ে গজিয়ে উঠল।
আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি দ্রুত।
দেখতে পাচ্ছি দাবা খেলার শুরুর সমত
যেভাবে ঘুটি সাজানো হয়- তেমন ভাবে ঘুটি সজ্জিত
হচ্ছে আপনা আপনি। অভাব থাকা ঘুটিটা হিসেবে হল
রুম থেকে বেশ কিছু মূর্তি শূণ্যে উথে যাচ্ছে!
গিয়ে ছাদের ওই ঘরগুলোতে বসছে নিজে নিজে!
আমি নিজের পায়ের ওপর ভর রাখতে পারছি না।
ওপরে খেলা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বাহিরে প্রকৃতিও
যেন ঝড়ের তান্ডব লীলা শুরু করেছে!বজ্রপাতের আলোয়
দেখা যাচ্ছে মূর্তিগুলো যুদ্ধের ময়দানের মত
একটা আরেকটাকে গিয়ে প্রচন্ড জোরে আঘাত
করে গুড়িয়ে দিচ্ছে। উপর থেকে ভেঙ্গে সেগুলো হল
রুমের ফ্লোরে আছড়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে!
চারপাশে ধূলো-বালুর ঝড় হল রুমের ভেতর! যেন যুদ্ধ
লেগেছে!
ডাঃ এমরান ছাদের এক মাথায় ঝুলে আছেন- অন্য
মাথায় জাহিদ। দু জনের চোখেই অদ্ভূত উল্লাস
ভরা রহস্যময় একটা হাসি.....!!
¤¤ চলবে ¤¤