Sunday, June 10, 2012

চতুরঙ্গ -(১৪তম পর্ব) [Ghost Stories - p14 ]



চতুরঙ্গ -(১৪তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব



[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

সোজা ছাদের দিকে উঠে যেতে লাগল।
মাঝামাঝি উচ্চতায় এসে গাড়িসহ চার মূর্তিই
উল্টে গেল। চাকা চলে গেল ছাদের দিকে, সুইমিং পুল
চলে এল মাথার ওপর দিকে। গাড়িটা নিয়ে নামল
ছাদের বোর্ডে। আমি তখন পাগলের মত নিঃশ্বাস
নিচ্ছি বাতাস পেয়ে। তার মাঝেই দেখলাম
সাদামূর্তি চারটা গাড়ির চারপাশে স্থির
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীক পুরাণের যোদ্ধাদের মত
মূর্তি।
আমি আমার দুই পা নাড়াতে পারছি না।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এর মাঝেই আবিষ্কার করলাম
আমি দরজা খুলে দাবার বোর্ডে নেমেছি। আমার দুই
পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে সাদা দাবার
ঘর ভেসে যাচ্ছে লাল হয়ে। অথচ আমি আমার দুই
পায়ে অদ্ভূত একটা শক্তি অনুভব করছি। নিজের
অজান্তেই মাথার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম হল
রুমের নানান জিনিস পত্র, সুইমিং পুলের পানি, নতুন
মূর্তি সব কিছু নড়ছে! যেন বৃষ্টির মত
নেমে আছড়ে পড়বে এই বোর্ডের ওপর। কিন্তু
আমি তাকানো মাত্রই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যার
যার স্থানে বসে গেল! আমি বাদুরের মত ঝুলে আছি,
আমার গাড়িটাও। তার ভেতরে জয়নাবের লাশ।
আধখোলা চোখে ভাঙ্গা উইন্ডশীল্ড
দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
মিষ্টি একটা হাসি ফুঁটে আছে ওর ঠোঁটের কোণায়।
সে রাতেই ছাদে চারটা নতুন সাদা মূর্তি যোগ হয়।
যেগুলোর কারিগর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য স্রষ্টা অদ্ভুত সব
ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা পুরণের
ব্যবস্থাটার মাঝে জয়নাবের সহযাত্রীও
পড়ে গিয়েছিল সেদিন।শেষের কথাগুলো বিড়বিড়
করে আপন মনে বললেন। চোখে পানি জমে উঠেছে তাঁর।
মানে?” আমি বুঝতে পারলাম না।
বিচিত্র ভাবে হাসলেন, “ বুঝবেনা এখন। বয়স বাড়ুক
তোমার। একদিন বুঝে যাবে।দেয়ালে ঝোলানো জয়নাব
আরার ছবিটার দিকে তাকালেন।
আমি বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলাম, “
আপনি আসলে সে রাতেই আবিষ্কার করেন
যে আপনি উল্টো হয়ে ছাদ থেকে ঝুলে থাকতে পারেন?
শুধু নিজের না, অনেক কিছুর গ্র্যাভিটির দিক
বদলে ফেলতেও পারেন- তাই না?”
ফিরে তাকালেন অবাক হয়ে ডাঃ এমরান।
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বিস্ময়ের
সাথে দেখলাম ডাঃ এমরানের অশ্রু
জমে ওঠা দুচোখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠেছে।
রহস্যময় একটা হাসি।জাহিদকে আমি আপনার
সাথে দাবা খেলতে দেখেছি স্যার। ছাদে,
উল্টো ভাবে......। আপনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন
আমি কাকে বোঝাচ্ছি। আমার খুব কাছের বন্ধু।
হাসপাতালে আপনারা মিট করেছিলেন......
জানি। তোরাব চাচার নাতি সে-ই।
হাসপাতালে ওকে পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম আমাকে চিনবে ও। কিন্তু একেবারেই
চিনতে পারেনি। একটা নতুন ফ্যামিলিতে অ্যাডপ্ট
করা হয়েছিল বোধ হয় ওকে। কারণ আমার
জানা মতে অনাথ ছিল ছেলেটা।কপাল ডললেন
চিন্তিতভাবে।
আপনাকে চিনতে পারেনি ঠিক আছে। কিন্তু ছাদ
থেকে ঝুলে আপনার সাথে দাবা খেলার
ব্যাপারটা বুঝলাম না। এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটার
সাথে জাহিদ জড়াচ্ছে কি করে?
আমি যতটা ওকে চিনি- ও অনেক সহজ সরল একটা ছেলে।
পড়া শোনা আর কবিতা লেখা-
লেখি ছাড়া জীবনে ওকে আর অন্য কিছু করতে দেখিনি।
দাবা খেলা তো দূরের কথা।ভ্রুঁ কুটি করলাম।
ডাঃ এমরান দুহাতের আঙ্গুলগুলো এক
সাথে লাগিয়ে মোচার মত করে সেটার
দিকে তাকালেন, “তুমি তো বুঝেই গেছো আমি ছোট
খাটো একটা হ্মমতা হঠাৎ করেই পেয়ে গেছি।
এটা হ্মমতা না অভিশাপ সেটাই জানি না......একটু
থামলেন। আমি কিছু বললাম না, কেবল
কৌতূহলি চোখে তাকিয়ে রইলাম।
হ্মমতাটা পাওয়ার অল্প কিছুদিন পরের কথা,
তখনো আমি হ্মমতার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস
করতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন লহ্ম্য করলাম
আমার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে ভিন্ন ভিন্ন হাতের
লেখা।
আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ঘটনাটা কি ঘটেছে।
আমি ভেবেছি কেউ আমার অগোচরে আমার
ডায়েরী খুলে তাতে হাবি জাবি সব অংক, ফিজিক্স
এসব লিখে ভরিয়ে দিয়েছে। যেগুলোর
আগা মাথা আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু কার এমন
ঠেকা পড়ল যে আমার ডায়েরীতে এসে অংক
নিয়ে গবেষণা পত্র লেখতে যাবে? খুব অবাক হলাম।
এরকম ঘটনা পর পর তিন দিন ঘটল।দাঁড়িতে আঙ্গুল
চালালেন অস্বস্তি নিয়ে।বুঝলাম না! আপনার
ডায়েরীতে অন্য মানুষ লিখবে কেন?” আমি অবাক গলায়
বললাম।
কথাটা সেখানেই। আমার খঁটকা লাগল। এই বিশাল
বাড়িতে কাজের মানুষ তিন জন ছাড়া আর কেউ
থাকে না। আর তারাও সবাই বিশ্বস্ত। বহু দিন
ধরে এখানে আছে। আমার অজান্তে এসে আমার
ডায়েরীতে লিখবে- এটা পুরোপুরি অসম্ভব! তার ওপর
ডায়েরীটা থাকে আমার বালিশের নিচে। কেউ
এসে যে ওটা নেবে- সেটাও সম্ভব না। তাই পরের
রেতে জেগে রইলাম সারা রাত। সারা রাতে কেউ এল
না আমার ঘরে। শেষ রাতে তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল।
অল্প সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করেছিলাম। হঠাৎ চোখ
মেলতেই দেখলাম বিছানার ওপর
ডায়েরীটা পড়ে আছে, খোলা- তাতে নতুন নতুন সব
ফিজিক্সের আংক!
( চলবে )

চতুরঙ্গ -(১৫তম পর্ব) [Ghost Stories-p15]


চতুরঙ্গ -(১৫তম পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব

[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত কম সময়ে কে এল!আর
লেখলোই বা কি এসব? ব্যাপারটা নিয়ে আমি এত
চিন্তায় পড়ে গেলাম যে আমার এক প্রফেসর
বন্ধুকে ডায়েরীটার লেখাগুলো পাঠিয়ে দিলাম
ফ্যাক্স করে। ফিজিক্সের টিচার ও,
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটেতে পড়ায়- ড.
নিকোলাস অগাস্টাস। সে তো ফ্যাক্স পেয়ে পরের
ফ্লাইটেই বাংলাদেশে এসে হাজির!
আমি তো তাকে দেখে অবাক! আমার বাড়িতে এসেই
আমাকে বলে বসল, “ কে লিখেছে এটা?
যে লিখেছে তাকে আমার সামনে হাজির করো!
তাকে আমার চাই! সে সায়েন্সের কি বিশাল বিপ্লব
ঘটাতে যাচ্ছে নিজেও জানে না।
আমি তার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষন
পর একটু ধাতস্থ
হয়ে আমাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে লাগল
নিকোলাস। যা বোঝালো তার সারমর্ম হলঃ সেই
ডায়েরীতে লেখা অংক গুলো হল স্পেস
টাইমিং এবং গ্র্যাভিটি বিষয়ক
একটা ম্যানুস্ক্রিপ্টপ্যাপার, গবেষণা পত্র। যদিও
অর্ধেক, কিন্তু সায়েন্স ওয়ার্ল্ডে হূল স্থূল
ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এক বস্তু এক
জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে মুহূর্তেই
চলে যাবে, এবং তার গ্র্যাভিটিকে কিভাবে সেই
হাইপার ডাইভের জ্বালানি কিংবা বল রুপে ব্যবহার
করবে- তার বিশাল বর্ণনা। আমি নিজে ডাক্তার মানুষ,
এক সময় আগ্রহ করে এইচ.জি.ওয়েলসের বই পড়ার সময়
ঝোঁকের বশে ফিজিক্স নিয়ে এক আধটু
নাড়াচাড়া করেছিলাম। টুকটাক লেখালেখি করতাম
বলে পড়তে হত। ব্যস এটুকুই। কিন্তু এত কঠিন ফিজিক্স
বোঝার মত জ্ঞান আমার নেই। তাই নিকোলাসের সব
কথা বুঝতে পারলাম না।
নিকোলাস আমাকে জিজ্ঞেস করল কে লিখেছে এটা?
আমি কিছুই চাপলাম না। বলে দিলাম সব। খুব অবাক হল
নিকোলাস। কি যেন ভাবল অনেকহ্মণ ধরে। তারপর বলল
রাতে সে আমার বাড়িতেই থাকবে।কে এসে লেখে যায়
বের করা দরকার। আমিও তাই চাচ্ছিলাম। বলার
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
সেদিন বিকালেই সারা বাড়িতে দশ বারোটা ক্লোসড
সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে দিল নিকোলাস।
বিজ্ঞানী ভদ্রলোক আসলেও
ক্যামেরা এড়িয়ে আসতে পারবে না। ধরা পড়তেই
হবে ক্যামেরার চোখে।
সব ঠিক করে রাতে খাওয়ার পর
অপেক্ষা করতে লাগলাম দুজনে।বসে আছি তো আছিই।
কোনো কিছুই হল না। নিকোলাস
লম্বা জার্নি করে এসেছিল। তাই ক্লান্ত ছিল।
জেগে থাকতে পারল না।ঘুমিয়ে পড়ল খুব তাড়াতাড়ি।
আমিও বসে বসে ঢুলতে লাগলাম ঘুমে।দম নেয়ার জন্য
থামলেন।
আমি বসে আছি। অপেহ্মা করছি ওনার
বাকি কথাগুলো শোনার জন্য। জাহিদের প্রসঙ্গ
থেকে এই প্রসঙ্গে চলে আসার
ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছি না। কিন্তু চুপ
থাকলাম।
ডাঃ এমরান বলা শুরু করলেন আবার, “ পরদিন
সকালে নিকোলাসকে হিষ্টোরিয়া রোগীরমত
কাঁপতে কাঁপতে পাগলের প্রলাপ বকতে দেখা গেল।
রীতিমত উন্মাদ হয়ে গেছে! দু-তিন জন মিলেও
ধরে রাখা যাচ্ছে না। বারবার
আমাকে দেখিয়ে বলছে, “ He's not a human!
something else! I saw him that he was
walking on the roof of the hall room! It seems
like - he was hanging from the roof!”

আমি তো হতবাক ওর কথা শুনে। কি বলে এসব?
কোনো মতে ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সি.সি.
ক্যামেরাগুলোর ভিডিও দেখতে বসে গেলাম। কি এমন
দেখেছে ও যে এরকম ভয় পেল?
ভিডিও দেখতে গিয়ে আমি নিজেই স্তম্ভিত
হয়ে গেলাম। মনিটরের মধ্যে আটটা ভাগ, আমার
পুরো বাড়িটার ভেতর বাহির সব দেখা যাচ্ছে।
আবছা অন্ধকার। ভিডিওর প্রথম কয়েক ঘন্টা সব কিছু
স্বাভাবিক, স্থির, চুপচাপ। তার পরেই ঘটনাটার শুরু।
আবছা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে রাত প্রায় আড়াইটার
দিকে আমার দোতলার রুমের
দরজা খুলে ভাসতে ভাসতে আমি ঘর
থেকে বেরিয়ে এসেছি। হাতে কলম আর ডায়েরীটা।
নভোচারীদের মত
শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে সোজা হলরুমের ছাদের
দাবা বোর্ডের দিকে উঠতে লাগলাম।
গিয়ে ঝুলে পড়লাম উল্টো ভাবে। গম্ভীর
মুখে হাটতে হাটতে ডায়েরীতে লিখে যাচ্ছি কি যেন!
এবং লিখছি আমার বাম হাত দিয়ে! যদিও আমি রাইট
হ্যান্ডেড!
আমি বজ্রাহতের মত বসে রইলাম।নিকোলাস
সরাসরি আমাকে এ অবস্থায় দেখেছে কাল রাতে! কারণ
আমি ভিডিওতেই দেখতে পেলাম নিকোলাসের ভয়ার্ত
চিৎকার- হল রুমের নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। আর
ছাদে ঝুলে থাকা আমিখুব বিরক্ত হয়ে নিকোলাসের
দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ইশারা করতেই নিকোলাস
শুন্যে উঠে ঝুলতে থাকল বিচিত্র ভঙ্গিতে!
চেঁচাচ্ছে সে অবস্থাতেই!
আমি সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করি আমার Split
personality বা দ্বৈত সত্ত্বা রয়েছে।
রোগটা কবে থেকে হয়েছে আমি নিজেও জানি না।
যেখানে নিজের ভেতরেই আরো একটা অস্তিত্ব
সৃষ্টি হয়েছে! আমি ঘুমিয়ে পড়লেই ওটা জেগে ওঠে।
সেই অস্তিত্বটাই এতদিন বাম হাতে আমার অজান্তেই
ডায়েরীতে এসব লিখে এসেছে!
( চলবে )