মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আজকের এ মজলিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস সম্পর্কে সংক্ষেপে মুযাকারা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
হাদীসটি ‘মুস্তাদরাকে হাকেম’সহ হাদীসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে—
সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাকে নসীহত করুন এবং সংক্ষেপে বলুন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন—
(১) মানুষের হাতে যা আছে, তা থেকে নিরাশ হয়ে যাও।
(২) লোভ করবে না। কারণ লোভই হল নগদ দারিদ্র্য।
(৩) তুমি নামায এমনভাবে আদায় করবে, যেন তুমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছ!
(৪) এমন কথা ও এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে, যার জন্য পরে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হয়। —মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৯২৮
লক্ষ করুন, সাহাবী বলেছেন— আমাকে নসীহত করুন এবং সংক্ষেপে বলুন। أَوْجزْ শব্দের মধ্যে ‘সংক্ষেপ করুন’-এর অর্থ যেমন আছে, তার চেয়েও বেশি রয়েছে ‘তাসীরপূর্ণ হওয়া’র কথা। অর্থাৎ আমার অন্তরে ও আমলে প্রভাব ফেলে এমন নসীহত করুন!
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চারটি নসীহত করলেন—
এক.
عَلَيْكَ بِالْإِيَاسِ مِمَّا فِي أَيْدِي النَّاسِ.
অর্থাৎ মানুষের হাতে কী আছে, দেখবে না। কার পকেটে কী আছে, কার কাছে কী ধন-সম্পদ আছে, তার দিকে যেন তোমার নযর না যায়! তা থেকে নিরাশ ও বিমুখ হয়ে তোমার দৃষ্টি থাকবে একমাত্র আল্লাহর রহমতের দিকে। আল্লাহ যা দিয়েছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকবে। অন্যের পকেটের দিকে কখনো তাকাবে না!
হালাত ও জরুরত আসতেই পারে। প্রথমেই তোমার মাথায় আসতে হবে যে, আল্লাহ দান করবেন। সেই উদ্দেশ্যে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে দুআ করবে। আর তার জন্য কোনো বৈধ উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার থাকলে সেটিও করবে। কিন্তু অন্য কেউ আমাকে দিয়ে দিক— এমনটা যেন আমার মাথায় না আসে। আসলে সেটা মাথা থেকে সরাতে হবে!
অনেক সময় মানুষের হঠাৎ জরুরত এসে যায়। হঠাৎ কোনো ঠেকা এসে যায়। যেটা বাহ্যত তার সামর্থ্যরে বাইরে। এই ধরনের ক্ষেত্রে অনেকের মাথায় প্রথমেই যা আসে তা হল, কেউ যদি আমার সহযোগিতা করত! অমুক যদি আমার জরুরতটা পূরণ করে দিত! কিন্তু না; এমন করা যাবে না। এমনকি করয বা ঋণ নিতে হলে, সে ক্ষেত্রেও প্রথমে আমার মাথায় সালাতুল হাজত ও দুআর কথা আসতে হবে।
এককথায় মানুষের কাছে কিছু পাওয়ার আশা করবে না। ‘আশা’ তো থাকতেই পারবে না, বরং থাকতে হবে নিরাশা। কে দেবে আমাকে? কেন দেবে? কিছু চাইব তো নয়-ই; চাওয়ার ভানও করব না।
তোমার মেযাজ যদি এমন হয়ে যায়, তোমাকে মানুষ ভালবাসবে। মানুষের ভালবাসা পাওয়ার এটাও একটা উপায়।
দুই.
وَإِيَّاكَ وَالطَّمَعَ فَإِنَّهُ الْفَقْرُ الْحَاضِرُ.
লোভ করবে না। কারণ লোভই হল নগদ দারিদ্র্য।
সুবহানাল্লাহ! আবার খেয়াল করুন। নবীজী বলেছেন—
فَإِنَّهُ الْفَقْرُ الْحَاضِرُ.
লোভই হল নগদ দারিদ্র্য।
কারণ লোভ করা মানে তুমি নিজের অবস্থার ওপর কখনোই সন্তুষ্ট হতে পারবে না। কেবল মনে করবে, আমার নাই! আমার নাই!!
আমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন তার ওপর যদি আমি সন্তুষ্ট থাকি এবং লোভ না করি, তাহলে আমার চেয়ে প্রাচুর্যবান আর কে আছে!
কারণ অন্তরের প্রাচুর্যই প্রকৃত প্রাচুর্য। হাদীস শরীফে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
لَيْسَ الْغِنى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ، وَلكِنَّ الْغِنى غِنَى النَّفْسِ.
অভাবমুক্তি ও প্রাচুর্য সম্পদের আধিক্যের কারণে হয় না; বরং প্রকৃত প্রাচুর্য তো হল অন্তরের প্রাচুর্য। —সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৫১
সেজন্য লোভ থেকে সর্বদা বাঁচতে হবে। লোভ যদি করা হয়, তাহলে যত বেশিই থাকুক, তাতে মন কখনো ভরবে না। সে সর্বদা অভাবের মধ্যেই ডুবে থাকবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
لَوْ كَانَ لِابْنِ آدَمَ وَادِيَانِ مِنْ مَالٍ لَابْتَغَى وَادِيًا ثَالِثًا، وَلَا يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلَّا التُّرَابُ، وَيَتُوبُ اللهُ عَلى مَنْ تَابَ.
আদমের বেটার যদি দুই উপত্যকা সম্পদ থাকে, সে তৃতীয় উপত্যকা চাইবে। আদমের বেটার পেট কেবল মাটিই ভরতে পারে। আর যে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৪৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৩৯
খরচ না বাড়িয়ে কমানোর চিন্তা করি
দুনিয়ার জীবনে আমরা শান্তি পাই না। আমাদের জীবনে শান্তি আসে না। শান্তি না আসার বড় কারণ কী? শান্তি না আসার বড় একটা কারণ হল আমাদের প্রয়োজন বাড়িয়ে ফেলা। জরুরি নয় এমন অনেক কিছুকে আমরা জরুরি মনে করি। তাই আমাদের কর্তব্য হল, আমি কী কী ছাড়া চলতে পারি আর কী কী ছাড়া চলতে পারি না, সেটা শনাক্ত করা।
কোনো খরচ বাড়ানোর আগে আমাকে চিন্তা করতে হবে খরচ কমানোর। এটা যিন্দেগীর গুরুত্বপূর্ণ ফালসাফা এবং অনেক হাদীসের নির্যাস এই চিন্তাটা।
ভাষাটা প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব রাহ.-সহ আরো অনেক বুযুর্গের। প্রফেসর হযরত রাহ. বলতেন, খরচ বাড়ানোর চিন্তা করবে না; বরং যা এখন খরচ হচ্ছে, সেটা কমানোর চিন্তা কর!
আমরা তো মনে করি, এখন যেভাবে খরচ বাড়ছে, আমাদের আয় বাড়ানো দরকার।
হযরত বলতেন, আয় বাড়ানো তো তোমার হাতে নয়; এটা কি মানুষ চাইলে বা ইচ্ছা করলেই পারে? বরং এটা তো সময়সাপেক্ষ ও তাকদীরের বিষয়। চেষ্টা করলে হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। হলেও সেটা নগদ পারব কিনা নিশ্চিত নয়। কিন্তু নগদ যে কাজটা আমি করতে পারি তা হল, খরচ কমিয়ে দেওয়া। আমি দেখি, যে যে খাতে আমি খরচ করছি, ওই খাতগুলোর মধ্যে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বা ‘কম প্রয়োজনীয়’ কোনো খাত আছে কি না!
আমাদের নিজেদের মাঝে এবং পরিবারের সদস্যদের মাঝে যদি এ কথার ওপর আমল এসে যায়, যিন্দেগী অনেক সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় এবং কম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পরিহার করি। এটাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন।
কিন্তু আমি যদি ভাবতে থাকি, অমুকের ওটা আছে, আমারও সেটা দরকার। তাহলে জীবন কঠিন হয়ে যাবে। আর যদি লোভ করা হয়, তবে তো আরো মুশকিল! খোদ লোভটাই এক বড় মসিবত। বড় এক অশান্তি। আর হাদীসের ভাষায়— فَإِنَّهُ الْفَقْرُ الْحَاضِرُ নগদ দারিদ্র্য।
তিন.
وَصَلِّ صَلَاتَكَ وَأَنْتَ مُوَدِّعٌ.
নামায আদায় করবে এমনভাবে, যেন তুমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছ!
এই নামাযই হয়তো আমার জীবনের শেষ নামায— এমন অনুভূতি নিয়ে নামায আদায় কর। নামাযে এমনভাবে মন লাগাও, যেন জীবনের শেষ নামায পড়ছ।
এমনভাবে নামায পড়লে নামাযে এমনিতেই খুশূ-খুযূ আসবে, ইনশাআল্লাহ।
চার.
وَإِيَّاكَ وَمَا تَعْتَذِرُ مِنْهُ.
এমন কথা ও এমন কাজ থেকে বিরত থাক, যার জন্য পরে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হয়।
এমন কথা বলবেই না। এমন কথা বা কাজ করবেই কেন যে, পরে আবার ওযরখাহি করতে হয়? ‘সরি’ বা ‘দুঃখিত’ বলতে হয়?
হাঁ, অনিচ্ছাকৃত কখনো হয়ে গেলে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে; এটা ভালো গুণ। কিন্তু তোমাকে তো সতর্ক থাকতে হবে, যেন এমন কাজ না হয়। আর বুঝে-শুনে এমন কাজ করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
উপরোক্ত হাদীসে এ চারটি নসীহত করা হয়েছে।
আচ্ছা, আমাদের যিন্দেগী ঠিক হওয়ার জন্য অনেক বেশি নসীহতের প্রয়োজন আছে কি? এই চারটা জিনিসের প্রতি লক্ষ রাখলে দ্বীন-দুনিয়া সবই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন, তাওফীক দান করুন— আমীন!