Friday, March 28, 2025

শিশুর লালন-পালনের মূলনীতি

শিশুর লালন-পালনের মূলনীতি
লেখিকা: বিনতে মুহাম্মদ রিজওয়ান (হিফজাহাল্লাহ)
نعم الہ علی العباد کثیرۃ و اجلھن نجابۃ الاولاد

"আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে নেককার সন্তান।"

ভূমিকা
সন্তান হল পিতামাতার জন্য এক অমূল্য উপহার, যা পাওয়া মাত্রই তাদের জীবন নতুন এক দিক নির্দেশনা পায়। তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তাদের সন্তান। অনেক সময় সন্তান লাভের আশায় মানুষ বছরের পর বছর অপেক্ষার কষ্ট সহ্য করে, আর যাদের এই নেয়ামত লাভ হয়, তাদের মধ্যে কখনো উদাসীনতা, কখনো অতিরিক্ত ভালোবাসা ও প্রশ্রয় দেখা যায়। ইসলাম ধর্ম মানুষের স্বভাব অনুযায়ীই জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তাই আমরা দেখি, সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা নবীগণও করেছিলেন।

সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা নবীগণের সুন্নত
সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা রাখা একটি স্বাভাবিক মানবিক চাওয়া। কুরআনে নবী জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া বর্ণিত হয়েছে—

وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِن وَرَائِي وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا
(সূরা মারইয়াম: ৫)

"হে আল্লাহ! আমার মৃত্যুর পর আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আমি শঙ্কিত, আর আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব, তুমি নিজ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরসূরি দান কর।"

নবী জাকারিয়া (আ.) তাঁর উত্তরসূরি চেয়েছিলেন, যে হবে তাঁর জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হিদায়াতের উৎস। একইভাবে কুরআনে তাঁর আরেকটি দোয়া উল্লেখ আছে—

قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ
(সূরা আলে ইমরান: ৩৮)

"হে আল্লাহ! তুমি নিজ অনুগ্রহে আমাকে নেক সন্তান দান কর, নিশ্চয়ই তুমি দোয়া শোনো।"

শিশুর স্বভাব ও চরিত্র গঠনের গুরুত্ব
একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনের ভিত্তি শৈশবেই স্থাপিত হয়। তাই ইসলামে শিশুর সঠিক লালন-পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন—

"তোমাদের প্রত্যেকে একজন দায়িত্বশীল, এবং তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

বিশ্বের মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটি শিশুর ছয় মাস বয়স থেকেই সে যা দেখে, তা তার মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে। আধুনিক গবেষণা দেখিয়েছে, গর্ভকালীন অবস্থায়ও মায়ের কাজকর্ম, ধর্মীয় অনুশীলন ও নৈতিকতা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে।

শিশুর লালন-পালনের ধাপসমূহ
১. গর্ভাবস্থার সময় থেকে জন্মের পূর্বপর্যন্ত
২. জন্ম থেকে তিন বছর পর্যন্ত
3. চার বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত
4. দশ বছর থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত
5. পনেরো বছর থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত

প্রথম ধাপ: জন্মের পূর্বের করণীয়
ইসলাম শিশুর সুস্থ, সুন্দর ও নেককার চরিত্র গঠনের জন্য গর্ভকাল থেকেই বিশেষ দোয়া ও আমলের নির্দেশনা দিয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

"যখন কেউ তার স্ত্রীর কাছে আসে, সে যেন এই দোয়া পড়ে—

'বিসমিল্লাহ! হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা করো এবং আমাদেরকে যে সন্তান দান করবে, তাকেও শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করো।'" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

এছাড়া, কুরআনে বলা হয়েছে, মা মেরিয়ামের মা তাঁর জন্য বিশেষ দোয়া করেছিলেন—

"আমি আমার সন্তান এবং তার বংশধরকে তোমার কাছে শয়তান থেকে রক্ষার জন্য অর্পণ করছি।" (সূরা আলে ইমরান: ৩৬)

ছেলে-মেয়ে উভয়ই আল্লাহর নেয়ামত
কুরআনে আল্লাহ বলেন—

"আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা উভয়ই দেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন।" (সূরা আশ-শূরা: ৪৯-৫০)

কিন্তু এখনো অনেক সমাজে কন্যাসন্তান অবহেলিত হয়। এমনকি কিছু মানুষ জন্মের আগেই মেয়ে সন্তান জেনে গর্ভপাত করিয়ে ফেলে, যা কুরআনে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে—

"নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হলো তারা, যারা মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের সন্তানদের হত্যা করে।" (সূরা আন'আম: ১৪০)

সন্তান পিতামাতার জন্য একটি আমানত ও পরীক্ষা
কুরআনে বলা হয়েছে—

"জেনে রাখো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এক ধরনের পরীক্ষা।" (সূরা আল-আনফাল: ২৮)

"সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা মাত্র।" (সূরা আল-কাহাফ: ৪৬)

শিশুর সঠিক লালন-পালনের জন্য করণীয়
১. ধর্মীয় শিক্ষা: শিশুদের ছোটবেলা থেকেই তাওহিদের শিক্ষা দেওয়া, কুসংস্কার ও বিদআত থেকে দূরে রাখা।
২. নৈতিক শিক্ষা: সুন্দর ভাষা, শিষ্টাচার, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা শেখানো।
৩. শারীরিক যত্ন: সুস্থ খাবার গ্রহণ, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা।
৪. বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষা: শিশুর চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশের দিকে মনোযোগ দেওয়া।
৫. মানসিক বিকাশ: শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা, লজ্জাশীলতা ও অপরাধবোধ তৈরি না করা।
৬. সামাজিক ও যৌন শিক্ষা: শিশুকে তার শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে উপযুক্ত সময়ে সচেতন করা।

দ্বিতীয় ধাপ: জন্ম থেকে তিন বছর পর্যন্ত
এই সময় শিশুর নিরাপত্তার জন্য বিশেষ দোয়া পড়া উচিত।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

"যখন কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করে, তখন শয়তান তাকে কষ্ট দেয়, ফলে সে কেঁদে ওঠে। তবে মা মেরিয়াম ও ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রে এটি হয়নি।" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

নবজাতকের ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া সুন্নত।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন—

"আজান দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর মহত্ব ও তাওহিদের বাণী পৌঁছানো।"

এই নীতিগুলোর অনুসরণ করলে সন্তান শুধু পার্থিব জীবনে নয়, আখিরাতেও সফল হবে, ইনশাআল্লাহ।

শিশুর জেদ দূর করার দোয়া

শিশুর জেদ দূর করার দোয়া

أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ

উচ্চারণ: আফাগাইরা দ্বি-নিল্লাহি ইয়াবগুন, ওয়ালাহু আসলামা মান ফিস্-সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্ব, তাউআং ওয়া কারহাং; ওয়া ইলাইহি ইয়ুরজাঊন।

অর্থ : ‘তারা কি আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্য জীবন ব্যবস্থা তালাশ করছে? নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে— স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তার অনুগত হবে। সবাই তার কাছে ফিরে যাবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৮৩)

ফজিলত ও হাদিস : যে ব্যক্তির সন্তান বা প্রাণী তাকে কষ্ট দেয়, সে যেন তার কানে সূরা আল ইমরানের ৮৩ নং আয়াত পড়ে। (আল-মুজামুল আউসাত লিত্ তাবারানি, হাদিস : ৬৪)


শিশুর জেদ দূর করার আমল

সন্তানের অতিরিক্ত জেদ থাকলে, কথা না শোনলে, কথা না মানলে প্রতিদিন ৭ বার সন্তানের কপালের উপরিভাগের চুলে হাত রেখে এ আয়াতখানা পাঠ করে তার চেহারা ও কানে ফুঁ দিলে— জেদ কমে আসে। এ আমল নূন্যতম ২১ দিন লাগাতার করতে হয়।

কালেক্টেড