Monday, December 19, 2011

শীতের সকালে [ Collection of Love Stories -10 ]



হাঁটতে হাঁটতে অদূরে থাকা পার্কটার কাছে চলে এলো আবির। শীতের সকালে প্রায়ই সে একা একা হাঁটতে বের হয়। কুয়াশায় ঢাকা ভোরবেলা সবাই যখন লেপের ভিতর আরামসে ঘুমে মগ্ন তখন সে সুয়েটার, কেডস আর মাফলার গলায় পেঁচিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্যান্টের পকেটের ভিতর দুই হাত ঢুকিয়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটলেও টের পায় না সে। শুরুতে একটু কষ্ট হলে আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তার।

রাস্তার পাশে টঙ চায়ের দোকান খোলা পেলে ওখানেই বসে পড়ে। ধোঁয়া ওড়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে থাকে। ঐ মুহুর্তের মতো এতো আনন্দ সে আর কখনো উপলব্ধি করতে পারে না। আনন্দের ঐ মুহুর্তের টানেই মনে হয় তার এই প্রায়শ বেড়িয়ে পড়া।



প্রায় ২০ মিনিট একটানা হাঁটার পর সম্মুখেই পার্কের ঢোকার প্রবেশ মুখ। পার্কের সবুজ ঘাসে ভোরের শিশির বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। খালি পায়ে শিশিরে ভেজা এই ঘাসের উপর হাঁটতে অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়।



পার্কের ভিতর মানুষের সমাগম খুবই কম। বিকেল বেলা তো জনসমুদ্র হয়ে যায়। কংক্রিট আর বিশাল বিল্ডিং-এ চারদিক ঢাকা এই শহরে পার্কের সবুজ ছায়ায় একটু শান্তির জন্য মানুষ এসে ভিড় করে। এখন যারাই আছে তারা কেউ কেউ জগিং করছে, আবার কেউ ব্যায়াম করছে। কেউবা সিমেন্টের বেঞ্চিটায় বসে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে।

অনেকক্ষণ থেকে হাঁটার ফলে একটু ক্লান্তি লাগছিল আবিরের। পার্কের ভিতর ঢুকে একটা বেঞ্চির উপর বসলো সে। মাথাটা উপরের দিকে দিয়ে চোখটা বন্ধ করলো একটু জিরিয়ে নিবে বলে।



ভাইজান ভাইজান ! হঠাৎ এই শব্দে আবিরের চেতন হল। এতক্ষন চোখটা বন্ধ করে প্রায় ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছিল সে।

চোখ খুলেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ১৩-১৪ বছরের একটি ছেলে। কাঁধে তার ঝুলানো একটি বস্তা। পরনে শুধুমাত্র একটি ময়লা হাফপ্যান্ট। এতো ঠাণ্ডার মধ্যেও খালি গায়ে টায় দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এসবে সে অনেক অভ্যস্ত। চেহারাটা দেখে অনেক নিস্পাপ মনে হয়।



-ভাইজান,দুইটা টাকা দেন। ছেলেটা আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল।

-দুই টাকা দিয়ে কি করবে?

-আপনে দুই টেকা দিলে আমার কাছে আরও দুই টেকা আরও এক টেকা কারও কাছ থাইকা নিয়া বন (বাটার পাউরুটি)খামু।

-আপনার কাছে ৩ টেকা চাইলে তো আর দিবেন না তাই দুই টেকা চাইলাম। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল ছেলেটা।

-আচ্ছা দিবো। তা তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?

-আমাগো আবার কিসের ঠাণ্ডা? আমাগো লাইগা ঠাণ্ডা-গরম সবই সমান।

-তা নাম কি তোমার?

-আমার কিছু বন্ধু আছে তারা আমারে বইল্যা নামে ডাকে। আর আম পাবলিকে ডাকে টোকাইকয়া।

-তোমার বাবা -মা আছে ?

-না ভাইজান বাবা-মারে কোনদিন দেখিই নাই। বুঝ হওয়ার পর থাইকা বস্তির আজম চাচার কাছে বড় হইছি। আজম চাচায়ও মারা গেল দুই বছর হইয়া গেছে। এরপর থাইকা রাস্তায় রাস্তায়। কোনসময় রাস্তায় আবার কোন সময় পার্কে শুইয়া রাইত পার কইরা দেই। যেখানে রাইত সেইখানে কাইত হইয়া যাই। তাও পুলিশে মাঝে মইদ্ধে বিরক্ত করলে ঐ রাইত আর ঘুমই অয় না।



ছেলেটার কথা শুনে কেমন যেন মায়া লাগলো আবিরের। তারও ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট একটা ভাই আছে। ওর মুখটার কথা কেন জানি ভেসে উঠলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখে।



- খিদা লাগছে তোমার? জিজ্ঞেস করলো আবির।

- খিদা তো ভাইজান অলটাইমই থাকে। খিদা লাগছে দেইখা তো আপনের কাছে দুই টেকা খুঁজলাম।

-বাহ ইংরেজিও জানো দেখছ। পড়ালেখা করো?

-হাসল বইল্যা। না ভাইজান পড়ালেখা করি না। আপনারদের মতো কিছু শিক্ষিত মানুষের কথা শুইনা শুইনা শিইখা ফালাইচি।

খিদা আমারও লাগছে। চলো ঐ দিকে একটা রেস্টুরেন্টে আছে ঐখানে যাই।

বইল্যা সন্দেহের চাহনি নিয়ে বলল, ভাইজান আপনি ছেলেধরা-টেলেধরা না তো ?

আবির হাসলো। আরে না আমি এসব কিছু না। তোমার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। তাছাড়া তুমিও ক্ষুধার্ত আমি ক্ষুধার্ত তাই বললাম আর কি। এখন তুমি চাইলে আসতে পারো, তোমার ইচ্ছা।

-হুম তাইলে চলেন। তাছাড়া আপনেরে দেখে এই সব মনেও অয় না।

আবির হাসল।



রেস্টুরেন্টে এসে ওয়েটারকে ডাক দিয়ে নাস্তার অর্ডার দিল আবির। ওয়েটারটা যাবার সময় বাঁকা চোখে চেয়ে গেলো বইল্যার দিকে।

-তা বইল্যা। রাতে তো প্রচণ্ড শীত থাকে ঘুমাও কিভাবে?

বইল্যা কোন কথা না বলে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে টেবিলের উপর রেখে বসল।

-এই যে ব্লেড দেখতাসেন ভাইজান এইটা দিয়া ব্যানার কাটি।

-ব্যানার কাটো মানে ? অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো আবির।

-রাতে বেশি ঠাডা পড়া শীত পড়ে। আর সামনে তো আরও বেশি শীত পরবো। তাই ব্যানার কাইটা শরিলে জড়াইয়া ঘুমাইলে ঠাণ্ডা একটু কমই লাগবো।





কথাগুলো শুনে এতোটাই খারাপ লাগলো আবিরের যে নিজের অজান্তেই মনের কোণ থেকে কখন একবিন্দু অশ্রু জড়িয়ে পরলো সে তা টেরই পেল না। এত কম বয়সে এই সব ছেলেরা এতো অবহেলিত? এতো কষ্টে দিন যাপন করে এরা ? আমরা কি কিছুই করতে পারি না এদের জন্য ?

মানুষ হিসেবে দাম দিলে কোন মানুষের জন্য কিছু করতে মন চায়। কিন্তু আমরা তো এদের মানুষই মনে করি না। কাছে এসে এক টাকা দুই টাকা খুঁজলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই, সাথে দেই কয়েকটা গালি। কবে যে এদের এই দুঃখের দিন শেষ হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন।

এরই মধ্যে ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। খাবার দেখে বইল্যার চোখে মুখে খুশির ছটা ফুটে উঠলো।



-ভাইজান, এইসব খাবার এর আগে অনেক দেখছি কিন্তু কখনো খাওয়া হয় নাই।

-তাহলে এবার যত খুশি খাও।



খুব তাড়াতাড়িই খাওয়া শেষ হয়ে গেল দুজনের। ঢেকুর তুলতে তুলতে বইল্যা বলল,

-ভাইজান আজকে আর খাওয়া লাগব না। যে খাওয়া খাইছি তাতে আইজ পার হইয়া যাইব। আপনারে অনেক ধইন্যবাদ ভাইজান। এরকম করে কেউ কোনদিন খাওয়ায় নাই।

-আরে ধন্যবাদ কিসের?

-তোমাকে খাওয়াতে পেরে অনেক ভালো লাগছে আমার।

-ভাইজান এবার আমাকে যেতে হবে না হলে সিটি কর্পোর গাড়ি সব ময়লা নিয়া গেলে শেষে কিছুই পামু না আমি। বইল্যা যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো।



একটু দাঁড়াও বইল্যা। আবির তার পড়নের সুয়েটারটা খুলে বইল্যাকে দিয়ে বলল, এটা রাখ তুমি। তোমার শীত কিছুটা হলেও কম লাগবে হয়তোবা রাতে আরামে ঘুমাতেও পারবে।

বইল্যা খুব বেশি অবাক হল।

-ভাইজান,আপনার তো এখন ঠাণ্ডা লাগবো।

-আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি বাসায় চলে যাব একটু পরে। তখন আরেকটা পড়ে নিবো। এটা তুমিই রাখো।

-ভাইজান,আমি আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়াতে আরেকটা দেখি নাই। দুনিয়াতে আপনি অনেক বড় হবেন। চোখ দুটি ছল ছল হয়ে উঠলো বইল্যার।

-লজ্জা দিও না আমাকে বইল্যা। ভালো থেকো।

-না ভাইজান আপনে হাছাই খুব ভালা মানুষ। আপনেও ভালো থাকেন ভাইজান।

চোখ মুছতে মুছতে বইল্যা রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। সুয়েটারটা এক হাতে আর আরেক হাতে বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল পার্কের মধ্যে। আবিরও উঠতে যাবে এমন সময় দেখে বইল্যার ব্লেডটা টেবিলের উপর পড়ে আছে।

আবির ব্লেডটা হাতে নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল-ব্লেডটার কি আর দরকার আছে??



******************************************************************





শেষকথাঃ এই গল্পটার স্থান এবং চরিত্র কাল্পনিক হলেও শীতের এক সকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা হয়েছে।

আমাদের চোখের আশেপাশে কত বইল্যারা এভাবে দিন যাপন করছে তার খোঁজ আমরা কখনই রাখি না।

অবহেলিত আর কষ্টে জর্জরিত জীবনে তাদের ক্ষীণ পাওয়া সুখ ঐ কষ্টের মধ্যেই আবার মিলিয়ে যায় যা আমরা দেখতে পারি না। এই বইল্যারা সঠিক পথের অভাবে আজ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রভুদের ডান আর বাম হাত !

এদের ছোটবেলাই কাটে অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যে বয়সে এদের খেলার কথা,পড়ার কথা সেই বয়সে তারা জীবন যুদ্ধের কাজে লিপ্ত। তাদের সঠিক পথে আনার কোন মাথা ব্যাথাই যেন নেই প্রভুদের।

তাদের মাথা ব্যাথাটা না থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ এই সব বইল্যাদের দিয়েই তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করে।



লিখেছেন- ফারহান খান

FB ID- Farhan Khan





গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/শীতের-সকালে/210922285654595 


''ভালবাসা কিংবা অন্য কিছু '' [ Collection of Love Stories -09 ]







মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে হিমেলের ৷ সকাল থেকে এ পর্যন্ত (রাত ২টা) ছয়টা এস .এম. এস করেছে সে লাবণ্যকে ৷ কিন্তু কোন রিপ্লাই নেই ৷ মোবাইলের ম্যাসেজ এলার্ট অন করা থাকলেও বার বার তাকাচ্ছে মোবাইলের দিকে ৷ সাধারনত অন্য সময় ব্যস্ত থাকলেও রাতে ঘুমোতে যাবার আগে এবং সকালে অন্তঃত একটা ''শুভ রাত্রি'' এবং একটা ''শুভ সকাল'' মেসেজ দিতে ভুলে না লাবণ্য ৷ কিন্তু আজ কোনটাই না পেয়ে চরম অস্হির হয়ে উঠেছে হিমেল ৷ শেষ পর্যন্ত ফোন করল লাবণ্যকে ৷ বেশ ক'বার রিং হবার পরও answer করল না লাবণ্য ৷ প্রচন্ড রাগে মোবাইলটা মাটিতে আছাড় মারল সে ৷ বাকি রাতটা অস্হিরতা আর অশান্তিতে না ঘুমিয়েই কাটাতে হলো হিমেলকে ৷



সকালে খুব ছোট একটা ম্যাসেজ আসলো মোবাইলে ''শুভ সকাল'' sorry আমি খুব busy পরে কথা বলব ,bye. সাথে সাথে রিপ্লাই দিল হিমেল ''তুমি কি কোন সমস্যায় আছো?'' কিন্তু কোন রিপ্লাই পেল না ৷ কিছুক্ষন পর ফোন করেও বন্ধ পেল লাবণ্য'র মোবাইল ৷ বিষয়টা বেশ চিন্তিত করে তুলেছে হিমেলকে ৷ কিছুই ভাল লাগছে না তার ৷ লাবণ্য'র এরকম হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারন বুঝতে পারছে না সে ৷ রাগ ও অভিমানে হিমেল সিদ্ধান্ত নিল কিছুদিন কোন যোগাযোগ করবে না লাবণ্য'র সাথে ৷



দুই দিন পর আবার এস.এ.মএস করল সে ৷ ভুলে গেল সব রাগ অভিমান ৷ যদিও মনের কোনে কিছুটা রাগ রয়ে গেছে কারন এই দুই দিনে লাবণ্য একটিবারও তার সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেনি ৷ কিন্তু লাবণ্য'র রিপ্লাই পেয়ে নিমিষেই সব কষ্ট ভুলে গেল ৷ কথা হল দুজনের অনেক্ষন ৷ কিন্তু ঐ পর্যন্তই ৷ লাবণ্য বদলে যেতে থাকলো ৷ আগে যেখানে  প্রায় সারাদিনই দুজনের কথা বা মেসেজ আদান প্রদান হত সেখানে এখন সারাদিনে ২/৩ টা রিপ্লাই দেয় লাবণ্য ৷ সে ফোন করলে ২/১ মিনিট কথা বলে পরে ফোন back করার কথা বলে রেখে দেয় ৷ কিন্তু backকরে না আর ৷ ক্রমেই বদলে যেতে থাকে লাবণ্য ৷



রাত বাড়ছে ,হিমেলের চোখে ঘুম নেই ৷ আজ খুব মনে পড়ছে লাবণ্য'র সাথে প্রথম পরিচয় পর্বটা ৷ মোবাইলের ক্রস কানেকশনের মাধ্যমে লাবণ্য'র সাথে প্রথমে পরিচয় ,তারপর বন্ধুত্ব ৷ অনেক কথা হত দুজনের ৷ পারিবারিক ,সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা গুলো দুজনে শেয়ার করত অনায়াসে ৷ কোন সময় একজনের কোন কারনে মন খারাপ হলে অন্যজন আপ্রান চেষ্টা করত মন ভাল রাখার ৷ঠিকমত ঘুম ,খাওয়া দাওয়া হচ্ছে কি না খবর রাখত একজন আরেকজনের ৷ এমন কী মাঝে মাঝে কিছু আবেগ অনুভূতি ,প্রেম ভালবাসার কথাও হত দুজনের মাঝে ৷ কোন কোন দিন এসব topic লাবণ্য কৌশলে এড়িয়ে যেত আবার কোন কোন দিন খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করত ৷ দিন যতই গড়িয়ে যেতে লাগল হিমেল ততই দূর্বল হয়ে পড়ল লাবণ্য'র প্রতি ৷ কিন্তু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে হিমেল তার ভালবাসার কথা কখনো স্পষ্ট করে বলতে পারেনি লাবণ্যকে ৷ তারপরও লাবণ্য'র প্রতি কেমন যেন বুদ হয়ে থাকত সবসময় ৷ একদিন কথা না হলে পাগলের মত হয়ে যেত হিমেল ৷ আজ এসব স্মৃতি মনে পড়ে চোখ জলে ভরে উঠল তার ৷ সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেন লাবণ্য  তাকে হঠাৎ করে  ignore করছে ৷ আজ দুই সপ্তাহ হতে চলল লাবণ্য'র সাথে কোন যোগাযোগ নেই হিমেলের ৷



বেশ কিছুদিন থেকে রাতে একদম ঘুম হয় না হিমেলের ৷ এক ধরনের ইনসমনিয়ায় ভুগছে সে ৷ প্রায় নির্ঘুম কাটে প্রতিটি রাত ৷ সারাক্ষন তাকিয়ে থাকে মোবাইলের দিকে ৷ জানে হারিয়ে গেছে লাবণ্য ,তারপরও হিমেল অজান্তেই অপেক্ষা করে তার ফোনের ৷



রাতে ঘুম না হওয়া চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেঁছে হিমেলের ৷ মাত্র ২/১ ঘন্টা ঘুম হয় ৷ তা-ও কিছুক্ষন পরপর ঘুম ভেঙ্গে যায় ৷ অশান্তি আর অস্হিরতা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে ৷ ঘুম না হওয়ার প্রভাব পড়েছে চেহারা ও আচরনে ৷ বন্ধু বান্ধব এমনকি পরিবারের সদস্যদের সাথে অকারনেই রেগে যাওয়া ,কর্কশ ভাষায় কথা বলা ,কথায় কথায় ঝগড়া করা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ সবকিছুই যেন অসহ্য লাগে ৷ এই তো সেদিনও দুপুরে খাবার খেতে জোরাজোরি করায় ছোট বোনটাকে কষে চড় মেরেছিল সে ৷ হিমেলের এ অবস্হা দেখে মা বার বার ডাক্তার দেখাতে বলছেন ৷ কিন্তু ইচ্ছে করেই সে ডাক্তার দেখাচ্ছে না ৷ কেবল রাতে বিছানায় এসে এপাশ ওপাশ করতে করতে যখন ঘুম আসেনা তখনই মনে হয় শীঘ্রই ডাক্তার দেখাতে হবে ৷



একটি আন্তর্জাতিক চ্যারেটি সংস্হায় সেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছে হিমেল ৷ তার কাজ হচ্ছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসায় বাসায় গিয়ে পুরনো ও অব্যবহৃত কাপড় চোপড় সংগ্রহ করা এবং কেউ উৎসাহিত হলে সংস্হায় কিছু আর্থিক অনুদান জোগাড় করা ৷ পরে এসব কাপড় শহরের অলিতে গলিতে থাকা পথহারা শিশুদের মাঝে বিতরন করা ৷ দুটো কারনে এই সংস্হায় কাজ করতে আগ্রহী হয়েছে সে ৷ এক; কাজের ক্ষেত্র ঢাকা শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা হওয়ায় লাবণ্য কে খুঁজা যাবে৷ দুই ;পথহারা শিশুদের মাঝে কাজ করে ওদের আনন্দের মাঝে নিজের দুঃখকে ভুলার চেষ্টা করা৷



আজ সারাদিন শিশুদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কেটেছে হিমেলের ৷ দিনভর প্রচুর পরিশ্রম গেছে ৷ বাসায় ফিরে তাই পরিশ্রান্ত দেহটা সে এলিয়ে দেয় বিছানায় ৷ এপাশ ওপাশ করতে করতে ও ঘুম না আসায় বাধ্য হয়ে একটি গল্পের বই হাতে নেয় ৷ পড়তে পড়তে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় হিমেল ৷



হঠাৎ দরজায় প্রচন্ড জোরে ধাক্কাধাক্কি আর ছোট বোন স্নেহার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার ৷ দরজা খুলে ধমকের সুরে বলল কী-রে ,বাড়িতে ডাকাত পড়েছে না কি ? এতো চেঁচামেচি কেন ? স্নেহা বলল ,ভাইয়া ,এর চেয়েও ভয়াভহ ঘটনা ঘটেছে ৷ একটা মেয়ে এসেছে তোমার খোঁজে ৷ বলছে তোমার জন্য না-কি সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ৷ স্নেহার কথায় যেন আকাশ থেকে পড়ল হিমেল ৷ লাবণ্য ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে তার এমন কোন সম্পর্ক নেই যে তার জন্য কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে আসবে ৷ আর লাবণ্য তো হারিয়ে গেছে ৷হিমেল তাই বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল মেয়েটা এখন কোথায় রে ? ড্রয়িং রুমে বসে আছে ৷



মুখ না ধুঁয়েই ড্রয়িং রুমে ছুটলো সে ৷এখানে লাবণ্যকে বসে থাকতে দেখে হার্টের একটা বিট যেন মিস করল হিমেল ৷ ভাল করে আবার তাকালো মেয়েটার দিকে ৷ হ্যাঁ ,ই-মেইলে যে ছবি লাবণ্য তাকে দিয়েছিল এ তো সেই মেয়ে অর্থাৎ লাবণ্যই ৷ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই ৷ তার হারিয়ে যাওয়া  লাবণ্যকে প্রথমবার সামনা সামনি দেখে মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না ৷ দুজনে নীরবে চোখে চোখে চেয়ে থাকল কিছুক্ষন ৷ শেষে লাবণ্যই নীরবতা ভাঙলো, চিনতে পেরেছো আমাকে ? অভিমানের সুরে হিমেল উত্তর দিল চিনতে পারার কথা কি? বেশ ! না চিনলে চলে যাই তাহলে ৷

চলেই যখন যাবে ,আসলে  কেন তাহলে ?



এভাবে মান অভিমান পর্ব শেষে হিমেল জানতে চাইল হঠাৎ অমন করে লাবণ্য তার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল কেন ? লাবণ্য বলল তোমার সাথে এভাবে ঘন ঘন যোগাযোগ ভাইয়া ও বাবা ভাল চোখে দেখেনি তাছাড়া  তারা  অন্য এক ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করায়  তোমার সাথে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দেয় ৷ এমনকি এক ধরনের গৃহবন্দি করে রাখে আমাকে ৷ আগামিকালই ঐ ছেলের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ,তাই অনেক কষ্টে ও চেষ্টায় আজ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি ৷

কিন্তু আমার ঠিকানা পেলে কী করে ?

তোমার মনে আছে ,একদিন তুমি বলেছিলে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে এই ঠিকানায় তোমরা move করছো ৷ ভাগ্যিস ঠিকানাটা আমার মনে ছিল ৷ তা-না হলে তো এ জীবনে আর তোমাকে পাওয়া হত না আমার ৷ আলাপের শেষ দিকে রুমে ঢুকে হিমেলের বাবা ,মা আর স্নেহা ও সব শুনল ৷ সব শুনে বাবা বললেন লাবণ্য'র পরিবারকে রাজি করিয়েই দুজনের বিয়ে দেয়া হবে ৷ মনে হয় তারা রাজি হবে না ,এতে ঝামেলা আরও বাড়বে হিমেলের সোজা উত্তর ৷ যা করার নিজেদেরকে করতে হবে আজই ৷ শেষ-মেষ সিদ্ধান্ত হল আজই কাজী ডেকে হিমেল আর লাবণ্য'র বিয়ে পড়ানো হবে ৷



বাড়িতে  অনেকটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে ৷ যদিও একান্ত পারিবারিক ভাবেই সাদামাটা বিয়ে হচ্ছে তারপরও ঘনিষ্ট কিছু আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এসেছেন ৷  তাদেরকে নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে স্নেহা, আর কিছুক্ষন পরপর এসে লাবণ্য'র সাথে দুষ্টুমি করছে ৷ কিছুক্ষন আগেই হিমেল ,লাবণ্য'র বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে ৷ হিমেল তাকিয়ে আছে লাবণ্য'র দিকে ৷ আজ যেন লাবণ্যকে আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি সুন্দর লাগছে ৷সে ভাবছে সব মেয়েকে-ই কি বিয়ের দিন এত সুন্দর লাগে? তার তাকিয়ে থাকা দেখে লাবণ্য বলল কী দেখছ এত ?

দেখছি তোমাকে ।

আমাকে তো আজ সারাদিনই দেখেছ ৷ নতুন করে দেখার কী হল ?

হুম ,সারাদিন দেখেছি অন্যভাবে ,এখন দেখছি নিজের বউ হিসাবে ।

তাক, আর দেখতে হবে না ।এই ,আজ পূর্নিমা না ? চলো ছাদে যাই ৷ আজ পুরো রাত দুজনে গল্প করে কাটাব ৷



 ভরা জোঁছনায় ছাদে হাত ধরাধরি করে বসে আছে তারা দুজন ৷ হিমেল বলল এত সহজে সবকিছু হয়ে গেল ,আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না ।

সত্যি ,আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না ।বাসা থেকে যখন পালাই তখন আশঙ্কায় ছিলাম এই ঠিকানায় যদি তোমাকে না পাই !! শেষ পর্যন্ত আমাদের ভালবাসারই জয় হল ।

আচ্ছা ,আমাকে এই ঠিকানায় না পেলে কী করতে ?

কী আর করতাম আত্মহত্যা ।

তুমি সত্যি এত ভালবাস আমাকে ?এত দিন কেন বুঝতে দাওনি ?

বরং আমি যেদিন তোমাকে ভালবাসার কথা বললাম সেদিন থেকেই তুমি আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলে ৷

আসলে ভালবাসার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে আমি দেখতে চেয়েছি তুমি সত্যি কতটা ভালবাস আমায় ৷ আর যোগাযোগ বন্ধ হবার কারন তো আগেই বলেছি ৷ যাই হোক ,বাদ দাও ঐসব ৷ এখন তো আমি তোমারই ৷

হুম , সেজন্যই-তো আমি এখন পৃথিবীর সেরা সুখী একজন ৷ আর সেই সুখে এখন আমার চোখে রাজ্যের সব ঘুম ৷ চল ঘুমাতে যাই ৷

কী! এখন ঘুমাবে?আমি আজ সারারাত তোমার হাত ধরে বসে থাকব আর তোমার কবিতা শুনব ৷



বেশ ,আমার চোখ দুটো তাহলে তোমাকে টেনে মেলে ধরতে হবে ৷

ঠিক আছে তা-ই হবে ৷





প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দ হচ্ছে ৷ স্নেহা উৎকন্ঠিত কন্ঠে ডেকেই যাচ্ছে ,ভাইয়া ,এই ভাইয়া ওঠ ,ওঠনা ৷ অনেক বেলা হয়ে গেছে ৷ বাবা ,মা ও ডেকে যাচ্ছেন হিমেল,বাবা  দরজাটা খোল, বাবা ৷ দরজা ধাক্কানোর শব্দ আরও বাড়তেই হঠাৎ ঘুম ভাঙল হিমেলের ৷ উঠে দরজা খুলতে খুলতে মোবাইলে সময় দেখল ,দুপুর ১২টা ৷ চোখ মুছতে মুছতে রুমের চারিদিকে তাকাল সে ৷ কোথাও লাবণ্য নেই ৷ তাহলে কি সে পুরো রাত জুড়ে স্বপ্নই দেখেছে ? কিন্তু স্বপ্নটা এতই স্পষ্ট ছিল যে ওটা স্বপ্ন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে হিমেলের ৷ ভাবছে ,এই ঘুম যদি আর কখনোই না ভাঙতো !!!






বিঃদ্রঃ পাঠক ,ইচ্ছে করলে আপনারা হিমেলকে ঘুম থেকে না জাগিয়েই গল্পটা শেষ করতে পারেন ৷ ধন্যবাদ ৷



লিখেছেন-সোহেল রহমান



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)







গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ভালবাসা-কিংবা-অন্য-কিছু-/212921565454667