হাঁটতে হাঁটতে অদূরে থাকা
পার্কটার কাছে চলে এলো আবির। শীতের সকালে প্রায়ই সে একা একা হাঁটতে বের হয়।
কুয়াশায় ঢাকা ভোরবেলা সবাই যখন লেপের ভিতর আরামসে ঘুমে মগ্ন তখন সে সুয়েটার, কেডস আর মাফলার গলায় পেঁচিয়ে রাস্তায় নেমে আসে।
প্যান্টের পকেটের ভিতর দুই হাত ঢুকিয়ে ঘন্টা দুয়েক হাঁটলেও টের পায় না সে।
শুরুতে একটু কষ্ট হলে আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তার।
রাস্তার পাশে টঙ চায়ের
দোকান খোলা পেলে ওখানেই বসে পড়ে। ধোঁয়া ওড়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে
থাকে। ঐ মুহুর্তের মতো এতো আনন্দ সে আর কখনো উপলব্ধি করতে পারে না। আনন্দের ঐ
মুহুর্তের টানেই মনে হয় তার এই প্রায়শ বেড়িয়ে পড়া।
প্রায় ২০ মিনিট একটানা
হাঁটার পর সম্মুখেই পার্কের ঢোকার প্রবেশ মুখ। পার্কের সবুজ ঘাসে ভোরের শিশির
বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। খালি পায়ে শিশিরে ভেজা এই ঘাসের উপর হাঁটতে অন্য রকম
অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
পার্কের ভিতর মানুষের সমাগম
খুবই কম। বিকেল বেলা তো জনসমুদ্র হয়ে যায়। কংক্রিট আর বিশাল বিল্ডিং-এ চারদিক
ঢাকা এই শহরে পার্কের সবুজ ছায়ায় একটু শান্তির জন্য মানুষ এসে ভিড় করে। এখন
যারাই আছে তারা কেউ কেউ জগিং করছে, আবার কেউ ব্যায়াম করছে। কেউবা সিমেন্টের বেঞ্চিটায় বসে খানিকটা
জিরিয়ে নিচ্ছে।
অনেকক্ষণ থেকে হাঁটার ফলে
একটু ক্লান্তি লাগছিল আবিরের। পার্কের ভিতর ঢুকে একটা বেঞ্চির উপর বসলো সে। মাথাটা
উপরের দিকে দিয়ে চোখটা বন্ধ করলো একটু জিরিয়ে নিবে বলে।
ভাইজান ভাইজান ! হঠাৎ এই
শব্দে আবিরের চেতন হল। এতক্ষন চোখটা বন্ধ করে প্রায় ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছিল সে।
চোখ খুলেই দেখে সামনে
দাঁড়িয়ে আছে ১৩-১৪ বছরের একটি ছেলে। কাঁধে তার ঝুলানো একটি বস্তা। পরনে
শুধুমাত্র একটি ময়লা হাফপ্যান্ট। এতো ঠাণ্ডার মধ্যেও খালি গায়ে টায় দাঁড়িয়ে
আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এসবে সে অনেক অভ্যস্ত। চেহারাটা দেখে অনেক নিস্পাপ মনে
হয়।
-ভাইজান,দুইটা টাকা দেন। ছেলেটা আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল।
-দুই টাকা দিয়ে কি
করবে?
-আপনে দুই টেকা দিলে
আমার কাছে আরও দুই টেকা আরও এক টেকা কারও কাছ থাইকা নিয়া বন (বাটার পাউরুটি)খামু।
-আপনার কাছে ৩ টেকা চাইলে
তো আর দিবেন না তাই দুই টেকা চাইলাম। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল ছেলেটা।
-আচ্ছা দিবো। তা তোমার
ঠাণ্ডা লাগছে না?
-আমাগো আবার কিসের
ঠাণ্ডা? আমাগো লাইগা ঠাণ্ডা-গরম সবই সমান।
-তা নাম কি তোমার?
-আমার কিছু বন্ধু আছে
তারা আমারে বইল্যা নামে ডাকে। আর আম পাবলিকে ডাকে “টোকাই”
কয়া।
-তোমার বাবা -মা আছে ?
-না ভাইজান বাবা-মারে
কোনদিন দেখিই নাই। বুঝ হওয়ার পর থাইকা বস্তির আজম চাচার কাছে বড় হইছি। আজম
চাচায়ও মারা গেল দুই বছর হইয়া গেছে। এরপর থাইকা রাস্তায় রাস্তায়। কোনসময়
রাস্তায় আবার কোন সময় পার্কে শুইয়া রাইত পার কইরা দেই। যেখানে রাইত সেইখানে
কাইত হইয়া যাই। তাও পুলিশে মাঝে মইদ্ধে বিরক্ত করলে ঐ রাইত আর ঘুমই অয় না।
ছেলেটার কথা শুনে কেমন যেন
মায়া লাগলো আবিরের। তারও ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট একটা ভাই আছে। ওর মুখটার কথা
কেন জানি ভেসে উঠলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখে।
- খিদা লাগছে তোমার?
জিজ্ঞেস করলো আবির।
- খিদা তো ভাইজান
অলটাইমই থাকে। খিদা লাগছে দেইখা তো আপনের কাছে দুই টেকা খুঁজলাম।
-বাহ ইংরেজিও জানো
দেখছ। পড়ালেখা করো?
-হাসল বইল্যা। না
ভাইজান পড়ালেখা করি না। আপনারদের মতো কিছু শিক্ষিত মানুষের কথা শুইনা শুইনা শিইখা
ফালাইচি।
খিদা আমারও লাগছে। চলো ঐ
দিকে একটা রেস্টুরেন্টে আছে ঐখানে যাই।
বইল্যা সন্দেহের চাহনি নিয়ে
বলল, ভাইজান আপনি ছেলেধরা-টেলেধরা না তো ?
আবির হাসলো। আরে না আমি এসব
কিছু না। তোমার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। তাছাড়া তুমিও ক্ষুধার্ত আমি
ক্ষুধার্ত তাই বললাম আর কি। এখন তুমি চাইলে আসতে পারো, তোমার ইচ্ছা।
-হুম তাইলে চলেন।
তাছাড়া আপনেরে দেখে এই সব মনেও অয় না।
আবির হাসল।
রেস্টুরেন্টে এসে ওয়েটারকে
ডাক দিয়ে নাস্তার অর্ডার দিল আবির। ওয়েটারটা যাবার সময় বাঁকা চোখে চেয়ে গেলো
বইল্যার দিকে।
-তা বইল্যা। রাতে তো
প্রচণ্ড শীত থাকে ঘুমাও কিভাবে?
বইল্যা কোন কথা না বলে
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে টেবিলের উপর রেখে বসল।
-এই যে ব্লেড দেখতাসেন
ভাইজান এইটা দিয়া ব্যানার কাটি।
-ব্যানার কাটো মানে ?
অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো আবির।
-রাতে বেশি ঠাডা পড়া
শীত পড়ে। আর সামনে তো আরও বেশি শীত পরবো। তাই ব্যানার কাইটা শরিলে জড়াইয়া
ঘুমাইলে ঠাণ্ডা একটু কমই লাগবো।
কথাগুলো শুনে এতোটাই খারাপ
লাগলো আবিরের যে নিজের অজান্তেই মনের কোণ থেকে কখন একবিন্দু অশ্রু জড়িয়ে পরলো সে
তা টেরই পেল না। এত কম বয়সে এই সব ছেলেরা এতো অবহেলিত? এতো কষ্টে দিন যাপন করে এরা ? আমরা
কি কিছুই করতে পারি না এদের জন্য ?
মানুষ হিসেবে দাম দিলে কোন
মানুষের জন্য কিছু করতে মন চায়। কিন্তু আমরা তো এদের মানুষই মনে করি না। কাছে এসে
এক টাকা দুই টাকা খুঁজলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই, সাথে দেই কয়েকটা গালি। কবে যে এদের এই দুঃখের দিন শেষ হবে তা আল্লাহই
ভালো জানেন।
এরই মধ্যে ওয়েটার খাবার
নিয়ে এলো। খাবার দেখে বইল্যার চোখে মুখে খুশির ছটা ফুটে উঠলো।
-ভাইজান, এইসব খাবার এর আগে অনেক দেখছি কিন্তু কখনো খাওয়া হয় নাই।
-তাহলে এবার যত খুশি
খাও।
খুব তাড়াতাড়িই খাওয়া শেষ
হয়ে গেল দুজনের। ঢেকুর তুলতে তুলতে বইল্যা বলল,
-ভাইজান আজকে আর খাওয়া
লাগব না। যে খাওয়া খাইছি তাতে আইজ পার হইয়া যাইব। আপনারে অনেক ধইন্যবাদ ভাইজান।
এরকম করে কেউ কোনদিন খাওয়ায় নাই।
-আরে ধন্যবাদ কিসের?
-তোমাকে খাওয়াতে পেরে
অনেক ভালো লাগছে আমার।
-ভাইজান এবার আমাকে
যেতে হবে না হলে সিটি কর্পোর গাড়ি সব ময়লা নিয়া গেলে শেষে কিছুই পামু না আমি।
বইল্যা যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
একটু দাঁড়াও বইল্যা। আবির
তার পড়নের সুয়েটারটা খুলে বইল্যাকে দিয়ে বলল, এটা রাখ তুমি। তোমার শীত কিছুটা হলেও কম লাগবে হয়তোবা রাতে আরামে
ঘুমাতেও পারবে।
বইল্যা খুব বেশি অবাক হল।
-ভাইজান,আপনার তো এখন ঠাণ্ডা লাগবো।
-আমাকে নিয়ে চিন্তা
করো না। আমি বাসায় চলে যাব একটু পরে। তখন আরেকটা পড়ে নিবো। এটা তুমিই রাখো।
-ভাইজান,আমি আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়াতে আরেকটা দেখি নাই। দুনিয়াতে
আপনি অনেক বড় হবেন। চোখ দুটি ছল ছল হয়ে উঠলো বইল্যার।
-লজ্জা দিও না আমাকে
বইল্যা। ভালো থেকো।
-না ভাইজান আপনে হাছাই
খুব ভালা মানুষ। আপনেও ভালো থাকেন ভাইজান।
চোখ মুছতে মুছতে বইল্যা
রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। সুয়েটারটা এক হাতে আর আরেক হাতে বস্তাটা কাঁধে
ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল পার্কের মধ্যে। আবিরও উঠতে যাবে এমন সময় দেখে
বইল্যার ব্লেডটা টেবিলের উপর পড়ে আছে।
আবির ব্লেডটা হাতে নিয়ে
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল-ব্লেডটার কি আর দরকার আছে??
******************************************************************
শেষকথাঃ এই গল্পটার স্থান এবং চরিত্র কাল্পনিক হলেও শীতের এক সকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা হয়েছে।
আমাদের চোখের আশেপাশে কত বইল্যারা এভাবে দিন যাপন করছে তার খোঁজ আমরা কখনই রাখি না।
অবহেলিত আর কষ্টে জর্জরিত জীবনে তাদের ক্ষীণ পাওয়া সুখ ঐ কষ্টের মধ্যেই আবার মিলিয়ে যায় যা আমরা দেখতে পারি না। এই বইল্যারা সঠিক পথের অভাবে আজ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রভুদের ডান আর বাম হাত !
এদের ছোটবেলাই কাটে অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যে বয়সে এদের খেলার কথা,পড়ার কথা সেই বয়সে তারা জীবন যুদ্ধের কাজে লিপ্ত। তাদের সঠিক পথে আনার কোন মাথা ব্যাথাই যেন নেই প্রভুদের।
তাদের মাথা ব্যাথাটা না থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ এই সব বইল্যাদের দিয়েই তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করে।
লিখেছেন- ফারহান খান
FB ID- Farhan Khan
গল্পটি নেয়া : https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/শীতের-সকালে/210922285654595