বেশ পরিচিত এক FMCG কোম্পানীর সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার । ইনবক্সে প্রায়ই টুকটাক কথাবার্তা হয় । কিছুদিন আগে ধরে বসল “ভাইয়া, ১৫ মিনিট সময় দিন । একটু দেখা করা খুব দরকার ।” এদিকে দম ফেলার সময় নেই আমার । তারপরও পর পর কয়েক সপ্তাহ ধরে গাবের আঠার মত তাঁর নাছোরবান্দা অনুরোধে একদিন সময় পেয়ে ঝট ডেকে বসলাম ।
.
“ঘটনা কি ?” কফিতে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম ।
“নতুন একটা প্রোডাক্ট launch করেছি । প্রচুর Promotion হয়েছে । অনেক টাকাও খরচ হয়ে গেছে । কিন্তু টার্গেট অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে না । সমস্যাটা কি বুঝতেও পারছি না । প্রচন্ড চাপে আছি ।“ ওর উত্তর ।
“প্রোডাক্টের আসল পারফর্মেন্স কেমন ?”
“চমৎকার । প্রতিটা কনজ্যুমার টেস্ট এবং Trial feedback ভাল ছিল ।”
“প্রাইস ল্যাডারিং কেমন এবং কোথায় ?”
“দারুণ কম্পিটিটিভ । ইনফ্যাক্ট, কম্পিটিটরের চাইতেও আমার প্রাইস কম ।“
“ট্রেড প্রফিট ?”
“এ্যাট্রাক্ট্রিভ X%, সাথে Y% ডিলও আছে ।”
“নিউমেরিক কেমন ?”
“এটা ভাল না । Availability কম ।”
“ভিজিবিলিটি টুলস ?”
“অনেক আছে প্ল্যানে কিন্তু নিউমেরিক কম বলে এক্সিকিউট হয়নি । ফিল্ড টিমও আগ্রহী না ভিজিবিলিটি টুলস্ নিয়ে ড্রাইভ দিতে ।”
“সেলস ইনসেভটিভ দিয়ে দেখেছ ?”
“হ্যা ভাইয়া, ইনসেভটিভ দিলে চমৎকার চলে । এমনকি নরমাল সেলের ৪-৫ গুণ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় । নিউমেরিকও বাড়ে । কিন্তু ইনসেনটিভ বন্ধ করলেই আবার যা তাই । এখন টানা ইন্সেন্টিভ দিয়ে তো আর চলা সম্ভব নয় ।”
“বিক্রি হয় মানে কি ? শুধু সেকেন্ডারী হয়ে দোকান পর্যন্ত স্টক হয় না কি টারসিয়ারী হয়ে কনজ্যুমারের বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছায় ?”
“না না, টারসিয়ারী হয় । দোকানে স্টক থাকে না ।“
বোঝা গেল প্রোডাক্টের গ্রহণযোগ্যতাও ভাল । ট্রায়াল হলে রিপিটও হয় ।
তবে সমস্যার গন্ধ পেলাম ঐ কথাটিতে “ইনসেভটিভ দিলে চমৎকার চলে । এমনকি নরমাল সেলের ৪-৫ গুণ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় । নিউমেরিকও বাড়ে । কিন্তু ইনসেনটিভ বন্ধ করলেই আবার যা তাই ।“
জিজ্ঞাসা করলাম “তোমার প্রোডাক্টের RTM ডিটেইলটা কি, বল দেখ, ?”
এইবার বান্দা মাথা চুলকে জবাব দিল “সেটা তো আমি ঠিক জানি না । ওটা তো সেলস্ টিম দেখে ।”
.
বুঝলাম রোগ ধরা পরল !
.
আমার কাছে সবসময়ই মনে হয় ‘RTM’ বা ‘Route-To-Market (রুট-টু-মার্কেট)’ মার্কেটিং এর সবচেয়ে গ্ল্যামারহীন এবং উপেক্ষিত একটা বিষয় ! মহা শোর-গোল, ঢোল-নাকাড়া বাজিয়ে প্রোডাক্ট নামানো হয় । প্রোডাক্ট বানানো থেকে শুরু করে, প্যাকেজিং, কম্যুনিকেশন সব কিছুতেই প্রচুর মনোযোগ দেয়া হয় । প্রোমোশনে প্রচুর টাকা ঢালা হয় । কিন্তু বাজারে প্রোডাক্টখানা কিভাবে ঢুকবে, অর্থাৎ রুট-টু-মার্কেটে এমনকি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নজরই দেয়া হয় না ।
.
কথা হলো এই ‘RTM’ বা ‘রুট-টু-মার্কেট’ ব্যপারখানা আসলে কি ?
.
বইয়ের তাত্ত্বিক সংজ্ঞায় যাব না । আমার লেখায় আমি কখনও তাত্ত্বিক কথা বলিও না । তত্ত্ব শেখাবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় সন্মানিত শিক্ষকগণ আছে । আমি Practical ফিল্ডের লোক ! সব সময়ই তাই আমি দেখে এবং ঠেকে যা শিখেছি সেটিই বরং বলার চেষ্টা করি ।
.
যা হোক । ধরুন আসছে কোরবানীর ঈদে আপনি বড়সড় একখানা গরু কোরবানী দেবার কথা ভাবছেন । নিয়মানুযায়ী এর তিনভাগের একভাগ এখন আপনার আত্নীয়-স্বজনের বাসায় পাঠাতে হবে । আপনি আপনার ভাগ্নেকে এই মাংশ নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেবেন বলে ভেবে রাখলেন ।
.
প্রথম প্রশ্ন হলো ভাগ্নে বেচারা ঈদের দিনে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে আপনার মাংশের প্যাকেট নিয়ে রাজ্যের সব আত্নীয়-স্বজনের বাসায় বাসায় যেতে রাজি হবে কেন ? তাঁর মোটিভেশন কি ? গেলেও কিসে করে যাবে - গাড়িতে, বাইকে না কি রিকসায় ? মাংশ পচনশীল জিনিষ । সুতরাং, কোনটাতে গেলে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সবার বাসায় পৌঁছাতে পারবে ? তাকে কোন কোন এলাকায় যেতে হবে ? সেক্ষেত্রে কোন এলাকা ধরে শুরু করবে, আর কোথায় শেষ করবে ? আত্নীয়-স্বজনের বাসার সিরিয়াল কি ? কোন পথে যাবে ? সবচেয়ে অপটিম্যাল পথ কোনটা ? প্যাকেট হবে কিভাবে ? যত প্যাকেট দিচ্ছেন সেগুলো কি একসাথে ওর পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ? গাড়িতে আঁটবে ? বাইকে ব্যালেন্স থাকবে ? না হলে কত বার যেতে হবে ? সেক্ষেত্রে কখন থেকে শুরু করা দরকার ? যাদের বাসায় পাঠাচ্ছেন তাঁরা কি বাসায় আছে ? যদি না থাকে তখন আপনার ভাগ্নে বেচারা তার মাংশের প্যাকেটখানা কি করবে ? গাড়িতে নেবার সময় যেন মাংশের রক্তে গাড়ি মেখে না যায়, তার জন্য ব্যবস্থা কি ?
.
জানি মনে মনে হাসছেন আর ভাবছেন কোরবানীর মাংশ বিলির সাথে রুট-টু-মার্কেটের সম্পর্কটা কি ?
.
এতক্ষণ যে প্রশ্নগুলো তুললাম ঠিক এগুলোর উত্তরই হচ্ছে গিয়ে যাকে মার্কেটিং-এর ভাষায় আমরা বলি ‘রুট-টু-মার্কেট’ বা সোজা বাংলায় বললে 'বাজারে ঢোকার পথ' । FMCG’র দুনিয়ায় যে কোনো প্রোডাক্টের সফলতা বা ব্যর্থতার পেছনে এই 'রুট-টু-মার্কেট' ভীষণ জরুরী একখানা অনুঘটক ।
.
কেন এবং কিভাবে ?
.
একটা একটা করে বলি ।
.
ধরুন আপনি ইতিমধ্যে ৫ টি প্রোডাক্ট বিক্রি করছেন । এবার নতুন প্রোডাক্ট হিসেবে ৬ নম্বর প্রোডাক্টখানা এনেছেন । প্রথম কথা হচ্ছে আপনার সেলস টিম যারা মাঠে প্রোডাক্ট ডিস্ট্রবিউশনের কাজ করে, তাঁরা কেন আপনার ৬ নম্বর প্রোডাক্টখানা বিক্রি করার অতিরিক্ত কষ্টটুকু করতে যাবে ? তাঁদের মোটিভেশন কি ? তাঁরা এই এক্সট্রা কষ্ট করে কি পাবে ? যদি ভেবে থাকেন “ব্যাটারা চাকরী করে, তাহলে বিক্রি করবে না কেন ?” আমি বলব “ভাই, দুনিয়া এত সহজ নয় । আপনি ভুল ভাবছেন ।” আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি উনারা কি করবেন । আপনার চাপে পরে হয়ত নতুন প্রোডাক্টটি বিক্রি করবেন কিন্তু সাথে সাথে আগের ৫ টির মধ্য থেকে যে কোনো একটির বিক্রি ফেলে দিবেন !
.
নাম বলাটা ঠিক হবে না কিন্তু এদেশের এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে খুব কাছ থেকে জানি, যারা নতুন প্রোডাক্ট নামাতে ভীষণ দক্ষ আর দ্রুতগতির । কিন্তু সমস্যা হলো যতবার উনারা নতুন প্রোডাক্ট আনেন ততবার আগের কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রোডাক্টের সেলস্ ঢুশ করে পরে যায় । ব্যপারটা অনেকটা বাঁদরের বাঁশ বাওয়ার মত । যতটুকু আগায়, প্রায় ততটুকুই আবার পেছায় !
.
সুতরাং, আপনাকে আগে থেকেই বের করতে হবে কি করলে আপনার সেলস্ টিম ৬ নম্বর প্রোডাক্টটিকে বিক্রি করবেন এবং আগের কোনোটিকে না কমিয়ে ।
.
এখন ধরুন, আপনার সেলসম্যান প্রতিদিন ৫০ টা করে দোকানে সার্ভিস দিয়ে থাকেন । সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো সময়টুকুই এই ৫০ টি দোকানে ঠিকঠাক মত ৫ টি প্রোডাক্ট বিক্রি করতে লেগে যায় । আপনি যে ৬ নম্বর প্রোডাক্টখানা তাঁদেরকে বিক্রি করতে দিলেন, গুণে কি দেখেছেন এর জন্য অতিরিক্ত সময় লাগবে কতটুকু ? সেই সময়টুকু কি আসলেই উনার হাতে আছে ? না থাকলে এই যে না বুঝেই আরেকটি প্রোডাক্ট চাপিয়ে দিলেন তাতে আদতেও কি লাভ হবে ?
.
ঠিক এই কথাটা আপনার ডিস্ট্রিবিউশনের লোকটা, যাকে আমরা সাধারণ ভাবে ‘ডেলিভারীম্যান’ বলি, তাঁর ক্ষেত্রেও খাটে । আরও একটা প্রোডাক্ট ডিস্ট্রিবিউট করার মত সময় বা ব্যান্ডউইডথ তাঁর আছে কি ? না থাকলে সে নিশ্চিতভাবে অর্ডার বাউন্স করাবে কিংবা ডেলিভারী গ্যাপ তৈরী করাবে ।
.
আবার ৫ টির উপর নতুন ১ টি - মানে অংকের হিসেবে ২০% বৃদ্ধি । যে ভ্যানে বা গাড়িতে আপনার ডেলিভারী চলে সেই ভ্যানে কি এই ২০% গ্রোথের ডেলিভারী দেবার উপায় আছে ? যদি না থাকে, তবে ডেলিভারীটা হবে কিভাবে আপনি যতই ডেলিভারীম্যান বেচারাকে চাপ দিন না কেন ! ভেবে দেখেছে ?
.
এবার আসি ডেলিভারী মডেল নিয়ে । ধরুন, আপনার আগের ৫ টি প্রোডাক্টই চিপসের মত হালকা কিন্তু বেশী জায়গা আটকে রাখে এমন প্রোডাক্ট । কিন্তু আপনি নতুন নামিয়েছেন ‘পানি’ জাতীয় একখানা প্রোডাক্ট যেটি জায়গা তত একটা নেয় না কিন্তু ওজন বেশী । সেক্ষেত্রে আপনার ডেলিভারী ভ্যানের ভারসাম্যতা, স্ট্র্যাকচার, বহনক্ষমতা, গতি ইত্যাদি সব কিন্তু রাতারাতি বদলে যাচ্ছে । সাথে বদলে যাচ্ছে আপনার প্রোডাক্টকে ফ্যাক্টরী থেকে শুরু করে দোকান পর্যন্ত পৌঁছাবার পুরো পদ্ধতিখানাই । প্রোডাক্ট নামাবার আগে আপনার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে এই বদলটুকু এনেছেন কি ? না করলে প্রোডাক্ট মুভ করবে কিভাবে ?
.
এরপর ধরুন Timing এবং Frequency of service । আমার ক্যারিয়ারে একবার খুব অল্প সময়ের জন্য পাউরুটির ব্যবসা দেখেছিলাম । ব্যবসা হাতে নিয়ে প্রথম সপ্তাহেই মার্কেট ভিজিটে গিয়ে দেখলাম আমার সেলসম্যান দোকানে যাওয়া শুরু করে সকাল সাড়ে-নয়টা থেকে । অথচ, পাউরুটি ভোর বেলার প্রোডাক্ট । লোকে নাস্তায় খায় । সুতরাং, ভোরবেলা সবার আগে এটির যোগান দেয়াটা ভীষণ ক্রিটিক্যাল বিষয় । নিয়ম করলাম আমার লোক ভোর সাতটায় দোকানে যাবে যখন প্রতিযোগী কোম্পানীর সেলসম্যান গিয়ে পৌঁছেনি । ফলাফল হলো দারুণ ! দুই সপ্তাহের টেস্ট ড্রাইভেই সেলস্ বাড়ল প্রায় ৪০% ! বিনিময় হিসেবে আমার সেলসের ছেলেদের বিকেল ৪ টার ভেতর ছুটি দিয়ে দেয়া হত, যেহেতু ওরা আগে কাজ শুরু করে ।
.
উদাহরণটা দিলাম এ কারণে যে প্রতিটা ব্যবসার একখানা ক্রিটিক্যাল Serving Timing আছে - দিন/মাস/বছরের ঠিক কখন আপনি মার্কেটে সার্ভিস দিবেন ? আছে ক্রিটিক্যাল Serving Frequency - দিনে/সপ্তাহে/মাসে কতবার সার্ভিস দিবেন ? ঠিকঠাক মত না দিতে পারলে প্রোডাক্ট চলবে না কখনই । এই সূক্ষ্ণ অথচ মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও রুট-টু-মার্কেটের অংশ ।
.
এরপর আসি আরেকটি ব্যপারে । আপনার নতুন প্রোডাক্টের জন্য নিশ্চয়ই একটা টার্গেট আছে - পিস, কেজী, লিটার, টন, টাকায়... ... ...যাতেই থাকুক না কেন । এই টার্গেটে পৌঁছাতে হলে আপনাকে কত দোকানে যেতে হবে ? অর্থাৎ, প্লেসমেন্ট নম্বর কত হবে ? সেখান থেকে আপনার ক্যাটাগরীর norm অনুযায়ী ড্রপ-আউট রেট কত ? সেটা গোনায় ধরলে আপনার নিউমেরিক ডিস্ট্রিবিউশন টার্গেট কত হতে হবে ? এবার আসুন ড্রপ-সাইজে । আপনার হিসেব করা নিউমেরিকের সাথে ড্রপ-সাইজ মিলালে আপনার টার্গেট কি পূরণ হয় ? না হলে কারেকশন কি ভাবে হবে ? নিউমেরিক বাড়িয়ে না কি ড্রপ-সাইজ বাড়িয়ে ? আপনার সেলস্ টিম দিয়ে কি এই নিউমেরিক বা ড্রপ সাইজের লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব ? না হলে বিকল্প উপায় কি ? এক্সেলের ঘরে কিংবা ক্যালকুলেটরে বোতামে এই Critical হিসেব নিকেশের খেলাটা এবং সেই অনুযায়ী কাজের পরিকল্পনা সাজানোটাও কিন্তু রুট-টু-মার্কেটের খেলা । এই হিসেব নিকেশ গুলো যতই বোরিং হোক, এগুলো ঠিক না করে মাঠে নামা আর স্যুইসাইড মিশনে যাওয়া একই কথা বলা যায় !
.
সবশেষে আসি সবচেয়ে Sensitive বিষয়ে, যেটি FMCG ইন্ড্রাস্ট্রিতে যাঁরা Three-tier বা তিন-স্তর মডেলের ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ব্যবহার করেন, তাঁদের জন্য প্রায়ই যাকে বলে ‘আখিলিসের গোঁড়ালি’র মত নাজুক বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ।
.
Three-tier ডিস্ট্রিবিউশন মডেল কি ? এটি হচ্ছে যখন প্রোডাক্টটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে তিন জনের হাত ঘুরে কনজ্যুমারের হাতে এসে পৌঁছায় । বাংলাদেশের মোটামুটি পুরো FMCG ইন্ডাস্ট্রিই এই মডেলের উপর দাঁড়িয়ে আছে । ইদানিং ই-কমার্স এবং নানাধরণের Start Up এসে এই মডেলকে Two-tier নিয়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু তার পরিমান সমগ্র দেশের ব্যবসার হিসেবে এখনও খুবই নগন্য । Three-tier মডেলে আপনার কাছ থেকে প্রোডাক্ট কিনবে আপনার ডিস্ট্রিবিউটর / ডিলারগণ (যাকে আমরা বলি ‘প্রাইমারী সেলস্’), তারপর তাঁরা সেই প্রোডাক্টকে ডিস্ট্রিবিউট করবেন দোকানে দোকানে (যাকে আমরা বলি ‘সেকেন্ডারী সেলস্’), সবশেষে দোকান থেকে আপনার প্রোডাক্ট কিনবেন কাস্টমার / কনজ্যুমারগণ (যাকে আমরা বলি ‘টারসিয়ারী সেলস্’) ।
.
এখন ধরুন আপনার আগের পাঁচটি প্রোডাক্টের বিক্রি ১ কোটি টাকা । আপনি নতুন যে ৬ নম্বর প্রোডাক্টটি এনেছেন সেটির থেকে আপনার টার্গেট আরও ৩০ লাখ টাকা বিক্রি বাড়ানো । এখন আপনার বিক্রি ৩০ লাখ টাকা বাড়াতে হলে সবচেয়ে আগে কিন্তু আপনার ডিস্ট্রিবিউটর সাহেবকে আপনার কাছে থেকে ৩০ লাখ টাকার প্রোডাক্ট বেশী কিনতে হবে । সমস্যা হলো আপনার ডিস্ট্রিবিউটর সাহেবের এই অতিরিক্ত ৩০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করার ক্ষমতা নেই অথবা ক্ষমতা থাকলেও তাঁর আর ব্যবসা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই । ইতিমধ্যে যা ব্যবসা করছেন তাতেই তিনি খুশী । তাহলে নতুন প্রোডাক্ট থেকে আপনার ব্যবসাটা বাড়বে কিভাবে ? সেক্ষেত্রে আপনার ডিস্ট্রিবিউটর হয় নতুন প্রোডাক্টখানা কিনবেনই না অথবা আপনার চাপে বা অনুরোধে পরে কিনলেও সাথে সাথে পুরোনো আরেকটা প্রোডাক্ট কেনা কমিয়ে দিবেন । অর্থাৎ, সেই বাঁদর আর সেই বাঁশ !
.
এতক্ষনে নিশ্চয়ই বোঝা গিয়েছে যে ‘রুট-টু-মার্কেট‘ এর প্রয়োজনীয়তাটা কতখানি ব্যপক, বিশেষত: FMCG ব্যবসার জন্য । কিন্তু যেটি শুরুতেই বলছিলাম যে এই ক্রিটিক্যাল বিষয়টি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই খুব উপেক্ষিত থাকে ।
.
কারণ কি ?
.
আমার অবজার্ভেশন বলে কারণ মূলত: তিনটি -
.
প্রথমত: খেয়াল করে দেখুন রুট-টু-মার্কেটে যারা যারা জড়িত অর্থাৎ Stakeholders সবাই কম-বেশী প্রতিষ্ঠানের নিজের লোক কিংবা Close group । সুতরাং, মার্কেটিং টিমের মাঝে এনিয়ে কিছুটা গা-ছাড়া ভাব থাকে যে “বলে দিলেই ওটা হয়ে যাবে, যেহেতু সবাই আমাদের নিজেদের লোক।“ প্রথম ভুলটা হয় ঠিক তখনই । নিজেদের বা কাছের লোক হলেও উপরের ব্যাখ্যা করা প্রতিটা বিষয় যে যথেষ্ট জটিল এবং গুরুত্বের দাবী রাখে সেটি নিশ্চয়ই বোঝার আর বাকি নেই । কিন্তু পরিষ্কার করা হয় না বলে শেষ পর্যন্ত পা কাটে এই পঁচা শামুকেই অর্থাৎ নিজেদের লোকের গাফলতি কিংবা কাজের পরিষ্কার প্রিপারেশন, রোড ম্যাপ এবং এক্সপেক্টেশন ক্লীয়ার না করার কারণে ।
.
দ্বিতীয়ত: বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রুট-টু-মার্কেট স্ট্রাটেজী বানানো এবং তাকে এক্সিকিউট করার দায়িত্ব কার, সেটি নিয়ে মার্কেটিং এবং সেলস্ ফাংশনের ভেতর ভীষণ ধোঁয়াশা থাকে । মার্কেটিং মনে করে এটি যেহেতু মূলত: ফিল্ড রিলেটেড বিষয়, সেহেতু সেলসের দায়িত্ব । আবার উল্টোদিকে সেলস্ মনে করে এটি মার্কেটিং এর 4P-এর একটি ‘P (Placement)’-এর অনুষঙ্গ । সুতরাং, এটি মার্কেটিং-এর দায়িত্ব । এই ঠেলাঠেলিতে ব্যপারখানা ঘটে এমন যে শেষ পর্যন্ত কেউই দায়িত্ব নেয় না । ফলাফল অসম্ভাবী disaster !
.
তৃতীয়ত: রুট-টু-মার্কেট বিষয়খানা প্রোডাক্টের launch প্রোগ্রাম বা এ্যাড বানানো বা ডিজিটাল মার্কেটিং বা এ্যাক্টিভেশনের মত গ্ল্যামারাস বা খুব লাউড কোনো বিষয় নয় । এটি বরং পুরোপুরি ব্যাকগ্রাউন্ডের কাজ । না করলে তার ভয়াবহ প্রভাব টের পাওয়া যায়, কিন্তু করলে সেটি কেউ টেরও পায় না । তাই অনেক মার্কেটিয়ার এবং সেলসের কর্তাগণ এটি করতে আগ্রহী হন না, এমনকি করতে হবে সেটিও বুঝে উঠতে পারেন না । Launch করার পর যতক্ষণের বোঝা শুরু করেন, ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে যায় !
.
তবে রোগের কারণগুলো যদি জানি, আমার মনে হয় ঔষধ দেয়াও খুব কঠিন নয় ।
.
প্রথমত: রুট-টু-মার্কেটের অংশ হিসেবে প্রতিটা বিষয় আগে থেকেই পুরো সেলস এবং মার্কেটিং টিমের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে । কি কি করতে হবে, কি কি প্রস্ততি লাগবে, কিভাবে করতে হবে, কি বাজেট লাগবে, কাকে কাকে involved হতে হবে, কখন হতে হবে.......ইত্যাদি সমস্ত ব্যপারে পরিষ্কার এ্যাকশন প্ল্যান থাকাটা অবশ্যই দরকার এবং রোগ সারাবার প্রথম স্টেপ ।
.
দ্বিতীয়ত: দায়িত্ব পরিষ্কার করা । আমার মতে রুট-টু-মার্কেটের স্ট্রাটেজিক দায়িত্ব মার্কেটিং-এর; আর এক্সিকিউশনাল দায়িত্ব মূলত: সেলসের । তবে এরজন্য সবচেয়ে প্রথমে যেটি দরকার সেটি হলো সেলস-এন্ড-মার্কেটিং ফাংশনের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া । সেলস-এন্ড-মার্কেটিং এক সাথে এক টিম হিসেবে না বসলে Route-To-Market এর সূক্ষাতি সূক্ষ্ণ এই ফাটলগুলো ধরা এবং দরকার অনুযায়ী সেগুলো ভরাট করা কখনই সম্ভব নয় । কে কি করবে এবং কিভাবে করবে সেটির Responsibility পরিষ্কার ভাবে assign না করলে RTM-এর নাজুক বোমা খানা Sale & Marketing -এর দুই চেয়ারের ফাঁক গলে মাটিতে পরে বিস্ফোরণ ঘটতে বাধ্য !
.
তৃতীয়ত: মার্কেটিয়ারদের একখানা চরম ভুল ধারণা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া দরকার যে ‘মার্কেটিং মানে এ্যাড বানানো’ । এই কথাটা এর আগেও বহু জায়গায় বলেছি এবং লিখেছি - এ্যাড বানানো মার্কেটিংএর কাজের ১০-১৫% এর বেশী নয় । মার্কেটিং-এর 4 P এর অন্যতম P হচ্ছে - Placement; আর RTM হচ্ছে সেই P সফল করার মূল মন্ত্র । এ্যাড, এ্যাক্টিভিশন বা ইভেন্টের মত গ্ল্যামারাস না হলেও এই P-টিও কিন্তু মার্কেটিয়ারেরই দায়িত্ব । ঠিক ঠিক RTM স্ট্রাটেজী আর মনিটরিং-এর অভাবে প্রোডাক্ট যদি মুখ থুবড়ে পরে তবে Brand owner হিসেবে দায়িত্ব কিন্তু মার্কেটিয়ারের ঘাড়েই পরবে । তাই গ্ল্যামারাস অংশগুলোর সাথে সাথে মার্কেটিং অন্যান্য সাদামাটা কিন্তু ভীষণ জরুরী বিষয়গুলোর প্রতিও দৃষ্টি দেয়াটা ভীষণ জরুরী ।
.
আপনার প্রোডাক্ট, এ্যাডভার্টাইজমেন্ট এগুলো ঠিকঠাক মত কাজ করলেও সেলসের চাকা নাও ঘুরতে পারে । রুট-টু-মার্কেটের ব্যর্থতা সেই চাকা-না-ঘোরার কারণগুলোর অন্যতম ।
.
তাই আপাত: গ্ল্যামারহীন মনে হলেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই রুট-টু-মার্কেটের কাজগুলো নজরে রাখি, যদি না হলে শত গ্ল্যামারযুক্ত এ্যাডভার্টাইজমেন্ট কিংবা চমৎকার প্রোডাক্টও মুখ থুবড়ে পরবে ।
.
.
#Marketing
#Professional
#RouteToMarket
#RTM
গালিব বিন মাহমুদ ভাই থেকে নেয়া
#rtmklik #RTmorefun #RTMSarawak