Tuesday, December 20, 2011

জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট বিধানমালা.... [ Proper Usage way of National Flag]



আমাদের জাতীয় পতাকার যত্রতত্র ব্যবহার রোধ করি। আসুন, জেনে নিই জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট বিধানমালা....
 by জবরুল আলম সুমন on Sunday, December 11, 2011 at 9:58pm







আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি... সম্ভবত বিশ্বে যত জাতী গোষ্ঠি আছে তাদের মধ্যে বাংগালী জাতিকেই কেবল হুজুগে বলা হয়ে থাকে। অবশ্য বাংগালীকে হুজুগে বলার পেছনে কিছু কারণও আছে। আমরা যে কোন ঘটনার কারণ না খতিয়েই সে ঘটনা নিয়ে কাঁদা ছুঁড়া ছুঁড়ি করতে পছন্দ করি যা অন্য কোন জাতি গোষ্ঠির মধ্যে বিরল বলেই আমাদেরকে হুজুগে বলা হয়ে থাকে। বাংগালী জাতি খুবই আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ এক সংক্রামক ব্যধি যা খুব সহজেই পাশের জনকে সংক্রমিত করে ফেলে। কিন্তু সব কিছুতে আবেগ চলেনা। আবেগ প্রকাশের আগে আমাদেরকে প্রকৃত ঘটনা বুঝতে হবে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস বা বিভিন্ন জাতীয় দিবস এলে আমরা বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করে দেশের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রকাশের চেষ্টা থাকে। অনেকেই অধিক উচ্ছসিত হয়ে বা আবেগের বশবর্ত্তী হয়ে পতাকার উপর বিভিন্ন ধরনের ছবি কিংবা নিজের বা অন্যের প্রতিকৃতি অংকন করে থাকেন। কেউ কেউ পতাকার প্রকৃত রূপ বিকৃত করে বিভিন্ন ফুল, বা প্রাণীর রূপদান করে থাকেন যা বাংলাদেশ দন্ড বিধি অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধের একটি। জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা না জানার কারণে অনেকেই জাতীয় পতাকা যত্রতত্র ব্যবহার করে পতাকাকে অসম্মান করে থাকে নিজের ভুলেই অথচ এর ব্যবহারের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট বিধিমালা। জাতীয় পতাকা একটি রাষ্ট্রের পরিচয়, জাতীয়তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক হচ্ছে আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকা। আসুন আজকে আমরা জেনে নিই জাতীয় পতাকা ব্যবহারের সংশোধিত বিধিমালা। এবং সেই সাথে জাতীয় পতাকার যত্রতত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকি।



 জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ জাতীয় পতাকা ব্যবহারের বিভিন্ন বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের নিদর্শন। তাই সব সরকারি ভবন, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভবনে সব কর্মদিবসে পতাকা উত্তোলনের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু অনুষ্ঠান উপলক্ষে যেমনঃ ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবসে বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রাঙ্গণে এবং কনসুলার কেন্দ্রগুলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবসে বা সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্যান্য দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকার বিধান করা হয়েছে। অর্ধনমিত রাখতে হলে পতাকা উত্তোলনের নিয়ম হলো, অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের প্রাক্কালে পতাকাটি পুরোপুরি উত্তোলন করে অর্ধনমিত অবস্থানে আনতে হবে এবং পতাকা নামানোর প্রাক্কালে পতাকাটি শীর্ষে উত্তোলন করে নামাতে হবে। পতাকার মাপ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দেশে বিভিন্ন মাপের পতাকা দেখা যায়। জাতীয় পতাকার মাপ হবে ১০:৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তাকার ক্ষেত্রের গাঢ় সবুজ রঙের মাঝে লাল বৃত্ত এবং বৃত্তটি দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যসার্ধবিশিষ্ট হবে। ভবনে ব্যবহারের তিন ধরনের মাপ হচ্ছে ১০ : ৬, ৫ : ৩ ও ২.৫ : ১.৫। তবে অনুমতি সাপেক্ষে ভবনের আয়তন অনুযায়ী এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ঠিক রেখে বড় আয়তনের পতাকা প্রদর্শন করা যাবে। গাড়িতে ব্যবহারের জন্য মাপ হচ্ছে ১৫:৯ (বড় গাড়ি) এবং ১০:৬ (ছোট ও মাঝারি গাড়ির জন্য)। তবে ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারে না। কেননা আইনে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই গাড়ি কিংবা কোনো যান, রেল কিংবা নৌকার খোলে, ওপরিভাগে বা পেছনে পতাকা ওড়ানো যাবে না। তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মোটরগাড়ি, নৌযানে ও বিমানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অধিকারী। তা ছাড়া আইনানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, কেবিনেট মন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, চিপ হুইপ, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন বা কনসুলার মিশনের প্রধান তাঁদের মোটরগাড়ি ও নৌযানে পতাকা উত্তোলনের অধিকারী। প্রতিমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এবং উপমন্ত্রী রাজধানীর বাইরে ভ্রমণকালে কিংবা বর্হিবিশ্বে মোটরগাড়ি অথবা জলযানে পতাকা ব্যবহার করার অধিকারী হবেন। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট মর্যাদাবান ব্যক্তি মোটরগাড়ি অথবা জলযানে থাকলেই কেবল পতাকা উত্তোলিত হবে। তবে শর্ত হচ্ছে, কোনো মোটরগাড়িতে পতাকা প্রদর্শিত হলে পতাকার দণ্ড অবশ্যই দৃঢ়ভাবে গাড়ির চেসিস কিংবা রেডিয়েটার কেনের ক্ল্যাম্পের সঙ্গে দৃঢ়াবদ্ধ করতে হবে। বিদেশি পতাকা বা রঙিন পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকালে বাংলাদেশের পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য স্থান সংরক্ষিত থাকবে। যে ক্ষেত্রে শুধু দুটি ভিন্ন পতাকা থাকবে, সে ক্ষেত্রে ভবনের ডানপাশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হবে এবং দুয়ের অধিক পতাকার সঙ্গে উত্তোলনকালে পতাকার সংখ্যা বিজোড় হলে বাংলাদেশের পতাকা ঠিক মধ্যে থাকবে। তবে জোড়সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা কেন্দ্র থেকে ডান দিকের প্রথমে উত্তোলন করতে হবে। অন্য কোনো দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হবে এবং সর্বশেষে নামানো হবে। দুই বা ততোধিক দেশের পতাকা হলে ভিন্ন ভিন্ন দণ্ডে উত্তোলন করতে হবে এবং পতাকাগুলোর পরিমাপ প্রায় একই হবে।



 আজকাল খেলার সময়, বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রেমীরা বাসভবনে নিজ সমর্থনীয় দেশের পতাকা এমনভাবে ওড়ান, যাতে দেশের জাতীয় পতাকা নিচে পড়ে থাকে। কিন্তু কাজটি বেআইনি। কেননা আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকার ওপরে অন্য কোনো পতাকা বা রঙিন পতাকা ওড়ানো যাবে না। মিছিলে পতাকা বহনের বিধান হচ্ছে, পতাকা মিছিলের কেন্দ্রে অথবা মিছিলের অগ্রগমন পথের ডান দিকে বহন করতে হবে। অনেকেই জাতীয় পতাকায় নকশা করে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু জাতীয় পতাকার ওপর কোনো কিছু লেখা বা মুদ্রিত করা যাবে না অথবা কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে কোনো চিহ্ন অঙ্কন করা যাবে না; এমনকি জাতীয় পতাকাকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না এবং গায়ে জড়িয়ে রাখা যাবে না। তবে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হলে তাঁর শবযাত্রায় জাতীয় পতাকা আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকাকে ট্রেডমার্ক, ডিজাইন বা পেটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাও অপরাধ। কোনো অবস্থায়ই পতাকা নিচে অবস্থিত কোনো বস্তু যেমনমেঝে, পানি ও পণ্যদ্রব্য স্পর্শ করবে না এবং কবরের ওপরে স্থাপন করার সময় পতাকাটি কবরে নামানো যাবে না কিংবা মাটি স্পর্শ করবে না। এ ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ, ধারণ বা বিলি করার জন্য পতাকাকে ব্যবহার করা যাবে না। পতাকা এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন বা মজুদ করা যাবে না, যাতে এটি সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে, মাটি লাগতে পারে বা নষ্ট হতে পারে। কোনো দেয়ালে দণ্ডবিহীন পতাকা প্রদর্শিত হলে তা দেয়ালের সমতলে এবং রাস্তায় প্রদর্শিত হলে উলম্বভাবে দেখাতে হবে। গণমিলনায়তন কিংবা সভায় পতাকা প্রদর্শন করা হলে বক্তার পেছনে ও ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে হবে।



 জাতীয় পতাকা কোনো অবস্থায়ই সমতল বা সমান্তরালভাবে বহন করা যাবে না এবং উত্তোলনের সময় সুষ্ঠু ও দ্রুতলয়ে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে অবনমিত করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত গাইতে হবে এবং যখন জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং প্রদর্শিত হয়, তখন উপস্থিত সবাইকে পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। মোটরগাড়ি, নৌযান, উড়োজাহাজ ও বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য সময় পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে এবং সূর্যাস্তের পর কোনো মতেই পতাকা উড্ডীয়ন অবস্থায় থাকবে না।



 জাতীয় পতাকা শুধু একটি কাপড় নয়, এটি দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। তাই পতাকার অবস্থা ব্যবহারযোগ্য না হলে তা মর্যাদাপূর্ণভাবে সমাধিস্থ করতে হবে। জাতীয় পতাকা ব্যবহারের এসব বিধি ভঙ্গ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং কেউ ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।



 আসুন আমরা জাতীয় পতাকাকে প্রকৃত অর্থে সম্মান করি। আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে অনেকের প্রোফাইলেই জাতীয় পতাকাকে আইন লংগন করতঃ বিকৃত করে ব্যবহার করা হচ্ছে তা থেকে যেন আমরা বিরত থাকি। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বা সম্মান আসে ভেতর থেকে, অন্তর থেকে। সম্মান প্রকাশ করতে গিয়ে যেন অসম্মান করা না হয় সেদিকে যেন আমরা লক্ষ্য রাখি। পরিশেষে আমার সকল বন্ধু বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানাই আসন্ন বিজয় দিবসের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আসুন, আমরা দেশকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসি। দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে দেশকে নিয়ে যাই সমৃদ্ধির পথে।



 জবরুল আলম সুমন

 সিলেট।

 ১২ই ডিসেম্বর ২০১১ খৃষ্টাব্দ।

 সংগৃহীত


Monday, December 19, 2011

ছেঁড়া ডায়েরী [ Collection of Love Stories -13 ]





চারপাশে আমাকে নিয়ে যে কানাঘুষা চলছে তা বেশ বুঝতে পারি । আমাকে দেখেই সবাই কেমন করে জানি তাকায় । আমার উপস্থিতিতে হঠাৎ থেমে যায় চায়ের দোকানের বিতর্ক । আমার দিকে নীরবে তাকায় । আমি তাদের চোখে খুজি চিরচেনা সেই বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসা । কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেগুলো । আজ তাদের চোখে কেবলি ভয় আর ঘৃণা । আমি ওদের কাছে আর সম্মানের বশির মাস্টার নই, আজ আমি বিশ্বাসঘাতক । তাদের ধারনা আমি হাত মিলিয়েছি পাকিস্থানীদের সাথে ।

                                                                                   ****

আজ পাকিরা আমার স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে । মোট শখানেক সৈন্য । আমার স্কুলের সবগুলো ঘর নিয়েছে তাদের থাকার জন্য । উত্তরের মাঠের পাশে আর দক্ষিনের পুকুরপাড়ে বাংকার খুঁড়ে ভারি এল.এম.জি. বসিয়েছে । উত্তর-দক্ষিন দুই দিকই বেশ সুরক্ষিত করেছে। ঘন্টায় ঘন্টায় পালা করে পাহারা দিচ্ছে জওয়ানেরা । তাদের  হাবভাবে বেশ বোঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওরা যমের মত ভয় পাচ্ছে । স্কুলের পেছনের জঙ্গলটাকে রীতিমতো পরিষ্কার করে ফেলেছে । স্কুলের ছাদে বসিয়েছে ভারি মর্টার গান । পুবদিকে নদী থাকায় ওদিকেই বেশী ক্যাম্প ফেলেছে সৈন্যদের থাকার জন্য । অধিকাংশ পাকি জওয়ান সাঁতার জানে না । তাই ওরা ধরেই নিয়েছে যে কোনো শত্রু এই খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আক্রমন করার সাহস পাবে না । আমাকে ওদের মেজর বার বার ডেকে নিয়ে গ্রামের ব্যাপারে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে ।

                                                                                    ****

মানুষ যে এতটা নির্মম হতে পারে তা আমারজানা ছিলনা । কতইবা বয়স হবে আকমল ছেলেটার। গত বছর সবে মেট্রিক পাস করেছে । আমার চোখের সামনে বড় হল ছেলেটা । কি নির্মম

নির্যাতন করল ছেলেটার উপর । ও নাকি মুক্তিদের খবর জানে । আমার সামনেই একটা একটা করে ওর হাতের আঙ্গুল কেটে নিলো । তীব্র ব্যথা আর পিপাসায় যখন ছেলেটা পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিল এক ফোটা পানিও ওকে দিল না নরপিচাশ গুলো । আমি শত চেষ্টাতেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । দিন দিন কেমন জানি বোধশক্তি হারিয়ে পশু হয়ে যাচ্ছি । না হলে কিভাবে আমি আমার ছাত্রের উপর এমন অন্যায় সহ্য করলাম ? বাড়ি ফিরে বারবার নিজেকে নিজেই খুন করতে ইচ্ছে করছিল । কি লাভ এই পশুর জীবন নিয়ে বেচে থেকে ? বারবার মনে পড়ছিলো আকমলের অসহায় দৃষ্টির কথা । ওর ঠোটের কোণের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করছিল আমাকে । আকমল, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা । তোর মৃত্যুর সময়েও আমি তোর মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারিনি, এ যে আমার জন্য কতবড় অপমানের তা কেবল আমিই জানি ।

                                                                                     ****

গ্রামের সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে । আমার জন্য তাদের মনে আর সেই ভালবাসার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই । তারা ভেবেছে আমি পাকিদের সাথে হাত মিলিয়েছি । ওরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছে । কিন্তু আমি অসহায়, তাদের কাছে আমার অসহায়ত্ব আমি বোঝাতে পারব না । শুধু আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কতটা ঘৃণা করি আমি ওই হায়েনাদের । যারা আমাদের শোষন করেছে বছরের পর বছর । আজ আবার রক্তাত্ত করছে আমার সোনার বাংলাকে । ওই সব নরপশুদের সাথে হাত মেলানো কিছুতেই সম্ভব না আমার পক্ষে । তবুও আমি অসহায়, আমাকে আমার কাজ করেই যেতে হবে । আমি যে গুরু দায়িত্ত্ব নিয়েছি জীবন দিয়ে হলেও সেই দায়িত্ত্ব আমাকে পালন করতেই হবে । আমি যেন গেরস্থের বাড়ির পাশের সুপারি আর ডাব গাছ । ঝড়- বৃষ্টি মাথায় করে আমায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । আমি ভেঙ্গে পড়লে যে গেরস্থের ঘরের চাল

উড়িয়ে নেবে ঝোড়ো বাতাস ।

                                                                                       ****

আজ রাতে এসেছিলো ছেলেগুলো। ওদের চোখে আমি আগুনের লেলিহান খেলা করতে দেখেছি । বুক ভরা তাদের স্বপ্ন। আমরাও কান পেতে থাকি একদিন আবার এইদেশ এর আনাচে কানাচে বউ কথা কও আর কুটুক পাখির ডাক শোনার জন্য । আবার আমরা প্রান খুলে গান গাইতে পারবো, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারব । যেদিন আর কোন হায়েনার ডাকে কেপে উঠবে না বাংলার ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সোনালি ধানের শীষের দোলায় প্রান নেচে উঠবে কৃষকের । আমি বিশ্বাস করি, এটা স্বপ্ন

নয় । খুব বেশি দূরে নয় সেইদিন । খুব গোপনে আমি দিয়ে এসেছি নকশাটা । আমার ক্যাম্পে আসা যাওয়ার যেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই নকশাতে দেখানো আছে পুরো ক্যাম্পটা । কোথায় কোথায় পাহারা থাকবে, কোথায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কোনদিকটা বেশি অরক্ষিত, সব আছে এই নকশায় । এখন শুধু পরিকল্পনা করে ঝাপিয়ে পরার অপেক্ষা । এখন শুধুই প্রতিশোধ নেয়ার পালা......







পড়তে পড়তে আমার চোখে জল চলে এলো । যাকে আমি এতোদিন এতো ঘৃণা করেছি, যার কথা ভাবলেই আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতো, যে মানুষটার জন্য আমি কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারিনি সমাজে সেই মানুষের লেখা ডায়েরীতে আমি এটা কি পড়লাম । এই মানুষটিই কি আমার বাবা, যাকে আমি বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিলাম । এই মহান হৃদয় মানুষটিকে আমি কেনো এতোদিনেও চিনতে পারিনি । কেনো আমি খুজে পাইনি এই ডায়েরী আর আগে ? আজ আমার আকাশ-বাতাস বল্যে ইচ্ছে করছে আমার বাবা দেশের মানুষের সাথে বেঈমানী করেননি । তিনি নিজের জীবন দিয়েছেন এই দেশের জন্য । তোমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা না বল, তিনি আজ আমার কাছে মহানায়ক । তিনি আমার গর্ব, জন সন্তানের ভাগ্য হয় ?





পরিশেষঃ ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিলো না । ধারনা করা হয়, সেদিনের সেই অভিযানে বশির মাস্টারও অংশ নিয়েছিলেন । ক্যাম্পের ভিতর তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল । সেই অভিযানে কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন । বশির মাস্টারের এই গোপন মিশনের কথা কমান্ডার ছাড়া কেউ জানত না । তাই সবাই ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে বশির মাস্টার প্রাণ

হারিয়েছে । আমাদের আশে পাশেই এরকম হাজারো বশির মাস্টার আজও আড়ালেই রয়ে গেছেন, আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি । অথচ, এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আজ বুক ফুলিয়ে বলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা যাদের কিনা জন্মও হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে । আর কতদিন এভাবে অসম্মানিত করা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ?




_________________________________________________________________________________



লিখেছেন-Raisul Zudge



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ছেঁড়া-ডায়েরী/209666862446804