Monday, December 19, 2011

ছেঁড়া ডায়েরী [ Collection of Love Stories -13 ]





চারপাশে আমাকে নিয়ে যে কানাঘুষা চলছে তা বেশ বুঝতে পারি । আমাকে দেখেই সবাই কেমন করে জানি তাকায় । আমার উপস্থিতিতে হঠাৎ থেমে যায় চায়ের দোকানের বিতর্ক । আমার দিকে নীরবে তাকায় । আমি তাদের চোখে খুজি চিরচেনা সেই বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসা । কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেগুলো । আজ তাদের চোখে কেবলি ভয় আর ঘৃণা । আমি ওদের কাছে আর সম্মানের বশির মাস্টার নই, আজ আমি বিশ্বাসঘাতক । তাদের ধারনা আমি হাত মিলিয়েছি পাকিস্থানীদের সাথে ।

                                                                                   ****

আজ পাকিরা আমার স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে । মোট শখানেক সৈন্য । আমার স্কুলের সবগুলো ঘর নিয়েছে তাদের থাকার জন্য । উত্তরের মাঠের পাশে আর দক্ষিনের পুকুরপাড়ে বাংকার খুঁড়ে ভারি এল.এম.জি. বসিয়েছে । উত্তর-দক্ষিন দুই দিকই বেশ সুরক্ষিত করেছে। ঘন্টায় ঘন্টায় পালা করে পাহারা দিচ্ছে জওয়ানেরা । তাদের  হাবভাবে বেশ বোঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওরা যমের মত ভয় পাচ্ছে । স্কুলের পেছনের জঙ্গলটাকে রীতিমতো পরিষ্কার করে ফেলেছে । স্কুলের ছাদে বসিয়েছে ভারি মর্টার গান । পুবদিকে নদী থাকায় ওদিকেই বেশী ক্যাম্প ফেলেছে সৈন্যদের থাকার জন্য । অধিকাংশ পাকি জওয়ান সাঁতার জানে না । তাই ওরা ধরেই নিয়েছে যে কোনো শত্রু এই খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আক্রমন করার সাহস পাবে না । আমাকে ওদের মেজর বার বার ডেকে নিয়ে গ্রামের ব্যাপারে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে ।

                                                                                    ****

মানুষ যে এতটা নির্মম হতে পারে তা আমারজানা ছিলনা । কতইবা বয়স হবে আকমল ছেলেটার। গত বছর সবে মেট্রিক পাস করেছে । আমার চোখের সামনে বড় হল ছেলেটা । কি নির্মম

নির্যাতন করল ছেলেটার উপর । ও নাকি মুক্তিদের খবর জানে । আমার সামনেই একটা একটা করে ওর হাতের আঙ্গুল কেটে নিলো । তীব্র ব্যথা আর পিপাসায় যখন ছেলেটা পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিল এক ফোটা পানিও ওকে দিল না নরপিচাশ গুলো । আমি শত চেষ্টাতেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । দিন দিন কেমন জানি বোধশক্তি হারিয়ে পশু হয়ে যাচ্ছি । না হলে কিভাবে আমি আমার ছাত্রের উপর এমন অন্যায় সহ্য করলাম ? বাড়ি ফিরে বারবার নিজেকে নিজেই খুন করতে ইচ্ছে করছিল । কি লাভ এই পশুর জীবন নিয়ে বেচে থেকে ? বারবার মনে পড়ছিলো আকমলের অসহায় দৃষ্টির কথা । ওর ঠোটের কোণের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করছিল আমাকে । আকমল, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা । তোর মৃত্যুর সময়েও আমি তোর মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারিনি, এ যে আমার জন্য কতবড় অপমানের তা কেবল আমিই জানি ।

                                                                                     ****

গ্রামের সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে । আমার জন্য তাদের মনে আর সেই ভালবাসার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই । তারা ভেবেছে আমি পাকিদের সাথে হাত মিলিয়েছি । ওরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছে । কিন্তু আমি অসহায়, তাদের কাছে আমার অসহায়ত্ব আমি বোঝাতে পারব না । শুধু আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কতটা ঘৃণা করি আমি ওই হায়েনাদের । যারা আমাদের শোষন করেছে বছরের পর বছর । আজ আবার রক্তাত্ত করছে আমার সোনার বাংলাকে । ওই সব নরপশুদের সাথে হাত মেলানো কিছুতেই সম্ভব না আমার পক্ষে । তবুও আমি অসহায়, আমাকে আমার কাজ করেই যেতে হবে । আমি যে গুরু দায়িত্ত্ব নিয়েছি জীবন দিয়ে হলেও সেই দায়িত্ত্ব আমাকে পালন করতেই হবে । আমি যেন গেরস্থের বাড়ির পাশের সুপারি আর ডাব গাছ । ঝড়- বৃষ্টি মাথায় করে আমায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । আমি ভেঙ্গে পড়লে যে গেরস্থের ঘরের চাল

উড়িয়ে নেবে ঝোড়ো বাতাস ।

                                                                                       ****

আজ রাতে এসেছিলো ছেলেগুলো। ওদের চোখে আমি আগুনের লেলিহান খেলা করতে দেখেছি । বুক ভরা তাদের স্বপ্ন। আমরাও কান পেতে থাকি একদিন আবার এইদেশ এর আনাচে কানাচে বউ কথা কও আর কুটুক পাখির ডাক শোনার জন্য । আবার আমরা প্রান খুলে গান গাইতে পারবো, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারব । যেদিন আর কোন হায়েনার ডাকে কেপে উঠবে না বাংলার ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সোনালি ধানের শীষের দোলায় প্রান নেচে উঠবে কৃষকের । আমি বিশ্বাস করি, এটা স্বপ্ন

নয় । খুব বেশি দূরে নয় সেইদিন । খুব গোপনে আমি দিয়ে এসেছি নকশাটা । আমার ক্যাম্পে আসা যাওয়ার যেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই নকশাতে দেখানো আছে পুরো ক্যাম্পটা । কোথায় কোথায় পাহারা থাকবে, কোথায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কোনদিকটা বেশি অরক্ষিত, সব আছে এই নকশায় । এখন শুধু পরিকল্পনা করে ঝাপিয়ে পরার অপেক্ষা । এখন শুধুই প্রতিশোধ নেয়ার পালা......







পড়তে পড়তে আমার চোখে জল চলে এলো । যাকে আমি এতোদিন এতো ঘৃণা করেছি, যার কথা ভাবলেই আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতো, যে মানুষটার জন্য আমি কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারিনি সমাজে সেই মানুষের লেখা ডায়েরীতে আমি এটা কি পড়লাম । এই মানুষটিই কি আমার বাবা, যাকে আমি বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিলাম । এই মহান হৃদয় মানুষটিকে আমি কেনো এতোদিনেও চিনতে পারিনি । কেনো আমি খুজে পাইনি এই ডায়েরী আর আগে ? আজ আমার আকাশ-বাতাস বল্যে ইচ্ছে করছে আমার বাবা দেশের মানুষের সাথে বেঈমানী করেননি । তিনি নিজের জীবন দিয়েছেন এই দেশের জন্য । তোমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা না বল, তিনি আজ আমার কাছে মহানায়ক । তিনি আমার গর্ব, জন সন্তানের ভাগ্য হয় ?





পরিশেষঃ ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিলো না । ধারনা করা হয়, সেদিনের সেই অভিযানে বশির মাস্টারও অংশ নিয়েছিলেন । ক্যাম্পের ভিতর তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল । সেই অভিযানে কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন । বশির মাস্টারের এই গোপন মিশনের কথা কমান্ডার ছাড়া কেউ জানত না । তাই সবাই ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে বশির মাস্টার প্রাণ

হারিয়েছে । আমাদের আশে পাশেই এরকম হাজারো বশির মাস্টার আজও আড়ালেই রয়ে গেছেন, আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি । অথচ, এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আজ বুক ফুলিয়ে বলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা যাদের কিনা জন্মও হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে । আর কতদিন এভাবে অসম্মানিত করা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ?




_________________________________________________________________________________



লিখেছেন-Raisul Zudge



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ছেঁড়া-ডায়েরী/209666862446804 

আনন্দ বেদনার কাব্য [ Collection of Love Stories -12 ]


যুদ্ধ মানে কি? সংগ্রাম? লড়াই? আর বিজয় মানে কি অর্জন? মমতা ভাবেন আর ভাবেন। এই যে অবিরাম যুদ্ধ, এর শেষ কোথায়!!!




অরিত্রর জন্ম সেই যুদ্ধের সময়। সেই ছেলে দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। পঁচিশ ছুঁই ছুঁই ছিপছিপে এক যুবক। এই যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ।পরনে আকাশ নীল একট টি- শার্ট। হাল্কা কোঁকড়ানো চুল। মসৃণ কাঁধ, ঝকঝকে গায়ের রং আর বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ। একদম মাহিন এর কার্বন কপি । দেখতে এমন এ ছিল মাহিন। শান্ত চেহারা কিন্তু ভেতরে অনেক জেদ। অনেক স্বপ্ন। একটু আবেগপ্রবণ কিন্তু নীতিতে অটল।

-মা নাস্তা দাও।    

-টেবিল এ চল।

-তুমি খেয়েছ?

-না।

-কেন?               

-এমনি।

-খাওনা কেন? এত সকালে উঠো।

-তুই খাবি চল।

-ভাত খাব মা।

-এই সকালে?

-হু। দুপুরে খাওয়ার ঠিক থাকে না।

-বাসায় চলে আসলেই তো পারিস।

- টাইম পাইনা । তোমার সেই কালকের মাংস আছে না?  ফাটাফাটি হইছিল ।

-হু, চল।

-আজকে ফিরতে দেরি হবে মা। প্রোজেক্ট এর কাজ।

-সে আর নতুন কি।

-আমার ভালো লাগে না মা।

-কি?

-এইযে চাকরি খোঁজা ।

-হবে চেষ্টা কর।

-আর কত?

-পানিতে ত পড়িস নাই।

-তুমি আর কত?

-আমার আরো চাকরি আছে ৩ বছর। হয়ে যাবে।নাস্তা খাবি  চল।

-মা তোমার কোন কিছুতে মন খারাপ হয়না?

-না।

-কেন?

-লাভ নাই তাই।

-তোমার কি দারুন ফিলসফি।

-এই ভাত খাবি ত চল।

পিছনে পিছনে অরিত্র আসে। গরম ভাত আর তাতে জ্বাল দেয়া কোরবানির মাংস । ঝুরা ঝুরা হয়ে গেছে , অরিত্রর তাই পছন্দ। তাতে ডাল।গরম গরম।তাতে  মরিচ। অরিত্র হাপুস হুপুস খায়।

-বলে মা রনির জব হল শাফিক এর ও হল একটা । আমার যে কবে হবে।

-হবে হবে আল্লাহকে ডাক।

-তোমার আজকে কি রুটিন?

-মিটিংএকটা আর কিছু নাই।

-কখন যাবা?

-এইত।

-চল একসাথে বের হই।

-না রে। তুই যা।

অরিত্র বেরিয়ে যায় ।



 মমতা গোসল করে রেডি হতে যান। তার এখন ও অনেক লম্বা চুল। টানা মসৃণ । কোমর ছাপানো। তাতে সকালের সূর্যের  আলো পড়ে ঝলমল করছে। একটা হাত খোঁপা বাঁধেন। তার পঞ্চাশ পেরিয়ে  গেছে  কিন্তু মুখে এখন ও তারুণ্য এর আভা। এককালে খুব সুন্দর ছিলেন তিনি। শাড়িতে খুব দারুন লাগত। এখন ও তাই। একটা  হাল্কা আকাশি শাড়ি বের করেন। তাতে সাদা ব্লাউজ।আজকে departmental মীটিং . Agenda আগে ই ঠিক করা।

দরজাতে তালা লাগিয়ে বের হতে হতে ১০ টা। তার আগে একটা বিস্কিট, এক কাপ গ্রীন টি।

চেয়ারম্যানশিপ এর দুই বছর চলছে।সপ্তাহে ২টা ক্লাস। আজকে ক্লাস নাই।

রুম এ রুমানা বসে আছে ।দেখতে খুব নরম শরম শান্ত । তার ছোট বোন তুলির মেয়ে।এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। এই মেয়েকে দেখলে তার নিজের সেই বয়স এর প্রতিচ্ছবি মনে হয়। ওর স্নিগ্ধ হাসি অনেক কথা বলে।

-কিরে রুমানা খবর কি?

-এইত চলছে।খালা এক্সাম কি পিছাবে? উড়া উড়া শুনি।

-তাই নাকি?

-তাইলে ত গেলাম।

-কেন?

-সময় চলে আসল না?

মমতা হাসেন। বলেন -সময়  বাড়ায়া নে ।অনার্স টা শেষ কর... তারপর

রুমানার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সামনের জানুয়ারীতে। ছেলে জাপান প্রবাসী ডাক্তার। বিয়ের পরই ও কে নিয়ে  যাওয়ার কথা। রুমানাকে বিষণ্ণ লাগে। চোখ দুটো কি এক কষ্টে ছল ছল করে।

গহন কালো চোখ দুটি তুলে বলে

-হু... বিয়ে বড় না পড়াশোনা?

-তাইতো। চিন্তিত ভাব দেখান মমতা। তা তোর হবু বর কি বলে?

-বলে পড়াশোনা করে লাভ কি? তুমি কি চাকরি করবা?

-তুই কি বলিস?

-বলি তাইত রান্না করতে আর বাসন মাজতে তো আর ডিগ্রি লাগেনা। কিন্তু খালা আমি এত সহজে ছাড়বনা। ফাইট দিব। পড়াশোনা শেষ করবই।

-জাপান এ গিয়ে জাপানিজ ফাইট? তোর মা কি বলে?

হাসে রুমানা। বলে মা আমার পক্ষে আছে। তোমার এক্সামপল দেয়। বলে মমতার মত হ। লাইফ এর কোন গ্যারান্টি আছে?

 -তুই তো এই যুগ এর মেয়ে। আমার মত কেন হবি? আরো আগাবি না ?

-তোমার মত হইলে এ হবে। দোয়া কইর। অরিত্র ভাই এর কি খবর?

-আছে।

-যাবনে বাসায়।

- আসিস।                                                                               



রুমানা চলে গেল।কিন্তু ওর সুবাস ছড়িয়ে রইল। সাহস এর দৃঢ়তার। মায়বি চেহারাতে কি যেন বলে গেল রুমানা! তার মত হতে চায়। লড়াই করতে চায়। বোকা মেয়ে। লড়াই করা কি খুব সুখের? একটা সময় ছিল যখন রুমানার মত ছিলেন তিনি। তেজি আর সাহসি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব সংবেদনশীল।



সেই মনের প্রেমে পড়ে গেল মাহিন । অভিজাত পরিবার এর একমাত্র সন্তান । হৃদয়বান মেধাবি আর পরোপকারী। তুখোড় বিতারকিক আর আবৃত্তিকার । সেই মাহিন এর বনলতা হয়ে গেলেন তিনি। মফঃস্বল থেকে আসা মহিলা কলেজ এ পড়া মমতা ।তার অসাধারন মুখশ্রী, মিষ্টি  গানের গলা আর নিবিড় কাল চুলের জন্য ফিদা হয়ে গিয়েছিল মাহিন। কি যে সময় গেছে তখন । অপ্রেমের কাল থেকে প্রেম এর কাল। রোকেয়া হল থেকে মুজিব হল।ডাকসু থেকে TSC.  

বিয়ের বছর এ যুদ্ধ। ততদিনে এ পাশ করে বেড়িয়ে গেছেন দুজনেই। মাহিন ইউনিভার্সিটির টিচার। মমতা  একটা সরকারি কলেজে। মাহিন এর চেষ্টাতো ছিলই নিরন্তর। জীবন গোছানোর। Full bright scholarship  হয়ে গেল। যাওয়ার গোছগাছ চলছে তখনি যুদ্ধ।

না সেই কাহিনি আর মনে করতে চান না মমতা। বাইরে ভিতরের নিরন্তর যুদ্ধের কাল। নিজেকে রক্ষা করা,  অরিত্রর জন্ম, তাকে একা হাতে মানুষ করা... আর অপেক্ষা ... কত দিন রত্রি প্রহর গেল... অপেক্ষা আর শেষ হয়না । আহ চোখে পানি আসে কেন ?

মিটিং আর টুকটাক কাজ সেরে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হতে হতে বিকেল। বাসা ৫ মিনিট এর হাঁটা পথ।এতটুকুতেই ফুরিয়ে  যায়। এবার অনেক ফুল ফুটেছে । কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর নাম না জানা কত ফুল। । মমতা ফুলের সুবাস মেখে ফুলার রোড এর রাস্তায় হাঁটেন আর ফুল দেখেন। মাহিন এর অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক বড় হবার, অনেক কিছু করার এই দেশটার জন্য । সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল  একদিন ১৯৭১ র এপ্রিল এর এক সকালে আর ফিরে এলোনা। কোথায় গেলো... কত খোঁজ .. . কত খোঁজ ...।  আর কত অপেক্ষা , আর কত চোখের জল। এই মাটিতে  কোথায় ঘুমিয়ে আছে।  কে জানে। বিয়ের পর পর অরিত্র এসেছিল গর্ভে । কি সুখ, কি আনন্দ, কত কল্পনা। ছেলে না মেয়ে। ছেলে হলে অরিত্র আর মেয়ে হলে বর্ষা। ছেলে হলে বুয়েট আর মেয়ে হলে মেডিকেল। স্বাধীন দেশে বড় হবে ওরা, সেই স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা।  সবই হল শুধু মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল মাহিন , ইংলিশ বিভাগ এর তরুন প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক শিক্ষক।



মুঠোফোন টা বেজে ওঠে।

-মা মা তুমি কই?

-কেন? কি হল?

-বলনা মা

-কি ? এই ত বাসার কাছে

-আস মা, তাড়াতাড়ি।

-তুই কই?

-বাসায় মা।আস...



বিকেল নেমেছে ফুলার রোড এ। তার সোনালি আলোতে মেখে আছে দশদিক। কাঁচা সোনার মত রোদ। এই রোদ এ রিকশা করে ঘোরা ছিল মাহিন এর খুব এ প্রিয়। আর তার সাথে গান। মমতার গান।

এক বিকাল এর কথা মনে পড়ল। সোনা সোনা রোদ। তার মাঝে আচমকা  বৃষ্টি। মাহিন এর কি উচ্ছাস। রাধাচূড়া ফুল আর বেলি ফুল এর গন্ধ মাখা রাস্তা। রিকশার পরদা ফেলা। আচমকাই হাতের পাতায় হাত। অসম্ভব ম্যানলি গলায় গহন ঘোর।

-মমতা প্লীজ বৃষ্টির গান কর একটা

মমতা অভ্যস্ত মাহিন এর পাগলামিতে। তাও বলেন কি বল না বল। রিকশাওালা শুনবে ত।

 চকিতে দুষ্টামি মাহিন এর গলায়। দারুন হাসিতে রাস্তা কাঁপিয়ে বলে আরে ওরে না হয় ২ টাকা কম দিবো... ফ্রী গান শুনবে তাই।

-আরে বল কি

-আরে লতা মুঙ্গেশকার, গান না একটা গান। নাহয় রিকশাওয়ালারে জিজ্ঞেস করি তোমার  গানের বদলে ফ্রী নিয়া যাবে নাকি আমদের?  

-না গাইলে কি করবা?

 -কি যে করব, হুড ফেলে বৃষ্টিতে তোমারে গোসল করাই দিবো। আর না হয় আমিই গান শুরু করব। চিল্লাব তখন বুঝবা কত ধান এ কত চাল।   তুমি ভালো বিপদ এ পড়বা।

 -এত জ্বালাও কেন তুমি?

-বউ হবা না আমার ? জ্বালা ত সইতেই হবে।।

 কি গান গেয়েছিলেন মনে নাই। ঝর ঝর মুখর শ্রাবন দিন এ না  অন্য কিছু... তাতে কি আনন্দ মাহিনের বলল আজকে আমারে বিয়ে করবা? প্লিজ চলনা কাজী অফিস। রাত বিরাতে তোমার গান শুনতে চাইলেও পারব তাইলে।



দরজাতেই দাঁড়িয়ে অরিত্র।। জড়িয়ে ধরল মাকে।

- মা মা দারুণ একটা ব্যাপার।          

-কি রে? কি হইছে?

-হয়ে গেছে মা , হয়ে গেছে।

-কি?

- গেস কর মা।

- চাকরি হইছে?

-না মা।

-তাইলে  কেমিক্যাল এর মুমু নিজেই তোরে বলছে তরে ছাড়া বাঁচবে না।

 -না মা

 -তাইলে... না রে তুই বল

-স্কলারশিপ পাইছি মা

-কোনটা

ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি তে মা... ফুল স্কলারশিপ মা

-সত্যি?

-তিন সত্যি মা।

 -কখন দেখলি?

-এইত রুমির বাসায় অনলইন হইলাম । তখনই । ফোনে বলতে ইচ্ছা করলনা তাই বাসায় আসলাম।

-কবে সেশান?  

-এইত মা সেপ্টেম্বরে । আর মাত্র ২ মাস।   

-তাইতো। সময় যে অনেক কম ।

-চল মা। সেলিব্রেট করি। তোমারে বাইরে খাওয়াব।  নতুন একটা দোকান হইছে  ধানমণ্ডিতে। ধানসিঁড়ি। ওদের  মাটন কাচ্চি আর চিকেন কড়াই। সাথে বোরহানি আর রায়তা। শেষে তোমারে পানবাহার এর একটা পান। দিলখুশ হয়ে যাবে।

অনেকদিন অনেকদিন কষ্টে ছিল অরিত্র। বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার । কোন চাকরি নাই ।  ছোটোখাটো প্রোজেক্ট এর কাজ আর কয়েকটা কোচিং এ ক্লাস। এবার খুশি। মমতার চোখে পানি আসে। সুখের দিন কি এসে গেল!! তার মিশন কি এইবার শেষ হল। তার যুদ্ধ কি বিজয় পেল? চোখের পানি ফেলার দিন কি শেষ হল?

-আমারে কেন? বন্ধুদের বল। আমি টাকা দেই।ভালমত খা। যা যা মন চায়। যতজনরে খাওয়াতে মন চায়।

-বন্ধুরে ই ত বললাম মা। সবচে বড় বন্ধু।   

-আরে ধুর।।                                                                        

-চলনা মা।শাড়ি বদলাইতে হবে না। তোমারে দারুন লাগতেছে মা।

-হইছে হইছে আর বলতে হবে না।

আবারও চোখে পানি আসে। আর মাত্র দুই মাস। অরিত্র ও চলে যাবে।

নিচে নেমে এসে রিকশাতে উঠে মা আর ছেলেতে। রিকশা চলতে থাকে। মা আর ছেলের কথা ও চলতে অরিত্র  এর স্বপ্ন, পরিকল্পনা । টুংটাং রিকশার হর্ন বাজে।    

-বলে মা আমারে ছাইড়া থাকতে পারবা তো? কিছুদিন। তোমারে  নিয়ে যাব ।

-নারে আমারে নিয়ে ভাবিস না। ৫ বছর ত। দেখতে দেখতে চলে যাবে। শুধু এই মাটিতে ফিরে আসিস।  অইখানে থাকিস না। কত কষ্টের এই দেশ। তোর বাবার কত স্বপ্নের দেশ।

-রুমানা রে  নিয়ে আস মা তোমার কাছে। হলেইতো থাকে । অনেক ভালো মেয়ে।

-নারে আমি একাই পারব । তুই থাকতে পারবি তো? দেখিস আবার কান্নাকাটি লাগাইস না।

অরিত্র মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। ওর দুই চোখে শ্রাবণ এর ঢল নামে।



                                  ********************

অনেক অনেকদিন চলে গেছে তারপর। আজকেও সন্ধ্যা নেমেছে। বসুন্ধারার ১০ নম্বর সড়কে ১১২ নং ছিমছাম দোতালা বাড়ীটিতে। সোনা সোনা রঙের আলোয় আলোকিত চারিদিক।

মিতু কাঁদছে।  এপোলো হসপিটাল এর শিশু বিশেষজ্ঞ মিতু। অরিত্রর ঘরনি।

- মিতু মিতু কাঁদছ কেন?

-কি জানি কাঁদি নাতো।

 -এই যে চোখে পানি। স্কলারশিপ পাওয়ার দিনটার কথা শুনতে চাইলা তাই না বললাম।

-না মা এর কথা যত শুনি ততই কেমন অস্থির লাগে...  ক বছর পরে ফিরলা তুমি?

-৫বছর।

-মা কেমনে ছিল!    

-মারে চিননা তুমি... সব পারে মা। ফোনে এ আমি কাঁদতাম। মা কাঁদত না।

অনিন্দ্য সুন্দর চোখ দুটি তুলে হাসে মিতু...  তাইত মায়েরা অনেক কিছু পারে। না পারলেও পারতে হয়।

-হু

মিতু উঠে। তার গহন মায়াবি চোখ  দুটো তখনো ভিজা।

-কই যাও

-যাই দেখি মা কি করে। বারান্দা তে আসবানা? একসাথে চা খাই।

মমতা  বসে ছিলেন ছোট্ট আনুশকে কোলে নিয়ে। লনে। অনেক ফুল ফুলে ভরা বাসার  সামনের লন। মিতুর হাতের অনবদ্য সৃষ্টি। এই মিতু নামক মেয়েটা যেন তার জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি কে ভুলিয়ে দিতে তার জীবনে পা রেখেছে। আর এই যে আনুশ।রেশম কাল চুল আর বরফ সাদা গায়ের রঙ । কি মায়া আর কি তৃপ্তি। তার বুকের উত্তাপ এ মিশে অনর্গল তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে ৩ বছর বয়সী আনুশকা।  মিতু পিছনে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে মমতার মাথায় হাত রাখে। নিবিড় কোমল সেই স্পর্শ। মনে মনে বলে মা আমি যেন আপনার মত হই। দোয়া করবেন।  

                                     *************


লেখকের কথাঃ পৃথিবীর সকল মাকে আমার অসীম শ্রদ্ধা।   


আমার যেন কখনই আমাদের মা আর মাটিকে ভুলে না যাই।



--------------------------------------------------------------------------



লিখেছেন-Sakiba Ferdousy



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)





গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/আনন্দ-বেদনার-কাব্য/209767732436717