চারপাশে আমাকে নিয়ে যে
কানাঘুষা চলছে তা বেশ বুঝতে পারি । আমাকে দেখেই সবাই কেমন করে জানি তাকায় । আমার
উপস্থিতিতে হঠাৎ থেমে যায় চায়ের দোকানের বিতর্ক । আমার দিকে নীরবে তাকায় । আমি
তাদের চোখে খুজি চিরচেনা সেই বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসা । কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেগুলো । আজ
তাদের চোখে কেবলি ভয় আর ঘৃণা । আমি ওদের কাছে আর সম্মানের বশির মাস্টার নই,
আজ আমি বিশ্বাসঘাতক । তাদের ধারনা আমি হাত মিলিয়েছি
পাকিস্থানীদের সাথে ।
****
আজ পাকিরা আমার স্কুলের মাঠে
ক্যাম্প করেছে । মোট শ’খানেক
সৈন্য । আমার স্কুলের সবগুলো ঘর নিয়েছে তাদের থাকার জন্য । উত্তরের মাঠের পাশে আর
দক্ষিনের পুকুরপাড়ে বাংকার খুঁড়ে ভারি এল.এম.জি. বসিয়েছে । উত্তর-দক্ষিন দুই
দিকই বেশ সুরক্ষিত করেছে। ঘন্টায় ঘন্টায় পালা করে পাহারা দিচ্ছে জওয়ানেরা ।
তাদের হাবভাবে বেশ বোঝা যায়
মুক্তিযোদ্ধাদের ওরা যমের মত ভয় পাচ্ছে । স্কুলের পেছনের জঙ্গলটাকে রীতিমতো
পরিষ্কার করে ফেলেছে । স্কুলের ছাদে বসিয়েছে ভারি মর্টার গান । পুবদিকে নদী
থাকায় ওদিকেই বেশী ক্যাম্প ফেলেছে সৈন্যদের থাকার জন্য । অধিকাংশ পাকি জওয়ান
সাঁতার জানে না । তাই ওরা ধরেই নিয়েছে যে কোনো শত্রু এই খরস্রোতা নদী পেরিয়ে
আক্রমন করার সাহস পাবে না । আমাকে ওদের মেজর বার বার ডেকে নিয়ে গ্রামের ব্যাপারে
এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে ।
****
মানুষ যে এতটা নির্মম হতে
পারে তা আমারজানা ছিলনা । কতইবা বয়স হবে আকমল ছেলেটার। গত বছর সবে মেট্রিক পাস
করেছে । আমার চোখের সামনে বড় হল ছেলেটা । কি নির্মম
নির্যাতন করল ছেলেটার উপর ।
ও নাকি মুক্তিদের খবর জানে । আমার সামনেই একটা একটা করে ওর হাতের আঙ্গুল কেটে নিলো
। তীব্র ব্যথা আর পিপাসায় যখন ছেলেটা পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিল এক ফোটা পানিও ওকে
দিল না নরপিচাশ গুলো । আমি শত চেষ্টাতেও চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । দিন দিন
কেমন জানি বোধশক্তি হারিয়ে পশু হয়ে যাচ্ছি । না হলে কিভাবে আমি আমার ছাত্রের উপর
এমন অন্যায় সহ্য করলাম ? বাড়ি
ফিরে বারবার নিজেকে নিজেই খুন করতে ইচ্ছে করছিল । কি লাভ এই পশুর জীবন নিয়ে বেচে
থেকে ? বারবার মনে পড়ছিলো আকমলের অসহায় দৃষ্টির কথা ।
ওর ঠোটের কোণের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করছিল আমাকে । আকমল, তুই
আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা । তোর মৃত্যুর সময়েও আমি তোর মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে
পারিনি, এ যে আমার জন্য কতবড় অপমানের তা কেবল আমিই জানি ।
****
গ্রামের সবাই আমাকে এড়িয়ে
চলছে । আমার জন্য তাদের মনে আর সেই ভালবাসার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নাই । তারা
ভেবেছে আমি পাকিদের সাথে হাত মিলিয়েছি । ওরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবছে । কিন্তু
আমি অসহায়, তাদের কাছে আমার
অসহায়ত্ব আমি বোঝাতে পারব না । শুধু আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কতটা ঘৃণা করি
আমি ওই হায়েনাদের । যারা আমাদের শোষন করেছে বছরের পর বছর । আজ আবার রক্তাত্ত করছে
আমার সোনার বাংলাকে । ওই সব নরপশুদের সাথে হাত মেলানো কিছুতেই সম্ভব না আমার পক্ষে
। তবুও আমি অসহায়, আমাকে আমার কাজ করেই যেতে হবে । আমি
যে গুরু দায়িত্ত্ব নিয়েছি জীবন দিয়ে হলেও সেই দায়িত্ত্ব আমাকে পালন করতেই হবে
। আমি যেন গেরস্থের বাড়ির পাশের সুপারি আর ডাব গাছ । ঝড়- বৃষ্টি মাথায় করে
আমায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । আমি ভেঙ্গে পড়লে যে গেরস্থের ঘরের চাল
উড়িয়ে নেবে ঝোড়ো বাতাস ।
****
আজ রাতে এসেছিলো ছেলেগুলো।
ওদের চোখে আমি আগুনের লেলিহান খেলা করতে দেখেছি । বুক ভরা তাদের স্বপ্ন। আমরাও কান
পেতে থাকি একদিন আবার এইদেশ এর আনাচে কানাচে বউ কথা কও আর কুটুক পাখির ডাক শোনার
জন্য । আবার আমরা প্রান খুলে গান গাইতে পারবো, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারব । যেদিন আর কোন হায়েনার ডাকে কেপে উঠবে না
বাংলার ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সোনালি ধানের শীষের দোলায় প্রান নেচে উঠবে কৃষকের ।
আমি বিশ্বাস করি, এটা স্বপ্ন
নয় । খুব বেশি দূরে নয়
সেইদিন । খুব গোপনে আমি দিয়ে এসেছি নকশাটা । আমার ক্যাম্পে আসা যাওয়ার যেটা মূল
উদ্দেশ্য ছিল। এই নকশাতে দেখানো আছে পুরো ক্যাম্পটা । কোথায় কোথায় পাহারা থাকবে, কোথায় রয়েছে অস্ত্রাগার, কোনদিকটা
বেশি অরক্ষিত, সব আছে এই নকশায় । এখন শুধু পরিকল্পনা করে
ঝাপিয়ে পরার অপেক্ষা । এখন শুধুই প্রতিশোধ নেয়ার পালা......
পড়তে পড়তে আমার চোখে জল
চলে এলো । যাকে আমি এতোদিন এতো ঘৃণা করেছি, যার কথা ভাবলেই আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতো, যে মানুষটার জন্য আমি কখনো মাথা উঁচু করে চলতে পারিনি সমাজে সেই
মানুষের লেখা ডায়েরীতে আমি এটা কি পড়লাম । এই মানুষটিই কি আমার বাবা, যাকে আমি বিশ্বাসঘাতক ভেবেছিলাম । এই মহান হৃদয় মানুষটিকে আমি কেনো
এতোদিনেও চিনতে পারিনি । কেনো আমি খুজে পাইনি এই ডায়েরী আর আগে ? আজ আমার আকাশ-বাতাস বল্যে ইচ্ছে করছে আমার বাবা দেশের মানুষের সাথে
বেঈমানী করেননি । তিনি নিজের জীবন দিয়েছেন এই দেশের জন্য । তোমরা তাকে
মুক্তিযোদ্ধা না বল, তিনি আজ আমার কাছে মহানায়ক । তিনি
আমার গর্ব, ক’জন সন্তানের ভাগ্য
হয় ?
পরিশেষঃ ডায়েরীতে আর কিছু
লেখা ছিলো না । ধারনা করা হয়, সেদিনের
সেই অভিযানে বশির মাস্টারও অংশ নিয়েছিলেন । ক্যাম্পের ভিতর তার লাশ পাওয়া
গিয়েছিল । সেই অভিযানে কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন । বশির
মাস্টারের এই গোপন মিশনের কথা কমান্ডার ছাড়া কেউ জানত না । তাই সবাই ভেবেছিল
মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে বশির মাস্টার প্রাণ
হারিয়েছে । আমাদের আশে
পাশেই এরকম হাজারো বশির মাস্টার আজও আড়ালেই রয়ে গেছেন, আমরা তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি । অথচ, এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আজ বুক ফুলিয়ে বলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা
যাদের কিনা জন্মও হয়নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে । আর কতদিন এভাবে অসম্মানিত করা হবে
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ?
লিখেছেন-Raisul Zudge
(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)
গল্পটি নেয়া : https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ছেঁড়া-ডায়েরী/209666862446804