লাল চূঁড়ি সমেত হাতটা বাইরে দিয়ে কুয়াশা ছুঁতে চায় কাঁকন।
আলতো করে মেলে
রাখে জানালার গ্রিলের বাইরে, যতটুকু যায় হাত ঠিক ততটুকু।
প্রকৃতির স্বাদ যেন সে নিতে চায় এই হাত দিয়ে। এখন তো শীতকাল, তাই হাতে কিছু আর ধরা দেয়না। বর্ষাতে যখন তার হাত এভাবে মেলে থাকে,
বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভেজায় কাঁকনের হাত আর সেই খুশিতে যেন রাঙায়
তার মন। খুব সাধারণ একটি ব্যাপার, তবু সে উপভোগ করে শান্ত
স্নিগ্ধ সকালটাতে। আর তার তিন বছরের ছোট বোন তিশাম লক্ষ্য করে যায় বড় বোনটার এই
নীরব পাগলামী। তিশামের চোখে সবথেকে সুন্দর মেয়ে তার বড় বোন কাঁকন। কি সুন্দর
টানা চোখ, মুখটাতে মায়া যেন উপচে পড়ে। আর ঠিক সকালের এই
সময়টাতে যখন কাঁকন চোখে কাজল দিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগে। জানালার এপাশটায় প্রায় দাঁড়ায় কাঁকন,
রুমের এই জায়গাটা যেন তার জন্য তৈরি।
- কিরে আপা, ক্লাশে যাবিনা।
- না, আজ ক্লাশ হবে না। তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আর ক্লাশ শেষে
তাড়াতাড়ি ফিরবি। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় বসিসনা যেন। বিকেলে বাবা আসবে। জানালার বাইরে হতে
চোখ না ফিরিয়েই কথাগুলো বলে যায় কাঁকন।
আজ তার বাবা
আসবে বিকেলে।
তার বাবা, তার সব থেকে প্রিয় বন্ধু। প্রিয় বন্ধু হতে দূরে বেশ কিছু বছর। অথচ
কতটুকু দূর তাদের বাড়ি? এক ঘন্টা হতে একটু বেশি লাগে
যেতে তার এই হোস্টেল হতে। কতজনই তো আছে তাদের সেই এলাকা হতে এসে ক্লাশ করে আবার
ফিরে যায় বাড়িতে, কিন্তু তাদের দু'বোনের জন্য অন্য নিয়ম। এত কাছে বাড়ি থেকেও তারা এই মহিলা হোস্টেলে।
মন চায় নিজ আবাসের মাঝে ফিরে যেতে, মাটির উঠোনে খালি
পায়ে হাঁটতে। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াতে, তাদের
নিজেদের ধান ক্ষেতের পাশে বসে থাকতে। কিন্তু হয় না আর এসব। আজ সে আর তার বোন যেন
অতিথি। মাসে একবার কি দু'মাসে একবার করে যায় বাড়িতে,
দু'তিন দিন থেকে চলে আসে। সেই দু'তিন দিনেই কত টিপ্পনী যে শুনতে হয় মা এর কাছ থেকে।
মা? নাকি সৎ মা?
মা শব্দটিতো
ভাগ করা উচিত নয়, মা তো শুধুই মা।
কিন্তু এই মা
শব্দটিতে নয় শুধু, বাস্তব জীবনেও অনেক ভাগ রয়েছে। তা যে শেখা
শুরু কাঁকনের সেই দশ বছর বয়স হতে। চোখের সামনে এখনও ভেসে উঠে তার মাকে। ঠিক
কাঁকনের মতই ছিল টানা চোখ। সাধারণের মাঝেও তার মা ছিল অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা।
এখনও চোখ বুজলেই কাঁকন দেখতে পায়, অনুভব করে মায়ের
হাতের ছোঁয়া। মা যখন এক পলকে তাকিয়ে থাকতো, তখন অন্যরকম
এক অনুভূতি হতো তার ভেতর। সব সময় আগলে রাখতো তাদের দু'বোনকে।
আর বাবা? বাসায় এসেই খেলতে বসে যেতো তাদের দু'বোনকে নিয়ে। হাসিখুশিতে চলে যাচ্ছিল দিনগুলো।
সাদার অপরে যে
কালো।
নীল আকাশ যে
ছেয়ে যায় নিকষ মেঘের আঁধারে। সূর্যের কি সাধ্য সেই কাল মেঘকে হটিয়ে উদয় হয়? ঢেকে যায় সব শুভ্রতা, ছেয়ে যায় কালো
সবখানে। স্বচ্ছ কাঁচ যেন ঘোলাটে হয় মূহুর্তেই। ঘোলাটে হয় জীবন। সব ভাসে চোখে,
সব। মাকে সাদা কাফনে জড়ানো, বাবাকে ধরে
চিৎকার, ছোট বোনের অসুস্থতা। সব কালো যেন ছেয়ে ছিল
জীবনের এক থমকে যাওয়া সময়ে। গ্রাস করেছিল সময়কে কোনো এক অদৃশ্য হাঙর। আর কিছু
অবশিষ্ট কি ছিল, ছিল না আর কিছু। খালি বাড়ির প্রতিটি বিন্দুতে
মাকে খুঁজে বেড়াতো সেই দশ বছরের কাঁকন। সাথে সদা ক্রন্দনরত তিশাম। দু'টি ছোট মেয়ের ক্রন্দন শোনবার তো ছিল না কেউ, নি:শব্দে
শুধু সেই ক্রন্দনের সঙ্গী ছিল নি:সঙ্গ সে বাড়ি।
এর পর মা এলো।
মা, সৎ মা।
কত তফাৎ এই
শব্দ দু'টোর মাঝে। কিন্তু "মা" শব্দটিতো আছে।
সেই আশাতেই মনে হয় কাঁকনের বাবা এনেছিলেন আরেক মা, সৎ
মা। প্রথম কিছুদিন ছিল বেশ ভাল। এরপর গল্প, উপন্যাসের মতই
বের হতে থাকে আসল রূপ। দু'বোন অসহ্য হতে থাকে সেই মা নামক
সৎ মার কাছে। উঠতে বসতে কথা শুনানো, রাগারাগি, ধমক তো আছেই। কিন্তু সব ছেড়ে যেত যখন বাবা আগলে ধরতো তার বুকের মাঝে
এই দু'বোনকে। বাবাই ছিল তাদের পৃথিবী, বাবাই ছিল সব। এরপর সৎ মা'র ঘরে এলো ফুটফুটে
একটা ছেলে। দু'বোনের খুশির অন্ত কে দেখে। কিন্তু সৎ মা যে
ধারে কাছেও ঘেষতে দিত না। এভাবেই যাচ্ছিল সময়। শত কষ্টের আঝেও দু'বোন আগলে ধরে বড় হচ্ছিল, আর ছোট সৎ ভাইটা যেন
নিজ মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আপন। সৎ মা সেটা নিয়ে কথা বলতেও ছাড়তো না,
তবু কাঁকনকে ছাড়া যেন কিছু বুঝতে চাই তো না ছোট্ট সে ভাইটা।
কলেজে থাকতেই
কাঁকনকে এই মহিলা হোস্টেলে এনে রাখা হয়।
কলেজের পাশে
এই হোস্টেল, ভালভাবে পড়াশুনা করতে পারবে এই বুঝিয়ে তাকে
এখানে রাখা। সে কি বুঝতে পারে না যে এসবই করা সৎ মায়ের নির্দেশে? সবই বুঝে, শুধু সরল বাবাটার মুখ চেয়ে সব সহ্য
করে নেয়। বাবার সুখের জন্য সে সব করতে পারে। এভাবেই সে হয়ে পড়ে নিজ পরিবারের
অতিথি। কালেভদ্রে বা ছুটি ছাড়া বাড়ি যেত না। গেলেই তার সৎ মায়ের কটু কথা তো
আছেই। তবু মন তাকে নিয়ে যেত বাবা, তিশাম আর ছোট্ট ভাইটার
টানে। এইচএসসি পাশের পর অন্য কোথাও না যেয়ে সেই কলেজে অনার্স শেষ করে এখন
মাষ্টার্স পড়ছে কাঁকন। তিশামকেও নিজের কাছে নিয়ে আসে তিশামের এইচএসসি'র পর। ছোট্ট তিশাম এখন অনার্স পড়ছে. ভাবতেই অবাক লাগে কাঁকনের। সময়
কিভাবে যায় ভেবে পায় না। বাবা এসে দেখে যান দু'বোনকে
মাঝে মাঝে। তখন কাঁকন সেই বাচ্চা মেয়েটির মতো হাত ধরে বসে থাকে বাবার পাশে। কখনও
বা আগলে থাকে, তার বাবাও চুপ করে বসে থেকে এই ভালবাসাটা
উপভোগ করে যান। মাঝে মাঝে নিজেকেও বা দোষ দেন মনের অজান্তেই। হয়তো তার বোঝার
ভুলের কারণেই হৃদয়ের এই অংশকে দূরে ঠেলে দিতে হলো।
দুপুর তিনটায়
বাবা আসেন।
কাঁকন সিঁড়ি
দিয়ে দৌড়ে নামে, গেস্টরুমে যেয়ে বাবাকে সেই আগের মতই শক্ত করে
জড়িয়ে ধরে। তার বাবাও সবসময়ের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। কাঁকন চোখ
বুজে সেই আদরটা উপভোগ করে যায়।
- তুমি এত শুকাইসো
কেন আব্বু?
- কইরে বেটি, আমি ঠিকই আছি। তুই উল্টো শুকাইছিস।
- আমি? আমি আরও দু'কেজি বাড়ছি আব্বু।
- ধুর, এসব বলতে নেই। নজর লাগবে।
- এ্যাহ, এখনও তুমি সেই মান্ধাতাই রয়ে গেছো।
- আমরা মফস্বলেররা
মান্ধাতাই থাকি, সেই ভাল। তিশাম কইরে?
- অর ক্লাশ আছে। দেরি
হবে।
- আচ্ছা।
এরপর আর কথা
শেষ হয়না বাবা-মেয়ের।
কত কথা বলে
যায়,
কত হাসাহাসি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারেনা কাঁকনের বাবা।
বিকেলেই চলে যেতে হবে।
- তোকে একটা কথা
বলিরে, রাগিস না যেন।
- বলো আব্বু।
- মা, তোর মায়ের শরীরটা ভাল নেই। ডাক্তার দেখিয়েছি। বেশ খরচও যাচ্ছে। তোকে
ল্যাপটপটা ক'মাস পর কিনে দেই? বলে
কাঁকনের বাবা বেশ মিনতির চোখে তাকায় তার দিকে।
- ধুর, এটা একটা কথা? আমি ভাবছিলাম কি না কি। আমার
এখন তো ল্যাপটপের দরকার নাই।
- পড়াশুনার জন্য তো
এখন লাগেরে মা, আমি বুঝি। তবে এবার আর দেরী হবেনা ঠিক
আছে। পাকা কথা দিলাম।
- আইচ্ছা আমিও কথা
নিলাম। এখন চুপ করো, আমি তোমারে ধরে বসে থাকি।
কাঁকনের বাবা
মেয়েটার এমন কথা শুনে হেসে ফেলে। কপালে চুমু দিয়ে দেয়।
বাবাকে
রিকশায় যেতে দেখে কাঁকন।
নিরিবিলি
রাস্তায় শুধু তার বাবাকে নিয়েই রিকশাটি চলে যাচ্ছে। দূরে কুয়াশায় ঘন হয়ে আছে
প্রকৃতি। চোখের কিছু অশ্রু গাল বেয়ে যেন উপভোগ করছে এই বেদনা। অপলক চোখে চেয়ে
থাকে কাঁকন। মাথা জড়িয়ে নেয় গায়ের চাদর দিয়ে। রুমে চলে আসে নিরবে।
সব সময় কেন
যেন এই চিন্তাটি হয়।
কেন হয়, জানেনা কাঁকন।
কেউ কি নেই এই
পৃথিবীতে যে কিনা তাকে ভালবাসবে পাগলের মতো? আগলে রাখবে ঠিক
প্রকৃতির মতোন?
ভালবাসার
মানুষের খোঁজ তো সে কখনও করেনি। বাস্তবতার বেড়াজালেই যে চলে গেলো জীবনের অনেকদিন।
তবু কেউ যে নিজে থেকে এলো না। কেউ যে একবারও বললো না, ভালবাসি তোমাকে।
এটাই হয়তো
নিয়তি। যখন কেউ থাকে না, তখন হয়তো কেউ আসে না। সে তো কারও অপেক্ষায়
নেই, তবু ভাবতে ভাল লাগে। কেউ একজন আসবে, সেই কেউ তাকে ভালবাসবে। আগলে রাখবে সারা জীবন, কত কথা শুনাবে তাকে। রাঙাবে প্রতিটি সময়, রঙীন
করে দেবে এই সাদাকালো জীবন। ভাবতে অনেক ভাল লাগে।
সেই কেউ হয়তো
আনবে তার জন্য রূপোর কাঁকন।
হাতে সেই
রূপোর কাঁকন পড়ে কাঁকন যে হয়ে উঠবে সত্যিকার কাঁকন। কাজল চোখের এই টানা চোখ
আবারও চেয়ে থাকে কোনো এক ভোর বেলায়, কাঁচের চূঁড়ির
রিনিঝিনি শব্দ তুলে হাত বাড়ায় কুয়াশাকে ছুঁয়ে যাবার। শীতের সেই ঠান্ডা বাতাস
হাত ছুঁয়ে যায় কাঁকনের। প্রকৃতি অদৃশ্য এক কাঁকন এঁকে যায় কাঁকনের সেই চূঁড়ি
পড়া হাতে।
[ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা ]
*******************************************************************************
গল্পের আড়ালের কথা
*******************************************************************************
কাঁকন আফরিন।
আজ(২৫ ডিসেম্বের) কাঁকনের জন্মদিন।
http://www.facebook.com/profile.php?id=100002263999377
কাঁকনের বড় ভাই নেই। আমাকে বসিয়ে দিলো সেই শূণ্যস্থানে।
তবে সে জানেনা যত না খুশি হয়েছিল সে, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। আমি ছোট ভাই বোনদের প্রতি সবসময়ই একটু দুর্বল। এদের আবদারকে অগ্রাহ্য করবার মতো সাহস আমার নেই। তার চাহিদা ছিল একটি সত্য ঘটনা নিয়ে যেন গল্প লিখি, প্রধান চরিত্র যেন হয় তার নামে। তাই এই গল্পের প্রধান চরিত্রটির নাম কাঁকন।
কাঁকন, তুমি নিজেও জানো না যে, আমার এক বড় বোনের নামও কাঁকন।
তার যখন বাচ্চা হয়, আমি তখন দেশের বাইরে। এর ৪ মাস পর যখন দেশে আসি, তখন জানতে পারলাম বাচ্চাটির শেষ মূহুর্ত চলছে। ৩৮ ঘন্টা যাত্রা করে দেশে আসি আমি। খবরটা শুনে কোনো বিশ্রাম না নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট হতে ছুটে গিয়েছিলাম সরাসরি হাসপাতালে। সেই ছোট্ট পরীটার জন্য তখন রক্তের প্রয়োজন। আমি সাথে সাথে রক্ত দিতে প্রস্তুত হই। ডাক্তাররা নিষেধ করা সত্যেও আমার জেদের কাছে হার মানে। যদি সেই বাচ্চাটি ছিল আমার বোনের জীবনের অমূল্য কাঁকন। এরপর কি হয়েছিল জানো?
আজ যখন এই গল্পটি লিখছি, আমার সেই ছোট্ট ছয় বছরের পরীটা বারবার আমাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছিলো। সে এখন সম্পূর্ণভাবে সুস্থ।
আমার বোন এসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বললেন যে, আমি কাঁকন শব্দ দিয়ে কি লিখি। জানালাম তোমার কথা।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল তোমাকে।
বাস্তবতা অনেক নির্মম আপু, তবু এই নির্মমতাকে যেন দূরে ঠেলে দিয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আনন্দময় করে তুলতে পারো এই কামনাই রইল।
শুভ জন্মদিন কাঁকন।
লিখেছেন- Daif MD Samrat
FB ID- Daif MD Samrat