মৌলবি আবদুস সোবহান
মৌলবি আবদুস সোবহান
সাহেবের সাথেআমার পরিচয় অনেক আগে থেকেই। ১৯৯১ সালে গয়েশপুর হাইস্কুলে শিক্ষক
হিসেবে যোগদান করার মাধ্যমে পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা আরো বৃদ্ধি পায়।উনি বয়সে অনেক বড়
ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে হাইস্কুলের শিক্ষক এবং গয়েশপুর জামে মসজিদেরইমাম।কন্তিু
নির্বিরোধী এই ভালো মানুষটার প্রতি করা হয়েছিল খুব বড় অন্যায়। হাস্যকর এক অপরাধের
ধুয়ো তুলে গ্রামের মানুষ কেড়ে নেয় তার ইমামত্ব।
চাকুরির মেয়াদ শেষ
হলে তিনি চলে গেলেন পুরোপুরি অবসরে। কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ ছিল।ধর্মীয় বিষয়
ছাড়াও নানাবিধ আলোচনা করতামআমরা।এই আলোচনার মাধ্যমেই একদিন জানতে পারলাম তিনি পানি
পড়া, তাবিজ দেওয়ার পাশাপাশি
ঝাড়ফুকও করেন।নতুন তথ্য হলো, আগে এইসব কম করতেন কিন্তু সংসারের অভাবের কারণে এখন একটু বেশী করেন।
যাইহোক, মূল গল্পে আসি।
কর্মব্যস্ততার কারণে একসময় যোগাযোগ কমে আসে। মাসখানেক পর উনার খোজ নিয়ে জানতে পারি
উনি খুবই অসুস্থ।পরদিনেই দেখতে যাই।দেখি উনার দেহ কাঠামো শুকিয়েযেন অর্ধেক হয়ে
গেছে।আমি এসেছি জানতে পেরে পাশ ফিরে আমার দিকে শুলেন।তার অবস্থার কারণ জানতে চাইলে
বলেন “না বাবা, এই অসুখ আমারআর সারবে না, এটা অসুখ না’!
'না না অত ভাববেন না, ভালো চিকিৎসাকরালে আপনার
অসুখ সেরে যাবে’।
কিন্তু তিনি মাথা
এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন। সেদিন চলে এলাম। এরপর কেটে গেল আরো একটা মাস। এক ভোর বেলায়
হন্তদন্ত হয়ে বাসায় এল মৌলবী সাহেবের মেজ ছেলে। বলল “ভাই, একনি হামার সাথে চলেন, আব্বাআপনার সাথে দেকা করার
জন্য ছটপট করোচে’।
গেলাম তার সঙ্গে।ঘরে
ঢুকে দেখি অবস্থা আসলেই খুব খারাপ।আমাকে দেখে সর্বশক্তি দিয়ে যেন নিজের কষ্ট সামলে
রাখলেন।আমাকে ছাড়া ঘরের সকলকে বাইরে চলে যেতে বল্লেন।বাইরে যাওয়া মাত্র আমার
হাতদুটো জাপটে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন ‘বাবা, মনে আছে, তোমাকে বলেছিলাম এটা কোনো
অসুখ না?’
‘হ্যা মনে আছে’।
মিনিটখানেক অপলক
আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর সত্যিই শোনালেন এক ভয়ানক গল্প। তার জবানিতেই তুলে
ধরছি:
‘মাসচারেক আগে ঘোলাপাড়া থেকে
দুজন লোক এসেছিল, বলল তদের পরিবারের এক মেয়েকে জিনে ধরেছে। তারা এসেছিল সকালে। বললাম ‘আজ আমার জরুরী কয়েকটা কাজ
আছে। এখনতো যেতে পারবো না মাগরিবের পর যাবো’। বাড়ির ঠিকানা বলে লোক দুটোচলে গেল।
মাগরিবের পর হেটেই
রওনা দিলাম। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। চারিদিকে জোছনায় ঝলমল করছে। গয়েশপুর স্কুল
ছাড়িয়ে উঠলাম ছোট যমুনার উপরের সেতুতে।সেতুর পর ডান হাতে বড় একটা বাঁশঝাড়। খুবই
খারাপ জায়গাটা। অনেক কিছু দেখেছিওখানে। ঝাড়টার পাশাপাশি যেতেই মুখোমুখি এসে
দাঁড়ালো সুদর্শন একযুবক। সাধারণ কেই দেখলে তাকে আর দশজন মানুষের মতই মনে
করতো।কিন্তু দু’চোখের গনগনে দৃষ্টি মুহূর্তে আমাকে বলে দিল, ওটা কি! অনেক বছর ধরে ওরকম দৃষ্টির সঙ্গে আমি
পরিচিত। কিছু না বলে পাশ কাটাতে গেলাম।
‘মৌলবি সাহেব, আছর ছাড়াতে যাচ্ছেন?’ হাসল ওটা।
চুপচাপ এগিয়ে গেলাম
ওটাকে পেছনে ফেলে।
‘যাবেন না মৌলবি সাহেব’
বলল ওটা।
‘কেন?’ বললাম আমি।
‘গেলে আপনার ক্ষতি হবে, কারণ আমি ধরেছি মেয়েটিকে’।
এবার রেগে গেলাম। ‘কী ক্ষতি করবিরে তুই? তোর মত ওই রকম অনেক জিনিস
দেখা আছে আমার, হুমকিও শুনেছি, কেউ ক্ষতি করতে পারেনি আমার’।
‘কিন্তু আমি পারবো’
ভেসে এল ঠান্ডাস্বর।
‘যা ভাগ, ব্যাটা!’
রাগে গা জ্বলে গেল আমার।
‘খুব ভুল করলেন মৌলবি সাহেব’।
আর কথা না বলে পা
চালালাম দ্রুত। পেছনেও আর সাড়া শব্দ নেই।
ঘোলাপাড়া গিয়ে
ভর-হওয়া মেয়েটির সামনে দাড়ানো মাত্র দাঁত খিচিয়ে বলল, ‘কী রে হারামজাদা, এত মানা করনো তা-ও শুনলু না?’
এরপর অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলো।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে
মেয়েটির আছড়ছাড়ালাম।
শেষমেষ ‘তাড়ালু, হামাক তাড়ালু? কুত্তার বাচ্চা, বুঝবু, একন বুঝবু!’
এই বলে বিকট এক চিৎকার করেমেয়েটি জ্ঞান হারালো।
কিছু পরে বাড়ির দিকে
রওনা হলাম। মেয়েটির বাবা সাথে লোক দিতে চেয়েছিল কিন্তু মানা করে দিলাম। ফিরতি পথে
বাঁশঝাড়টার কাছাকাছি আসতেই দেখলাম,
আবার ওটা এসে দাড়িয়েছে।এবার আর সুন্দর চেহারায় নয়, আসল রূপে! চোখ দু’টো যেন জলন্ত কয়লার টুকরো, শরীরের ওপরের অংশসহ বাম
পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ভালুকের মতো বড় বড় লোম,
ডান পায়ে দগদগে ঘা, দুই হাঁটুর উপর বাড়তি দুটো চোখ,
আর মনে হল রক্তের মত লাল টকটকে বিরাট এক জিভ, নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত!
‘কী রে শুয়োরের বাচ্চা, মেয়েটির আছড় ছাড়িয়ে দিয়ে এলি? আমাকে থাকতে দিলিনা’!
ভয়ংকর গলায় বলতে লাগলো। ‘হারামজাদা এত নিষেধ করলাম তাও শুনলি না কেন?’ প্রত্যেকটা কথার সাথে সাথে
ছিটকেছিটকে পড়ছে আগুনের কণা।
‘আমার কাজ আমি করেছি’
বললাম যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে।
‘কাজ করেছিস তাইনা! বল শক্তি
দেখালি! এত বড় সাহস তোর! এবার দেখ আমার শক্তি!’
দপ করে জ্বলে উঠলো
একটা আগুনের গোলা, কিছু বুঝে উঠার আগেই সোজা ছুটে এসে ঢুকে গেল আমার ভেতর। পড়তে পড়তে সামলে নিলাম, সারা শরীরে যেন আগুন ধরে
গেছে! কোনোমতেবাড়িতে এসে সেই যে শুয়ে পড়লাম আর উঠতে পারলাম না।
‘জানতাম আর উঠতে পারবো না তাই
তোমাকে বলেছিলাম এটা অসুখ না। গত কয়েক মাস ধরে ওটা কেবল আমার ভেতরেবসে খলখল করে
হেসেছে আর চুষে চুষেখেয়েছে আমাকে!’
চুপ করলেন মৌলবি
সাহেব, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে
লাগলো।
খানিকক্ষণ পর বললাম ‘আর কিছু বলতেচান?’
এপাশ ওপাশ মাথা
নাড়লেন, বলতে চান না।
কিছুক্ষণ থেকে বিদায়
নিয়ে চলে এলাম। বাড়ি ফিরে আসার মিনিট বিশেক পরেই খবর পাই মৌলবি সাহেব মারা গেছেন।
দ্রষ্টব্যঃ খসরু
চৌধুরী লিখিত “আমার যত ভৌতিক অভিজ্ঞতা” গ্রন্থ থেকে নেয়া।