প্রশ্ন: ইসালে সওয়াব করা কি শরিয়ত সম্মত?
▬▬▬◆◯◆▬▬▬
উত্তর:
ইসালে সওয়াব বলতে বুঝায়, কোনও নেক আমল করার পর এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিকে দান করা বা তার কবরে সওয়াব পৌঁছানো। এটিকে সওয়াব রেসানিও বলা হয়।
ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হল, ইবাদত হল তওফিফিয়া বা কুরআন-সন্নাহর দলিলের উপর নির্ভরশীল। অত:এব একজন ইমানদারের কর্তব্য, দলিলের অনুসরণ করা; নতুন উদ্ভাবন করা নয়।
সুতরাং হাদিসে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের যেসকল করণীয় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে আমরা শুধু সেগুলোই করব। নিজেদের পক্ষ থেকে যা ইচ্ছা তাই করব না।
মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দুআ করা, দান-সদকা করা, তার পক্ষ থেকে বদলি হজ্জ-উমরা আদায় করা ইত্যাদি দলিল দ্বারা সাব্যস্ত। সুতরাং এগুলো সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ।
কিন্তু কুরআন খতম, শবিনাখানি, কুলখানি, ফাতিহাখানি, মিলাদ মাহফিল, সালাত আদায় ইত্যাদি করার পর ইসালে সওয়াব বা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সওয়াব দান করার সমর্থনে যেহেতু কোনও দলিল নাই তাই নির্ভরযোগ্য অভিমত অনুযায়ী সেগুলো করাও শরিয়ত সম্মত নয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
لم يكن من عادة السلف إهداء ذلك إلى موتى المسلمين ، بل كانوا يدعون لهم ، فلا ينبغي الخروج عنهم
“মৃত মুসলিমদের প্রতি সওয়াব দান করা আমাদের সালাফ তথা পূর্ববর্তী মনিষীদের নিয়ম ছিল না বরং তাঁরা মৃতদের জন্য দুআ করতেন। অতএব, তাদের এ নিয়মের বাইরে যাওয়া আমাদের সমীচীন নয়…।” (মাওয়াহিবিল জালীল শারহু মুখতাসিল খালীল ৩/৫২০)
‘মুয়াফাকাত’ কিতাবে আল্লামা আবু ইসহাক রহ. [নাম: ইবরাহীম বিন মুসা আবু ইসহাক আশ শাত্বেবী-গ্রানাডা। জন্ম: ৭২০ হিজরি। তার রচিত অন্যতম গ্রন্থ হল, আল মুয়াফাকাত ফী উসূলিশ শারীয়াহ।] অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ইসালে সওয়াব তিনটি কারণে জায়েজ নয়। যথা:
◉ এক. ইসলামে সম্পদ দান করা বৈধ প্রমাণিত; সওয়াব দান করা প্রমাণিত নয়। সুতরাং সওয়াব দানের ব্যাপারে যেহেতু কোন প্রমাণ নেই তাই তাকে বৈধ বলাও অন্যায়।
◉ দুই. যে কোন আমলের পুরস্কার বা শাস্তি ইসলামে নির্ধারণ করা রয়েছে। তাছাড়া প্রতিদান পাওয়া কাজের উপর নির্ভরশীল। মানুষ যেমন কাজ করবে তেমন প্রতিদান লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“তাদের কর্ম অনুপাতে তাদের জন্যে রয়েছে প্রতিদান।” [সূরা সাজদাহঃ ১৭]
সুতরাং এ ক্ষেত্রে কারো এখতিয়ার নেই যে, ইচ্ছা করলেই নিজের আমলের প্রতিদান আরেকজনকে দান করে দিবে।
◉ তিন. সওয়াব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। এ ব্যাপারে আমল কারীর হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। অতএব, নিজের আমলের সওয়াব অন্য কাউকে দান করার অধিকারও তার নেই।
কিছু মানুষ ইসালে সওয়াবের প্রমাণ হিসেবে বদলী হজ্জ, বদলী রোযা এবং দান-সদকা করার হাদিসগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে অথচ বদলী এবং ইসালে সওয়াব এর মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যেমন:
বদলীর ক্ষেত্রে একজনের দায়িত্ব আরেকজন পালন করে থাকে। যেমন: বদলী হজ্জ করার সময় বলা হয় “লাব্বাইকা আন ফুলান” (হে আল্লাহ,আমি অমুকের পক্ষ থেকে হাজির) অথবা মনে মনে নিয়ত করা হয়, আমি অমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করছি। কিন্তু ইসালে সওয়াব বা সওয়াব দানের ক্ষেত্রে নিজের পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদন করে সে বলে, হে আল্লাহ,আমার এ হজ্জের সওয়াব অমুক ব্যক্তিকে দিয়ে দাও।
প্রথম পদ্ধতি অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ-উমরা আদায় করা, দান-সদকা করা ইত্যাদি কুরআন-হাদিস দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অর্থাৎ নিজ আমলের সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করা প্রকৃত বিদআত যেমনটি বলেছেন ইসমাইল শহীদ রহ.।
মাওলানা ইসমাইল শহীদ রহ. ‘ঈযাহুল হক’ কিতাবে লিখেছেন, “জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সওয়াব বখশীয়ে দেয়া প্রকৃত বিদআত। পক্ষান্তরে আর্থিক ইবাদত (হজ্জ, উমরা, দান-সদকা ইত্যাদি) ক্ষেত্রে বদলী নিযুক্ত করা বৈধ।” [ উৎস: কুরআন খানী আওর ঈসালে সওয়াব-মুখতার আহমদ নদভী-অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল]
তবে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি জীবিতদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:
১) তার জন্য দুয়া করা।
২) তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করা।
৩) তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ বা উমরা আদায় করা।
৪) তার মানতের রোযা বাকি থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তা পালন করা। আর রমাযানের রোযা বাকি থাকলে প্রত্যেক রোযার বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করা।
৫) সে যদি ঋণ রেখে মারা যায় অথবা কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বা ওসিয়ত করে যায় তবে তা প্রাপকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া।
▬▬▬◆◯◆▬▬▬
উৎস: মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে করণীয় ও বর্জনীয়
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব