প্রতি বছরই কুরবানী ঈদে এই প্রশ্নগুলো করবো বলে ঠিক করি, কিন্তু করবো করবো করেও আর করা হয়ে উঠে না।
প্রশ্নগুলো হলো,
আপনার সন্তান কি পশু কুরবানী দেওয়া দেখেছে কখনো সামনাসামনি? তার কাছে কুরবানীর ফিলসফি কি? কুরবানীর প্র্যাকটিক্যাল ফ্যাক্টগুলো কিভাবে উপস্থাপন করেছেন তার সামনে?
অষ্ট্রেলিয়াতে দেখেছি, বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ২য় প্রজন্মের থেকে এই ব্যাপারটাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। সচেতনভাবেই। এজ ইফ কুরবানী একটা নিষ্ঠুর প্রথা। এইটা বাচ্চাদের না দেখতে দেয়াই উত্তম। ভাবখানা এমন, যে পশু জবাই দেখতে দেখতে এই বাচ্চা একদিন মানুষ জবাই করবে! কিংবা পশুদের প্রতি মমত্ববোধ কমবে? বা হিংস্র হবে!
কিন্তু এই আশংকা কি সত্যি? ব্যাপারটা একেবারেই হাস্যকর! নিজেদের দিয়েই চিন্তা করেন। আপনারা তো বাংলাদেশে থাকাকালীন বাচ্চা বয়স থেকেই কুরবানী ঈদে এবং কসাইখানায় গরু জবাই দেখতে দেখতে বড় হইসেন, তো আপনাদের মধ্যে ঠিক কতজন লোক পরবর্তী জীবনে মানুষ জবাই করেছেন? কিংবা পশু-পাখীদের প্রতি মমত্ববোধ কমে গেছে? কয়জন হিংস্র হইসেন?
যদি সচেতনভাবে আপনার সন্তানদের কুরবানী প্রথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, সে বড় হয়ে হয়তো কুরবানী দিয়ে ওয়াজিব আদায় করলেও করতে পারে, কিন্তু আপনার নাতি-পুতিরা এই কাজটা করবে না, তাদের কাছে ঈদের দিন পশু কুরবানী করাটা হবে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এক নিশ্ঠুর কাজ।
মানে আপনি আপনার নেক্সট জেনারেশনের জন্য পুরোপুরি দ্বীন মানার রাস্তাটা নিজের হাতে যত্ন করে বন্ধ করে যাইতেছেন। এবং এর জন্য আপনাকে কেয়ামতের দিন জবাবদীহি করতে হবে।
বাস্তবতা হলো, পুরো দুনিয়ার ফুড চেইনটাই ক্রুয়েল। আচ্ছা, তার আগে আপনাকে ডিফাইন করতে হবে, ক্রুয়েল বা নিষ্ঠুরতা বলতে আপনি কি বুঝেন?
আপনাকে জীবন ধারনের জন্য অন্য কিছু খেতে হবে, নাহলে আপনি নিজে মারা যাবেন। অন্যের জীবের প্রতি মায়া দেখাতে চাইলে আপনার উচিত হবে আগে নিজের জীবনের প্রতি মায়া ত্যাগ করা্ ভেগান হওয়ার কথা বলতে পারেন, কিন্তু গাছ-পালার যে প্রাণ আছে, তারাও যে সংবদেনশীল, পাতা ছিঁড়লে ব্যাথা পায়, - এসব তো বৈজ্ঞানিকভাবে বহু বছর আগেই প্রমাণিত।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়াঁলো, মানুষের বাস্তুসংস্থানটাকে আল্লাহপাক এমনভাবেই ডিজাইন করেছেন যে, শুধু মানুষ নয় - দুনিয়ার সব প্রাণীই অপর প্রাণীকে ভক্ষন করার মাধ্যমে নিজে বেচেঁ থাকবে। সেটা খাদ্যের জন্য হোক বা নিরাপত্তার জন্য হোক।
যেখানে আপনার অস্তিত্ব রক্ষার একটা অংশই হচ্ছে অন্য জীবকে হত্যা করা, সেখানে আপনি এইটাকে ”ক্রুল” আখ্যা দিতে পারেন কিনা, সেটা আগে ডিফাইন করা উচিত।
Mohammad Nazim Uddin ভাইয়ের অমর সৃষ্টি “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেনি” - থ্রিলার উপন্যাসে তিনি দেখান যে মানুষ নিজেকে বাচিঁয়ে রাখার স্বার্থে ভাগ্যের নিমর্ম শিকার হয়ে নিজের সহযাত্রী অপর মানুষের মাংস ভক্ষন করতেও পিছপা হয় না। কারন এটা না করলে সে নিজেই মারা যাবে। আর মানুষ সবচাইতে বেশী ভালোবাসে তার নিজেকে। নিজেকে বাচিঁয়ে রাখার স্বার্থে দিন শেষে দুনিয়ার যে কোন প্রাণীকেই বধ করতে সে প্রস্তুত, যতই আমি মানবিকতা কপচাই না কেন?
এখন বলেন, এই যে মানুষের মাংস ভক্ষন করা, এটা কি ”ক্রুয়েল” হলো না?
আপনি এক্সপেক্ট করতে পারেন না যে পৃথিবীর সব মানুষ আপনার ফিলোসফি মেনে রাতারাতি ভেজিটেরিয়ান কিংবা ভেগান হয়ে যাবে।
দুনিয়ার বেশীরভাগ মানুষ মাংসকেই প্রেফার করে, করবে। এবং এই জন্য প্রাণী হত্যা করেই যাবে।
ল্যাবরেটরিতে যে মাংস উৎপাদন হয়, তার পিটফল বের হবে, যারা অর্গানিক মাংস খেয়ে অভ্যস্ত, তারা এই কৃত্রিম মাংস মুখেই দিতে পারার কথা নয়, বিস্বাদ লাগবে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে কৃত্রিম মাংস সুস্বাদু হবে, তবে দেখা যাবে কিছুদিন পর মানুষ অন্য কোন প্রাণী বধ করে তার মাংস খাওয়া শুরু করেছে।
কারণ তাকে এইভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে!
যা হোক, আমার এই বছরের বই হালাল মার্কেটিং থেকে কিছু অংশ কোট করছিঃ
প্রবাসের কুরবানী ইদ, এবং হালাল মাংস খাওয়ার অভ্যস্ততাঃ
খুব সম্ভবত পৃথিবীতে সবচাইতে পুরনো এবং সবচাইতে জনপ্রিয় হালাল পণ্য হচ্ছে হালাল গোশত, যে বিষয়ে আমি গতবারের বইতে সচিত্র তথ্য-উপাত্তসহকারে মোটামুটি বিস্তারিত লিখেছি। তাই এখানে আর সে সবের পুনরাবৃত্তি না করি। তারচেয়ে বরং বছর দুয়েক আগে আমি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, সেটি এখানে দেয়াটা প্রাসঙ্গিক মনে করছি, কারণ অমুসলিম দেশে হালাল মাংসের সংস্থান কিভাবে হয় বা কুরবানী ইদ ঠিক কিভাবে পালন করা হয়, তা নিয়ে আমি দেশের অনেকের ভেতরই বেশ আগ্রহ দেখতে পেয়েছি।
তাই ভাবলাম, তাদের জন্য আমার প্রবাস জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করিঃ
”…আমাদের হালাল মাংসের কাহিনী বলি। সিডনির মুসলিম এলাকা লাকেম্বার মাংসের দোকানে দোকানে হালাল' শব্দটি বড় করে লেখা। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে পশু-পাখি জবাই করলে সেটি হালাল হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের আবার পশু-পাখির জবাইর সময় গলা কেটে দ্বিখন্ডিত করা যাবে না! পশু-পাখির গলা কাটার সময় দ্বিখন্ডিত হয়ে গেলে সেটির নাম হয়ে যাবে 'বলি'। আমরা এদেশে যত জবাই করা পশু-পাখির দেহ দেখি এর সবই জবাই হয় খামারে। গলা থাকে দ্বিখন্ডিত। কারন এগুলো জবাই হয় মেশিনে। ট্রে-ওপরে শতশত মুরগি থাকে একসঙ্গে। ট্রে-প্রান্তে যে ব্লেড এগুলোকে কাটে সেখানে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা শব্দ বাজে ' বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর' সেই মুরগিগুলোর গলা সেখানেই দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়।
এরপর সেটি মেশিনে ক্লিন হয়ে বেরোবার পর প্যাকেট হয়ে চলে যায় রেফ্রিজারেটরে। সেখান থেকে বাজারে। গরু-ছাগল-ভেড়া সবক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটে। হাতে জবাই, মৌলভী বা কেউ একজন ‘’বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলবে অত মৌলভী এদেশে নেই বা মানুষের এসব নিয়ে এত গবেষনার সময় কারো নেই। অতএব হালাল একটি বিশ্বাস। বছরের পর বছর উন্নত বিশ্বের মুসলমানরা এভাবে হালাল জ্ঞানে মাংস খান। এর জন্যে কী আমাদের হাশর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদিদের সঙ্গে হবে?
উপরের লেখাটি একজন প্রবাসী সিনিয়র ভাইয়ের। তার কয়েকটা পয়েন্টে অধিকতর স্পষ্টীকরণের নিমিত্তে আমি তার উক্ত লেখার প্রেক্ষিতে বিশাল একটা মন্তব্য টাইপ করলাম, যেটিকে কয়েক টুকরো করে পাবলিশ করতে হয়েছিলো।
উপরের লেখাটির প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য ছিলোঃ
১) ”সিডনির মুসলিম এলাকা লাকেম্বার মাংসের দোকানে দোকানে হালাল' শব্দটি বড় করে লেখা।”
- এটা আসলে একটা সময় অথেনটিক ছিলো। এখন ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। শুনেছি এখন নাকি টাকা দিলেই হালাল সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। সত্যতা কতুটুকু তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে কিছু কিছু দোকান আছে লেকেম্বা, পাঞ্চবল, অবার্ণ আর রকডেল নামক মফস্বল এলাকায় (যাকে suburb বলা হয়), যারা প্রকৃতঅর্থেই হালাল মাংস সাপ্লাই দেয় বলে জানি। ‘আহমেদ বুচার’স নামে একটা কসাইর দোকান আছে রকডেলে, সেখান থেকে অনেক মুসলমান বাঙ্গালি গোশত কিনে থাকেন।
’হার্ড চিকেন’ নামের এক প্রকার চিকেন কিনতাম আমি, অনেকটা দেশীয় মুরগীর মতো স্বাদ। এর মাংস শক্ত, সিদ্ধ হতে বেশী সময় নেয়। কিন্তু সুস্বাদু ও হালাল। এই কারণে দামও বেশী। গ্রোসারী মুরগী যেখানে প্রতি কেজি ৪ ডলার, সেখানে হার্ড চিকেন আমি কিনতাম ১১ ডলার দিয়ে। একবারে দশ-বারো কেজি কিনে ফ্রিজে স্টক করে রেখে সারা মাস খেতাম। আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখলে বাসায় এসে দিয়ে যেতো পাঞ্চবলের একজন লেবানীজ মুসল্লী। উনি এই ব্যবসায়ই করতেন। তিনি নিজের হাতে জবাই করতেন প্রতিটি মুরগী। আরেকজন অষ্ট্রেলিয়ান ধর্মান্তরিত মুসলমানও এই ব্যবসা করতেন।
আমাদের দেশে মাংস ব্যবসার সাথে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা খুব একটা জড়িত নেই। কারণ, মাংস হালাল হবার জন্য ইসলামের যে সমস্ত সূক্ষ অথচ মৌলিক বিষয়াদি রয়েছে, সে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা অনেক মুসলমানের পক্ষেই সম্ভব হয় না, সেখানে ভিন্ন ধর্মের লোকেদের মানার ব্যাপারে ক্রেতাদের সন্দেহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তাই সঙ্গত কারণেই এই দেশের মাংসের ব্যবসায়ে এককভাবে আধিপত্য মুসলমানদেরই। আমি কিছুদিন আগে একটা ছোট্ট অথচ ইন্টারেস্টিং জরিপ করেছিলাম আমার ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে। জানতে চেয়েছিলাম - বাংলাদেশে কোন ভিন্ন ধর্মের লোক যদি হালাল সার্টিফাইড মাংস বিক্রি করে থাকে, তবে মুসলমানরা তার কাছ থেকে মাংস কিনতে রাজী কিনা? আপনি যদি মুসলমান হন, আপনি কিনবেন?
অনেকেই উত্তর দিয়েছেন, মাংস হালাল হলে বিক্রেতার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মাংস এবং বিক্রেতা উভয়কেই হালাল হতে হবে। মানে অমুসলমান কারো কাছ থেকে মাংস কিনতে তারা রাজী নন। আরেকজন জানালেন, ”কসাইয়ের এর ধর্মীয় পরিচয়ের চাইতে জরুরী বিষয় হচ্ছে পশুটি জবেহ হচ্ছে কিভাবে? কে করছেন, কি পাঠ করে জবেহ করছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। কোন মুসলমান কসাই ও যদি কিছু পাঠ না করে পশু জবেহ করেন সেটাও খাওয়ার অনুমতি নেই। কোন বিধর্মীও যদি কোন মুসলমানকে দিয়ে পশু জবেহ করান, যিনি বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর পাঠ করে পশু জবাই করেন- এমন হলে আমি কিনবো।”
আরেকজন মন্তব্য করলেন - ”দুবাইতে প্রকাশ্যে শুকরের মাংস বিক্রি হতে দেখলাম, আমার ধারনা ওখানে কিছু হলেও অমুসলিম আছে। আর কোশার করার জন্য তো থাকা লাগবেই। হালাল ট্যাগ থাকলে অমুসলিম কারও থেকে না নেয়ার কারণ দেখি না।”
দেশের বাইরে দেখেছি, অনেক অমুসলমান সার্টিফাইড হালাল মাংস বিক্রি করছে, এবং অনেক মুসলমানও তাদের কাছ থেকে কিনছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা করতে পছন্দ করি তা হলো, আমি যে শহরে বাস করি, যে শহরে যদি মুসলমান মাংস বিক্রেতা না পাওয়া যায়, শুধু অমুসলিম বিক্রেতাই থাকে, তবে আমি তার কাছ থেকেই সার্টিফাইড হালাল মাংস কিনবো। এবং যথাযথভাবে খোজঁ-খবর নিবো যে সে মাংসের সোর্সিং কিভাবে করে? কোথা থেকে সনদপত্র নিয়েছে ইত্যাদি।
২) ”মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে পশু-পাখি জবাই করলে সেটি হালাল হয়।” - কথাটা অসম্পূর্ণ।
হানাফি মাযহাবমতে, কোন পশুর মাংস হালাল হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ হতে হবেঃ
ক. যে জবাই করবে তাকে মুসলমান হতে হবে। কারণ একজন অমুসলিম বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে জবাই করলেও সেটি হালাল হবে না।
খ. জবাই করার সময় সেই মুসলিমকে অবশ্যই বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলতে হবে। নাহলে হালাল হবে না।
তবে ইমাম শাফেয়ী আর হাম্বেলী মাযহাবমতে, আল্লাহু আকবার না বল্লেও মাংস হালাল হবে কিন্ত জবাইকারী ব্যাক্তিতে নিদেনপক্ষে মুসলমান হতেই হবে। নাহলে উক্ত মাংস হারাম হবে।
গ. সেই পশুকে ইটসেলফ হালাল হতে হবে। যেমনঃ কোন মুসলমান যদি আল্লাহ আকবার বলেও কোন শুকরকে জবাই করে, তার মাংস হালাল হবে না।
আপনি যেভাবে বল্লেন, ’কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা শব্দ বাজে ' বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর' - যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে সেই মাংস কোন মাযহাবমতেই হালাল হবে না, কারণ সেটা উক্ত তিনটার একটা শর্ত পূরণ করে না। আমার ধারনা, যারা এইসব মাংস কিনে খায়, ঐ মাংস হালাল না, তারা এটা জেনেই খায়।
৩) ”অতএব হালাল একটি বিশ্বাস “ - দ্বিমত পোষন করছি। হালাল একটি পদ্ধতি, কর্মপন্থা। বিশ্বাস হচ্ছে কোন কিছুর অস্তিত্ব না দেখেও মেনে নেয়া। হালাল হারামের বিষয়টা সেরকম না। যে কেউ চাইলেই হারাম-হালাল প্রমাণ করতে পারে সেটার প্রসেসিং স্ট্রাটেজি দেখে। হালাল পন্য বা প্রসেস অদৃশ্য নয়।
৪) বছরের পর বছর উন্নত বিশ্বের মুসলমানরা এভাবে হালাল জ্ঞানে মাংস খান, কথাটা সত্যি। কিন্তু দুনিয়ার সব মুসলিমরা যদি আজ থেকে হারাম মাংসকে হালালজ্ঞান করে খাওয়া শুরু করে, তাহলে কিন্তু হারাম জিনিস হালাল হয়ে যাবে না। ব্যবহারকারীর সংখ্যার বিচারে তো আর হারাম-হালাল নির্ধারন করা হয় না।
প্রবাসী মুসলিমরা যারা হারাম জেনেও এসব মাংস খান, তাদের কিছু ক্লাসিফিকেশন আছে।
i) মডারেট মুসলিমঃ এরা হারাম মাংসকে হালাল বানাবার ফতোয়া খোঁজে। যেমনঃ ”লেবানিজ মুসলমানরা যেহেতু বিক্রি করছে, সেহেতু সে গোশত নিশ্চয়ই হালাল। ওরা তো আর নিশ্চয়ই হারাম জিনিস বেচবে না।” অথচ একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে না যে আসলেই লেবানিজরা হালাল সার্টিফিকেট দোকানে ঝুলিয়ে হারামটা বিক্রি করছে কিনা। অনেক লেবানিজ ক্রিষ্টানও রয়েছে কিন্তুু! মানে লেবানিজ মানেই মুসলমান নয়।
ii) উদাসীন মুসলিমঃ এরা আদতে আলসে। হালাল মাংস কিনতে হলে একটু কষ্ট করে খোঁজ খবর নিতে হবে, এই কষ্টটুকু করতে তারা নারাজ। (অনেকে বলেন সময় নাই, কিন্তু এটা ভুল কথা। দুনিয়ার বাদ বাকী সব কাজে সময় পাওয়া যায়, আর এটাতে পাওয়া যাবে না কেন?) তাছাড়া হারাম মাংস বেশ সুলভ, বাড়ীর কাছের গ্রোসারি শপেই পাওয়া যায়। কিন্তু হালাল মাংস তুলনামূলক দুর্লভ।
iii) অভ্যস্ত মুসলিমঃ দীর্ঘদিন ধরে হারাম মাংসকেই হালালজ্ঞান করে খেয়ে আসছেন, তাদের কোন খোজঁ খবর নেবার কথা মাথাতেও আসে না।
iv) কিপটা মুসলিমঃ ম্যানুয়ালি স্লটার করা হয় বলে, হালাল মাংসের দাম একটু বেশী। এই টাকা বাঁচানোর জন্যও অনেককে আমি “লেখা-হালাল-অথচ-হালাল নয়” টাইপ মাংস খরিদ করতে দেখেছি।
৪) ”এরজন্যে কী আমাদের হাশর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদিদের সঙ্গে হবে?” - শুধুমাত্র “লেখা হালাল অথচ হালাল নয়” টাইপ মাংস খরিদ করলে আপনার হাশর তাদের সাথে হবে কিনা এটা জানি না, তবে জেনে শুনে, আলসেমি করে, উদাসীন থেকে এসব মাংস কিনে খেলে অবশ্যই বড় ধরনের গুনাহ হবে, এটা বলতে পারি। এমন যদি হতো অষ্ট্রেলিয়ায় হালাল গোশত পাওয়াই যায় না, তাহলেও না হয় একটা কথা ছিলো।
বেশীরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলিমদের কোরবানী দেবার চর্চাটা দেশের থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমি যা দেখেছি তা হলো, অনেকেই কোরবানী ইদের কিছুদিন আগে কোরবানীর টাকাটা কোন এক স্থানীয় বুচার শপে (মাংসের দোকানে) জমা দিয়ে দেন। এক ভাগে যতটুকু পরে ততটুকু টাকা আর কি। এর পরিমাণ হয় সাধারণত ১০০ থেকে ৩০০ ডলারের ভেতর। তবে পশু ভেদেও ভিন্ন হয় টাকার পরিমান। আমি ভেড়ার মাংস কোরবানী দিয়েছি পার হেড ১০০ ডলার করে। টাকা দিয়ে দিলে বুচার শপের লোকজন আপনার নামে কুরবারীর পর আপনার ভাগের মাংসটুকু কেটে প্যাকেট করে এনে রেখে দেবে দোকানের ফ্রিজে।
আপনি পরদিন রসিদ দেখিয়ে সেটি বাসায় নিয়ে যাবেন। অর্থাৎ, আপনাকে কোরবানী সংক্রান্ত কোন ধরনের খাটাখাটুনির ভেতর দিয়ে যেতে হলো না। এর একটা বড় সুবিধা হলো, কোরবানী পশুর সাইজ বা দাম নিয়ে বড়াই করা, সেটার সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে দেয়া, চামড়া নিয়ে টানাটানি, মাংস নিয়ে ফকির মিসকিনদের মাঝে কাড়াকাড়ি, কসাইরা মাংস চুরি করলো কিনা সেই উদ্বেগ, এইসব অনাচার থেকে নির্বিঘ্নে দূরে থাকা যায়।
ওখানে কোরবানী দেবার পর পশুর নাড়িভুড়ি, চামড়া, বর্জ্য সব ডাম্প করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সিটি কাউন্সিল থেকে নির্ধারিত আলাদা একটি জাগায়, সার্টিফাইড ব্যাক্তির দ্বারা কোরবানী করা হয়। কুরবানির মাংস তিনভাগ করা হয়। একভাগ গরিবের, একভাগ বন্ধু-বান্ধবের। মাংস দেবার মতো গরিব লোকজন ওদেশে নেই।
বরং সেই অংশটুকুর টাকা অনেকেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন পরিবারের কাছে, পরিবার তার পক্ষ থেকে গরিব লোকজনের মাংসের হক শরিয়ত সম্মত উপায়ে আদায় করে নেন। আবার বন্ধু-বান্ধব বা পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে মাংস বিলি করার সময় বা সুযোগ ওখানে তেমন কারোরই থাকে না। অগত্যা সব মাংসই মোটামুটি বাসাতেই রান্না করে ফেলা হয়। তবে রান্না করা মাংসের একটা বড় অংশ অনেকেই স্থানীয় মোসাল্লায় পাঠিয়ে দেন, যাতে করে ভারতীয় উপমহাদেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান) থেকে আগত মুসলিম ছাত্ররা আয়েশ করে কোরবানীর মাংস খেতে পারেন, যারা কোরবানী দিতে পারেনি বা যাদের উপর কোরবানী ওয়াজিব হয়নি। এটাও ছদাকা হিসেবে গন্য হতে পারে।
তবে মুদ্রার ওপর পিঠও আছে। অজি মাইগ্রেটেড মুসলিমদের সেকেন্ড জেনারেশন হয়তো কোরবানী কি জিনিস জানেই না। এনিমেল স্লটারিং তাদের কাছে বর্বরতা। তারা বড় হয়ে পশু কোরবানী দিয়ে ওয়াজিব আদায় করবে কিনা সেটা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। অথচ আমাদের দেশে সবাই মিলে মিশে আনন্দ করি, ছেলে মেয়েরা ছোট থেকেই জানে যে বড় হয়ে তাদেরকেও কোরবানী দিতে হবে, তাদের বাবা যেমন দিচ্ছে।
অষ্ট্রেলিয়া যাবার আগে দেশে যখন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম, তখন দেখতাম এলাকার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মসজিদের ভেতরে ঢুকে অনর্থক হৈ চৈ করতো। বিরক্ত হতাম খুব, কারণ নামাজে ব্যাঘাত ঘটতো। অনেক অষ্ট্রেলিয়ার মসজিদে দেখি ইয়াং জেনারেশন নাই বললেই চলে, যারা আছেন তারা সবাই তাবলীগ করেন কিংবা স্থানীয় বয়স্ক লোকজন। তাইলে বাচ্চা বা ইয়াং মুসলিমরা কই?
তাদের অনেককেই দেখবেন তাদের ওয়ার্কপ্লেসে কিংবা ব্যবসায় কিংবা অন্য কোথাও। কেউবা স্থানীয় সরাইখানায়, বান্ধবীদের সাথে ফূর্তি করছে। শুক্রবার ছাড়া পাঞ্জেগানা নামাজে মসজিদের ভেতর তাদের দেখা মেলা ভার। এরপর থেকে আমি আর কখনো দেশের মসজিদে এলাকার বাচ্চাদের আর বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখিনি।
কারণ আমি বুঝেছি, ওরা তো তাও মসজিদে আসছে এই বয়সে। অথচ ওদের বয়সে মিডল ইষ্টের মুসলিম দেশের মুসলিম শিশুরাও মসজিদ চেনে না। সুতরাং, যে সব ছেলেমেয়েরা নিজের চোখে দেখছে না কোরবানী কিভাবে দেওয়া হচ্ছে, যে জেনারেশন জানেই না কোরবানী ঈদের আনন্দ কি, তারা কোরবানীর ত্যাগের মাহাত্ন্য কি করে বুঝবে?
কোরবানীর যে মাংস আপনি ফ্রিজে কিনে এনে রেখে দিনের পর দিন ডিফ্রোষ্ট করে রান্না করে খাচ্ছেন, সেই মাংসের সাথে বছরের বাকী ১১ মাসে কেনা মাংসের সাথে কোন পার্থক্য কি খুজেঁ পাবে আপনার সন্তানেরা? মাংস দেখে তো আর বুঝার উপায় নেই যে সেটা কোরবানীর মাংস, তাই না?
প্রবাসীদের ২য় বা ৩য় প্রজন্ম আসলে এক ধরনের ক্রমাগত দোটানায় ভোগা জেনারেশন। সঙ্গতকারণেই এদেরকে আপনি যদি ধর্ম না শিখান, এরা ধর্ম ভুলে যাবে। এদেরকে যদি আপনি নিজের দেশের আচার ও সংস্কৃতি না শেখান, তারা সেটাও ভুলে যাবে। যারা ধার্মিক পরিবারের, তারা ধর্ম শেখায়, কিন্তু আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার শেখায় না। আবার যারা সংস্কৃতিমনা, তারা নিজস্ব দেশীয় আচার-কালচার শেখায়, কিন্তু ধর্ম শেখাতে নারাজ।
অথচ ধর্ম এবং সংস্কৃতি – আমি মনে করি দুটোই গুরুত্বের সাথে শেখা উচিত। দুটোই আমাদের জীবনে চলার পথে পাথেয়। আমি আমার সন্তানকে একই সাথে ধার্মিক এবং সংস্কৃতিমনা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, আমার আম্মু আমাকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন।
যা বলছিলাম, বেশীরভাগ প্রবাসী শিশুরা যে ধর্মাচার বা নিজ দেশীয় সংস্কৃতি শিখতে পারছে না, তা অবশ্যই তাদের দোষ নয়। আমরা তাদের শেখাতে পারি নাই বলেই তারা ধর্ম ও সংস্কৃতি কোনটাই শিখতে পারে না। এই দায় তাদের পিতা-মাতা ও অভিবাবকদের। তাদের নয়। একটা সময় তারা গর্ব করে বলবে - “My parents were migrated here, I am not. I born and raised here. My Parents were Bangladeshi, I am not. I am a true Australian." এসব আপনার সামনেই বলবে। তখন হয়তো বুঝবেন যে কোথাও একটু ভুল করে ফেলেছেন। কিন্তু ততদিনে মনে হয় অনেক দেরী হয়ে যাবে।
প্রলয় হাসান ভাই