| তারবিয়্যাহ—সঠিক প্রশিক্ষণ |
ইসলাম পুরোটাই চর্চার বিষয়। ইসলামে নন-প্র্যাক্টিসিং বলে কোনো কথা নেই। মুসলিম মানেই তো ইসলাম অনুযায়ী জীবনযাপনকারী। যে ইসলাম সম্পর্কে জেনেও মানে না, সে আবার কেমন মুসলিম! তাই ইসলামে তারবিয়্যাহ এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজকে প্রভাবিত করতে পারবে, এমন নীতিমান নাগরিক গড়ে তুলতে হলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আচার-আচরণের সুষ্ঠু রীতিনীতি থাকা অপরিহার্য। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছোট-বড় যত ধরনের সামাজিক সমস্যা আছে, তার সবগুলোর মূলে রয়েছে তারবিয়্যাতের অভাব।
বর্তমানে আমরা উন্মাদের মতো বস্তুগত উন্নতির পিছনে ছুটছি। সন্তান প্রতিপালনের জন্য আমরা জাদুকরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির তালাশে আছি, যেন আমাদের নিজেদের সময় ও শক্তি খরচ করতে না হয়। এর ফলে আমাদের সন্তানরা বড় হয়ে অযত্নশীল ও স্বার্থপর হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা খরচ করলেই এইসব সমস্যা সমাধান হয়ে যায় না। কথায় আছে, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। সন্তানদের যেভাবে বড় করে তুলব, তার উপর নির্ভর করবে আমাদের সমাজ, জীবন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সন্তানদের বিলাসিতার মধ্য দিয়ে বড় করার অর্থ হচ্ছে নিজেদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করা। আর পার্থিব ভবিষ্যৎ তথা পরনির্ভরশীল বার্ধক্যের দুর্ভোগ তো আছেই। সন্তানকে শুধু টাকা দিলেই হয় না, সময় এবং মনোযোগও দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই।
তারবিয়্যাতের ক্ষেত্র পাঁচটি:
১. আকিদা (ধর্মীয় বিশ্বাস)
২. ইবাদাত
৩. মু‘আমালাত (লেনদেন)
৪. মু‘আশারাত (আচরণ)
৫. আখলাক (চরিত্র)
উল্লিখিত প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতি সমান মনোযোগ দেওয়া জরুরি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে আখলাকের শিক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে।’ এর মানে এই নয় যে, আকিদা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আকিদা ও আখলাক উভয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সচরাচর প্রথম দুটির প্রতি মনোযোগ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করি। আর বাকি তিনটিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করি। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে অন্যদের পদ্ধতি গ্রহণ করছি। আসলে আমরা নিজেদের পদ্ধতি সম্পর্কে জানিই না।
মু‘আমালাত, মুয়া‘আশারাত এবং আখলাকের মূল বিষয়গুলো কুরআন, সুন্নাহ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সীরাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে পাওয়া যায়। তাই সেই সর্বোত্তম প্রজন্মের কথা বেশি বেশি আলোচনা করাকে জীবনের অংশ বানিয়ে নিতে হবে। নিজেরাও জানতে হবে, জানাতে হবে সন্তানদেরও। তাদের ঘটনাগুলো যেন আমাদের কাছে বাস্তব ও জাজ্বল্যমান অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়। খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং নাটক-সিনেমার তারকা নয়; সাহাবায়ে কেরামগণই আমাদের স্বতন্ত্র ও গৌরবময় পরিচয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সন্তানরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামের নামের তুলনায় তথাকথিত এসব সেলিব্রিটিদের নামের সাথেই অধিক পরিচিত। আর কথাটা কেবল আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়।
আসুন, একটি উদাহরণের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের জীবনী জানার উপকারিতা বোঝার চেষ্টা করি। আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার দিকে একটু তাকান। ক্ষমতাশীল লোকেরা এই শাসনব্যবস্থা থেকে নিজেদের মনের মতো ফায়দা লুটছে। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলাম কি এমন কোনো পন্থা দেখিয়েছে, যেখানে এমন সুবিধাবাদের কোনো স্থান নেই? যার মাধ্যমে একজন ভালো শাসক নিযুক্ত পাওয়া সম্ভব?
খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনকে বিশ্লেষণ করে দেখলে এর উত্তর পাওয়া যাবে। কোন ভিত্তি ও মৌলিক শক্তি তাঁদেরকে সঠিক পথের উপর অটল রেখেছিল? আল্লাহর প্রতি তাকওয়া এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে—এই নিশ্চিত বিশ্বাস। এটাই তাদেরকে শয়তানের সকল ষড়যন্ত্র থেকে সুরক্ষা দিয়েছে। তারাও তো মানুষ, তাদেরও ছিল নিজস্ব কামনা-বাসনা। ইসলামি ব্যবস্থা লঙ্ঘন করে যে অনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে, তা-ও ছিল তাদের জানা। তাকওয়াই তাঁদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কিছু করা থেকে বিরত রেখেছে। এটাই মূল চাবি। আর তারবিয়্যাহ হলো তাকওয়ার সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর উপায়।
© মির্জা ইয়াওয়ার বেইগ
['বিশ্বাসের পথে যাত্রা'—বই থেকে]
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
No comments:
Post a Comment