Friday, June 16, 2023

দিনলিপি-১৮২৬

 

দিনলিপি-১৮২৬
১৬-০৬-২০২৩
দ্য গ্রেট গেইম—১
--
ক্ষমতা কারো চিরদিনের জন্য নয়। ক্ষমতা বারবার পক্ষ বদল করে। ধর্মবদল করে। জাতি বদল করে। স্থান বদল করে। দল বদল করে। ক্ষমতার পালাবদলে এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ ‘আমেরিকা’। ভবিষ্যতে বিশ্বনেতৃত্বে আসতে হলে, অতীত ও বর্তমান বিশ্বনেতৃত্ব সম্পর্কে জানা জরুরী।
এখন দুনিয়াতে এক মহাখেল (Great Game) চলছে। এই গেইমে মূলত তিনটি পক্ষ। প্রধান পক্ষ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা এককভাবে পরাশক্তির সুবিধা ভোগ করে আসছে। আমেরিকার সুপার পাওয়ার আজ হুমকির সম্মুখিন। বর্তমানে আমেরিকার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হল, তার সুপার পাওয়ার রক্ষা করা। আমেরিকার মোকাবেলায় অপরদিকে আছে চিন ও রাশিয়া। চায়না-রাশার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, তারা আজ উঠতে বসতে আমেরিকার পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। দুই দেশের চ্যালেঞ্জ জানানোর ভঙ্গি ও পন্থা আলাদা হলেও, উদ্দেশ্য এক। চায়না ও রাশা মূলত আমেরিকার একটি ‘ডকট্রিন’ বা মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করছে। ঘটনার শুরু অনেক আগে।
আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হলেন জেমস মনরো (১৭৫৪-১৮৩১)। মনরো আমেরিকা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট (১৮১৭-১৮২৫)। জেমস মনরোই সর্বপ্রথম আমেরিকাকে পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে নামিয়েছিল। মনরো ১৮২৩ সালে এক ডকট্রিন (Doctrine) পেশ করেছিল। সেই মনরোনীতি ছিল পৃথিবীর শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে এক ধমকি ও হুমকি। সেই মতবাদে আমেরিকা নিজেকে প্রকাশ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে মনরো নীতিকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩২-তম প্রেসিডেন্ট থিউডোর রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫)। তিনি ১৯০১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তিনি চার মেয়াদে ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তারা গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অধিপত্য আরও ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি, তার জনক মনে করা হয় রুজভেল্টকেই। তার শাসনামলেই যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক শক্তি থেকে প্রধান বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই অধিপত্য ১০০ বছরের বেশি সময় পরও বহাল আছে।
মনরোনীতির প্রধানতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল,
প্রথম ধারা: এখন থেকে নতুন দুনিয়া (New World)-এর উভয় মহাদেশে, অর্থাৎ উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কোনো ভূখণ্ড, ইউরোপ থেকে কোনো দেশ এসে দখল করবে না। কলোনি বানাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা এজন্য, নয়াদুনিয়া (আমেরিকা মহাদেশ) আবিষ্কৃত হওয়ার পর, এখানকার অমূল্য খনিজ সম্পদ লুঠ করার জন্য দলে দলে ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো হানা দিচ্ছিল। যে যার মতো দেশ দখল করে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ কব্জা করে নিজ দেশে পাচার করছিল। আমেরিকার আবিষ্কর্তা ও নির্মাতারাও এখানকার আদিবাসিন্দাদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ইউরোপিয়ানদের মতোই লুণ্ঠনকর্ম চালিয়েছিল। নিজেরা যা করেছে, সে কাজ করতে আমেরিকা এখন অন্যদেরকে বাধা দিচ্ছে।
ল্যাটিন আমেরিকা বলতে সাধারণত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের যেসব অঞ্চলের জনগণ ল্যাটিন ভাষা থেকে উদ্ভূত স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ভাষা ব্যবহার করে। ল্যাটিন আমেরিকার আওতায় দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দশটি, মধ্য আমেরিকার ছটি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের তিনটি ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একটি দেশ আছে।
দ্বিতীয় ধারা: মনরোনীতির দ্বিতীয় ধারা ছিল, এখন থেকে কোনও দেশ যদি ল্যাটিন আমেরিকায় এসে উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়, সেটা হবে সরাসরি আমেরিকার উপর সরাসরি হামলার নামান্তর। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রকে আমেরিকার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।
তৃতীয় ধারা: ইউরোপিয়ান দেশগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কোন্দলে নাক গলাবে না।
চতুর্থ ধারা: ল্যাটিন আমেরিকায় এখন যেসব ইউরোপিয়ান উপনিবেশ আছে, সেগুলোতেও আমেরিকা নাক গলাবে না। হস্তক্ষেপ করবে না। সেগুলোকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হবে।
চতুর্থ ধারাটি আমেরিকা শুরু থেকেই নিয়মিত অমান্য করে এসেছে। মনরোনীতি ঘোষণার ঠিক দুইবছর আগেই এমন ঘটনা ঘটেছিল। টেক্সাস রাজ্যটি ছিল স্পেনের কলোনি। আমেরিকা যোগসাজশ করে টেক্সাসকে স্বাধীন করিয়েছিল। মনরোনীতি ঘোষণার সময় ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ স্পেন ও পুর্তগালের নাগপাশ থেকে ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়ে গেছে নয়তো স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে আছে। ১৮০০ সালে আমেরিকার অধীনে মাত্র ১৩ টি রাজ্য ছিল। তখন মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় পুরোটাই ছিল স্পেন ও পুর্তগীজ উপনিবেশ। ১৮২২ সালের দিকে ল্যাটিন আমেরিকার চিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। কিছু দেশ নতুন করে ফ্রান্সের কব্জাতে চলে গিয়েছিল। বেশিরভাগ দেশ স্পেন ও পুর্তগাল থেকে স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। এমন টালমাটাল সময়ে আমেরিকা মনরোনীতি ঘোষণা করে, নিজের শিকারসীমা নির্ধারিত করে নিয়েছে। কুকুর বা শিকারী প্রাণীদের নিজস্ব একটা শিকারসীমা থাকে। সেখানে অন্য কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। আমেরিকাও গায়ের জোরে তাই করেছে। রাজা হতে হলে নিজের একটা স্বাধীন, সার্বভৌম এলাকা থাকা জরুরী। পরাশক্তি হতে চাইলে, চারপাশের অঞ্চলগুলো পুরোপুরি নিজের প্রভাববলয়ে থাকতে হয়। রাতারাতি কেউ পরাশক্তি হয়ে যায় না। মনরোনীতি ঘোষণার মাধ্যমে আমেরিকা মূলত নিজ বলয়ে অবস্থান সংহত করে নিয়েছিল।
দ্বিতীয় খেলোয়াড়
হুবহু একই ঘটনা ঘটছে চায়না ও রাশার ক্ষেত্রেও ঘটে চলছে। প্রথমে চায়নার কথাই ধরা যাক। ইন্ডিয়া, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাউস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সাউথ চায়না সি, তাইওয়ান, ইস্ট চায়না সির তীরবর্তী কোরিয়া আর মঙ্গোলিয়া। এসব অঞ্চলকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে (Geo Politically) চায়নার প্রভাববলয়ের বলা যেতে পারে। ঠিক যেমন পুরো ল্যাটিন আমেরিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবলয়াধীন। আমেরিকার মতো চায়নাও চায়, উক্ত অঞ্চলগুলোকে পুরোপুরি নিজের নিজের বাহুডোরে রাখতে। এসব দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ নিজের প্রভাবাধীনে রাখতে। এসব অঞ্চলকে ঘিরে চায়নারও একটা ‘ডকট্রিন’ আছে। কিন্তু আমেরিকা যতটা নির্বিঘ্নে পরাশক্তি হয়ে বসেছিল, চায়নার পথ অতটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। চায়নাকে এমন কিছু দেশ চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, যেগুলো আমেরিকারই প্রভাবাধীন। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া সবই বেশ আর কম আমেরিকার পকেটে থাকা দেশ। কিছু দেশ তো প্রায় শতভাগ আমেরিকার আশ্রয় ও প্রশ্রয়েই নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত ও টিকিয়ে রেখেছে। এই তালিকায় তাইওয়ান, ভিয়েতনামের নাম আসবে সবার আগে। তাছাড়া মার্কিন রণতরীগুলো সাউথ চায়না সী ও ইস্ট চায়না সীতে নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়ায়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ফিলিফাইনের প্রত্যক্ষ মদদে। মার্কিন রণতরীর দিকে চায়নিজ নেভাল কর্তৃপক্ষ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেও, বাধা দিতে পারে না। এই তো কিছুদিন আগে (জানুয়ারি ২০২২), প্যাসিফিক ওশনের যে অংশকে চায়না নিজের অংশ বলে দাবি করে, সেখানে দুটি মার্কিন বিমানবাহি রণতরী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। চীনা কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, এই এলাকায় প্রবেশের আগে চায়নার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু মার্কিন রণতরী চায়নিজ হুঁশিয়ারি থোরাই কেয়ার করেছে। তার ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়িয়েছে। চায়নার মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, আমেরিকা চারদিক থেকে চীনরে পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে। চায়না এই ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। তার গলায় থাকা মার্কিন ফাঁস ছিঁড়ে ফেলতে চায়। শুধু তাই নয়, এসব অঞ্চলে চায়না নিজস্ব বিশ্বব্যবস্থা (World Order), নিজস্ব আঞ্চলিক প্রভাব (Regional Order) বলবৎ করতে চায়। প্রশ্ন হতে পারে, নিজের মতবাদ প্রচারে চায়নাকে কে বাধা দিচ্ছে? আসলে ডকট্রিন ঘোষণা করলেই হয় না, পাশাপাশি ছলেবলেকৌশলে বাস্তবায়নও করতে হয়। এখনো পর্যন্ত চীনের সেই শক্তি অর্জিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট মনরোর মতো দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে চীন বলতে পারছে না, ইস্ট ও সাউথ চায়না সী একান্তই আমার, এখানে অন্য কেউ প্রভাব বিস্তার করার মানে, আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর। চায়না এমন কথা বলতে চায়, কিন্তু সামর্থের অভাবে বলতে পারছে না। সামর্থ নেই বলে কি চায়না চুপ করে বসে আছে? উঁহু। চীন এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা (Long Term Strategy) অনুসারে হরদম কাজ করে যাচ্ছে। এটাই গ্রেটগেমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমেরিকাকে নিজের দোরগোড়া থেকে তাড়াতে চাইলে, আগে সারাবিশ্বে আমেরিকার প্রভাব খর্ব করতে হবে। চীন শুরুতেই সরাসরি আমেরিকার সাথে সামরিক ঠোকাঠুকিতে যাবে না। যাওয়ার কথা ভাবেও না। চীন খেলছে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে। বিশ্বপরাশক্তি হওয়ার জন্য, আমেরিকাকে একক বিশ্বপরাশক্তির আসন থেকে আছাড় দিয়ে ফেলার জন্য, চীন মনরো ডকট্রিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কৌশল নিয়ে খেলছে। চীনের অনুসৃত কৌশলের নাম দেয়া যেতে পারে,
‘যুদ্ধহীন জয় (Winning Without Fighting) কৌশল’।
এই কৌশলের প্রধানতম ধারা হল ‘নিরবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতা (Continuing Compitition)। প্রতিটি ময়দানে তীব্র, হাড্ডাহাড্ডি, নির্দয়, নৃশংস লড়াই অব্যাহত রাখা। এই লড়াইয়ে কোনও মূলনীতি, নীতি-নৈতিকতা, নিয়মনীতি, কায়দাকানুন, মূল্যবোধ, আদব-আখলাক, শরমহায়া, তাহযিব-তামিয বলে কিছু নেই। যে কোনও মূল্যে, যে কোনও উপায়ে যুদ্ধজয়ই প্রথম ও শেষ কথা। এটা যে শুধু চীনের অনুসৃত কৌশল তা নয়, আমেরিকাও নিজ লক্ষ্য অর্জনে নির্দয় (Ruthless), নিরাবেগ। আমেরিকাকে শীর্ষস্থান থেকে পেড়ে ফেলতে চীন কী করছে?
প্রথম পদক্ষেপ
আমেরিকার বিভিন্ন খাতে বেশি বেশি বিনিয়োগ করছে। কোভিডের আগ পর্যন্ত চীন প্রতিবছর আমেরিকায় ৩৭ থেকে ৪৭ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করে এসেছে। এই বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমেরিকায় নির্মিত, উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক টেকনোলজি হাতানো। এই খাতে চায়না আমেরিকার চেয়ে এখনো বহু পেছনে পড়ে আছে। এসব বিনিয়োগ চায়না সরকার সরাসরি করে না। আমেরিকা বা কানাডায় অবস্থানরত চায়নিজ নাগরিক বা চায়নিজ বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিককে দিয়ে, আমেরিকা বা কানাডায় বড়ধরণের ব্যয়বহুল টেকনোলজি কোম্পানি চালু করে। এই কাজটা চায়নিজ নাগরিক একা করে না। সাথে এক বা একাধিক মার্কিন বা কানাডিয়ান নাগরিককে সামনে রাখে। অথবা প্রতিষ্ঠিত বড় কোনো মার্কিন কোম্পানিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে তাদের ব্যবসার অংশীদার হয়। সামরিক (Defence) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) নিয়ে কাজ করে এমন কোম্পানীগুলোই প্রধানত চায়নার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে। এ-ধরণের কোম্পানিগুলোতেই চায়না বিনিয়োগ করে। চায়নিজ প্রতিনিধি এসব কোম্পানির মালিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে এত বিপুল অংকের টাকার টোপ রাখে, এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। চায়নিজ প্রতিনিধি দেখতে-শুনতে চায়নিজ হলেও তিনি সাধারণত মার্কিন নাগরিকই হয়ে থাকেন। সুতরাং কারো মনে সন্দেহ জাগার অবকাশ থাকে না। এই চিনোমার্কিন লোকগুলো মনেপ্রাণে মার্কিন হয় না। জন্ম আমেরিকায় হলেও, মূল উৎসা চায়নার প্রতি তাদের একধরণের অকথিত, অলিখিত আনুগত্য ও দুর্বলতা থাকে। চায়নিজ ইন্টেলিজেন্স এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। প্রথম প্রথম মার্কিন কর্তৃপক্ষ চায়নিজ ব্যক্তির আসল অভিসন্ধি টের না পেলেও, পরে বিভিন্ন উপলক্ষ্য থেকে তাদের মনে সন্দেহ উদ্রেক হয়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ দেখে, তারা দীর্ঘদিন ধরে, বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অতি গোপন যে ‘প্রডাক্ট’ তৈরি করেছে, সেটা অল্পকিছুদিনে ব্যবধানে চায়নাতেও ‘কপি’ হয়ে গেছে। এ কী করে সম্ভব? নিশ্চয় কোথাও ঘাপলা আছে। মার্কিন গোয়েন্দারা ফাঁক খুঁজতে খুঁজতে চায়নিজ বংশোদ্ভুক্ত ব্যক্তির দিকে সন্দেহের আঙুল তাক করে। কিন্তু বাহ্যিক কোনও প্রমাণ ছাড়া তাকে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সন্দেহের ভিত্তিতে চায়নিজ ব্যক্তিকে পাকড়াও করতে গেলে দুটি সমস্যা সামনে আসে,
ক. চায়নিজ ব্যক্তিকে ধরলে, মার্কিন আইন কোম্পানির শরিকদার অমেরিকান নাগরিকদের ব্যাপারেও সমানভাবে তদন্তের নির্দেশ দিবে। গোপন তথ্য পাচারে চায়নিজ ব্যক্তির সাথে তারাও জড়িত নেই তো? কোম্পানির তদন্ত করতে গেলে খবর মিডিয়াতে ফাঁস হয়ে যাবে। কোম্পানির এতদিনকার সমস্ত সম্মান ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। কোম্পানির প্রতি ক্রেতাদের আস্থা কমে যাবে। কোম্পানির শেয়ারদর পড়ে যাবে। এমন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। দীর্ঘদিন মেহনত করে, হাজারো মানুষের মেহনতে, বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে পথে বসিয়ে দেয়ার ঝুঁকি থাকে।
খ. মার্কিন গোয়েন্দাবিভাগের কাছে অকাট্য প্রমাণ থাকে না যে, চায়নিজ বিনিয়োগকারী এমএসএস (গঝঝ)-এর এজেন্ট। এজন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না।
আবার কখনো এমনো হয়, যখন মার্কিন গোয়েন্দবিভাগ চায়নিজ বিনিয়োগকারী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে, ততক্ষণে এমএসএস এজেন্ট বেইজিংয়ে বিমান থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরেছে।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ
চায়না সরকার মার্কিন ডলার জমা করে যাচ্ছে। চীন ও হংকংয়ের কাছে এই মুহূর্তে প্রায় ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত আছে। এই বিপুল পরিমাণ ডলার নড়াচড়া করে, চীন চাইলে বিশ্ববাজারে ডলারের ‘দর’ পতন ঘটাতে সক্ষম। এই ডলার বাজারে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দিয়ে, মার্কিন অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম।
তৃতীয় পদক্ষেপ
চিন সাইবার আক্রমণ করে। মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা, মহাকাশযান, বিশেষ করে ডিফেন্স কোম্পানিগুলোর ওপর হামলা করে। মার্কিন সংস্থাগুলোর নিয়মিত অভিযোগ: চায়নিজ হ্যাকাররা তাদের অতি গোপনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। এই কাজ নিয়মিত হয়েই চলছে। মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানি লডহেড মার্টিন করপোরেশন (The Lockheed Martin Corporation) এফ-৩৫ ও এফ-২৫ যুদ্ধবিমান, বোয়িং নির্মাণ বিষয়ক প্রায় ৬ লাখেরও বেশি ফাইল গোপনে কপি হয়ে চায়না স্থানান্তর হয়ে গেছে। এটা নিয়ে মিডিয়াতে বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। চায়নিজ কর্তৃপক্ষও বিষয়টা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কর্তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। যে তথ্য তারা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় রেখেছিল, সবই চায়নাতে চলে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ময়দানে টিকে থাকতে হলে নিজেকে ‘হালনাগাদ’ রাখা জরুরী। চায়না চোরের ওপর বাটপারি করেই ময়দানে টিকে থাকে। লড়াইয়ে যে কোনো মূল্যে টিকে থাকাটাই আসল, পদ্ধতি মুখ্য নয়।
তৃতীয় খেলোয়াড়
এই গ্রেট গেমে রাশিয়া কী করছে? রাশিয়া কিছুদিন আগে, মাত্র ৩৩ বছর আগে, আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। আমেরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলত। আমেরিকা কুস্তিতে রাশিয়াকে এমনভাবে আছাড় দিয়ে ফেলেছিল, দীর্ঘদিন রাশিয়া নড়াচড়াই করতে পারেনি। রাশিয়ার হাতে চায়নার মতো অত টাকাপয়সা নেই, আমেরিকাকে টেক্কা দেয়ার মতো তথ্যপ্রযুক্তিগত সক্ষমতাও নেই। রাশার কাছেও অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী সমর প্রযুক্তি আছে, তবে সেটা আমেরিকার সাথে সমানতালে পাল্লা দেয়ার মতো নয়। রাশার জন্য আরেকটি সমস্যা হল, আগে চারপাশের যেসব অঞ্চল রাশার প্রভাববলয়ে ছিল, সেগুলোর প্রায় পুরোটাই মার্কিন প্রভাবাধীনে চলে গেছে। জার ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে পশ্চিমাঞ্চলের পুরোটাই রাশার কজ¦ায় ছিল। পশ্চিমে ফিনল্যান্ড থেকে শুরু করে, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, মালদোভা, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও তুরস্ক পর্যন্ত সবই রাশার পকেটে ছিল। দক্ষিণে দেখলে জর্জিয়া, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজিস্তান, কাজাখাস্তান সবই রাশার একপ্রকার উপনিবেশই ছিল বলা চলে। পূর্বে জাপান সাগর পর্যন্ত রাশিয়ার আঞ্চলিক প্রভাববলয়ে ছিল। এখন রাশার পশ্চিমে পূর্ব ইউরোপে বেলারুশ ছাড়া প্রায় সবদেশই আমেরিকার বলয়ে চলে এসেছে। এসব দেশ রাশার হাতে তাদের স্বাধীনতা খোয়া যাওয়ার আশংকাতেই মূলত মার্কিন-ইউরোপিয় বলয়ে যোগ দিয়েছে না হয় ন্যাটোর সদস্য হয়েছে বা সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। আফগানিস্তান, ‘স্তান’ দিয়ে শেষ হওয়া দেশগুলোর বেশিরভাগ, এদিক দিয়ে জাপান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ ভূখ-গুলোতে রাশার পরিপূর্ণ ইজারাদারি নেই। এমতাবস্থায় রাশা তার চারপাশে আগেকার দিনের হারানো প্রভাব ফিরিয়ে আনার জন্য যে কোনো কিছু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাশা এখনি যদি নিজের প্রভাববলয় পুনর্বহাল করতে না পারে, তাহলে আমেরিকা তো বটেই, কদিন তাকে চায়নারও অধীন হয়ে চলতে হবে। ক্ষমতার লড়াইয়ে ‘সাধুচরিত্রের’ কোনো স্থান নেই। চায়না আজ রাশার যতই দোস্ত থাকুক, কাল এক নাম্বার পরাশক্তি হয়ে গেলে, দুশমন হয়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? চায়না নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। বর্তমান বিশ্বে পরাশক্তি হতে হলে শুধু নিজের রাস্তাই দেখতে হয়।
নিজের ক্ষমতাবলয় ফিরে পাওয়ার জন্য আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারছে না। রাশার আপাতত সে ক্ষমতা নেই। অদূর ভবিষ্যতে হবে, তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাই আমেরিকার বিরুদ্ধে রাশা নিজের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ংকর অস্ত্র ‘সাইবার এটাক’ ব্যবহারে মনোযোগী হয়েছে। চায়নার মতো রাশাও বেশ সফলভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সাইবার আক্রমণে সোশাল মিডিয়ার ‘প্রপাগা-া’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রপাগা-া যুদ্ধে রাশা অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। আমেরিকার বিরুদ্ধে বৃহত্তর পরিসরে প্রথমবার প্রপাগা-া অস্ত্র ব্যবহার করে ২০১৬ সালে। হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বপক্ষে নির্বাচনী প্রচারনাকালে।
পৃথিবীতে বর্তমানে অস্ত্র, গোলাবারুদবোমা ছাড়া যে যুদ্ধ লড়া হয়, সেটাকে ‘হাইব্রিড ওয়ার’ বলা হয়। এই যুদ্ধে শক্তিশালী দেশগুলো মাঝেমধ্যে অত্যন্ত বেকুব, আহমক লোকদেরকে বেশি বেশি প্রচারের পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যা সংবাদ, মিথ্যা প্রশংসা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতি অযোগ্য, অথর্ব লোককেও বিখ্যাত আর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এই অযোগ্য লোকদেরকে বিখ্যাত করে তুলে, তাদের মাধ্যমে সমাজে বিভক্তি, দলাদলি, রায়ট, হিংসা ছড়িয়ে দেয়। শত্রুরাষ্ট্রের জনগণকে বহুধাবিভক্ত করে ফেলে। পরস্পরের মধ্যে ঘৃণা, অবিশ্বাস ছড়ায়। জনগণের মধ্যে তীব্র বিরোধ ছড়িয়ে দিতে পারলে, সে দেশের জনগণ একাট্টা হয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। দেশটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে। হিংসা-হানাহানির কারণে একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ লেগে থাকে। কীভাবে আরেকদলকে ফাঁদে ফেলে ক্ষমতা দখল করা যায়, এই চিন্তায় বিভোর থাকে। এসব করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি, সমরনীতি, কূটনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাশা লাখো ফেইক আইডির মাধ্যমে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে নির্বাচনে জেতার জন্য অবিশ^াস্য রকমের মদদ যুগিয়েছিল। প্রতিপক্ষ হিলারির ই-মেইল হ্যাক করে, হিলারির বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে অদ্ভুদ সব বদনাম ছড়িয়েছিল। এসব করে ট্রাম্পশিবিরের হাতে নির্বাচনজয়ী হাতিয়ার তুলে দিয়েছিল। হিলারির বিরুদ্ধে রাশান হ্যাকার দ্বারা প্রচারিত গুজবগুলোকে ট্রাম্পের সমর্থকরা রীতিমতো লুফে নিয়েছিল। এসবের ওপর ভিত্তি করে ট্রাম্পের স্বপক্ষে, হিলারির বিরুদ্ধে মিলিয়ন হ্যাশট্যাগ চালু হয়েছে, লাখো ফেসবুক পেজ তৈরি হয়েছে, লাখো পোস্ট হয়েছে। এসব প্রপাগান্ডার ফলে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছিল ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। ট্রাম্পের পক্ষে রাশার সাইবার এটাকের সংবাদ যখন মার্কিন গোয়েন্দাবিভাগ জানতে পেরেছে, ততদিনে রাশান প্রপাগান্ডা মেশিন নিজের কাজ শেষ করে ফেলেছে। নির্বাচন শেষ হয়ে ট্রাম্প জয়ী হয়ে গেছে। এটাই ছিল দেশের বাইরে, রাশান সাইবার আর্মির প্রথম আক্রমণ। পুতিন এরপর এস্তোনিয়া, ক্রিমিয়া, ইউক্রেন ও পোলান্ডে এই প্রপাগান্ডা মেশিন কাজে লাগিয়েছিল।
(আপাতত চলবে, ইন শা আল্লাহ)
.
.
গ্রেট গেইম বুঝতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার ইতিহাসসহ আরো কিছু বিষয় জানা জরুরী। বক্ষ্যমান সিরিজের পাশাপাশি সমান্তরালে আরো বেশকটি সিরিজ চলবে, ইন শা আল্লাহ।
রাব্বে কারিম তাওফিক দান করুন। আমীন।
দোয়ার দরখাস্ত।
পরামর্শ ও সংশোধনী থাকলে, জানানোর বিনীত অনুরোধ থাকল।
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
 
- শায়েখ আতিক উল্লাহ (হাফিযাহুল্লাহ)

No comments:

Post a Comment