Sunday, December 18, 2011

"মিষ্টি মিতু" [ Collection of Love Stories -05 ]





"ভাইয়া ঘুমুচ্ছেন?" 
আজব প্রশ্ন! একটা লোক ভরদুপুরে ষ্টেশন এর বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কি করতে পারে? বাংলাদেশ এর মানুষের কি ধড় থেকে মাথাটা উধাও হয়ে গেল নাকি? মেজাজটা চড়ে গেল। কাঁচা ঘুমটা... তেড়ে উঠলাম প্রশ্নকর্তাকে উপযুক্ত একটা জবাব দেয়ার জন্য।
"না ! ফুটবল খেলছি ! এখনও শেষ হয় নাই! আসেন সেকেন্ড হাফ শুরু করি..." বলতে বলতে আমার মুখের কথা আটকে গেল । সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের চোখ দেখলে পুকুরের কথা মনে পড়ে । এই মেয়েটি সেই কিসিমের । চোখটা দেখলেই মনে হয় জল টলমল করছে । মনে হয় পলক ফেললেই পানি গড়িয়ে পড়বে । আমি বাকহারা হয়ে তাকিয়ে আছি । আমারই চোখের পলক পড়ছে না । 
"গুড! এটাই তো চাই!" বলতে বলতে আজব মেয়েটি আমার বালিশ (ব্যাগ) টা আমার কোলে দিয়ে ওখানে বসে পড়ল। অদ্ভুত মেয়ে! একটিবারের জন্যও অনুমতির ধার ধারল না। আমি ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমার আসলে নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না । এই অপ্সরা এল কোথা থেকে? আর এতো মানুষ থাকতে আমার পাশেই...? তারপরও একটু ভাব ধরার জন্য বললাম, "ম্যাডাম, এতো খালি সিট থাকতে কিনা এই ঘুমন্ত অভাগাকেই পেলেন? হাহ!" বলে কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম ।
মেয়েটি দেখি ভাবের আরেক ধাপ উপরে! বলল,
"হুহ! কি ভেবেছেন আপনি? আপনার সাথে ভাব জমানোর জন্য আমি এসেছি? দেখুন মিস্টার আপনি কি ভাবেন আমার খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই? আপনাকে দেখে মনে হল আপনিও আমার মতো ট্রেন লেট এর শিকার ।তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি । হয়ত সময়টা ভালই কাটবে ।আর আপনি! হাহ! আর আরেকটা কথা..." বলে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল , "মিস্টার আপনি যেভাবে হাঁ করে ঘুমুচ্ছিলেন! কয়টা মাছি যে আপনার মুখে ঢুকেছে কে জানে! আজ আমি না আসলে হয়ত মাছি দিয়েই লাঞ্চ করে ফেলতেন । তারপর ঘুম থেকে উঠে বলতেন কি ব্যাপার! আমি আজ কি খেলাম! পেটটা এতো ভরল কিভাবে?" বলে তার সে কি হাসি! হাসতে হাসতে ঝুঁকে মাটি ছুয়ে ফেলছে প্রায়। আমি শুধু হাঁ করে দেখছি । এত সপ্রতিভ মেয়ে এই প্রথম দেখলাম । বললাম ,
"আপনি সবসময়ই কি এতো বেশি কথা বলেন? নাকি এই প্রথম?"
"সবসময়! কেন আপনার ভালো লাগে না? আমার বান্ধবীরা তো বলে তুই এত্ত কিউট! এতো কথা বলতে পারিস । তারা আমার মতো পারে না তো! আমার অবশ্য......... 
মেয়েটির ট্রেন চলতেই থাকল! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে আছি । কেন জানি বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। এই অজানা ষ্টেশনে এক অপরিচিত মেয়ে এসে আমার মতো গাধার সাথে এভাবে কথা বলবে তা বিশ্বাসই হতে চায় না । কেন জানি মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি হঠাৎ করে আমার ঘুম ভাঙবে,দেখবো আমি তন্ময় বসে আছি অচেনা এক ষ্টেশনে, চট্টগ্রামগামী ট্রেনের আশায়! এই...
"হ্যালো মিস্টার!" দেখি মেয়েটা আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজাচ্ছে ।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, " কিছু বললেন?"
"নাম... আপনার নাম? নাম নেই?"
"না না আছে আছে । তন্ময় । তন্ময় রায়হান।"
"বাহ বেশ ভারিক্কি নাম বলে মনে হচ্ছে? আমাদের অবশ্য একটা তন্ময় আছে । আমরা তাকে ডাকি 'টনটনে তন্ময়', হি হি হি" বলে সে দুলে দুলে সে হাসতে লাগলো । 
আমাকে আবার টনটনে তন্ময় ডাকা শুরু করে নাকি এই ভয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, "আপনার নাম?"
"কেন?"
আমি তো অবাক! "ওমা! আপনি আমার নাম জানলেন না?"
"তো?"
"আশ্চর্য মেয়ে তো আপনি! নাম বললে সমস্যা কোথায়?"
মেয়েটা এখন আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসতে লাগলো যে আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। নিজের দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। বিশেষ করে জিপার এর দিকে। শালার জিপার! এই ব্যাটা কিভাবে যেন সময় বুঝে নিজের দ্বার খুলে দেয়। একবার নতুন জামা কাপড় পড়ে খুব মাঞ্জা মেরে স্কুলে গিয়েছি । ক্লাস এ ঢুকেই দেখি সালাম স্যার । বাংলার টিচার। তিনি প্রায়ই আমাদের দাড় করিয়ে দেন সকলের সামনে কোনও একটা বিষয় নিয়ে কিছু বলার জন্য । আজ আমাকে লেট দেখে আমাকেই দাড়া করিয়ে দিলেন । বিষয় 'বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প'! আমি তো মহাখুশি । ভাবে ভাবে নতুন জামা কাপড় নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম । সামনে দাড়াতেই দেখি মেয়েরা মিটিমিটি হাসছে । বাহ! দারুন তো! আমি দ্বিগুণ উৎসাহে বক্তৃতা শুরু করলাম । মাঝে মাঝে মেয়েদের প্রবল হাসির চোটে তা তিনগুন হয়ে যাচ্ছিল আমি তো কথার মাঝে মাঝে শাহেদার দিকে তাকাচ্ছি । ওকে আবার আমি খুব পছন্দ করতাম । সেও দেখি হাসছে! বাহ! তো বক্তৃতা শেষ করে বীরদর্পে নিজ আসনে গিয়ে বসতেই রাকিব বলল, "শালা! জিপার লাগাস নাই ক্যান?" নিচে হাত দিয়ে দেখি ঘটনা সত্যি । মেয়েদের হাসির মানে আমার কাছে পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেল । ক্লাস শেষে ওই প্রান্ত থেকে উড়ে আসা কথার তীরগুলো আমার বুকে শেলের মতো বিঁধছিল । রবিনহুড ও তীর ছুড়ে তার শত্রুদের এতটা ঘায়েল করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ!
না । জিপার তো ঠিকই আছে । তবে মেয়েটা কেন হাসছে? 
"কি ব্যাপার? হাসছেন কেন?"
সে হাসতে হাসতেই বলল, "আপনি কি জোকস বুঝেন না? আপনার সাথে একটু মজা করলাম । আমি মিতু ।"
"শুধু মিতু? আগে পিছে কিছু নেই?"
"আছে ! কিন্তু বলব না।" বলেই আবার সেই বিখ্যাত হাসি ।
আমার মুখ দিয়ে কেন যেন বের হয়ে গেল, "আপনি যেমন মিষ্টি , আপনার নামটাও তেমনি মিষ্টি । মিষ্টি মিতু ।"
"ভালই বলেছেন । মিষ্টি মিতু ! আচ্ছা আপনি কোথায় পড়েন?"
"আমার পড়ালেখা শেষ। এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করি । আপনি?"
মেয়েটি লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, " আমার এখনও লেখাপড়া শেষ হয় নাই ভাইয়া । ফার্মেসি তে পরছি । ঢাকা ভার্সিটিতে । পড়তে পড়তে অবস্থা কাহিল!"
মেয়েটির বলার ভঙ্গিতে আমার হাসি পেয়ে গেল । এমন বাচ্চাদের মতো করে বলল! আমার হাসি দেখে সে বলল , "খুব হাসি পাচ্ছে না? হাসেন হাসেন! আমি মরি আর উনি হাসেন! কারে দেখাব মনের দুঃখ..."
আমি এবার হো হো করে হেসে উঠে বললাম, "আপনি তো খুব মজার মানুষ । "
মেয়েটি কিছু না বলে হাসল ।
আমি বললাম, "তা এখন কি ঢাকা ফিরে যাচ্ছ?" মিতুর চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, "যাচ্ছেন?"
সে হেসে বলল "না না তুমিই বলেন । আমি তো আপনার ছোটই । হ্যাঁ, এখানে বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম । এখন আবার যাচ্ছি ফিরে আমার আপন আলোয় ।"
"বাহ! কবিতা লিখেন নাকি?"
"হু মাঝে মাঝে ।" একটু বোধয় লালচে হয়ে গেল গালদুটো ।
আমার মনের মাঝে কেমন যেন করছে । কি হল? এইটুকু সময়ের জন্য এই মেয়েটি এসে কি আমার জীবনটা ওলটপালট করে দিয়ে যাবে? আমি আকাশের দিকে তাকালাম । কি সুন্দর হাসছে । যেন বলতে চাইছে , 'দেখো আমি তোমার মনের রঙ্গে সাজিয়ে নিয়েছি নিজেকে।' মিতুর জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করছে । কি করব?
"আইসক্রিম খাবেন?" বাস্তবে ফিরে এলাম মিতুর ডাকে । 
"খাওয়া যায় । কিন্তু জানেন কেউ কোনোদিন আমাকে এভাবে আইসক্রিম খেতে আমন্ত্রন জানায়নি ।"
"তাই? হি হি। আপনি তো দেখি বিরাট অভাগা । দাঁড়ান আমি নিয়ে আসি ।"
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম । আইসক্রিম যে আমার কিনে নিয়ে আসা উচিত তা একবারও মাথায় এল না । 
"এই নিন । কোন ই পেলাম । আর ভালো কিছু এখানে নেই । তবে এইটাই আমার ফেবারিট ।"
আমি জীবনে আইসক্রিম খুব একটা খাইনি । আমার টনসিল এর সমস্যা । তাও বললাম, "আমারও ।"
মিতু এক চোখ উপরে তুলে আমার দিকে তাকাল, "তাই?"
"না মানে...ইয়ে... হ্যাঁ হ্যাঁ। এইটা আমারও খুব ভালো লাগে । আর আগে না লাগলেও এখন থেকে লাগবে!"
দূর থেকে একটি ট্রেন এর শব্দ শোনা যাচ্ছে । সেদিকে তাকিয়ে মিতু বলল, " এইযে আমার ট্রেন এসে গেছে ।"
কি সহজ করেই না মিতু বলল কথাগুলো । কিন্তু এই চঞ্চল মেয়েটি কি জানে এই কথাগুলো একটি ছেলেকে কি পরিমান কষ্ট দেবে? আমি জানি না অচিন কোনও দৈত্য এসে আমার বুকটা চিরছে কিনা । আমি শুধু জানি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । একটি ট্রেন আমার চোখে জল এনে দিলো । মিতুও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে উদাস চোখে । তার চোখেও কি কিছু এসেছে?
আমি বললাম, "তোমার ট্রেন?"
"হ্যাঁ! যেতে হবে তো । তাই না?"
আমার কথাগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে । আমি প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করছি "যেও না মিতু! আমার সাথে আরও কিছুক্ষন থাকো না!" কিন্তু বলতে পারছি না । বলতে পারছি না এই প্রথম কোনও মেয়ের জন্য আমার খারাপ লাগছে। আমি শুধু মিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । চোখগুলো যেন কি একটা বলতে চাইছে । 
ট্রেনটা এসেই গেল । সকলের মধ্যে এক তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল । জীবনের পথে এক মুহূর্তও নষ্ট হতে দেয়া যাবে না । ছোটো ছোটো! ইস! সময়টাকে যদি থামিয়ে দিতে পারতাম!
"যাই ভাইয়া?" ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মিতু ।
আমিও উঠে দাঁড়ালাম । সবাই ট্রেন এ উঠে পড়েছে । এখন ছাড়ার অপেক্ষা । মিতু ধীরে ধীরে ট্রেনে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে রইল ।ট্রেন ছেড়ে দিলো । প্রচণ্ড শব্দ । বললাম, "ভালো থেকো।"
সে উঁচু স্বরে বলল, "শুনতে পাচ্ছি না ।"
এবার আমি চিৎকার করে বললাম, "ভালো থেকো"
সে হাসল । একটু বিষাদও মিশে রইল হাসিটাতে। সেও চিৎকার করলো, "থাকবো।"
আমি বললাম, "পুরো নামটা?"
মিতু হেসে বলল, "নাই বা জানলেন!"
"যোগাযোগ?"
"নাই বা থাকলো!"
আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? দুচোখ ভিজে গেছে । আবার বললাম, "ভালো থেকো ।"
ট্রেন ততক্ষনে অনেক দূরে চলে গেছে । মিতু দরজার হাতল দুহাতে ধরে শরীর বের করে আছে । বলল, " থাকবো, থাকবো! আপনিও ভালো থাকবেন।"
আমি ফিসফিস করে বললাম, " থাকবো।"
আমার উত্তর মিতু শুনতে পেল না। যতক্ষণ দেখা গেল হাত নেড়ে গেল । আর আমি তাকালাম আকাশের দিকে । কেমন যেন মুখ গোমড়া করে আছে । আমাদের মনের রঙের সাথে সাথে কি আকাশও নিজের রঙ বদলায়? নাকি আমাদের মনের রঙ ই আকাশের রঙের সাথে সাথে বদলে যায়?
**************
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে । এরিমধ্যে আমার বিয়েও হয়েছে । কান্তাকে বিয়ের রাতে বলেছিলাম মিতুর কথা । সব শুনে সে হাসতে হাসতে বলেছে ,"তুমি একটা গাধা । মেয়েটা তোমার কাছ থেকে কিছু আশা করছিল । মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে কিছু বলতে পারে না । ছেলেদেরই বলতে হয় ।" আমি তখন ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়েছি, " হ্যাঁ! খুব পণ্ডিত না? বেশি জান?" কিন্তু তারপর মনে হয়েছিল হয়ত কান্তাই ঠিক । আসলেই হয়ত মিতু কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিল । 
কান্তা আর আমার খুব সুখের সংসার । ছোট্ট একটা বাগান । তবুও মাঝে মাঝে যখন বিকেলে চা খেতে বসি তখন মনে হয় মিতু আমার পাশে বসে হাসছে । ঢাকায় গেলে রাস্তায় হাঁটার সময় দুচোখ একটি মিষ্টি মুখ খুজে ফেরে । কোন ষ্টেশনে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় শুধু মনে হয় এই বুঝি একটা মিষ্টি কণ্ঠ আমার কানের কাছে এসে বলবে... 
"ভাইয়া......ঘুমুচ্ছেন?"..........


লিখেছেন-Farhad Mahmud
 গল্পটি নেয়া     https://www.facebook.com/notes/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81-%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%81/211933848886772

(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)

শুভ্রের বউ [ Collection of Love Stories -04 ]

শুভ্র চশমা পাচ্ছে না। রাতে ঘুম যাওয়ার আগে চোখ থেকে খুলে রেখেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাচ্ছে না। ঘুমে থাকলে চশমার দরকার হয় নাই, আর বাকীটা সব সময় চশমা লাগেই ওর। বিয়ের পর কক্সবাজার গেছে। সমুদ্রে নেমেছে দুই জন। চোখে চশমাসহ পানিতে নামায় অবাক ইলা।

: আশ্চর্য ব্যাপার তো! তুমি চশমা পড়ে নামলে কেন? সমুদ্রের ঢেউ আসলে চশমা নিয়ে যাবে তো। তাছাড়া চশমার মধ্যে পানি পড়লে তো গ্লাস ঝাপসা হয়ে যাবে। তুমি কিছুই দেখবে না।

এটা শুনে আমতা আমতা করে শুভ্র বলে, আসলে আমি চশমা ছাড়া তো তেমন কিছু দেখি না।




এর মধ্যে বড় এক ঢেউ কূলে আছড়ে পড়ে। ঢেউ থেকে সরে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে লাফ দেয় শুভ্র। কিন্তু উল্টাফল হয়। আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। চশমাটা পানিতে পড়ে যায়।

হাতড়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু এ বড় সমুদ্রে কি তা পাওয়া সম্ভব! তারপরও খুঁজে যায়। ইলা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য চোখে হাত দিয়ে রাখে। লজ্জা লাগে ও।

: ইলা আমার একটু হোটেলে ফিরতে হবে। তুমি থাকো আমি এক্ষুনি আসছি।

: কেন হোটেলে গিয়ে কি করবে।
: এই যাবো আর আসবো।

ইলা ব্যাপারটা বুঝতে পারে। চোখে চশমা নাই। চশমা ছাড়া শুভ্রকে অন্যরকম লাগে। চশমা পড়লে যে বোকা ভাবটা থাকে, চশমা না থাকলে সেটা থাকে না। তারপরও ওকে চশমা পড়াই দেখতে ভাল লাগে।

: ওহ চশমা পড়ে গেছে? তুমি বলবে না! সমস্যা নাই। হোটেলে যেতে হবে না। তুমি আমার হাত ধরো।

হাত বাড়িয়ে দেয় ইলা।
: আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন? চশমাতো এভাবে পড়ে যেতেই পারে, তাই না। এটাতে লজ্জার কিছু নাই। আর চশমা হারানোয় ভালয় হয়েছে। আমার চোখ দিয়ে তুমি দেখো। নাহয় চোখের জন্য কিছুক্ষণের জন্য আমরা দুইজন এক মানুষ হয়ে রইলাম। বলে হাসে ইলা।
কথাটা শুনে ঝাপসা পৃথিবীটাও অনেক সুন্দর মনে হয় শুভ্রের কাছে। ইলার মোলায়েম হাতটা ধরে আলতো করে।

: এই আলতো করে ধরছে যে! সামান্য ঢেউ এলেও তো আলাদা হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে আমার চোখের প্রতি তোমার আস্থা নেই।

নাহ নাহ বলে শক্ত করে ধরে ইলার হাত। বাচ্চারা যেমন ধরে অনেকটা তেমন। ইলার ভাল লাগে। আগে কক্সবাজার বেশ কয়েক বার এসেছে। কিন্তু এবার কেন যেন অন্যরকম ভাল লাগছে। নতুন নতুন মনে হচ্ছে সব। সমুদ্রের ওপারে পানির সাথে মিশে যাওয়া আকাশটাকে ছুতে ইচ্ছা করছে।

: আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? চলো আমরা সমুদ্রের শেষ সীমানায় গিয়ে ওই আকাশটাকে ছুইয়ে আসি।

শুভ্র বলে, চলো। এখুনি যাই।

একথা বলেই নিজেই সামনের দিকে হাটা শুরু করে।

ইলার মজা লাগে। সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে বসেছে ও। এত সরল কেন ছেলেটা! এই দাড়াও। এখন না। এখন একটু দুষ্টামি করবো।

: কি দুষ্টামি?
: ঢেউ যখন আসবে তখন আমি মাথা ঢেউয়ের নিচে ডুবিয়ে দেবো। ঢেউ মাথার ওপর দিয়ে যাবে। ঢেউয়ের নিচে থেকে ঢেউয়ের বেগ অনুভব করার অন্যরকম আনন্দ।

: ঠিক আছে। তাহলে আমি কূলে অপেক্ষা করি।

: আরে গাধারাম! তুমি কূলে অপেক্ষা করবে কেন! তুমি আমার হাত ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমরা একসাথে ডুব দিবো। তুমি আমার হাত ধরে থাকবে। কি বলছি মনে নাই, আমরা কিছুক্ষণের জন্য এক মানুষ।

শুভ্রের চোখে মুখে আনন্দ। এই দুষ্টামি সেও উপভোগ করতে চায়। ওর চোখ মুখ সে কথাই বলছে।

: সমুদ্রকে একটা ধন্যবাদ দাও তো। সে তোমার চশমা কেড়ে নিয়ে আমাদের একসাথে করে দিলো। দাও উচ্চস্বরে ধন্যবাদ দাও। বলো, সমুদ্র তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সকাল বেলা। সমুদ্রে তেমন বেশি লোকজন নাই। তাছাড়া একটু ঢেউ আসছে। সে শব্দে কে কি বলছে তা অন্যদের শোনার কথা নয়। তারপরও লজ্জা লাগে শুভ্রের উচু গলায় সমুদ্রকে ধন্যবাদ দিতে। বিড় বিড় করে ও বলে, সমুদ্র তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। বলার ক্ষেত্রে শব্দের আওয়াজ কম থাকলেও মনের ভেতরে এ বলাটা অনেক শক্তিশালী ছিল।

মনেরটা দেখতে পেলো না ইলা। বিড়বিড় করাটাই দেখলো। আরে তোমার কি ভাল লাগছে না? আচ্ছা ভালো না লাগলে চলো হোটেলে ফিরে যাই।

শুভ্র বাচ্চা ছেলেদের মত চিল্লিয়ে বললো, সমুদ্র তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সত্যিই তুমি অনেক ভাল।

এটা শুনে অভিমান করে ইলা।
: সমুদ্র ভাল। আমি ভাল না?

: তুমি তো সমুদ্রের চেয়েও ভাল।

: নাহ সমুদ্রের চেয়ে ভাল হওয়ার কাজ নেই আমার। সমুদ্র সমুদ্রের মত ভাল, আমি আমার মত। বলে হাসতে থাকে ইলা।

হাসলে ইলার মুখে টোল পড়ে। ঝকঝকে ফর্সা দাঁতগুলো দেখা যায়।

হাসিটা অনেক প্রিয় শুভ্রের। কিন্তু চশমা না থাকায় সেটি দেখতে পারছে না।

: চলো ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে যায়। কি প্রস্তুত তো।

শুভ্র মাথা নাড়ে। তার বেশ আনন্দ হচ্ছে।

বড় একটা ঢেউ আসে। সে ঢেউয়ের মাঝে দুইজনই লাফিয়ে পড়ে। ঢেউ যেমন তাদের দিকে ছুটে আসছিল ঠিক তেমনি তারা ঢেউয়ের মধ্যে ছুটে যায়। একজনের হাত আরেকজনের হাতে। দুইজন পাশাপাশি। ঢেউ তাদের শরীরের ওপর দিয়ে চলে যায়।

অন্যরকম মজা হয়েছিল সেবার।

শুভ্র ডাক দেয়, ইলা, একটু আসবে?

ইলা বারান্দায় ফুলের টবগুলোতে পানি দিচ্ছিলো। বারান্দাটা দুই রুম পড়ে। বিশাল বারান্দা। সেখানে সারি করে বিভিন্ন ফুলের টব রাখা হয়েছে। প্রতিটিদিন কোন না কোন গাছে ফুল থাকে। ইলা একটা গোলাপ ছিড়ে হাতে নেয়।
আবার ডাক দেয়, ইলা!
অসহায় গলা। ছুটে আসে ইলা।

: কি হলো?

: আমার চশমাটা পাচ্ছি না। একটু দেখবে?
: কই রেখেছিলে?

খাটের পাশে টেবিলটাতে রেখেছিলাম মনে হয়। কিন্তু এখন দেখছি নাই। ভুলে হয়ত অন্য কোথাও রেখেছি। অপরাধী ভঙ্গিতে বলে যায় শুভ্র।

কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খুঁজাখুঁজি করে ওয়ার্ড ড্রবের ওপর থেকে চশমাটা এনে দেয় ইলা। চশমা পেয়ে একটা হাসি দেয় শুভ্র।

ইলা দেখেই থাকে। কি নির্মল হাসি, ভোরের প্রকৃতির মত নির্মল। ঘুম থেকে উঠে এ হাসিটা প্রতিদিন দেখতে ইচ্ছা করে ইলার। এজন্য মাঝে মাঝে নিজেই চশমাটা লুকিয়ে রাখে। হাসিটা দেখার লোভে ওর প্রতিদিনই চশমাটা লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বুঝে যাবে বলে তা করা হয় না। আজকের চশমাটা ও-ই সরিয়ে রেখেছিলো। মাঝে মাঝে রাখে।

চশমা দিতে দিতে বলে, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে?

: কেন! আজ যে একটা মিটিং হওয়ার কথা। জার্মানি থেকে ওরেস্ট কোম্পানির লোক এসেছে। তাদের সাথে আমাদের কোম্পানির একটা আলোচনা হবে।

: ঠিক আছে আসতে হবে না।

আরে বাবা, আমি সেটা বলেছি নাকি। আমি অবশ্যই আসবো। কই যাবে?

ইলার ভাল লাগে। ভাবতে ভাল লাগে ওর ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে এভাবে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাদ দেওয়া। বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। জানে এতে বেশ লোকসান হবে। তারপরও ভাল লাগে।

আর এত টাকা দিয়ে কি হবে! যে টাকা আছে তা দিয়েই আরো কয়েক প্রজন্ম চলতে পারবে। আর তাদের নিজেদের প্রজন্মই এখনও আসে নি।


কথাটা ভাবতে লজ্জা লাগে ইলার। সাথে একটা ভাল লাগার অনুভূতিও। ব্যাপারটা বলতে হবে শুভ্রকে। ও ঠিক করে, রাতেই বোকা শুভ্রটাকে ব্যাপারটা বলবে।




লিখেছেন-হাসান মুন্না
FB ID-Hasan Munna
BLOG ID-বই পাগল


গল্পটি নেয়া :      https://www.facebook.com/notes/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%9B%E0%A7%81-%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA/%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%89/212054515541372