Monday, December 19, 2011

আনন্দ বেদনার কাব্য [ Collection of Love Stories -12 ]


যুদ্ধ মানে কি? সংগ্রাম? লড়াই? আর বিজয় মানে কি অর্জন? মমতা ভাবেন আর ভাবেন। এই যে অবিরাম যুদ্ধ, এর শেষ কোথায়!!!




অরিত্রর জন্ম সেই যুদ্ধের সময়। সেই ছেলে দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। পঁচিশ ছুঁই ছুঁই ছিপছিপে এক যুবক। এই যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ।পরনে আকাশ নীল একট টি- শার্ট। হাল্কা কোঁকড়ানো চুল। মসৃণ কাঁধ, ঝকঝকে গায়ের রং আর বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ। একদম মাহিন এর কার্বন কপি । দেখতে এমন এ ছিল মাহিন। শান্ত চেহারা কিন্তু ভেতরে অনেক জেদ। অনেক স্বপ্ন। একটু আবেগপ্রবণ কিন্তু নীতিতে অটল।

-মা নাস্তা দাও।    

-টেবিল এ চল।

-তুমি খেয়েছ?

-না।

-কেন?               

-এমনি।

-খাওনা কেন? এত সকালে উঠো।

-তুই খাবি চল।

-ভাত খাব মা।

-এই সকালে?

-হু। দুপুরে খাওয়ার ঠিক থাকে না।

-বাসায় চলে আসলেই তো পারিস।

- টাইম পাইনা । তোমার সেই কালকের মাংস আছে না?  ফাটাফাটি হইছিল ।

-হু, চল।

-আজকে ফিরতে দেরি হবে মা। প্রোজেক্ট এর কাজ।

-সে আর নতুন কি।

-আমার ভালো লাগে না মা।

-কি?

-এইযে চাকরি খোঁজা ।

-হবে চেষ্টা কর।

-আর কত?

-পানিতে ত পড়িস নাই।

-তুমি আর কত?

-আমার আরো চাকরি আছে ৩ বছর। হয়ে যাবে।নাস্তা খাবি  চল।

-মা তোমার কোন কিছুতে মন খারাপ হয়না?

-না।

-কেন?

-লাভ নাই তাই।

-তোমার কি দারুন ফিলসফি।

-এই ভাত খাবি ত চল।

পিছনে পিছনে অরিত্র আসে। গরম ভাত আর তাতে জ্বাল দেয়া কোরবানির মাংস । ঝুরা ঝুরা হয়ে গেছে , অরিত্রর তাই পছন্দ। তাতে ডাল।গরম গরম।তাতে  মরিচ। অরিত্র হাপুস হুপুস খায়।

-বলে মা রনির জব হল শাফিক এর ও হল একটা । আমার যে কবে হবে।

-হবে হবে আল্লাহকে ডাক।

-তোমার আজকে কি রুটিন?

-মিটিংএকটা আর কিছু নাই।

-কখন যাবা?

-এইত।

-চল একসাথে বের হই।

-না রে। তুই যা।

অরিত্র বেরিয়ে যায় ।



 মমতা গোসল করে রেডি হতে যান। তার এখন ও অনেক লম্বা চুল। টানা মসৃণ । কোমর ছাপানো। তাতে সকালের সূর্যের  আলো পড়ে ঝলমল করছে। একটা হাত খোঁপা বাঁধেন। তার পঞ্চাশ পেরিয়ে  গেছে  কিন্তু মুখে এখন ও তারুণ্য এর আভা। এককালে খুব সুন্দর ছিলেন তিনি। শাড়িতে খুব দারুন লাগত। এখন ও তাই। একটা  হাল্কা আকাশি শাড়ি বের করেন। তাতে সাদা ব্লাউজ।আজকে departmental মীটিং . Agenda আগে ই ঠিক করা।

দরজাতে তালা লাগিয়ে বের হতে হতে ১০ টা। তার আগে একটা বিস্কিট, এক কাপ গ্রীন টি।

চেয়ারম্যানশিপ এর দুই বছর চলছে।সপ্তাহে ২টা ক্লাস। আজকে ক্লাস নাই।

রুম এ রুমানা বসে আছে ।দেখতে খুব নরম শরম শান্ত । তার ছোট বোন তুলির মেয়ে।এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। এই মেয়েকে দেখলে তার নিজের সেই বয়স এর প্রতিচ্ছবি মনে হয়। ওর স্নিগ্ধ হাসি অনেক কথা বলে।

-কিরে রুমানা খবর কি?

-এইত চলছে।খালা এক্সাম কি পিছাবে? উড়া উড়া শুনি।

-তাই নাকি?

-তাইলে ত গেলাম।

-কেন?

-সময় চলে আসল না?

মমতা হাসেন। বলেন -সময়  বাড়ায়া নে ।অনার্স টা শেষ কর... তারপর

রুমানার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সামনের জানুয়ারীতে। ছেলে জাপান প্রবাসী ডাক্তার। বিয়ের পরই ও কে নিয়ে  যাওয়ার কথা। রুমানাকে বিষণ্ণ লাগে। চোখ দুটো কি এক কষ্টে ছল ছল করে।

গহন কালো চোখ দুটি তুলে বলে

-হু... বিয়ে বড় না পড়াশোনা?

-তাইতো। চিন্তিত ভাব দেখান মমতা। তা তোর হবু বর কি বলে?

-বলে পড়াশোনা করে লাভ কি? তুমি কি চাকরি করবা?

-তুই কি বলিস?

-বলি তাইত রান্না করতে আর বাসন মাজতে তো আর ডিগ্রি লাগেনা। কিন্তু খালা আমি এত সহজে ছাড়বনা। ফাইট দিব। পড়াশোনা শেষ করবই।

-জাপান এ গিয়ে জাপানিজ ফাইট? তোর মা কি বলে?

হাসে রুমানা। বলে মা আমার পক্ষে আছে। তোমার এক্সামপল দেয়। বলে মমতার মত হ। লাইফ এর কোন গ্যারান্টি আছে?

 -তুই তো এই যুগ এর মেয়ে। আমার মত কেন হবি? আরো আগাবি না ?

-তোমার মত হইলে এ হবে। দোয়া কইর। অরিত্র ভাই এর কি খবর?

-আছে।

-যাবনে বাসায়।

- আসিস।                                                                               



রুমানা চলে গেল।কিন্তু ওর সুবাস ছড়িয়ে রইল। সাহস এর দৃঢ়তার। মায়বি চেহারাতে কি যেন বলে গেল রুমানা! তার মত হতে চায়। লড়াই করতে চায়। বোকা মেয়ে। লড়াই করা কি খুব সুখের? একটা সময় ছিল যখন রুমানার মত ছিলেন তিনি। তেজি আর সাহসি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে খুব সংবেদনশীল।



সেই মনের প্রেমে পড়ে গেল মাহিন । অভিজাত পরিবার এর একমাত্র সন্তান । হৃদয়বান মেধাবি আর পরোপকারী। তুখোড় বিতারকিক আর আবৃত্তিকার । সেই মাহিন এর বনলতা হয়ে গেলেন তিনি। মফঃস্বল থেকে আসা মহিলা কলেজ এ পড়া মমতা ।তার অসাধারন মুখশ্রী, মিষ্টি  গানের গলা আর নিবিড় কাল চুলের জন্য ফিদা হয়ে গিয়েছিল মাহিন। কি যে সময় গেছে তখন । অপ্রেমের কাল থেকে প্রেম এর কাল। রোকেয়া হল থেকে মুজিব হল।ডাকসু থেকে TSC.  

বিয়ের বছর এ যুদ্ধ। ততদিনে এ পাশ করে বেড়িয়ে গেছেন দুজনেই। মাহিন ইউনিভার্সিটির টিচার। মমতা  একটা সরকারি কলেজে। মাহিন এর চেষ্টাতো ছিলই নিরন্তর। জীবন গোছানোর। Full bright scholarship  হয়ে গেল। যাওয়ার গোছগাছ চলছে তখনি যুদ্ধ।

না সেই কাহিনি আর মনে করতে চান না মমতা। বাইরে ভিতরের নিরন্তর যুদ্ধের কাল। নিজেকে রক্ষা করা,  অরিত্রর জন্ম, তাকে একা হাতে মানুষ করা... আর অপেক্ষা ... কত দিন রত্রি প্রহর গেল... অপেক্ষা আর শেষ হয়না । আহ চোখে পানি আসে কেন ?

মিটিং আর টুকটাক কাজ সেরে ইউনিভার্সিটি থেকে বের হতে হতে বিকেল। বাসা ৫ মিনিট এর হাঁটা পথ।এতটুকুতেই ফুরিয়ে  যায়। এবার অনেক ফুল ফুটেছে । কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর নাম না জানা কত ফুল। । মমতা ফুলের সুবাস মেখে ফুলার রোড এর রাস্তায় হাঁটেন আর ফুল দেখেন। মাহিন এর অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক বড় হবার, অনেক কিছু করার এই দেশটার জন্য । সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল  একদিন ১৯৭১ র এপ্রিল এর এক সকালে আর ফিরে এলোনা। কোথায় গেলো... কত খোঁজ .. . কত খোঁজ ...।  আর কত অপেক্ষা , আর কত চোখের জল। এই মাটিতে  কোথায় ঘুমিয়ে আছে।  কে জানে। বিয়ের পর পর অরিত্র এসেছিল গর্ভে । কি সুখ, কি আনন্দ, কত কল্পনা। ছেলে না মেয়ে। ছেলে হলে অরিত্র আর মেয়ে হলে বর্ষা। ছেলে হলে বুয়েট আর মেয়ে হলে মেডিকেল। স্বাধীন দেশে বড় হবে ওরা, সেই স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা।  সবই হল শুধু মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল মাহিন , ইংলিশ বিভাগ এর তরুন প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক শিক্ষক।



মুঠোফোন টা বেজে ওঠে।

-মা মা তুমি কই?

-কেন? কি হল?

-বলনা মা

-কি ? এই ত বাসার কাছে

-আস মা, তাড়াতাড়ি।

-তুই কই?

-বাসায় মা।আস...



বিকেল নেমেছে ফুলার রোড এ। তার সোনালি আলোতে মেখে আছে দশদিক। কাঁচা সোনার মত রোদ। এই রোদ এ রিকশা করে ঘোরা ছিল মাহিন এর খুব এ প্রিয়। আর তার সাথে গান। মমতার গান।

এক বিকাল এর কথা মনে পড়ল। সোনা সোনা রোদ। তার মাঝে আচমকা  বৃষ্টি। মাহিন এর কি উচ্ছাস। রাধাচূড়া ফুল আর বেলি ফুল এর গন্ধ মাখা রাস্তা। রিকশার পরদা ফেলা। আচমকাই হাতের পাতায় হাত। অসম্ভব ম্যানলি গলায় গহন ঘোর।

-মমতা প্লীজ বৃষ্টির গান কর একটা

মমতা অভ্যস্ত মাহিন এর পাগলামিতে। তাও বলেন কি বল না বল। রিকশাওালা শুনবে ত।

 চকিতে দুষ্টামি মাহিন এর গলায়। দারুন হাসিতে রাস্তা কাঁপিয়ে বলে আরে ওরে না হয় ২ টাকা কম দিবো... ফ্রী গান শুনবে তাই।

-আরে বল কি

-আরে লতা মুঙ্গেশকার, গান না একটা গান। নাহয় রিকশাওয়ালারে জিজ্ঞেস করি তোমার  গানের বদলে ফ্রী নিয়া যাবে নাকি আমদের?  

-না গাইলে কি করবা?

 -কি যে করব, হুড ফেলে বৃষ্টিতে তোমারে গোসল করাই দিবো। আর না হয় আমিই গান শুরু করব। চিল্লাব তখন বুঝবা কত ধান এ কত চাল।   তুমি ভালো বিপদ এ পড়বা।

 -এত জ্বালাও কেন তুমি?

-বউ হবা না আমার ? জ্বালা ত সইতেই হবে।।

 কি গান গেয়েছিলেন মনে নাই। ঝর ঝর মুখর শ্রাবন দিন এ না  অন্য কিছু... তাতে কি আনন্দ মাহিনের বলল আজকে আমারে বিয়ে করবা? প্লিজ চলনা কাজী অফিস। রাত বিরাতে তোমার গান শুনতে চাইলেও পারব তাইলে।



দরজাতেই দাঁড়িয়ে অরিত্র।। জড়িয়ে ধরল মাকে।

- মা মা দারুণ একটা ব্যাপার।          

-কি রে? কি হইছে?

-হয়ে গেছে মা , হয়ে গেছে।

-কি?

- গেস কর মা।

- চাকরি হইছে?

-না মা।

-তাইলে  কেমিক্যাল এর মুমু নিজেই তোরে বলছে তরে ছাড়া বাঁচবে না।

 -না মা

 -তাইলে... না রে তুই বল

-স্কলারশিপ পাইছি মা

-কোনটা

ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি তে মা... ফুল স্কলারশিপ মা

-সত্যি?

-তিন সত্যি মা।

 -কখন দেখলি?

-এইত রুমির বাসায় অনলইন হইলাম । তখনই । ফোনে বলতে ইচ্ছা করলনা তাই বাসায় আসলাম।

-কবে সেশান?  

-এইত মা সেপ্টেম্বরে । আর মাত্র ২ মাস।   

-তাইতো। সময় যে অনেক কম ।

-চল মা। সেলিব্রেট করি। তোমারে বাইরে খাওয়াব।  নতুন একটা দোকান হইছে  ধানমণ্ডিতে। ধানসিঁড়ি। ওদের  মাটন কাচ্চি আর চিকেন কড়াই। সাথে বোরহানি আর রায়তা। শেষে তোমারে পানবাহার এর একটা পান। দিলখুশ হয়ে যাবে।

অনেকদিন অনেকদিন কষ্টে ছিল অরিত্র। বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার । কোন চাকরি নাই ।  ছোটোখাটো প্রোজেক্ট এর কাজ আর কয়েকটা কোচিং এ ক্লাস। এবার খুশি। মমতার চোখে পানি আসে। সুখের দিন কি এসে গেল!! তার মিশন কি এইবার শেষ হল। তার যুদ্ধ কি বিজয় পেল? চোখের পানি ফেলার দিন কি শেষ হল?

-আমারে কেন? বন্ধুদের বল। আমি টাকা দেই।ভালমত খা। যা যা মন চায়। যতজনরে খাওয়াতে মন চায়।

-বন্ধুরে ই ত বললাম মা। সবচে বড় বন্ধু।   

-আরে ধুর।।                                                                        

-চলনা মা।শাড়ি বদলাইতে হবে না। তোমারে দারুন লাগতেছে মা।

-হইছে হইছে আর বলতে হবে না।

আবারও চোখে পানি আসে। আর মাত্র দুই মাস। অরিত্র ও চলে যাবে।

নিচে নেমে এসে রিকশাতে উঠে মা আর ছেলেতে। রিকশা চলতে থাকে। মা আর ছেলের কথা ও চলতে অরিত্র  এর স্বপ্ন, পরিকল্পনা । টুংটাং রিকশার হর্ন বাজে।    

-বলে মা আমারে ছাইড়া থাকতে পারবা তো? কিছুদিন। তোমারে  নিয়ে যাব ।

-নারে আমারে নিয়ে ভাবিস না। ৫ বছর ত। দেখতে দেখতে চলে যাবে। শুধু এই মাটিতে ফিরে আসিস।  অইখানে থাকিস না। কত কষ্টের এই দেশ। তোর বাবার কত স্বপ্নের দেশ।

-রুমানা রে  নিয়ে আস মা তোমার কাছে। হলেইতো থাকে । অনেক ভালো মেয়ে।

-নারে আমি একাই পারব । তুই থাকতে পারবি তো? দেখিস আবার কান্নাকাটি লাগাইস না।

অরিত্র মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। ওর দুই চোখে শ্রাবণ এর ঢল নামে।



                                  ********************

অনেক অনেকদিন চলে গেছে তারপর। আজকেও সন্ধ্যা নেমেছে। বসুন্ধারার ১০ নম্বর সড়কে ১১২ নং ছিমছাম দোতালা বাড়ীটিতে। সোনা সোনা রঙের আলোয় আলোকিত চারিদিক।

মিতু কাঁদছে।  এপোলো হসপিটাল এর শিশু বিশেষজ্ঞ মিতু। অরিত্রর ঘরনি।

- মিতু মিতু কাঁদছ কেন?

-কি জানি কাঁদি নাতো।

 -এই যে চোখে পানি। স্কলারশিপ পাওয়ার দিনটার কথা শুনতে চাইলা তাই না বললাম।

-না মা এর কথা যত শুনি ততই কেমন অস্থির লাগে...  ক বছর পরে ফিরলা তুমি?

-৫বছর।

-মা কেমনে ছিল!    

-মারে চিননা তুমি... সব পারে মা। ফোনে এ আমি কাঁদতাম। মা কাঁদত না।

অনিন্দ্য সুন্দর চোখ দুটি তুলে হাসে মিতু...  তাইত মায়েরা অনেক কিছু পারে। না পারলেও পারতে হয়।

-হু

মিতু উঠে। তার গহন মায়াবি চোখ  দুটো তখনো ভিজা।

-কই যাও

-যাই দেখি মা কি করে। বারান্দা তে আসবানা? একসাথে চা খাই।

মমতা  বসে ছিলেন ছোট্ট আনুশকে কোলে নিয়ে। লনে। অনেক ফুল ফুলে ভরা বাসার  সামনের লন। মিতুর হাতের অনবদ্য সৃষ্টি। এই মিতু নামক মেয়েটা যেন তার জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি কে ভুলিয়ে দিতে তার জীবনে পা রেখেছে। আর এই যে আনুশ।রেশম কাল চুল আর বরফ সাদা গায়ের রঙ । কি মায়া আর কি তৃপ্তি। তার বুকের উত্তাপ এ মিশে অনর্গল তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে ৩ বছর বয়সী আনুশকা।  মিতু পিছনে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে মমতার মাথায় হাত রাখে। নিবিড় কোমল সেই স্পর্শ। মনে মনে বলে মা আমি যেন আপনার মত হই। দোয়া করবেন।  

                                     *************


লেখকের কথাঃ পৃথিবীর সকল মাকে আমার অসীম শ্রদ্ধা।   


আমার যেন কখনই আমাদের মা আর মাটিকে ভুলে না যাই।



--------------------------------------------------------------------------



লিখেছেন-Sakiba Ferdousy



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)





গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/আনন্দ-বেদনার-কাব্য/209767732436717 


"অনিঃশেষ অনির্বাণ" [ Collection of Love Stories -11 ]






আজকাল যখন তখন চোখ চলে যায় আংটিটার দিকে।আংটিটা অনির্বাণের দেওয়া,আমাদের বিয়ের।আংটির দিকে চোখ যায় আর কিছুক্ষন পর তা ঝাপসা হয়ে ওঠে ,জলটা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ার পর আবার আংটিটাকে দেখতে পাই আমি। চোখটায় এতো জ্বালা কেন ?আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই তখন রঙহীন সাদা শাড়িতে চোখটা জ্বালা করে,যখন অনুভূতিশুন্য মুখটা দেখতে পাই,তখন ও মনে পড়ে অনির্বাণকে । দোষটা কার? আমার,আয়নার নাকি চোখের ?



অনির্বাণ আমাকে বিয়েতে এই আংটিটাই দিতে পেরেছিলো।তার যে এই এতটুকুই সামর্থ ছিলো। আমরা বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে,আমার পরিবার রাজি ছিলোনা এতে। যেদিন অনির্বাণের হাত ধরে চলে আসি,পরিবারের ভালোবাসার দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে যায় । হ্যাঁ, সব দরজাই খোলে,সে কথায় পরে আসছি ।আর অনির্বাণের পরিবার ? সে কথা বলতে গেলে, সে বড় হয় এতিমখানায়,তাঁর পরিচয় সে একজন পাকিস্তানির সন্তান,একজন যুদ্ধশিশু । তার মা জগতের নিষ্ঠুরতায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো । মাকে চিনলে ও তাকে অজানা করে রেখেছিলো সে।



আমার সাথে অনির্বাণের পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। একদিন দেখি, এক উচ্ছ্বল এলোমেলো চুলের ছেলে, কতগুলো গরীব ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে,হাতে তাদের বিরিয়ানীর প্যাকেট,সবাই একসাথে খাচ্ছে। এতিমখানায় ছিলো বলেই অনির্বাণ তাদের ভালোবাসত খুব। তাদের খাওয়া দেখে অনির্বাণের মুখে দেখেছিলাম সেই জগত আপন করা হাসি,যা মৃত্যু ও কেড়ে নিতে পারেনি। সেদিন ও যেন জগতের সবাইকে হাসিতে আপন করে অনির্বাণ বলে উঠেছিলো- "আসি তবে" !



সেই অনির্বাণের সেদিনের কান্ড দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। অনির্বাণ জানতো না,প্রায়ই আমি নানান কাজের অজুহাতে তাকে দেখতে যেতাম। একদিন দেখতে পেলাম ছেলেটা অনেকগুলো ফুল কিনছে,সেদিন ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারী। দেখতে পাই রাস্তার সেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের অনির্বাণ ফুলের সাথে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। কি যেন হয়ে হয়ে যায় আমার মাঝে।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাই তার দিকে,হাত বাড়িয়ে বলে উঠি- "আমি?" অনির্বাণ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে,তারপর একটা ফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে । জানিনা কি হয়েছিলো সেদিন আমাদের।



তারপর থেকে প্রায়ই যেতাম অনির্বাণের কাছে,মিশতে থাকি, তার সাথে আমি ও এমনটাই করতে থাকি আর অগোচরে তাকে ভালোবাসতে থাকি।শুনতে পাই তার জন্ম ইতিহাস-তা আমাকে একটু ও বদলায় না,আমি তাকে ভালবাসতেই থাকি। অনির্বাণ বলতো,"আমাকে কী ভাবে বলতে হবে আমি এই দেশের একজন,এই দেশের আলো হাওয়ায় আমি বড় হয়েছি,এই দেশের মাটিতে আমার নাড়ি পোঁতা,এই দেশেকে ভালোবাসি অনেক,আর কত প্রমাণ করে যেতে হবে আমি এই দেশের?"

অনির্বাণ আমার সামনে এক বঞ্চিত অথচ দৃঢ় মানুষের প্রতিনিধি। তাই আমার ভালোবাসা গোপনে বাড়তেই থাকে। অনির্বাণ হয়ত বুঝতো সবই কিন্তু সে নিজেকে বঞ্চিতই করে রেখেছিল,আমার থেকে ও!



হয়তো যুদ্ধশিশুর আবেগ থেকেই এই দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো অনির্বাণ,অন্যয়ের বিরুদ্ধে ছিলো উচ্চকণ্ঠ আর সব বঞ্চিত শিশু ছিলো তার আপনজন। " অনির্বাণ কি করে বলি,আমি তো এত মহান ছিলাম না।আমি ভাবতাম তোমাকে নিয়ে শুধু তোমাকে নিয়ে"।

আমার ৩ বছর আগে তুমি আইন নিয়ে পড়ে কাজে ঢুকলে,নিজেকে প্রমাণ করলে,সবকিছুর পর ও তুমি প্রতিষ্ঠিত হলে,হার মানলে না। কিন্তু তোমার কাজই ছিলো অপরাধ নিয়ে,তাই ভয় হতো আমার বড় ভয় !



এদিকে বাসায় আমার বিয়ের তোড়জোর চলছিলো। আমি তখন ও অনির্বাণকে বলিনি কিছুই। এক বিকেলে আমি হাজির হয়ে যাই অনির্বাণের ছোট্ট বাসায়,বলে উঠি- অনির্বাণ,এই পৃথিবীত মানুষ জন্মেই তোমাকে যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে,আমি তা দূর করতে পারবো না,কিন্তু তোমাকে দিবো সুন্দর আগামী। অনির্বাণ মেলাবে তোমার জগত আমার জগতে ?" অনির্বাণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো আমার দিকে,জানিনা আমার চোখে কী ছিলো সেদিন,সে আমাকে আর ফেরাতে পারেনি।

আমাদের বিয়ে হয় অনির্বাণের বন্ধুদের নিয়ে,বিয়ের পর আমি উঠি অনির্বানের সেই ছোট্ট বাসায়। সৃষ্টি করি ভালোবাসার এক বিশাল জগত। সেই জগতে আমরা কষ্টকে স্থান দেইনি কখন ও। সেই জগতে ছিলো আমাদের ভালবাসার এক বিশাল দিঘী,যাতে ফুটেছিলো ভালোবাসার নীলপদ্ম।



অনির্বাণের কাজের জন্য প্রায়ই নানান হুমকি আসতো,হুমকি আসতো আমার বাবার ও। আমি বড় ভয় পেতাম। অনির্বাণ হেসে বলতো," কিছু হবে না !"

"কই অনির্বাণ হলো তো,কিছু তো হলো। তুমি তো হারিয়ে গেলে!" বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করলেন, তোমাকে ও । তুমি হারিয়ে গেলে। বিয়ের সবে ১ মাস পার হয়েছিলো! সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিলো, বৃষ্টির ধারা রাস্তায় তোমার লাশের রক্ত ধুয়ে মুছে হয়তো শোক কাটাবার চেষ্টা করছিলো। তোমার মুখে কেন যেন হাসি ছিলো মৃত্যুর সময়ে ও! "কাকে দেখেছিলে? কী বুঝছিলে ? কী ভেবেছিলে তুমি ?" তোমার লাশের মুখের সেই হাসি দেখে আমি ঠিক ছিলাম না,অনির্বাণ। কিভাবে শোকে দুঃখে যে দিন কেটে গেলো,আমি বুঝতে পারিনি ।



আমার বাসার বন্ধ দরজা আমার জন্য খুলে গেলো আবার। সবাই বলতে লাগলো,"সেই জাতচুলোহীন ছেলেটা মরেছে,আর তুমি বেঁচেছো।" আমি নাকি বেঁচে গেছি অনির্বাণ! জীবন নিয়ে থেকেও ,যে জীবন আমার নয়,আমি তো মৃত ! তুমি আমায় কী করে গেলে অনির্বাণ ! আমার বাসায় কেউ তোমাকে দেখতে পেত না,তারাই,যারা পৃথিবীর আর সব মানুষের মতো তোমাকে বঞ্চিত করেছিলো।

আমাকে বোঝানোর পালা শুরু হলো,শুরু হলো বিয়ের তোড়জোড়। এবার আর প্রকাশ্যে নয়,গোপনে। যেন কেউ জানতে না পারে । আমার মুখ থেকে কথা বের হতো না,আমি নিঃচ্চুপ থাকতাম। একদিন মা বলে, " হাতের এই আংটিটা খুলে রাখো মীরা,তার আর প্রয়োজন নেই।" আমি মেনে নেই,হাতে রয়ে যায় আংটির ছাপ।

হঠাৎ ওইদিন রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে স্বপ্ন দেখে। আমার অনির্বাণ এসেছিলো স্বপ্নে !! সে এসে একটু হেসে,আমার হাতে পড়িয়ে দিয়ে যায় সেই আংটিটা। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কেঁদে উঠি,ছুটে গিয়ে আংটিটা বের করে পড়ে নেই,হঠাৎই মাথা ঘুরে উঠে আমার ,তারপর আর কিছু মনে নেই ।



আজ ৭-৮ মাস পার হয়েছে। আমি আমার মাঝে ধারণ করেছি নতুন প্রাণ। কী এক অজানা শক্তিতে সবার বিরুদ্ধে যেয়ে এই প্রাণকে আপন করেছি। আজকাল অনির্বাণ প্রায়ই আমার কাছে আসে। সূর্যের আলো যখন আমার গায়ে পড়ে,তখন সে আসে । জানালার গ্রীলের ফাঁকে পর্দা কাঁপিয়ে যে বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায় তাতে অনির্বানের স্পর্শ থাকে,বৃষ্টির ফোঁটায় অনির্বাণের ভালোবাসা আমাকে ভিজিয়ে যায়।



অনির্বাণ, তুমি গভীর দুঃখে বলতে,একজন পাকিস্তানির সন্তান ও কী পাকিস্তানি হবে? যদি সে এ দেশকে নিজেরই ভাবে ! এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানিনা। শুধু জানি তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর যে সংগ্রামের তোরণ আমার সামনে,তা আমি পার করবো। তোমার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা করবো অধিকারের পথে,সত্যের পথে। তুমি তো আবার ফিরে এসেছ অনির্বাণ। তোমার ছেলে ও কী তবে পরিচিত হবে একজন যুদ্ধশিশুর সন্তান অথবা জাতচুলোহীন হয়ে ? জানি না। অনির্বাণ তুমি কীভাবে আমাকে দ্রোহের মন্ত্রে জাগিয়েছো। তোমার সন্তানকে আমি পরিচয় দিবো। সে এদেশেরই সন্তান। সে হবে তোমার মত- শোষিত,বঞ্চিত মানুষের কাছের একজন।

অনির্বাণ,তোমার নামেই তোমার পরিচয় কারণ অনির্বাণরা কখনো হারিয়ে যায় না ।

------------------------------------------------------------------


লিখেছেন- প্রাচীন



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প
লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/অনিঃশেষ-অনির্বাণ/209895625757261