Monday, December 19, 2011

"অনিঃশেষ অনির্বাণ" [ Collection of Love Stories -11 ]






আজকাল যখন তখন চোখ চলে যায় আংটিটার দিকে।আংটিটা অনির্বাণের দেওয়া,আমাদের বিয়ের।আংটির দিকে চোখ যায় আর কিছুক্ষন পর তা ঝাপসা হয়ে ওঠে ,জলটা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ার পর আবার আংটিটাকে দেখতে পাই আমি। চোখটায় এতো জ্বালা কেন ?আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই তখন রঙহীন সাদা শাড়িতে চোখটা জ্বালা করে,যখন অনুভূতিশুন্য মুখটা দেখতে পাই,তখন ও মনে পড়ে অনির্বাণকে । দোষটা কার? আমার,আয়নার নাকি চোখের ?



অনির্বাণ আমাকে বিয়েতে এই আংটিটাই দিতে পেরেছিলো।তার যে এই এতটুকুই সামর্থ ছিলো। আমরা বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে,আমার পরিবার রাজি ছিলোনা এতে। যেদিন অনির্বাণের হাত ধরে চলে আসি,পরিবারের ভালোবাসার দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে যায় । হ্যাঁ, সব দরজাই খোলে,সে কথায় পরে আসছি ।আর অনির্বাণের পরিবার ? সে কথা বলতে গেলে, সে বড় হয় এতিমখানায়,তাঁর পরিচয় সে একজন পাকিস্তানির সন্তান,একজন যুদ্ধশিশু । তার মা জগতের নিষ্ঠুরতায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো । মাকে চিনলে ও তাকে অজানা করে রেখেছিলো সে।



আমার সাথে অনির্বাণের পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। একদিন দেখি, এক উচ্ছ্বল এলোমেলো চুলের ছেলে, কতগুলো গরীব ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে বসে আছে,হাতে তাদের বিরিয়ানীর প্যাকেট,সবাই একসাথে খাচ্ছে। এতিমখানায় ছিলো বলেই অনির্বাণ তাদের ভালোবাসত খুব। তাদের খাওয়া দেখে অনির্বাণের মুখে দেখেছিলাম সেই জগত আপন করা হাসি,যা মৃত্যু ও কেড়ে নিতে পারেনি। সেদিন ও যেন জগতের সবাইকে হাসিতে আপন করে অনির্বাণ বলে উঠেছিলো- "আসি তবে" !



সেই অনির্বাণের সেদিনের কান্ড দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। অনির্বাণ জানতো না,প্রায়ই আমি নানান কাজের অজুহাতে তাকে দেখতে যেতাম। একদিন দেখতে পেলাম ছেলেটা অনেকগুলো ফুল কিনছে,সেদিন ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারী। দেখতে পাই রাস্তার সেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের অনির্বাণ ফুলের সাথে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। কি যেন হয়ে হয়ে যায় আমার মাঝে।আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাই তার দিকে,হাত বাড়িয়ে বলে উঠি- "আমি?" অনির্বাণ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে,তারপর একটা ফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে । জানিনা কি হয়েছিলো সেদিন আমাদের।



তারপর থেকে প্রায়ই যেতাম অনির্বাণের কাছে,মিশতে থাকি, তার সাথে আমি ও এমনটাই করতে থাকি আর অগোচরে তাকে ভালোবাসতে থাকি।শুনতে পাই তার জন্ম ইতিহাস-তা আমাকে একটু ও বদলায় না,আমি তাকে ভালবাসতেই থাকি। অনির্বাণ বলতো,"আমাকে কী ভাবে বলতে হবে আমি এই দেশের একজন,এই দেশের আলো হাওয়ায় আমি বড় হয়েছি,এই দেশের মাটিতে আমার নাড়ি পোঁতা,এই দেশেকে ভালোবাসি অনেক,আর কত প্রমাণ করে যেতে হবে আমি এই দেশের?"

অনির্বাণ আমার সামনে এক বঞ্চিত অথচ দৃঢ় মানুষের প্রতিনিধি। তাই আমার ভালোবাসা গোপনে বাড়তেই থাকে। অনির্বাণ হয়ত বুঝতো সবই কিন্তু সে নিজেকে বঞ্চিতই করে রেখেছিল,আমার থেকে ও!



হয়তো যুদ্ধশিশুর আবেগ থেকেই এই দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো অনির্বাণ,অন্যয়ের বিরুদ্ধে ছিলো উচ্চকণ্ঠ আর সব বঞ্চিত শিশু ছিলো তার আপনজন। " অনির্বাণ কি করে বলি,আমি তো এত মহান ছিলাম না।আমি ভাবতাম তোমাকে নিয়ে শুধু তোমাকে নিয়ে"।

আমার ৩ বছর আগে তুমি আইন নিয়ে পড়ে কাজে ঢুকলে,নিজেকে প্রমাণ করলে,সবকিছুর পর ও তুমি প্রতিষ্ঠিত হলে,হার মানলে না। কিন্তু তোমার কাজই ছিলো অপরাধ নিয়ে,তাই ভয় হতো আমার বড় ভয় !



এদিকে বাসায় আমার বিয়ের তোড়জোর চলছিলো। আমি তখন ও অনির্বাণকে বলিনি কিছুই। এক বিকেলে আমি হাজির হয়ে যাই অনির্বাণের ছোট্ট বাসায়,বলে উঠি- অনির্বাণ,এই পৃথিবীত মানুষ জন্মেই তোমাকে যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে,আমি তা দূর করতে পারবো না,কিন্তু তোমাকে দিবো সুন্দর আগামী। অনির্বাণ মেলাবে তোমার জগত আমার জগতে ?" অনির্বাণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো আমার দিকে,জানিনা আমার চোখে কী ছিলো সেদিন,সে আমাকে আর ফেরাতে পারেনি।

আমাদের বিয়ে হয় অনির্বাণের বন্ধুদের নিয়ে,বিয়ের পর আমি উঠি অনির্বানের সেই ছোট্ট বাসায়। সৃষ্টি করি ভালোবাসার এক বিশাল জগত। সেই জগতে আমরা কষ্টকে স্থান দেইনি কখন ও। সেই জগতে ছিলো আমাদের ভালবাসার এক বিশাল দিঘী,যাতে ফুটেছিলো ভালোবাসার নীলপদ্ম।



অনির্বাণের কাজের জন্য প্রায়ই নানান হুমকি আসতো,হুমকি আসতো আমার বাবার ও। আমি বড় ভয় পেতাম। অনির্বাণ হেসে বলতো," কিছু হবে না !"

"কই অনির্বাণ হলো তো,কিছু তো হলো। তুমি তো হারিয়ে গেলে!" বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করলেন, তোমাকে ও । তুমি হারিয়ে গেলে। বিয়ের সবে ১ মাস পার হয়েছিলো! সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিলো, বৃষ্টির ধারা রাস্তায় তোমার লাশের রক্ত ধুয়ে মুছে হয়তো শোক কাটাবার চেষ্টা করছিলো। তোমার মুখে কেন যেন হাসি ছিলো মৃত্যুর সময়ে ও! "কাকে দেখেছিলে? কী বুঝছিলে ? কী ভেবেছিলে তুমি ?" তোমার লাশের মুখের সেই হাসি দেখে আমি ঠিক ছিলাম না,অনির্বাণ। কিভাবে শোকে দুঃখে যে দিন কেটে গেলো,আমি বুঝতে পারিনি ।



আমার বাসার বন্ধ দরজা আমার জন্য খুলে গেলো আবার। সবাই বলতে লাগলো,"সেই জাতচুলোহীন ছেলেটা মরেছে,আর তুমি বেঁচেছো।" আমি নাকি বেঁচে গেছি অনির্বাণ! জীবন নিয়ে থেকেও ,যে জীবন আমার নয়,আমি তো মৃত ! তুমি আমায় কী করে গেলে অনির্বাণ ! আমার বাসায় কেউ তোমাকে দেখতে পেত না,তারাই,যারা পৃথিবীর আর সব মানুষের মতো তোমাকে বঞ্চিত করেছিলো।

আমাকে বোঝানোর পালা শুরু হলো,শুরু হলো বিয়ের তোড়জোড়। এবার আর প্রকাশ্যে নয়,গোপনে। যেন কেউ জানতে না পারে । আমার মুখ থেকে কথা বের হতো না,আমি নিঃচ্চুপ থাকতাম। একদিন মা বলে, " হাতের এই আংটিটা খুলে রাখো মীরা,তার আর প্রয়োজন নেই।" আমি মেনে নেই,হাতে রয়ে যায় আংটির ছাপ।

হঠাৎ ওইদিন রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে স্বপ্ন দেখে। আমার অনির্বাণ এসেছিলো স্বপ্নে !! সে এসে একটু হেসে,আমার হাতে পড়িয়ে দিয়ে যায় সেই আংটিটা। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে কেঁদে উঠি,ছুটে গিয়ে আংটিটা বের করে পড়ে নেই,হঠাৎই মাথা ঘুরে উঠে আমার ,তারপর আর কিছু মনে নেই ।



আজ ৭-৮ মাস পার হয়েছে। আমি আমার মাঝে ধারণ করেছি নতুন প্রাণ। কী এক অজানা শক্তিতে সবার বিরুদ্ধে যেয়ে এই প্রাণকে আপন করেছি। আজকাল অনির্বাণ প্রায়ই আমার কাছে আসে। সূর্যের আলো যখন আমার গায়ে পড়ে,তখন সে আসে । জানালার গ্রীলের ফাঁকে পর্দা কাঁপিয়ে যে বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায় তাতে অনির্বানের স্পর্শ থাকে,বৃষ্টির ফোঁটায় অনির্বাণের ভালোবাসা আমাকে ভিজিয়ে যায়।



অনির্বাণ, তুমি গভীর দুঃখে বলতে,একজন পাকিস্তানির সন্তান ও কী পাকিস্তানি হবে? যদি সে এ দেশকে নিজেরই ভাবে ! এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানিনা। শুধু জানি তোমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর যে সংগ্রামের তোরণ আমার সামনে,তা আমি পার করবো। তোমার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা করবো অধিকারের পথে,সত্যের পথে। তুমি তো আবার ফিরে এসেছ অনির্বাণ। তোমার ছেলে ও কী তবে পরিচিত হবে একজন যুদ্ধশিশুর সন্তান অথবা জাতচুলোহীন হয়ে ? জানি না। অনির্বাণ তুমি কীভাবে আমাকে দ্রোহের মন্ত্রে জাগিয়েছো। তোমার সন্তানকে আমি পরিচয় দিবো। সে এদেশেরই সন্তান। সে হবে তোমার মত- শোষিত,বঞ্চিত মানুষের কাছের একজন।

অনির্বাণ,তোমার নামেই তোমার পরিচয় কারণ অনির্বাণরা কখনো হারিয়ে যায় না ।

------------------------------------------------------------------


লিখেছেন- প্রাচীন



(বন্ধুরা, গল্পটি কেমন লাগলো সেটা আপনার কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিন। আপনার কমেন্টটি হয়তো লেখককে আরও সুন্দর সুন্দর গল্প
লিখতে অনুপ্রাণিত করবে। আর গল্পটি ভালো লাগলে ‘like’ করতে ভুলবেন না যেন!)



গল্পটি নেয়া :     https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/অনিঃশেষ-অনির্বাণ/209895625757261 

No comments:

Post a Comment