Friday, April 13, 2012

খোলা চিঠি [collection of love stories - 23 ]


খোলা চিঠি

হৃদি,
তুমি প্রায়ই বলতে,তোমাকে যেন আমি চিঠি লিখি। আমি বলতাম-আমি ভালবাসার চিঠি লিখতে পারি না,এই মোবাইল, ফেইসবুকের যুগে চিঠি লিখে আমি কি করব, তোমাকে দিব? না, তোমাকে দিব না,তুমি পড়লে হাসতে হাসতে মারা যাবে, অনেক বানান ভুল থাকবে সেগুলো ধরবে আর আমাকে পচাবে সুতরাং আমি চিঠি লিখবো না, মজা করে বলতাম-চলো মোবাইল ফেলে দিয়ে আমরা আগের যুগের মত চিঠি লিখে প্রেম করি। চিঠি লিখতে অস্মমতি জানালাম বলে আমার সাথে টানা দুইদিন কথা বললে না,এত অভিমানি কেন তুমি। নিজেও কষ্ট পেলে আমাকেও কষ্ট দিলে। তুমি আসলেই একটা পাগলী, কষ্ট পাবে তবুও আমাকে কষ্ট দিবে, ভালবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে তোমার এত ভাল লাগে কেন...?
তোমার মনে আছে, আমরা প্রথম যেদিন দেখা করেছিলাম। একটা খোলা মাঠের মাঝখানে, ঐদিন ছিল পূর্নিমা,একদিকে সূর্য লালিমা ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছিল আর অন্যদিকে চাঁদমামা হাসতে হাসতে যেন আমার ভালবাসার আগমনি বার্তা শোনাচ্ছিল। তুমি বলেছিলে এখন থেকে প্রতিবছর এই দিনে আমরা এখানে দেখা করবো। ছোট্ট একটি কথার এত শক্তি আমি বুঝিনি,যে আমি পৃথিবীর কারো কথা শুনি না মানি না,সেই আমি তোমার মুখ থেকে যেদিন ঐ কথাটা শুনেছিলাম সব কিছু কেমন যেন উল্টা-পাল্টা হয়ে গেল, আমার ছন্নছাড়া জীবনটা কেমন যেন গোছালো হয়ে গেল,আমিও এটাই চেয়েছিলাম কেউ যেন এসে তার মত করে আমার জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়। তুমি প্রায়ই বলতে আমি নাকি অপরিণত (immature) একটা ছেলে,আমাকে নাকি তোমার পাশে বাচ্চা বাচ্চা লাগে এবং অনেক বোকা। আসলেই আমি অনেক বোকা এবং পাগলাটে টাইপের একটা ছেলে কিন্তু সেটা যে আমি কার জন্য হয়েছি এটা কি তুমি কখনো পরখ করে দেখেছ...?
আজ না আমার মনটা অনেক খারাপ,পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে এই জন্য না, আমার মাএর জন্য। কত আশা করে বসে আছে,আমি পাস করে চাকরি পেয়ে আস্তে আস্তে তার দুঃখ দূর করবো, তার জন্য আমাকে আরো তিনমাস থাকতে হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পরীক্ষাটার আগে বলেছিলে তোমাকে আর ফোন না দিতে, তোমার সাথে আর যোগাযোগ না করতে, তুমি মুক্তি চাও,তুমি পালাতে চাও। এই খারাপ রেজাল্টের জন্য আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। আমার জ্বর ছিল, তারও দোষ দিব না। আমিতো এমনিতেই পড়ালেখা করি না, তারপরেও ঐ পরীক্ষার আগে আরো বেশি পড়ার চেষ্টা করছি যেন খারাপ রেজাল্টের জন্য তোমার কোন দোষ না হয়। আমার হাতে তোমার জন্য যে দুই বছর সময় আছে তার থেকে আমার তিন মাস সময় কমে গেল। আমি আমার জীবন থেকে তিনমাস পিছিয়ে গেলাম। তুমি ভয় পেও না, আমি এই তিন মাস কঠোর পরিশ্রম দিয়ে পূরণ করে নিব,যেন তুমি আমার কাছে আসার পরে দুঃখ না করতে পার যে তোমার জন্য আমার জীবন থেকে তিনটা মাস হারিয়ে গেছে।
আজও আমি যখন ফেইসবুকে ঢুকি তোমার প্রোফাইল খুলে বসে থাকি। তুমি আমাকে তোমার ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে রিমুভ করেছ তাতে কি,তোমার প্রোফাইলের কিছুই দেখতে পারি না,কিন্তু নামটাও অন্তত দেখা যায়, তাও আমার দেখতে ভাল লাগে। তুমি যেসব পেজ দিয়ে ঘুরাঘুরি করতে আমি এখনো সেই পেজগুলোতে খুজে বেড়ায় তোমার কোন মন্তব্য, তোমার কোন লাইক আছে নাকি। প্রতিদিন কতবার যে তোমার মোবাইল নাম্বার লিখে সেন্ড বাটনে হাত দিয়ে বসে থাকি কিন্তু প্রেস করি না। বিশাল বিশাল মেসেজ লিখি মোবাইলে,ফেইসবুকে, লিখে আবার আস্তে আস্তে মুছেও ফেলি। সেন্ড করার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্বেও তুমি বিরক্তি বোধ করবে বলে আর সামনে এগোয় না।
তোমার স্মৃতি বলতে আমার সাথে তোমার বলা কথাগুলো,যা কানের কাছে সারাক্ষণ বাজতে থাকে, কম্পিউটারে কিছু ছবি আর আমার মোবাইলে রেকর্ড করা তোমার গাওয়া একটি রবীন্দ্রসংগীত আছে। তোমাকে বলতাম তোমার কথা না শুনলে রাতে আমার ঘুম আসে না,সকালে তোমার ফোন না পেলে আমার ঘুম ভাঙ্গে না, তাই তুমি প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোন দিতে আর আমাকে সকালে ঘুম থেকে তুলে দিতে। এখন ক্লাস নেই তাই সকালে উঠার তাড়া ও নেই তবুও খুব ইচ্ছা করে তোমার ফোনে যেন আমার ঘুম ভাঙ্গে। যখন মনটা অধিক ব্যাকুল হয়ে যায় তোমার সাথে কথা বলার জন্য,তোমার একটু কণ্ঠ্য শোনার জন্য তখন তোমার গাওয়া আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুলএই গানটা শুনি আর তোমার ছবিগুলো দেখি। তোমার কি মনে আছে গানটা তুমি আমাকে কবে গেয়ে শুনিয়েছিলে ? এখন মনে হয় তুমি ফেইসবুকে আরো অনেক নতুন ছবি আপলোড করছ, না? কতদিন হল তোমার কোন নতুন ছবি দেখি না। আচ্ছা তুমি কি আমার স্মৃতিগুলো সব নষ্ট করে ফেলেছ...?
হঠাৎ তুমি একদিন বললে-চল আমরা এক সপ্তাহ কথা না বলে থাকি। আমি বললাম- একদিন ও পারবো না। কিন্তু তোমার জোরাজুরিতে রাজি হলাম,আমার বিশ্বাস ছিল তুমিও একদিনের বেশি পারবে না,ঠিক তাই হল পরদিন রাতে আমাকে ফোন দিয়ে বললে আর পারছি না। অথচ দেখো এই কতদিন হয়ে গেল তুমি আমাকে ফোন দাও না। আমার না বিশ্বাস করতে অনেক কষ্ট হয়, একটা মানুষ এত সহজে কেমনে বদলে যায়...?
তুমি এই ভেবে কষ্ট পেও না যে আমি কষ্ট পাচ্ছি,তোমাকে পাওয়ার জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি। আর আমি ভালই আছি। তুমিও ভাল থেকো, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা করো। না এই চিঠিটা আমি তোমাকে পাঠাবো না, কত আজে বাজে প্যাচালে ভরা এত বড় একটা চিঠি দেখে তোমার মেজাজ খারাপ হবে। এই বিরক্তটুকুও তোমাকে করতে চায় না। চিঠিটা যেভাবে লিখছি সেভাবেই আমার ডায়েরীর পাতায় বন্ধী থাক। যদি জীবনে কোনদিন তোমাকে আপন করে পায়, তোমাকে দেয়া কথা রাখতে পারি সেইদিন প্রথম দেখাতেই তোমাকে তোমার অনেক চাওয়ার এই চিঠিটা উপহার স্বরূপ দিব। ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করবেতো পাগলী...?

উৎসর্গঃ সিলেটবাসী এক পাগলীকে……

লিখেছেন- ধুতু

পদ্ম পাতার জলে যে ভালোবাসা...... [ Collection of Love stories - 22 ]


পদ্ম পাতার জলে যে ভালোবাসা......


এক্সকিউজ মি বস ইউ হ্যাভ আ টেক্সট মেসেজ।

ঘুম ভেঙ্গে গেল হাসানের। ধুর, এতো সকালে কে মেসেজ পাঠায়। ঘুমাতে ঘুমাতে তার এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে, এতো সকালে মেসেজ পেয়ে ঘুম ভাঙ্গায় তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল।

ঘুম জড়ানো চোখে এদিক সেদিক হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা খুঁজে নেয় সে। এয়ারটেল!!! ধুর,...... খারাপ একটা গালি উচ্চারণ করে মোবাইল টা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে সে। শুভ নববর্ষের মেসেজ। মেজাজ এখন তার সপ্তমে উঠল। গতরাতে সে পরিকল্পনা করেছে আজকে সারাদিন ঘুমাবে, নববর্ষের কথা মাথা তেই আনবে না, মাকেও বলে রেখেছে তাঁকে সকালে না ডাকতে, আর ঘোড়ার ডিম এয়ারটেল তাঁকে সকালে ঘুম তো ভাঙ্গালই আবার দিনটির কথাও মনে করিয়ে দিল। বিরক্তির চিহ্ন এনে মুখে বালিশ চাপা দিল সে। ঘুমানোর অনর্থক চেষ্টা। কাল রাতে ঘুমোতেই তার অনেক কষ্ট হয়েছে আর এখন এই সকাল বেলা ঘুমানোর চেষ্টা করা যে নিরর্থক তাও সে বুঝতে পারছে, তবু চেষ্টা করে যাওয়া।

এক্সকিউজ মি বস ইউ হ্যাভ আ টেক্সট মেসেজ।

সেলফোনটার দিকে এবার তাকিয়ে রইল হাসান। এখন কে মেসেজ দিতে পারে? বন্ধুদের কাউকে সে এমন শুভেচ্ছা পাঠায় না, বন্ধুদের আবার শুভেচ্ছা কি? তাঁরা তো আর দূরের কেউ না। তবে কে পাঠাল মেসেজ টা? বুক টা হটাত কেঁপে উঠে তার। ও না তো? কিন্তু বাস্তব বাদী মনটা বাঁধা দিল তাকে, ও হবে কেন? সব তো চুকে বুকেই গেছে। নিজের উপরি বিরক্ত হল হাসান। নিজেকে অনেক সেলফ কন্ট্রোলড ভাবতো সে, কিন্তু সে জানে তার এই ক্ষমতা আশেপাশের মানুষ দের চোখে একটা ধুলোর মতো। এই ক্ষমতা সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। সেল ফোনটা তোলার সময় বুকের ভিতর একটা বাড়ি খাবার শব্দ শুনতে পায় সে। নাহ, ও না। শাকির মেসেজ দিয়েছে। কুত্তা, তুই সকাল বেলায় ডেটে যাবি যা, আমারে মেসেজ দিয়া ঘুম ভাঙ্গানোর দরকার টা কি তোর, আমি কইছি আমি বাইর হমুনা; মনে মনে চিন্তা করতে করতে মেসেজ টা খুলে সে। না, বের হবার জন্য বলে নি, শাকির জিজ্ঞেস করছে আজকের পত্রিকায় যে হাসান যুবায়ের এর কবিতা ছাপা হয়েছে সেটা সে কিনা? হাসান একটু অবাক হল। এই শালা আবার সাহিত্য পাতা কবে থেকে পড়ে? নাকি প্রেম করছে বলে আঁতেল গিরি শুরু করেছে। নাহ, আর বিছানায় থাকা যায় না। উঠে বসে হাসান। ড্রয়িং রুমে খোঁজ করে পত্রিকা। আহা, নববর্ষ। মানুষের কত তেল? পুরোটা পত্রিকা জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব। সে সাহিত্য পাতায় চলে যায়। একি, ঠিক ই তো দেখি তার কবিতা ছাপা হয়েছে। একদম প্রথম পাতায়, হালকা রঙ্গে হাইলাইট করে বক্স করে ছাপা। শুধু তার একার কবিতাই ঐ বক্সে। হাসান জানে, এটা রেয়ার ঘটনা। প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতাও এভাবে ছাপা হয়না বেশি, সেখানে তার মতো একজনের লিখা কবিতা এভাবে ছাপা হওয়া!!! অবাক হল সে।

আজ বসন্তের শেষে

বেশ বড় কবিতা। পত্রিকা টা রেখে দেয় সে। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সামনের চুল গুলোতে আনমনেই আঙুল চালায়। পিছনের চুলগুলো টেনে লম্বা করার চেষ্টা করে। নিজের চেহারার দিকে তাকায়। রাত জাগার ছাপ চোখে মুখে। ভালো করে পানির ঝাপটা দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় হাসান। বের হয়ে আসে। এক কাপ চা চেয়ে নেয় মায়ের কাছ থেকে। চায়ের ব্যাপারে সে অনেক খুঁতখুঁতে, তাই চা বানানোর পুরোটা সময় সে মায়ের কাছাকাছি থাকে। চা টা নিয়ে পত্রিকা টা হাতে নেয়।

শীতের জীর্ণতার পথ ধরে এসেছিল ফাগুন
অনলের বৃন্দাবন পেরিয়ে রাধাচূড়ার ডালে

রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া। লাল রঙ, আগুন লাগা ফাগুন। কিছু শব্দ, কিছু কাব্য। কিন্তু তার কাছে?? জীবন। চায়ের কাপটা হাতে তুলে নেয় হাসান।


কি মামা আজকে কার লগে চালাও? শাকির কে চ্যাট এ নক করেই প্রশ্নটা করে হাসান। সাথে জিব বের করা ইমো। ফেসবুকে নতুন করে চ্যাট শুরু করেছে সে, মোবাইল দিয়ে চ্যাট করার সময় এইসব ইমো দেয়া যেত না, ল্যাপটপ এ চ্যাট করার সময় তাই কিছু হলেই এই ইমো টা সে ব্যাবহার করে।
ধুর ব্যাটা, আমি কি তোর মতো লুইচ্ছা নাকি? শাকির তড়িৎ জবাব দেয়। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস তাদের হাতের দ্যোতনায় কম্পিউটারের মনিটরে উছলে পড়ে। শাকির জিগ্যেস করে তুমি কার লগে চালাও মামা? সে একটা জিব বের করার ইমো দেয় আবার। অর্থাৎ সে বলবে না। শাকির ও আর কথা বারায় না। সে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।

জীবন কত সুন্দর। সামনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, স্বাধীনতা। যার জন্যে সেই ছোটকাল থেকে স্বপ্ন বুনে যাওয়া। সে আজ মাত্র কয়েকদিনের দূরত্বে। দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি তে সুযোগ পাওয়া, স্বপ্নে যেন আরও বেশি রঙ চড়া। আহা, আনন্দ শুধু আনন্দ। হাসানের রাতগুলো এখন পুরো অন্যরকম। একসাথে কয়েকটি মেয়ের সাথে তার চ্যাট হয়। প্রতিদিন, কখনো নতুন কারো সাথে পরিচয় ঘটে। সবাই ক্লাস শুরু হবার জন্য দিন গুনছে। ভার্সিটির নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই সবার সাথে পরিচয়। অপর্ণার সাথে পরিচয়টাও তখনি। আলাদা কিছু মনে হয়নি, তবে চ্যাট ওর সাথেই বেশি হতো তার। একটা, দুইটা, সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ও তাদের চ্যাট চলতে থাকা। হাবিজাবি বিষয় থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। কি নাই তাদের বিষয়ে।

হাসান চায়ের কাপে দ্রুত চুমুক দেয়। হেলান দিয়ে বসে সে। কবিতার দিকে তাকায়।

ধুকধুক বয়ে চলা হৃৎপেশীর অলিন্দে সেই ফাগুন ছুটিয়েছিল নবরক্তের ধারা...

হ্যাঁ, ক্লাস শুরু হবার পর দেখা হওয়া। ১৪১৭ এর ফাগুন যেন নিজের জীবনের ফাগুন হয়ে ধরা দিল হাসানের কাছে। আহামরি কিছু তো সে নয়, তবু তার মাধুর্য তে হাসান মুগ্ধ হয়ে গেল। জীবনে প্রথম বারের মতো। শাকির কে দেখেছে সে স্কুল থেকে প্রেমে পড়ছে তো পড়ছেই। কিন্তু কাছের বন্ধু হয়েও সে তার পথ ধরেনি। কিন্তু আজ দূর্বার তারুণ্যের কাছে সে মার খেয়ে গেল।

সে ধারার গাহনে নির্জীব প্রাণের নবস্পন্দনে অবরুদ্ধ মন যে আমার ভাঙল শিকল কারা

ফাগুন, কৃষ্ণচূড়ার কলি। গাছের তলায় পড়ে থাকা লাল রঙের ফুল গুলো যেন তার হৃদয়ের রক্তে রেঙ্গেছে। নিজেকে টাফ গাই ভাবতো সে, কি হল আজ? হাসান যুবায়ের, স্কুল কলেজে মেয়েদের ধারে কাছেও যে ভিড়ত না সে আজ প্রেমের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমন নয় তার গাটস নেই, আসলে ঐসব তার ভালো লাগত না। কিন্তু এখন? পড়াশুনা শিকেয় উঠল হাসানের। রাত জেগে কথা বলা, দুইটার ঘড়ির কাঁটা ক্রমশঃ চারটায় পৌঁছান। কথা আর শেষ হয়না। অপর্ণা অবাক হতো। তোর কি অনেক টাকা? বাংলালিংক থেকে এয়ারটেলে কল দেয়া। প্রতিদিন একশ তো খরচ হতই। তবে প্রশ্নের জবাবে হাসান শুধু হাসত। পরে অবশ্য এয়ারটেল নেয় সে।

ঐ সময়েই শাকির প্রেমে পড়ল। তার জীবনে তৃতীয় বারের মত। তবে বুঝা গেল, এবার তাকে আসল প্রেমে ধরেছে। আগে প্রেমে পড়লেও তার রেজাল্ট খাওয়া ঘুমের কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার তার সব কিছু গিয়েছে। বাল্যকালের দুই বন্ধুর জীবন অন্য সব বাঁকের মতো এখানেও এসে মিলে গেল। সাথে জুটল আরেক বাল্যবন্ধু রশিদ। তিনজনের জীবন যেন একি সুতায় গাথা। তিন জন ই প্রেমে হাবুডুবু। সারাদিন ক্লাস করে টিউশনি, তারপর বাসায় ব্যাগ টা রেখেই নিচে নেমে এসে খাল পাড়ে বসে আলপনা জল্পনা করা। কবে বলবে, কিভাবে বলবে। ক্যামনে বলবে? আর বুকের ভিতর কাঁপন। অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালো লাগা। অবশেষে রাত জেগে ফোনে কথা বলা। হাসান, শাকির আর রশিদের জীবনটা হয়ে গিয়েছিল একরকম, পুরো ছকে বাঁধা। তবে দুর্ভাগ্যবশত সেটা প্রেমের ছক, পড়াশুনার নয়। মাঝে মাঝে অবশ্য ক্লাস এক্সামের মার্কস গুলো তাদের কে মাটিতে নামিয়ে আনত। তবে টা ঘণ্টা খানেকের জন্যই শুধু। এভাবে গেল ফাগুন, তিনজনের অগ্রগতি একি রকম। তাঁরা তাদের পছন্দের মানুষের খুবই ভালো ফ্রেন্ড। তবে তিন মূর্তির কাছে তো এই বন্ধুত্বের সংজ্ঞাই অনেক অনেক বড়... এটাই তো তাদের ক্রমশঃ বুনে চলা স্বপ্নের রঙিন সুতা।

বৈশাখের আগমনী বার্তা শহর জুড়ে। হাসানের মতো তিন জন ই ঠিক করল সেদিন ই হবে নিবেদন। কত উন্মাদনা তা নিয়ে, পাঞ্জাবি কেনা নিয়েই তো কত গল্প। কোনও পাঞ্জাবি ই মনে ধরেনা। অবশেষে সেই দিন। সকাল বেলায় তীব্র উত্তেজনা নিয়ে বের হওয়া। ক্যাম্পাসে পৌঁছান, তাকে দেখে বুক চেপে ধরা। হাসান বুকের ভিতর সেই উত্তেজনাটা এখনো অনুভব করে।

নাহ, শাকির আর রশিদ এর মতো সেদিন হাসান বলতে পারেনি। আর তাদের দুইজনের প্রত্যাখ্যাত হওয়া দেখে পরের দুটো মাস বলার সাহস ও করেনি। এজন্যে তার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। অবশ্য তাদের বন্ধুত্ব সীমা ছাড়িয়েছে এর মাঝে। কথায় কথায় ফোন, টেক্সটিং কিছুই আর বাকি রইল না। বৃষ্টির রাতে বৃষ্টি নিয়ে উন্মাদনা, ভরা জোছনায় হৃদয় আটকানো কথার কাপাকাপি, ক্লাস শেষে মাঠের দিকটাতে দুইজনের হেঁটে যাওয়া। নাহ, এটা বন্ধুত্বের সীমাতে আর বন্দি নেই। হাসান বুঝতে পারছিল, এতো মানব মানবীর সেই চিরন্তন কাছে আসার গল্প। সে লক্ষ বছরের পুরানো অনুভূতি। সেই জমাট বাঁধা বেদনার আনন্দময় প্রকাশ। ভালোবাসা? হ্যাঁ, এর নামই তো ভালোবাসা!!

প্রকৃতি ও তাদের জন্য যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। নইলে একদিন শুধু তাদের দুইজনের জন্যই কেন কালবোশেখি হবে? তীব্র বাতাসে ঝরে পড়ছে কৃষ্ণচূড়া ফুল, সাদা রঙের মাদক গন্ধমাখা কি এক নাম না জানা ফুল। আর পিচ ঢালা রাস্তায় একাকী তাদের দুইজনের প্রায় অন্ধকারে আস্তে আস্তে হেঁটে যাওয়া। জীবনটা অর্থবহ মনে হয়েছিল সেদিন হাসানের কাছে। প্রকৃতি যেন তাদেরকে নিয়ে এসেছিল একে অপরের কাছে। অচেনা এক ভালোলাগা, একদমই অচেনা!!!

অস্থির চিত্ত আমার প্রণয়ের রঙ্গিন স্বপ্নে,
সে ফাগুনের লগ্নে মেলেছিল দিগন্ত হীন ডানা...

নিজের কবিতার চরণটা পড়তে পড়তে হাসান বাস্তবে ফিরে আসে। কল্পনার মাঝে সেই বিকালটি হটাত উকি দিয়ে হারিয়ে যায়; অপর্ণার মতো!

ঐ সময় শাকির আর রশিদ এর প্রিয় গান চির অধরা। দিন রাত এই এক গানের মধ্যেই ডুবে থাকা। গানটা তখন তার মাঝে আলোড়ন তুলত কি? পরে তুলেছে। সেই রাতের পর।

অপর্ণাকে অবশেষে বলেই ফেলল হাসান। কিন্তু সেই অবাক কণ্ঠস্বর শুনে হাসান এতো অবাক হয়েছিল যে এতো অবাক সে আর কখনই হয়নি। তারপর পেয়েছিল তীব্র কষ্ট। We are just friends. আমি তো কখনই এভাবে চিন্তা করিনি। অপর্ণার এই কথা গুলো যেন হাসানের হৃদয়কে ফুটো করে দিচ্ছিল। তাহলে এতো কাছে আসা, এসবই কি বন্ধুত্ব শুধু? হাসান মেলাতে পারেনা। সে প্রশ্নও সে তুলে না। মিফতাহ এর কথা গুলো কে বুকে ধারণ করে হাসান:

ডাকবে না তুমি আমায় জানি কোনদিন...
তবু প্রার্থনা তোমার জন্য... হবেনা মলিন...

হাসান বসে থাকে সোফার উপর। শাকির প্রত্যাখ্যাত হয়েও পরে ফিরে পেয়েছে, রশিদ ও। সে অমন আশা করেনি। তবু মনের মাঝে ঘুরে ফিরে আসে অপর্ণার কথা, বারংবার। হাসান চোখ বন্ধ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকে। পাশের ঘরে মা টিভি দেখছে। এসো হে বৈশাখ এসো এসো...... মুমূর্ষু রে দাও উড়ায়ে...সেতো মুমূর্ষু, তাকে কি বৈশাখ উড়িয়ে নিবে। হাসান তার কবিতাটার দিকে তাকায়। এক বছরে কত কিছু চেঞ্জ। গত চৈত্র এর শেষ দিন কত উত্তেজনা আর আজ পহেলা বৈশাখে সে একাকী বসে আছে বাসায়...
হাসান নিজের কবিতার শেষ চরণটি মনে মনে পড়ে...

আমি হাসব না, মাতব না এই নতুন বৈশাখে...


লিখেছেন- Rizwanur Rahman Abeer