আমার বন্ধু রিয়ান -শেষ পর্ব
কি তবে অশরীরী কিছু একটা?? আর কিছু ভাবতে
পারলাম না ঠান্ডার মধ্যে ভয়ে শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। কোন মতে কাপতে
কাপতে বাড়িতে ঢুকলাম। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছি;চাচা-ফুপু ও ভাইবোন গুলোর সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারলাম না। সারাক্ষণ এক ধরনের
অস্বস্তি লেগেই থাকলো। অনেক কষ্টে বাবাকে বুঝিয়ে পরদিন ঢাকার পথে রওনা হলাম।
বিকালে ঢাকার বাসায় ঢুকলাম আমি একা। সারাদিন জার্নি করে এসেছি তাই বিকালে আর
কোথাও গেলাম না। বাসায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলাম। রিয়ানের আম্মাকেও ফোন দিলাম না
কারণ জানি রিয়ানকে পাওয়া যায়নি। সন্ধার পর অস্বস্তি কাটাতে টিভি দেখতে বসলাম।
এবার খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পড়ে গেছে ঢাকায়। বাসায় বসেই হাত পা জমে যাওয়ার
যোগাড় হয়েছে। ফোন বাজতেই রিসিভ করলাম। পাড়াঁত বড়ভাই ফোন করেছে;আড্ডা দিতে ডাকলো. সারাবিকেল তো বাসায় বসে ছিলাম তাই কিছু
না বলে আমিও বের হলাম বাসা থেকে। ফিরলাম একটু দেরি করেই। বাসায় একা, কিছুই তো করার নাই ; একটিভি দেখা ছাড়া। তার থেকে আড্ডা দেয়া ভালো ছিলো। মন ভালোই ছিলো এতক্ষণ,এখন আবার নিজেকে খুব একা মনে হলো। রিয়ানকে মিস করা শুরু
করলাম। লক খুলে বাসায় ঢুকতেই মনে হলো আমি কোন চুলার মধ্যে ঢুকলাম। এত গরম কেন
বাসার ভিতরে আর কি বাজে পোড়া গন্ধ!! ভাবলাম জানলাগুলো আটকানো আছে এজন্য হয়ত গরম
হয়ে উঠেছে ভিতরটা। ভ্যাপসা গরমে মনে হলো সিদ্ধ হয়ে যাবো।আমার রুমে ঢুকে লাইট
জ্বালাতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম!! আমার বিছানায় রিয়ান বসে আছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি
ওর মুখে গলায় কেমন কালো কালো দাগ। মায়াভরা চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে ও আমার দিকে।
বোবার মত নাকি সম্মোহিতের মত আমিও তাকিয়ে আছি ওর দিকে,ঠিক বুঝতে পারছি না। এত গরমের মাঝেও শীতল স্রোত অনূভব করলাম
মেরুদন্ডে। জানি না হয়ত আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই রিয়ান বলে উঠলো “আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না স্বাধীন। শুধু চল আমার সাথে।
প্লিজ চল।” রিয়ান যেহেতু
বলছে আমি অবশ্যই যাবো ওর সাথে কিন্তু এখন রাত মোটামুটি ১টা বাজে; এত রাতে ও আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। বেশ খটকা লাগলো
আমার। এবারও আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই রিয়ান বলে উঠলো ”আমি সময়মত সব বলবো তোকে,এখন চল আমার সাথে। আমার হাতে বেশি সময় নেই।” না বলার মত শক্তি ছিলো না আমার গায়ে। মনে হচ্ছিলো কেউ
স্ট্র দিয়ে বোতল থেকে পেপসি খাওয়ার মত আমার শরীর থেকে সব শক্তি শুষে নিয়েছে।
চুপচাপ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম রিয়ানের সাথে। রিয়ান আমার সামনে হাটছে আর আমি
পিছনে। কেমন আজব এক ধরনের অনূভুতি কাজ করছিলো আমার ভিতরে। খুব বেশিক্ষণ না,আমার অনুমান মত প্রায় ১০ মিনিট হাটার পর খেয়াল করলাম আশে
পাশে কোন বাড়ি-ঘর নেই,রাস্তার লাইট
পোস্টের বাতিগুলোও জ্বলছে না। যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। খেয়াল করিনি কখন
রিয়ান আমার পাশে চলে এসেছে…এখন ও আমার সাথে সাথেই হাটছে, প্রায়
নিঃশব্দে। নিরবতা ভেংগে অন্ধকারের মাঝে একসময় রিয়ানের গলা শুনতে পেলাম। খুব
আস্তে,সময় নিয়ে নিয়ে রিয়ান বলতে শুরু করলো “রাত জেগে রাস্তায় রাস্তায় হাটা আমার স্বভাব। প্রতিদিনের
রুটিন হয়ে গিয়েছিলো আমার সেটা। তুই সবই জানিস।
সেদিন রাতেও বেরিয়েছি হাটতে। রাতের সুনসান নিরবতা আর অবিরত অন্ধকারের মাঝে
নিজেকে খুজতে শুরু করেছি মাত্র,এই তো এই
রাস্তাতেই। তোর সাথে কথা বলছিলাম তখন সাঁ করে একটা জিপ আমার পাশ দিয়ে কিছুদূর
গিয়ে থামলো। এত রাতে একটা জিপকে এই নির্জন রাস্তায় থামতে দেখে আমার ভারী অবাক
লাগলো। ফোনটা কেটে দিয়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনা কি দেখতে। ততক্ষণে কতগুলো লোক জিপ থেকে
একটা মেয়েকে নিয়ে নামলো। মেয়েটার কান্না শোনা যাচ্ছিলো থেকে থেকে। ঘটনা কি ঘটতে
চলেছে বুঝতে পারলাম। মাথায় একটা
চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো কিভাবে মেয়েটাকে বাচানো যায়।
হঠাৎ একটা ছেলে কোথ্থেকে উদয় হয়ে এগিয়ে গেলো জিপটার দিকে। ততক্ষণে লোকগুলো
মেয়েটিকে নগ্ন করে ফেলেছে। ছেলেটিকে দেখে লোকগুলো থেমে গেলো এবং তাদের মধ্যে থেকে
একজন এসে ছেলেটিকে চলে যেতে বললো।
ছেলেটি মেয়েটিকে ওই পশুদের অত্যাচার হতে বাঁচাতে চাইলো, সে ওদের বাধা দেবার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু একা ছেলেটির
পক্ষে এতগুলো লোককে সামলানো সম্ভব ছিলো না, ফলে মার খেতে খেতে দূর্বল হয়ে পড়লো ছেলেটি। লোকগুলো ছেলেটি কে উঠিয়ে নিয়ে
চললো ঔ ইটভাটাটির দিকে” হাত উচিয়ে দিক নির্দেশ করলো আমাকে রিয়ান। ওর কথা মন দিয়ে শুনছিলাম। আশে পাশে
ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নেই। আবছা আলো আধারিতে আশে পাশের মাঠ দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে।
রিয়ানের নির্দেশ করা দিকে তাকাতেই দেখলাম কিছু একটা রয়েছে সেখানে উচু মত; হ্য়ত ইটভাটাই। রিয়ান আবার বলতে শুরু করলো” ইটভাটা টা পুরানো এবং ভাংগা। এখানে এখন আর ইট পোড়াঁনো হয়
না। তবুও ভিতরে পোড়াঁর মত কিছু কাঠ ছিলো। লোকগুলো ছেলেটিকে ইটভাটার মধ্যে ফেলে
জ্যান্তই আগুন ধরিয়ে দিলো। সারা শরীরে উত্তাপ অনূভব করে ছেলেটি, কিন্তু নড়াচড়ার শক্তি না থাকায় কিছুই করতে পারলো না।
অনেক গরম আর অনেক ব্যাথা। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে ছেলেটি, গায়ে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে। একসময় পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে
যায়। আগুনও নিভে যায় আস্তে আস্তে। পুরোপুরি না জ্বললেও শরীরের সিংহভাগই চলে যায়
তার আগুনের দখলে। দগ্ধ লাশটি ওখানেই পড়ে থাকে, কেউ খুজতে আসে না ছেলেটাকে!!”
রিয়ান থেমে যায়।
বলবো বলবো করে বলেই ফেলি আমি “ছেলেটা এভাবে তোর চোখের সামনে মারা গেলো, তুই কেন বাচাতে পারলি না ছেলেটাকে??” রিয়ান কিছু না বলে হাটতে শুরু করে ইটভাটা-টির দিকে।
আমি ডাকি পিছন থেকে ওকে।
রিয়ান তবুও থামে না। হেটেই চলে। গরমে ঘেমে আমি মোটামুটি গোছল করে ফেলেছি। আমি
আবারও ডাকি “রিয়ান দাড়া।
কোথায় যাচ্ছিস?” এবার রিয়ান কথা বলে উঠে “আমার সময় শেষ স্বাধীন। ওখানেই ফিরে যেতে হবে আমাকে। আমার শরীরটা যে ওখানেই
পড়ে আছে সেই কবে থেকে!!! কেউ খুজতে আসে না!!!”
আমার চোখের সামনেই রিয়ান ইটভাটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভোররাত্রির নিরবতা
ছাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে আমি “না! ঐ ছেলেটা তুই কিছুতেই হতে পারিস না রিয়ান!!”
ঠান্ডার মধ্যে শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে উঠে এবার!!
সমাপ্ত
ঘটনাটি জানিয়েছেনঃ রোদেঁশী