আমার বন্ধু রিয়ান-পর্ব-১
রিয়ানকে দুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই প্রথম রিয়ান
আমাকে না জানিয়ে কোথায় যে ডুব মেরেছে বুঝতে পারছি না। সেবার বাড়ি থেকে পালিয়ে
ও যে বান্দরবান গিয়েছিলো তা একমাত্র আমিই জানতাম। আমাদের ক্লাসমেট শান্তা আর
সজীবের রিলেশনের ব্যাপারটা ওদের বাসায় জানিয়ে একটা ঝামেলার সৃষ্টি করেছিলো
রিয়ান,সেটাও একমাত্র আমিই জানতাম। আর সেই রিয়ান দুদিন ধরে কাউকে
কিছু না জানিয়ে কোথায় যে গেছে আল্লাহ মালুম। রাগ লাগছে আমার আবার সাথে সাথে
দুশ্চিন্তাও হচ্ছে ওর জন্য। কোন ঝামেলায় পড়ে নাই তো ও। আর যদি কোথাও যেয়েই থাকে তাহলে
আমাকে বললো না কেন?
কি এমন জরুরী কাজ পড়লো ?? মাঝে মাঝেই
রিয়ান এমন হাওয়া হয়ে যায় তাই ওর বাবা মা তেমন দুশ্চিন্তা করছেন না ; কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোথাও কোন বড় অঘটন ঘটেছে।
ওকে মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না। কোন পজেটিভ নিউজ পাবো না জেনেও রিয়ানের আম্মাকে
ফোন করলাম।
-অ্যান্টি রিয়ানের কোন খোজ পেলেন?
-না বাবা। জানোই তো ও বরাবরই এমন করে। দেখো ঠিকই ৪-৫দিন পর এসে
হাজির হবে।
-জ্বি অ্যান্টি,তাই হবে হ্য়ত। ঠিক আছে রাখি।
অ্যান্টিকে বলতেও পারলাম না যে অন্যবারের মত নিশ্চিত মনে বসে থাকতে পারছি না
আমি। কারণ এবার যে রিয়ান আমাকেই কিছু বলে যায় নাই। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি শেষ
কখন,কি কথা বললাম রিয়ানের সাথে। হ্যা মনে পড়েছে,রিয়ান সেদিন রাতে রাস্তা দিয়ে হাটছিলো যথারীতি অন্যান্য দিনের মত। রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা ওর শখ। হাটতে
হাটতে আমাকে ফোন করেছিলো,কথা বলছিলাম
দুজন।
হঠাৎ রিয়ান “পরে ফোন
দিচ্ছি” বলেই কলটা কেটে দিলো। ব্যস এইটুকুই। তারপর থেকেই ওকে ফোনে
আর পাওয়া যাচ্ছে না। ধ্যাত কারেন্ট চলে গেলো। মোমবাতি জ্বালিয়ে ড্রইংরুমে এসে
বসলাম। আব্বা আম্মা গেছেন ছোটমামার বাসায়। কখন আসবেন ঠিক নেই। ওহ এত গরম লাগছে
কেন আমার। এখন তো শীতকাল!! যদিও শীতের মাত্রাটা কম,কিন্তু গরম লাগার কথা না।ভাপসা গরমের সাথে পোড়া পোড়া গন্ধও পাচ্ছি। মনে
হচ্ছে বাথটাবে বসে থাকি। দরজায় নক করার আওয়াজে চিন্তায় ছেদ ঘটলো। কিন্তু কলিং
বেল না বাজিয়ে দরজায় নক করছে কোন বেকুব। একটু বিরক্তি নিয়েই দরজা খুললাম।
রিয়ান দাড়িয়ে বাইরে!! কোন কথা না শুনে গালাগাল শুরু করলাম ওকে। “কোথায় ছিলি? আর কাউকে নাহোক আমাকে তো বলে যেতে পারতি। কারো কেয়ার তো তুই কখোনোই করিস নাই,ভাবতাম আমার জন্য একটু হলেও দরদ আছে তোর। কিন্তু না,আমাকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করিস তুই। এখন আর চুপ করে দাড়িয়ে না থেকে ভিতরে এসে বোস। বলে আমিই আগে ঘরে ঢুকলাম। সোফায়
বসতে যেয়ে দেখলাম রিয়ান ঘরে ঢোকেনি। দরজায় তাকিয়ে দেখলাম সেখানে কেউ নাই। আরে
একটু আগেও তো রিয়ান ছিলো এখানে। ভীষণ রাগ লাগলো আমার। রিয়ান কি শুরু করেছে এসব। “দরজা খুলে রেখেছিস কেন?” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবা বললেন।“না মানে…” বলতে যেয়েও চেপে গেলাম। বাবা মা পছন্দ করেন না,আমি রিয়ানের সাথে মিশি। কারন রিয়ান আগে ড্রাগ এডিক্ট ছিলো কিন্তু এখন ও
পুরাপুরি সুস্থ, কিন্তু সেকথা বাবা মাকে কে বোঝাবে? চুপচাপ নিজের ঘরে চলে আসলাম। তাহলে কি বাবা মা কে দেখেই
রিয়ান চলে গেল। বাবা মা থাকলে ও বাসায় আসে না।ও জানে বাবা মা চান না আমি ওর সাথে
মিশি। রাগ কিছুটা কমে গেল আমার। কিন্তু রিয়ান এত চুপচাপ ছিলো কেন? ৫ মিনিট ধরে আমি এতগুলো কথা বললাম্, ও না উত্তর দিলো না নিজে থেকে কিছু বললো। তবুও আশ্বস্ত হলাম
এটা চিন্তা করে ও ফিরে তো এসেছে। খুশী হলাম অনেক্,রিয়ান কে ছাড়া আমিও যে অচল। রাতের খাবার খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। নাস্তা খেয়ে ভার্সিটিতে যাবো বলে ফোন দিলাম
রিয়ানকে। ফোন বন্ধ। ফাজিলটা নিশ্চই ফোনে চার্জ দেয়নি। আন্টির মোবাইলে ফোন করলাম।
আমি হ্যালো বলতেই আন্টি বললেনঃ “ কি বাবা রিয়ানের কোন খোজঁ পেলে?”
আন্টির কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। রিয়ান কি তবে বাসায় যায়নি? কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলাম। রিয়ান কি শুরু করেছে এগুলো? কাল রাতে দেখা হলো আমার সাথে ,এখন আবার লাপাত্ত্বা। এই ছেলের কপালে যে কি আছে আল্লাহ
জানে। এতই বেশি রাগ লাগছে আমার যে মনে হচ্ছে রিয়ানের সাথে যোগাযোগ করাই বন্ধ করে
দেই। আর ওকে ফোন দিবো না ডিসাইড করলাম। একাই রওনা দিলাম ভার্সিটির দিকে। সন্ধায়
বাসায় ফিরে শুনলাম বাবা দেশের বাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করছেন। আমরাও যাবো সাথে,৫ দিন পর ঢাকায় ফিরবো। আমার ঢাকার বাইরে যেতে ভালো লাগে না
কিন্তু বাবার উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। পরদিন অনেক সকালে আমরা রওনা হলাম
বাগেরহাটের পথে। পৌছালাম বিকাল ৩টায়। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই ঘুরতে বের হলাম।
ছোট্ট একটি মফস্বল শহর বাগেরহাট কিন্তু খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। রাস্তা ঘাট
চিনি না কিন্তু তবুও হাটতেই থাকলাম। দড়াটানা নদীর তীরে যেতেই এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ভরে গেলো। চুপচাপ
এক গাছের নিচে বসেই সারাবিকেল পার করে দিলাম। শেষ বিকেলের লালচে কালো আভাটুকুও
মিলিয়ে গেলো নদীতে তবুও বসে রইলাম মনোমুগ্ধের মত। ঠান্ডা বাতাসে গায়ে রীতিমত
কাঁপন ধরে গেলো।সকাল থেকে এত ব্যস্ত ছিলাম যে রিয়ানের ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে
গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়ে গেল। নতুন করে ভাবনাগুলো এসে একসাথে ঘিরে ধরলো আমায়।
খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো আমার;অনেক কষ্টে
কান্না থামিয়ে উঠে দাড়ালাম। ওহ! হঠাৎ করে এত গরম লাগছে কেন? এত গরমে মানুষ জামা কাপড় পড়ে থাকে কিভাবে;আমি আবার পড়েছি ফুল স্লীভ টি-শার্ট। মনে হলো একটানে শার্ট
খুলে ফেলি।চুপচাপ হাটতে থাকলাম।একটু সামনে হেটে আসতেই মনে হলো দূরে কেউ গাছের নিচে
কেউ বসে আছে। যে কেউ বসে থাকতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার কেন জানি ভীষন অস্বস্তি লাগতে লাগলো।কারণ যে বসে
আছে তার বসার গড়ন আমার খুব পরিচিত,তার চুলগুলোও লম্বা; ঠিক যেন
রিয়ানের মত। ওটা রিয়ান না তো ?? মনে হলো সেও
আমাকে দেখছে। হাটতে হাটতে ছেলেটির কাছে চলে আসলাম আমি। যা ভেবেছি ঠিক
তাই।রিয়ানই!! কিন্তু ও এখানে কি করছে? আমি বেশ রাগান্বিত হয়েই ডাকলাম “রিয়ান!” রিয়ান খুব
আস্তে,খুবই আস্তে উচ্চারণ করলো “স্বাধীন আমাকে সাহায্য কর” আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর গলার স্বর শুনে। রিয়ানের ভয়েজ তো
এমন কখনোই ছিলো না।এতই আস্তে এবং ফ্যাসফ্যাসে গলা যে ও কি বললো তা বুঝতে আমার
কিছুটা সময় লাগলো।কি বলবো ঐ মূহর্তে ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমার
কাঁধে হাত রাখলো। ফিরে দেখি একটা লোক। আমাকে তাকাতে দেখে জিজ্ঞেস করলো “ভাই কি শহরে নতুন?” “না,আমার দাদাবাড়ি
এখানে। কিন্তু আমরা ঢাকায় থাকি” “তাইলে ভাইজান একটা কথা কই,এই জায়গা খুব একটা সুবিধার না। বাড়িত যান,এইখানে খাড়াবার দরকার কি ? শীতের রাইত, লোকজন কম,কি হয় কওয়া
যায় না।”
এটুকু লোকটা হাটা শুরু করলো। রিয়ানের দিকে ঘুরতেই দেখি ও নেই। নদীর পাড়ে
যতটুকু চোখ যায় দেখি শুধু লোকটি হেটে যাচ্ছে আর আমি দাড়িয়ে আছি।হাওয়ার মিলিয়ে
যাওয়ার মত এত তাড়াতাড়ি রিয়ান গেলো কোথায় ?? একটু একটু ভয় লাগলো আমার। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম রিয়ান আমাকে কিছু বলতে
চায়;বলার জন্যই আসে আমার কাছে কিন্তু সামনে থাকলে চলে
যায়।রিয়ান জানলোই বা কিভাবে আমি এখন বাগেরহাটে।আগে তো ও কখনো আসে নাই এদিকে!!ও
জানতো আমার দাদাবাড়ি বাগেরহাটে,কিন্তু ঠিক
এখানে আসলেই যে আমাকে এখন পাওয়া যাবে তা তো রিয়ানের জানার কথা না!! খাপে খাপ মিলাতে
পারলাম না আমি। মাথা ঘুরতে লাগলো;বাড়ির দিকে
রওনা হলাম আমি।এত ঠান্ডা লাগছে যে গরম কাপড় পড়ে বের হলাম না কেন ভাবছি। একটা কথা
খেয়াল করা মাত্রই আমার গাঁ শিরশির করে উঠলো। ঢাকায় আমার বাসায় যেদিন রিয়ান
এসেছিলো ঔদিন ঠান্ডার মাঝেও অস্বাভাবিক গরম লেগেছিলো আমার এবং আজও লাগলো। রিয়ান
চলে যাবার পর আবার ঠান্ডা লাগা শুরু করলো!!এমন কেন হলো? রিয়ান কি তবে অশরীরী কিছু একটা??আর কিছু ভাবতে পারলাম না ঠান্ডার মধ্যে ভয়ে শরীর আরো
ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো।
১ম পর্ব সমাপ্ত
ঘটনাটি জানিয়েছেনঃ রোদেঁশী
No comments:
Post a Comment