Saturday, May 15, 2021

দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম

 

দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

 

(১৪৩৩ হি. শাবান মাসে এক খাছ মজলিসে এক বিশেষ উপলক্ষে আদীব হুজুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। মুসাজ্জিলা থেকে তা পত্রস্থ করা হল)

***

কিছু দিন আগে আমার এক প্রিয় তালিবে ইলম দেখা করতে এসে বললো, হুযূর, আগামী পরশু আমার বিবাহ। চমকে উঠে তাকালাম। বড়বে-চারামনে হলো। কারণ আমিও একদিন বড় অপ্রস্ত্তত অবস্থায় জেনেছিলাম, আগামীকাল আমার বিবাহ! ভিতর থেকে হামদরদি উথলে উঠলো। ইচ্ছে হলো তাকে কিছু বলি, যিন্দেগির এই নতুন রাস্তায় চলার  জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পাথেয়, আল্লাহর তাওফীকে তাকে দান করি। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া আমরা কেই বা কী করতে পারি!

তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিবাহের জন্য কী প্রস্ত্ততি নিয়েছো? বড় ভোলাভালা নও জোয়ান! সরলভাবে বললো, আমার কিছু করতে হয়নি, সব প্রস্ত্ততি আববা -আম্মাই নিয়েছেন। কেনা-কাটা প্রায় হয়ে গেছে, শুধু বিয়ের শাড়ীটা বাকি।

অবাক হলাম না, তবে দুঃখিত হলাম, আমার এই প্রিয় তালিবে ইলম এখন একজন যিম্মাদার আলিমে দ্বীন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের ছোহবতে ছিলো, তার কাছে বিবাহের প্রস্ত্ততি মানে হলো জিনিসপত্র এবং বিয়ের শাড়ী! তাহলে অন্যদের অবস্থা কী?!

বড় মায়া লাগলো; বললাম, দেখো, মানুষ যে কোন কাজ করতে চায়, প্রথমে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজটির হাকীকত উদ্দেশ্য কী? কাজটি আঞ্জাম দেয়ার সঠিক পন্থা কী? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলোর সমাধান কী? এগুলো জেনে নেয়। এজন্য দস্ত্তর মত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আয়োজন আছে, এমনকি বাস্তব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে।

অথচ জীবনের সবচেকাঠিন জটিল অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে, বরং বলতে পারো ঝাঁপ দেয়, কিছু না শিখে, না জেনে এবং না বুঝে একেবারে অপ্রস্ত্তত অবস্থায়। ফল কী হতে পারে?! কী হয়?! অন্যদের কথা থাক, চোখের সামনে আমার জন ছাত্রের ঘর ভেঙ্গে গেলো! একজনের তো এমনকি দুজন সন্তানসহ। কিংবা ঘর হয়ত টিকে আছে, কিন্তু শান্তি নেই। স্বাভাবিক শান্তি হয়ত বজায় আছে, কিন্তু বিবাহ যে দুনিয়ার বুকে মানবের জন্য আল্লাহর দেয়া এক জান্নাতি নেয়ামত, সুকূন সাকীনাহ, সে খবর তারা পায়নি, শুধু অজ্ঞতার কারণে, শুধু শিক্ষার অভাবে।

আশ্চর্য, মা-বাবা সন্তানকে কত বিষয়ে কত উপদেশ দান করেন; উস্তাদ কত কিছু শিক্ষা দেন, নছীহত করেন, কিন্তু জীবনের সবচেকঠিন জটিল বিষয়টি কেন যেন তারা সযত্নে এড়িয়ে যান!

তাকে বললাম, যদিও তুমি উদ্দেশ্যে আসোনি তবু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, যা ইনশাআল্লাহ আগামী জীবনে তোমার কাজে আসবে।

খুব জযবা ছিলো, অবেগের তোড় ছিলো, ‘দিল কো নিচোড় ক্যর’, বাংলায় যদি বলি তাহলে বলবো, হৃদয় নিংড়ে, কিন্তু দিল কো নিচোড়না-এর ভাব হৃদয় নিংড়ানোতে আসবে কোত্থেকে! যাক, বলছিলাম, হৃদয়টাকে নিংড়ে কিছু কথা তাকে বলেছিলাম। পরে আফসোস হলো যে, কথাগুলো তো সব হাওয়ায় উড়ে গেলো, যদি বাণীবদ্ধ করে রাখা যেতো কত ভালো হতো! হয়ত আল্লাহর বহু বান্দার উপকারে আসতো। শেষে বললাম, এককাজ করো, কথাগগুলোর খোলাছা কাগজে লিখে আমাকে দেখিও।

আগামী পরশুর বিয়ের খবর দিয়ে ছেলেটা সেই যে গেলো, তিন বছরে আর দেখা নেই! দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় দরসেও আমি অনেক কথা বলেছি।সবচেবেশী বলেছি আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্র (বর্তমানের হাতিয়ার হুযূর) মাওলানা আশরাফ হালীমীকে, আশা করি তিনি সাক্ষ্য দেবেন, অনেকবার বলেছেন, আমার কথাগুলো তার জীবনে বে-হদ উপকারে এসেছে। আরো অনেকে বলেছে, কিন্তু কথাগুলো কেউকলমবন্দকরেনি।

তো এখন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তোমাদের মজলিসে কথাগুলো আবার বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, সেই আবেগ জযবা তো এখন নেই যা প্রিয় তালিবে ইলমকে বলার সময় ছিলো। আবেগভরা দিলের কথা তো রসভরা ইক্ষু, আর শুধু চিন্তা থেকে বলা কথা হলো রস নিংড়ে নেয়া ইক্ষুর ছোবা! তবু কিছু না কিছু ফায়দা তো ইনশাআল্লাহ হবে।

আমি আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, এখন তোমার জীবনের এই যে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে উর্দূতে এটাকে বলে ইযদিওয়াজী যিন্দেগী, বাংলায় বলে দাম্পত্য জীবন, অর্থাৎ এটা জীবন যিন্দেগির খুবই এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জটিল ঝুঁকিপূর্ণ। এটা তোমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য বলছি না; প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি গ্রহণ পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য বলছি, যাতে পূর্ণ আস্থা সাহসের সঙ্গে তুমি তোমার এই নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে সবই সহজ।

এটা যে শুধু তোমার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়! আমার জীবনেও হয়েছে, আমার মা-বাবার জীবনেও হয়েছে! তোমার মা-বাবাও একদিন জীবন শুরু করেছিলেন। যদি সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মাকে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, কীভাবে তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন? জীবনের শুরুতে তারা কী ভেবেছিলেন, কী চেয়েছিলেন, কী পেয়েছেন?

কখন কী সমস্যা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। এই জীবনের শুরুতে তোমার প্রতি তাদের কী উপদেশ? এধরনের সহজ আন্তরিক আলোচনায় সংসার জীবনের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। অবশ্য সব মা-বাবার সঙ্গে সব সন্তানের এমন সহজ সম্পর্ক থাকে না, তবে থাকা উচিত। জীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সন্তান মা-বাবার কাছেই আসবে, মা-বাবাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করবে, বন্ধুবান্ধবকে নয়। কঠিন সমস্যার মুখে একজন অপরিপক্ব বন্ধু কীভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারে! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, হয়ত কোন জটিলতায় পড়েছে; তখন তাদের প্রথম চেষ্টা হয় যে, মা-বাবা যেন জানতে না পারে, কারণ তাদের কানে গেলে সর্বনাশছেলে তার বন্ধুর শরণাপন্ন হয়, মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে বলে, তারা তাদের মত করে পরামর্শ দেয়। ফলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়।

অতীতে যাই ছিলো, এখন তো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, মা-বাবার জন্য সন্তানের বন্ধু হওয়া। বিপদে সমস্যায় সন্তানকে তিরস্কার পরে করা, আগে তার পাশে দাঁড়ানো। তাহলে সন্তান আরো বড় অন্যায় করা থেকে এবং আরো গুরুতর অবস্থায় পড়া থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা হলো, সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, বন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে। আমার ছেলেকে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি এবং আশা করি, কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। অনেক সমস্যা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, কারণ সবার আগে সে আমার কাছে এসেছে, আর আমি বলেছি, ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। আগে তাকে সাহায্য করেছি, তারপর প্রয়োজনে দরদের সঙ্গে তিরস্কার করেছি, বা শিক্ষা দিয়েছি। বন্ধুর কাছে আগে পাওয়া যায় সাহায্য, মা-বাবার কাছ থেকে আগে আসে তিরস্কার। তাই সন্তান সমস্যায় পড়ে মা-বাবার কাছে আসে না, বন্ধুর কাছে আসে। এভাবে নিজের কারণেই সবচেকাছের হয়েও মা-বাবা হয়ে যায় দূরের, আর দূরের হয়েও বন্ধু হয়ে যায় কাছের। সন্তানের সমস্যা বন্ধু জানে সবার আগে। মা-বাবা জানে সবার পরে, পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তখন।

তো আমি আশা করছি, জীবনের অন্যসকল ক্ষেত্রে যেমন তেমনি, আল্লাহ না করুন দাম্পত্যজীবনে যদি কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে সন্তান সবার আগে আমার কাছে আসবে, তার মায়ের কাছে আসবে, আমাদের উপদেশ, পরামর্শ নেবে।

আলহামদু লিল্লাহ, সেই রকমের সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই সন্তানের সঙ্গে আমার, আমাদের।

আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বললাম, কথা অন্য দিকে চলে গেছে, তো এই প্রসঙ্গে তোমাকে একটি আগাম নছীহত করি; আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী, দুদিন পরেই হয়ে যাবে, মা এবং বাবা। সেটা তো জীবনের আরো কঠিন, আরো জটিল অধ্যায়। আমি প্রায় বলে থাকি, প্রাকৃতিক নিয়মে মা-বাবা হয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শিক্ষা দীক্ষা। তো তোমরা দুজন জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করো যে, একটি মেয়ে কীভাবে একজন আদর্শ মা হতে পারে এবং একটি ছেলে কীভাবে একজন আদর্শ বাবা হতে পারে! আগে বলেছিলাম একটি নছীহত, এখন বলছি দুটি নছীহত।

সন্তানের সামনে কখনো তার মাকে অসম্মান করো না। তোমাকে মনে রাখতে হবে, সে তোমার স্ত্রী, কিন্তু তোমার সন্তানের মা, তোমার চেয়েও অধিক শ্রদ্ধার পাত্রী। সন্তান যেন কখনো, কখনোই মা-বাবাকে ঝগড়া-বিবাদ করতে না দেখে। নছীহত আমি তোমাকে করছি, আল্লাহর শোকর নিজে আমল করে। আমার বড় সন্তানের বয়স ত্রিশ বছর, এর মধ্যে কখনো সে আমাদের বিবাদ করতে এমনকি তর্ক করতেও দেখেনি। দ্বিতীয়ত  তোমরা উভয়ে সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বন্ধু যাকে নিজের মনের কথা, সব কথা নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারে।

আগের কথায় ফিরে আসি; আগামীপরশু তোমার বিবাহ। তার মানে, আজ তুমি নিছক একটি যুবক ছেলে, অথচ আগামী পরশু হয়ে যাচ্ছো, একজন দায়িত্ববান স্বামী। কত বিরাট পার্থক্য তোমার আজকের এবং আগামী পরশুর জীবনের মধ্যে। বিষয়টি তোমাকে বুঝতে হবে। কেন তুমি বিবাহ করছো? বিবাহের উদ্দেশ্য কী? দেখো, আমাদের দেশে পারিবারিক পর্যায়ে একটা নিন্দনীয় মানসিকতা হলো, সংসারের প্রয়োজনে, আরো খোলামেলা যদি বলি, কাজের মানুষের প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করানো। সবাই যে এমন করে তা নয়, তবে এটা প্রবলভাবে ছিলো, এখনো কিছু আছে। আমি নিজে সাক্ষী, আমার একজন মুহতারাম তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিলেন, বিয়ে হওয়ামাত্র ছেলের বাবা স্বমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি মেয়ে বিদায় করেন। মেয়ের মা বাবা তো হতবাক!

মেয়ে বিদায় হলো। শশুরবাড়ীতে রাত পোহালো, আর পুত্রবধুর সামনে কাপড়ের স্ত্তপ নিক্ষেপ করে শাশুড়ী আদেশ করলেন, কাপড়ে সাবান লাগাও, দেখি, মায়ের বাড়ী থেকে কেমন কাজ শিখে এসেছো!

আমার এক ছাত্রের কথা, বিয়ের প্রয়োজন। কেন? কারণ মা-বাবার খেদমত করার কেউ নেই।

এটা কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না। মা-বাবার খেদমত মূলত তোমার দায়িত্ব। এখন সে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমার সাথে এতে শরীক হয়, তবে সেটা তোমাদের উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হতে পারে। দেখো, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই আমাদেরও ঘরে পুত্রবধু আসবে। আমরা আমাদের না দেখা সেই ছোট্ট মেয়েটির প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আমি আমার পুত্রকে অবশ্যই বলবো, বিবাহের উদ্দেশ্য মা-বাবার খেদমত করা হতে পারে  না।

আমি দু করি, তোমার মা-বাবা তোমার যেমন, তেমনি তোমার স্ত্রীরও যেন মেহেরবান মা-বাবা হতে পারেন। আমার দুই মেয়ের শশুর, দুজনই এখন জান্নাতবাসী (ইনশাআল্লাহ) আল্লাহর কাছে আমার সাক্ষ্য এই যে, সত্যি সত্যি তারা আমার মেয়েদুটিরবাবাছিলেন। আমার ছোট মেয়ের শশুর বড় আলিম ছিলেন, তাঁকে আমার একটি বই হাদিয়া দিয়েছিলাম এভাবে, ‘সাফফানার আববুর পক্ষ হতে সাফফানার আববাকে তিনি খুশী হয়ে অনেক দু করেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘আপনি তো এই ছোট্ট একটি বাক্যে সম্পর্কের মহামূল্যবান এক দর্শন তুলে ধরেছেন!

আমার বড় মেয়ের অবস্থা হলো, মায়ের বাড়ী থেকে যাওয়ার সময় সে কাঁদে না, কাঁদেআম্মারবাড়ী থেকে আসার সময়।

দুআকরি, আমার দেশের প্রতিটি মেয়ে যেন মা-বাবার ঘর থেকে এমন মা-বাবার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। আর তুমি দু করো, আমরা দুজন যেন আমাদের অনাগত মেয়েটির জন্য তেমন মা-বাবাই হতে পারি।

তো বলছিলাম বিবাহের উদ্দেশ্যের কথা। বৈধ উপায়ে স্ত্রীপরিচয়ে কাউকে ভোগ করা, এটাও বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা হয় শরীকে হায়াত, জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী। বস্ত্তত এই শব্দটির মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সুমহান  উদ্দেশ্যটি নিহিত রয়েছে। আর যদি কোরআনের ভাষায় বলি তাহলে বিবাহের উদ্দেশ্য হল,

هن لباس لكم وانتم لباس لهن

তুমি তো কোরআন বোঝো। ভেবে দেখো, দাম্পত্য-সম্পর্কের কী গভীর তাৎপর্য এখানে নিহিত

পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নত। আর বলেছেন, যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।

বিবাহ নবীর সুন্নত! সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বিরাট মহান কোন মাকছাদ রয়েছে এর পিছনে।

বিবাহের আসল মাকছাদ বা উদ্দেশ্য  হলো স্বামী স্ত্রী- এই পরিচয়ে একটি নতুন পরিবার গঠন করা এবং মা বাবা- এই পরিচয়ে সন্তান লাভ করা। তারপর উত্তম লালন-পালন এবং আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা তারবিয়াতের মাধ্যমে নেক সন্তানরূপে গড়ে তুলে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা, যাতে নস্লে ইনসানি বা মানববংশ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পছন্দমত আগে বাড়তে থাকে। 

এটাই হলো বিবাহের আসল উদ্দেশ্য; অন্য যা কিছু আছে তা সব পার্শ্ব-উদ্দেশ্য। তো এখনই তুমি নিয়ত ঠিক করে নাও যে, কেন কী উদ্দেশ্যে বিবাহ করবে। উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে, আল্লাহ চাহে তো এখনই তোমার ভিতরে কত সুন্দর পরিবর্তন আসছে! কী আশ্চর্য এক পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে! আগামী জীবনের সকল দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য গায়ব থেকে তুমি আত্মিক শক্তি লাভ করছো। আল্লাহ তাওফীক দান করেন।

এবার আসো জীবনের

বাস্তবতার কথা বলি, এতদিন তোমার জীবনে ছিলেন শুধু তোমার মা, যিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসববেদনা ভোগ করেছেন। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এতদিন তোমার উপর ছিলো তাঁর অখন্ড অধিকার। হঠাৎ তিনি দেখছেন, তাঁর আদরের ধন, তাঁর অাঁচলের রত্ন পুত্রের জীবনে স্ত্রীপরিচয়ে অন্য এক নারীর প্রবেশ (অনুপ্রবেশ?) ঘটেছে! এভাবে পুত্রের উপর তার অখন্ড অধিকার খন্ডিত হতে চলেছে। যে পুত্র ছিলো এতদিন তাঁর একক অবলম্বন, এখন সে হতে চলেছে অন্য এক নারীর অবলম্বন। বাস্তবতা না তিনি অস্বীকার করতে পারছেন, না মেনে নিতে পারছেন। সংসারে প্রত্যেক মায়ের জীবনে কঠিন সময়টি আসে। এমন এক অর্ন্তজ্বালা শুরু হয় যা শুধু তিনি নিজেই ভোগ করেন, কাউকে বোঝাতে পারেন না, এমনকি এতদিনের আদরের ধন পুত্রকেও না। ফলে সামান্য সামান্য কারণে, এমনকি অকারণেও তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; তাঁর অনুভূতি আহত হয়। এমন সময় ছেলে (এবং তার স্ত্রী অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা অপিরপক্বতার কারণে) যদি অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসে তাহলে তো মায়ের মনে কষ্টের শেষ থাকে না। প্রসববেদনা থেকে শুরু করে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে যায়।

আম্মার কাছে শুনেছি, গ্রামের এক মা তার পুত্রবধুকে বলেছিলেন, ‘ততা ফানি আমি খাইছিলাম, না তুই খাইছিলি?’

তখনকার যুগে প্রসবপরবর্তী বেশ কিছু দিন মা শিশুর স্বাস্থ্যগত কল্যাণ চিন্তা করে মাকে গরম পানি খেতে দেয়া হতো, ঠান্ডা পানি দেয়া হতো না।

তো কথাটা কিন্তু নির্মম। আমার জন্যতাতানো পানিআমার মা খেয়েছেন, আমার সব আবর্জনা আমার মা পরিস্কার করেছেন। নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে তিনি আমাকে বড় করেছেন, উপযুক্ত করেছেন। সেই সব কষ্টের সুফল হঠাৎ করে অন্য একটি মেয়ে এসে অধিকার করে বসেছে। তখন সব হারানোর একটা বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়। তো তোমার মায়ের অন্তরেও এরকম অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক। মায়ের মনের এই কষ্টের উপশম, এই বেদনার সান্ত্বনা তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।

মায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে বাবার কথা, তারপর ভাই-বোনদের কথা। (এসম্পর্কেও ছাত্রটিকে বিশদভাবে বলেছিলাম।)

তৃতীয়ত তোমার স্ত্রী। যদিও তৃতীয় বলছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই হলো সবচেগুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেনাযুক। তবে এটা থাকবে তোমার দিলে, তোমার অন্তরে। মা-বাবার সামনে মুখের কথায় বা আচরণে এটা প্রকাশ করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না।

কেন বলছি স্ত্রীর বিষয়টি সবচেনাযুক? তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও; কোন বিবাহে কোন ছেলেকে কাঁদতে দেখেছো?! কোন ছেলের মা-বাবাকে বিষণ্ণ দেখেছো?! দেখোনি; (হয়তো ব্যতিক্রম এক দুইটি ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা এটিই, এদের কেউ কাঁদে না।) কেন? কারণ বিবাহের মাধ্যমে ছেলে কিছু হারায় না, ছেলের মা-বাবা কিছু হারায় না, বরং অর্জন করে। তাই তাদের মুখে থাকে অর্জনের হাসি এবং প্রাপ্তির তৃপ্তি।

বিবাহের আসরে কাঁদে শুধু মেয়ে, আর মেয়ের মা-বাবা। কেন কাঁদে একটি মেয়ে? কারণ তাকে সবকিছু হারাতে হয়, সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়, শৈশবের সব স্মৃতি তাকে মুছে ফেলতে হয়। একটি ছোট্ট মেয়ের জীবনে এটি অনেক বড় আঘাত। যেন একটি ছোট্ট গাছের চারাকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বহু দূরে ভিন্ন পরিবেশে নতুন মাটিতে এনে রোপণ করা। বাকি জীবন তাকে এই মাটি থেকেই রস আহরণ করে বেঁচে থাকতে হবে।

হিন্দিতে বলে, ‘আওর্যত কী ডোলী যাহা উত্যরতী হ্যয়, উসকী আর্থী ওহীঁ সে উঠতি হ্যয়।অর্থাৎ মেয়েদের পালকি যেখানে গিয়ে নামে, সেখান থেকেই তার জানাযা ওঠে।

কত বড় নির্মম সত্য! তো তোমার স্ত্রীরূপে তোমার ঘরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির যখমি দিলে তাসাল্লির  মরহম তোমাকেই রাখতে হবে। একমাটি থেকে উপড়ে এনে আরেক মাটিতে রোপণ করা একটি চারাগাছ থেকে দুদিন পরেই ফল দাবী করা কতটা নিষ্ঠুরতা! ফল পেতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। চারা গাছটির পরিচর্যা করতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা তার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ধীরে ধীরে শিকড় যখন মাটিতে বসবে এবং মাটি থেকে রস সংগ্রহ করার উপযুক্ত হবে, তখন তোমাকে ফল চাইতে হবে না; সজীব বৃক্ষ নিজে থেকেই ফল দিতে শুরু করবে।

কত আফসোসের বিষয়, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যত আদেশ-উপদেশ সব ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হয়। প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হয়, এখন থেকে তাকে স্বামীর মন জয় করতে হবে, শশুর-শাশুড়ি সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, শশুর বাড়ীর সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। তার নিজের যেন কোনমননেই। সুতরাং সেটা জয় করারও কারো গরজ নেই।

তো মায়ের মন তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, আবার স্ত্রীর মনোরঞ্জনও তোমাকেই করতে হবে। সবদিক তোমাকেই শামাল দিয়ে চলতে হবে। কত কঠিন দায়িত্ব! অথচ না শিক্ষাঙ্গনে, না গৃহপ্রাঙ্গণে, কোথাও সম্পর্কে শিক্ষার নূন্যতম কোন ব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দুটি অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীকে যেন সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া! মেয়েটিও জানে না, আজ থেকে সে আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন স্ত্রী হয়ে একটি অপরিচিত মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে, যার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোন আছে এবং তাদের প্রতি তার স্বামীর অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। সহানুভূতির সঙ্গে কোমলাতার সঙ্গে এই দায়িত্ববোধ কেউ তার মধ্যে জাগ্রত করে দেয়নি। দোষ কার!

তো আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, কথা দ্বারা আচরণ দ্বারা তোমার মাকে তুমি বোঝাবে, মা, আমি আপনারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। স্ত্রী হলো আমার জীবনের নতুন প্রয়োজন; আপনি আমার প্রাণ, আপনার সঙ্গে আমার নাড়ির টান।

অন্যদিকে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে, এই সংসার সমুদ্রে তুমি একা নও; আমি তোমার পাশে আছি। নতুন জীবনে চলার পথে আমারও অনেক কষ্ট হবে, তোমারও অনেক কষ্ট হবে। তবে সান্ত্বনা এই যে, তুমিও একা নও, আমিও একা নই। আমার পাশে তুমি আছো, তোমার পাশে আমি আছি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা তুমি, তোমার কষ্টের সান্ত্বনা আমি। আমরা পরস্পরের কষ্ট হয়ত দূর করতে পারবো না, তবে অনুভব করতে পারবো এবং হয়ত কিছুটা লাঘব করতে পারবো।

আল্লাহর কসম, এমন কোন নারিহৃদয় নেই যা এমন কোমল সান্ত্বনায় বিগলিত হবে না।

তোমার স্ত্রীকে তুমি এভাবে বলবে, আমাদের জীবন তো আলাদা ছিলো। আমরা তো একে অপরকে চিনতামও না। আল্লাহ আমাদের কেন একত্র করেছেন জানো?! একা একা জান্নাতে যাওয়া কঠিন। আল্লাহ আমাদের একত্র করেছেন একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলার জন্য। আমি যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে; তুমি যদি পিছিয়ে পড়ো, আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। তুমি সতর্ক থাকবে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়; আমিও সতর্ক থাকবো, তোমার দ্বারা যেন কারো প্রতি যুলুম না হয়।

প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দুদিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দুদিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত! যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত। তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐরকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো। আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনেউফকরি, তুমি আমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।

প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?! বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে, আর এটা দুএকদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়। কিন্তু আমরা জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার একথার উৎস হলো,

أنصر أخاك ظالما أو مظلوما

অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত প্রজ্ঞার সঙ্গে।

একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!

আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এইমাডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচপরের বাড়ীর মেয়েটি মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টেমাডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবে না কেন মা?

আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দুটো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!

দুদিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দুদিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!

ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?

মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব। স্ত্রী, মা শাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালো দিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো। আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে। তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি। এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবন যাপন করতে হবে, পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনের দায়িত্ব কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়।

ইসলামপুরে আমার আববার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আববা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো, কিন্তু আববা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দুবছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক  দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।

আববা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হে আল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।

সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো।

আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।

প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দুঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।

তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতাআত আনুগত্য আদায় করে নিবা, গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।

প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের অনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল, আর তিনি ইরশাদ করেছেন,

خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي

তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।

স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা। তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনার বিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। একারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।

স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।

متاع   মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্ত্ত নয়  متاع  মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতে না পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।

তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে  তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।

প্রথমেই বর্বর পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।

যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।

[দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা সচেতনতা অতি প্রয়োজন।

বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতামাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী। দাম্পত্যজীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।

আল্লাহ করুন, কোনো মজলিসে আমরা যেন হুজুরের কাছ থেকে বিষয়েও বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা লাভ করি।-তত্ত্বাবধায়ক]

যৌতুক : কনের অশ্রু, বরের উল্লাস

 

যৌতুক : কনের অশ্রু, বরের উল্লাস

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

বর-কনে পছন্দের পর উভয় পক্ষ আলোচনায় বসে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। কোথায় আকদ হবে, কনেকে কবে তুলে দেওয়া হবে, ওলিমা কবে হবে-এসব সাব্যস্ত হয়। এর সঙ্গে সমাজের একটি বড় অংশে আলোচনা হয় দেনা-পাওনা নিয়ে। এই দেনা পাওনার আলোচনাটা অনেক সময় একদম শুরুতেই হয়। কখনো কখনো বর-কনে পছন্দেরও আগে। যেন দেনা-পাওনাটাই মুখ্য, বর ও কনের পছন্দের বিষয়টি গৌন। দেনা-পাওনা মনমতো হলে কালা-ধলা কোনো ব্যাপারই নয়।

এই দেনা-পাওনাটা কী? মেয়েপক্ষ বর ও বরের পরিবারকে কী কী দেবে তা সাব্যস্ত করাই দেনা-পাওনা। বহু পরিবারে বিয়ের ক্ষেত্রে এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ের আলোচনার সমস্ত মনোযোগ ও বুদ্ধিমত্তা এখানে প্রয়োগ করতে দেখা যায়। বাস্তবে এ দেনা-পাওনার কিছু অংশ নগদ ও কিছু বকেয়া রাখা হয়। সেটা পরে মেয়েপক্ষের কাছ থেকে উসূল করে নেওয়া হয়। কিংবা উসূল করতে গিয়ে নব পরিণীতা মেয়েটির জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। এরই নাম-যৌতুক।

দুই.

বিয়ে উপলক্ষে মেয়েপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যৌতুকের এই অভিশাপ কেবল আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ নয়। এর বিস্তৃতি পুরো উপমহাদেশজুড়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান। ১৯৪৭ পূর্ব ভারতবর্ষের বর্তমান     সীমানায় যৌতুক প্রথার প্রচলন রমরমা। ঠিক এভাবে ও এরূপে যৌতুক প্রচলনের নজীর পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে পাওয়া যায় না বলে জানা গেছে। মেয়েপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে, সাব্যস্ত করে, অবধারিত পাওনা মনে করে যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার নজীর অন্য কোথাও নেই। মুসলিম দেশগুলোতে তো নেই-ই। খুঁজতে গিয়ে যেটা পাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের প্রভাবই এর প্রধান কারণ। উপমহাদেশের বৃহত্তর সম্প্রদায়-হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৈবাহিক রীতিতে যৌতুকের গুরুত্ব অত্যধিক। ওই ধর্মে উত্তরাধিকারের সম্পদে মেয়েদের অংশিদারিত্বের স্বীকৃতি নেই। বিয়ের সময়ই মোটামুটিভাবে যা দেওয়া যায় ও যা নেওয়া যায়-এর পর্বটি সম্পন্ন করা হয়। এ জন্য যৌতুক তাদের বিবাহপর্বের একটি শক্তিশালী অনুষঙ্গ ও উপলক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে এসেছে ও আসছে। এ অঞ্চলে প্রতিবেশী বড় সম্প্রদায়টির সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে যেমন অন্য বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, তেমনি ধরা পড়ে এই যৌতুকের ক্ষেত্রেও। অথচ মুসলিম জীবনে এই বিষয়টির চিত্র হওয়ার কথা সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের বিধান সেটাই। বিয়ে, বা দাম্পত্যের ক্ষেত্রে ছেলে দেবে, মেয়ে নেবে। যেমন মোহর। মেয়ে কিংবা মেয়েপক্ষের এ ক্ষেত্রে কিছুই দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের প্রভাব ও রেওয়াজ থেকে নেওয়া এ রীতির কারণে বহু মুসলিম নারীর জীবন আজ অভিশাপের পাঁকে আটকে যাচ্ছে।

মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশের এই যৌতুক প্রথাকে আঁকড়ে থাকার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে, সামাজিক রেওয়াজগত সিদ্ধতা। আর্থিক সুবিধা ও স্বার্থ ত্যাগ করা সাধারণভাবে মানুষের জন্য কঠিন। এতে সামাজিক রেওয়াজ ও রেওয়াজগত স্বীকৃতি থাকলে সেটি যেন আরেকটু অধিকারের ছোঁয়া পেয়ে যায়। শুরুতে অন্য সম্প্রদায়ের প্রভাবে মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখন আর এতে প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। এটা এখন নিজেদের মধ্যেই স্বাভাবিক একটা লেনদেন ও দেনা-পাওনার হিসাবে পরিণত হয়েছে। বরের পরিবার স্বচ্ছল ও বিত্তবান হলেও এখন কনেপক্ষের সঙ্গে দেনা-পাওনা নিয়ে কথা বলেন এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের মতো এই দেনা-পাওনার হিসাব বুঝে নেন।

তবে এ বিষয়টিকে এক্ষেত্রে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, এর সঙ্গে নির্লজ্জ ও নির্মম লোভের একটা সম্পর্ক রয়েছে। দেখা যায়, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অন্য বহুবিধ প্রভাব সম্পর্কে বিগত এক-দু শতাব্দীতে আলেম-সমাজের পক্ষ থেকে সতর্ক করার পর অনেকে সেগুলো ত্যাগ করেছেন। কিন্তু যৌতুকের মায়া ত্যাগ করে আসতে পারছেন না অনেকেই। যে মেয়েটিকে পছন্দ করে নিজেদের ঘরে আপন করে নিয়ে আসা হচ্ছে তার পরিবারের কাছ থেকেই যৌতুক হিসেবে অর্থ ও আসবাবপত্র চেয়ে-চিন্তে, ধার্য করে আদায় করা সাধারণ চোখে কঠিন একটি লজ্জার বিষয়। যারা এটি করেন তারা লজ্জা ও বিবেক মাথার বাইরে রেখেই করেন। একই সঙ্গে যৌতুক আদায়ের ক্ষেত্রে মেয়েপক্ষের কোনো অপারগতা ও গড়িমসি বন্ধ করতে নিজেদের সংসারের অংশ হয়ে যাওয়া মেয়েটির ওপরই চাপ সৃষ্টি করা কিংবা তাকে এড়িয়ে তার বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি করা চরম এক নির্মমতা। মারধর ও খুন-জখমই শেষ কথা নয়, যারা চাপ ও তিক্ততার পথে যান তারাও নির্মম হয়েই সেটা করেন। তাই এ ক্ষেত্রে লোভের পাশে নির্লজ্জতা ও নির্মমতা একাকার হয়ে যায়।

আমাদের সমাজে যৌতুক গ্রহণের অপর কারণটি হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ভয়হীনতা এবং শরীয়তের বিধানের প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। নারীর মর্যাদা দান ও নারীর আর্থিক অধিকার সুরক্ষায় ইসলাম যে বিধিবিধান দিয়েছে তার প্রতি সাধারণ পর্যায়ের সম্মানবোধ থাকলে কোনো বরের পরিবারের পক্ষেই যৌতুক গ্রহণের কোনো উদ্যোগ থাকার কথা ছিল না।

অথচ যৌতুক গ্রহণের সঙ্গে এ সম্মানবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষত যৌতুকের নামে দেনা-পাওনা ধার্য করা এবং তা উসূল করার নির্মম পর্যায়গুলোতে ন্যূনতম স্তরের মানুষির কোনো আলামত দৃশ্যত থাকে না। এটা শরীয়তের বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তাই      অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা নয়।

তিন.

কনে বা মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে বরপক্ষকে যা যা দেওয়া হয় সেগুলোকে আমরা যৌতুক বলে জানি। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। যৌতুকের এই সম্পদ কনের পরিবারের পক্ষ থেকে আসছে বরের পরিবারে, কনের কাছে নয়। বরের পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত করে, ধার্য করে ও চাপ দিয়ে কনের কাছে আসলেও যে সেটা যৌতুক হতো না, তেমন নয়। কিন্তু ভুল পথে হলেও তখন বলা যেত, এতে হয়তো কনে উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যৌতুকের সম্পদের উপলক্ষ ওই কনে হলেও তা আসছে বরের কাছে অথবা বরের গোটা পরিবারের কাছে। এখানে কনের ভূমিকা কেবল একটি সেতুর। এক পরিবারের অশ্রুমেশানো সম্পদ আরেক পরিবারে উল্লাসের উপকরণ হয়ে আসছে কনের কারণে। নির্দোষ মেয়েটিকে গ্রহণ করে যেন তাকে উদ্ধার করল ছেলের পরিবার। নগদ অর্থ, মোটর সাইকেল, প্রাইভেটকার, ফ্রিজ, সোফাসেট, খাট-পালঙ্ক-যৌতুক হিসেবে আসা সবকিছুরই মালিক তখন ছেলের গোটা পরিবার। প্রচলিত যৌতুক প্রথার অনুশীলনটা এরকমই। এ এক অদ্ভুৎ নিয়ম! প্রশান্তিদায়িনী মায়াবতী নবপরিণীতা নারীকে এখানে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণে সেতু অথবা পাইপ লাইনের ভূমিকা রাখতে হয়।

প্রচলিত এই যৌতুক নয়, ইসলামের ইতিহাসে ও ইসলাম-অনুসারী মুসলিম জীবনাচারে অন্য রকম এক জাহীযের নমুনা পাওয়া যায়। সেখানে কোনো দেনা-পাওনা থাকে না। শর্ত, ধার্য ও উসূল থাকে না। উসূলের জন্য নির্লজ্জ প্রত্যাশা ও নির্মম গঞ্জনা থাকে না। তার স্বরূপ হচ্ছে, স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে আপন কন্যার জন্য এবং কন্যাকেই কনের পিতা বা পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু উপহার দেওয়া। এই দেওয়াটাও নিয়ম করে নয়, বরপক্ষের প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নয়। দেওয়া হলে দেওয়া হল, না দেওয়া হলে নাই-এমনভাবে দেওয়া। যেমন কোনো সন্তান কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হয়ে দূরের কোনো দেশে সফরে যাচ্ছে। সে সফরের প্রয়োজনীয় ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ সব আয়োজন ও খরচের ব্যবস্থা ওই প্রতিষ্ঠানই করে রেখেছে। সফরে তার প্রয়োজনীয় কোনো জোগান ও আয়োজনই বাকি নেই। তারপরও মনের টানে পিতা তার সন্তানকে বাড়তি সুবিধার জন্য কিছু ডলার হাতে তুলে দিতে পারেন। উপযোগী এক সেট পোশাক বানিয়ে দিতে পারেন। শীতে না জানি সন্তানের কষ্ট হয়-এমন উদ্বেগ থেকে একটি শাল কিনে দিতে পারেন। সন্তানের সফর-আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান এসব প্রয়োজনের দিকে যথেষ্টই নজর রাখবে। তারপরও পিতার মন বলে কথা। দূরের সফরে সন্তানের স্বাচ্ছন্দে কোনো ব্যাঘাত না ঘটুক-এমন একটি প্রত্যাশা ও সান্ত্বনা তিনি খুঁজতে চাইতেই পারেন। তার এই চাওয়া ও এই উপহার নির্দোষ। ইসলামের ইতিহাসে যে জাহীয-এর নজীর পাওয়া যায়, তার স্বরূপটা এ রকমই। প্রচলিত যৌতুকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

জাহীয-এর সাধারণভাবে বাংলা তরজমা করা হয় যৌতুক। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আদরের কন্যা হযরত ফাতিমা রা.-এর বিয়ের সময় যে জাহীয দিয়েছিলেন হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে এর বর্ণনা রয়েছে। এ থেকে সরল চিন্তার অনেকে বলে ফেলেন, নবীজীও তো যৌতুক দিয়েছেন। এখানে জাহীযের স্বরূপের চেয়ে শব্দের ভ্রান্তিটাকেই খুলে দেখা দরকার।

দ্বীনী বহু কাজের পেছনে সাধারণ ও বিত্তবান মুখলিস মুসলমানের দেওয়া স্বেচ্ছাচাঁদার ভূমিকা সব সময় বড় ভূমিকা রেখে এসেছে। ইসলামী খেলাফত ও সালতানাত শেষ হওয়ার পর দ্বীনী এদারা ও প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলমানদের চাঁদার ভিত্তিতেই চলে এসেছে ও আসছে। এসব চাঁদার ভূমিকা দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিকট অতীতের বহু বুযুর্গ দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের চাঁদা গ্রহণ ও দান ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বহু দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন।

এখনও এ জাতীয় চাঁদার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। কিন্তু এদেশে গত দেড় যুগ যাবত চাঁদা বা চান্দা শব্দের ব্যাপক যে ব্যবহার আমরা দেখি সেটা কোন অর্থে? মিডিয়া, সরকারী আইন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টিতে চাঁদা ও চান্দা হচ্ছে মাস্তান ও সন্ত্রাসী শ্রেণীর জোরপূর্বক আদায়কৃত অর্থ। একজনকে ছিনতাইকারী বললে তার সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়, চাঁদাবাজ বললে তার চেয়ে ভালো কোনো ধারণা তৈরি হয় না। বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সন্ত্রাসীরা জোরপূবর্ক যে অর্থ আদায় করে থাকে এখন ব্যাপকভাবে তাকেই চাঁদা বলে। এটা বিশেষ সময়ে বিশেষ কারণে শব্দ ও শব্দের অর্থের স্থানান্তর। এতে কি ভালো ও দ্বীনী কাজে গ্রহণকৃত চাঁদাও দোষণীয় হয়ে গেল? নিশ্চয়ই নয়। দ্বীনী কাজের চাঁদার ধারা স্বতঃস্ফূর্ত ও বিনয়পূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে জোর খাটানোর প্রশ্নও নেই, জোরও নেই। সেজন্য চাঁদা শব্দটি যখন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন স্বতঃস্ফূর্ততার স্বরূপটি সবার সামনে স্পষ্ট থাকে। আর সন্ত্রাসীরা যখন চাঁদা তুলতে যায় তখন লোকজন আঁতকে উঠে।

জাহীযের ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসের ঘটনাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত উপহারের ঘটনা। আর এই উপমহাদেশীয় প্রচলন এবং এ যুগের যৌতুকের ঘটনা হচ্ছে শর্ত করে, ধার্য করে উসূল করার নির্মমতার নমুনা। শুধু শব্দের মিলের কারণে দুটো বিষয়কে এক রকম মনে করা মারাত্মক ভ্রান্তিকর। দু ক্ষেত্রেই শব্দ এক রকম হলেও স্বরূপ ও তাৎপর্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

চার.

যৌতুক কিংবা দেনা-পাওনা ভাষায় আমরা যাই বলি, আমাদের সমাজে এই অভিশপ্ত ধারা বন্ধ হতেই হবে। সুখের কথা, অনেক পরিবারেই মানসিকতার একটি রূপান্তর ফুটে উঠছে। যৌতুক গ্রহণের কোনো রকম মানসিকতা ও মনোভাব থেকে সম্পূর্ণ সরে আসতে হবে প্রত্যেক পরিবারকে। গ্রহণের মানসিকতা বন্ধ হলে দেওয়ার ক্ষেত্রটাও একদিন নেই হয়ে যাবে। এটাকে অবৈধ আয় ও জুলুম হিসেবে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে মনে কোনো সংশয় রাখা যাবে না। প্রচলিত অর্থে ও পদ্ধতিতে যৌতুক গ্রহণ করা ইসলামী শরীয়তে কোনোভাবেই বৈধ নয়।  বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম ও মানবতাবিবর্জিত যৌতুকের এই উপায় অবলম্বন করার ইহ-পরকালের শাস্তি কী হতে পারে সেটা ভেবে শঙ্কিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর ভয়কে মনে জাগ্রত করতে হবে।

যৌতুক গ্রহণ দৃশ্যত আর্থিকভাবে লাভজনক হলেও এর মাঝে রয়েছে অনেকগুলো অন্যায় ও অপরাধ। যৌতুকের চুক্তি বা দেনা-পাওনা সাব্যস্ত করা এক অন্যায়। যৌতুক আদায় করা আরেক অন্যায়। অনাদায়ী যৌতুক আদায়ের জন্য বার বার চাপ দেওয়া বার বার অন্যায়। এই চাপের সঙ্গে যদি শারীরিক-মানসিক জুলুম যুক্ত হয় সেগুলোও অন্যায়। একইভাবে এর প্রতি অন্তরে ও আচরণে যে লোভ পোষণ করা হয় সেটাও অন্যায়। এতে নারীর প্রতি জুলুম ও অপমানের ঘৃণ্য ধারা চালু হয়, সেটিও আরেক অন্যায়। ইহকালীন আইন ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেই কেবল নয়, এর প্রতিটিই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের কুফল আখেরাতে তো অবশ্যই, দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। এত অপরাধের নর্দমা পাড়ি দিয়ে যে অর্থ বা সম্পদ হাতে আনা হয়, তা ভোগ করায় কোনো শান্তি থাকে না, বরকত তো হয়ই না।

সর্বোপরি যৌতুক প্রথা সম্পর্কে ব্যাপক ও সূক্ষ্ম সচেতনতা তৈরি করা দীনদার প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব মনে করতে হবে। সরকারী আইন-কানুনের চেয়েও অনেক বড় বিষয়  হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বিচারেও এটা মস্ত বড় জুলুম। কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মুসলমান তার স্ত্রী কিংবা পুত্রবধুকে বাপের বাড়ির সম্পদ আহরণের সেতু বানাতে পারে না। নিজের ঘরে আনা নারীর অশ্রুর মূল্যে নিজেদের বিলাস-উপকরণ কিনতে পারে না।