ছোট ছেলে আর বৌ বাইরে থাকে, বড় ছেলে আর তার বৌ আমাদের সাথে দেশের বাড়িতে থাকে।
আমার উনার অভ্যাস ফজরের নামাযের পর ডিমসেদ্ধ আর চা খাওয়া। বড় বৌ প্রতিদিন সাড়ে ছয়টার দিকে বানিয়ে ঘরে দিয়ে যায়। এরপর আটটা বাজতে বাজতে নাস্তা রেডি করে, ছেলে খেয়ে বাচ্চাদের জন্য নিয়ে যায়। এরপর আমাদের খেতে দেয়, নিজে খায়, বাইরে কর্মচারীকে দেয়।
নাস্তার পরপরই ঘর-দুয়ার একটু গোছগাছ করেই দুপুরের রান্নার এন্তেজামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে! কেননা, সাড়ে বারোটার মধ্যে বাচ্চাদের দুপুরের খাবার পাঠাতে হবে, আর মেহমান তো প্রায় সবসময়েই থাকে। মেহমান থাকলে তাদের জন্য আলাদা রুটিন দরকার পড়ে।
এমন হাজারো জিম্মাদারির নিয়ম মেনে চলতে হয় তাকে। ইচ্ছেমতো একটু বিশ্রাম নিতেও পারে না। যৌথ পরিবারে থাকলে যা হয়!
ঈদের ছুটিতে নাতি-নাতনিরা কিছুদিন থেকে বাড়িতে রয়েছে। কাজের টেনশন একটু হলেও কমেছে। এখন আটটার পরিবর্তে নয়টার সময় সকালের নাস্তা হলেও সমস্যা নাই।
কিন্তু আবু ফাহীম যেন বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেমন খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গিয়েছে।
তার সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই চা আর ডিম চাই। সেদিন বৌটা একটু বেলা করে উঠলে বেশ নাখোশ হয়ে উঠেন উনি। আমাকে বলেন, ‘এতো বেলা করে ঘুম ভেঙেছে! কেন তুমি কিছু বলতে পার না?’
আমি বললাম, ‘একেকদিন না হয় একটু দেরি করেই খেলেন। এখন তো সবার মাদ্রাসা ছুটি, টাইমের কোনো তাড়া নাই, দুই-একদিন একটু দেরি করে উঠলে তো সমস্যা নাই। মেয়েটারও তো জীবনের ছক একদিন হলেও বদলাতে মন চায়। একঘেয়েমি জীবনটায় একটু আরাম পেতে চায়।’
কিন্তু ঐ যে বয়সের দোষ! তবু খিটমিট করতেই থাকেন। তাই আজ নিজেই উনার জন্য চা-ডিম তৈরি করতে রান্না ঘরে গেলাম। পুরুষমানুষ সুবিধা-অসুবিধা বোঝে কম। তার মাথা তো ঠান্ডা করতে হবে।
বৌ কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘরে কেমন একটা অপরাধী অপরাধী চেহারা নিয়ে প্রবেশ করে বলে, ‘একটু দেরি হয়ে গিয়েছে আম্মু, বাসি বারান্দাও ঝাড়ু হয়নি এখনও! আপনি যান, বাসি ঘর-বারান্দা ঝাড়ু দিয়ে বাকিটা আমি করি।’
ওর মাঝে যেন আমি নিজেকে আবিষ্কার করি।
সস্নেহে তাকে বললাম, ‘কোনো ব্যাপার না মা, একেকদিন এমন করে নিয়মের ব্যতিক্রম না হলে আমাদের বদভ্যাস হয়ে যাবে। প্রতিদিন তো তুমিই কর, আজকে না হয় আমি করলাম। আর হ্যাঁ, বাসি ঘর-বারান্দা ঝাড়ু দিয়ে রান্নার কাজ করলে ভালো লাগে, তাই বলে সকালে উঠেই বাসি ঘর ঝাড়ু দিতেই হবে, না হলে অমঙ্গল হবে–এমন কুসংস্কারপূর্ণ ভাবনা থেকে বের হয়ে এস। কী হবে যদি একটু পরেই ঝাড়ু দেওয়া হয় তো? যাও মা, তুমি বরং নাস্তার এন্তেজাম শুরু করে ফেলো।’
আরেকদিন বৌ এবং আমার দু’জনেরই শরীর ভালো না, তবু বৌকে দেখলাম অসুস্থ শরীর নিয়েই সকালে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। বৌকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘থাক মা, আজকে শরীর খারাপ, রান্নাঘরে যেতে হবে না। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও।’
ছেলে বলল, ‘কষ্ট করে অল্প কিছু একটু করে নিক।’
ছেলেকে বললাম, ‘আমার বাড়ি কোন কারাগার না আর আমার বৌ কোনো কয়েদিও না, যে না পারলেও শাস্তিস্বরূপ জোর করে করতে হবে। যাও আজকে হোটেল থেকে কিছু নিয়ে এস।’
আমার ধমক খেয়ে ছেলে হোটেলের দিকে যাত্রা করলো।
.......
এগুলো আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আংশিক কিছু অংশ। ভবিষ্যতের জন্য এমন হাজারো ভাবনা ভেবে রেখেছি আমি। যা আমার সাথে, আমাদের সাথে হয়েছে তার নিয়ম কিছুটা হলেও বদলাতে চাই আমি। কেননা, “আমিও একদিন শাশুড়ি হবো”।
.....................
|| আমিও একদিন শাশুড়ি হবো ||
উম্মে ফাহীম
রৌদ্রময়ী