Saturday, February 15, 2025

জীবনের মোড়

জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী একটি লেখা।
সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, "Compound Interest হল এই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য"।
.
উনার এই কথার সাথে একমত হয়ে SUCCESS Magazine- এর Publisher Darren Hardy একটি বই লিখেন The Compound Effect নামে, যেটি The New York Times Bestseller.
.
এই বইটিতে কিছু চমৎকার Key Idea আছে যা আমাদের সবাইকে একটা Perfect Life Resolution বানাতে সাহায্য করতে পারে। 
.
আচ্ছা বলুনতো,
কোন মানুষের Successful বা Failure হওয়ার পিছনে Root Factor হিসেবে কাজ করে কোনটা? তার ছোটবেলা, সে কিভাবে বড় হয়েছে, তার পরিবেশ নাকি অন্য কিছু?
.
লেখকের মতে সেই Root Factor হল তার নিজের নেয়া ছোট ছোট চয়েজগুলো।
.
এই পুরো পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটাই জিনিস আছে যেটা যদি আমরা চাই তাহলে পুরোপুরিভাবে কন্ট্রোল করতে পারি, সেটা হচ্ছে আমাদের চয়েজ। আর এই চয়েজগুলোই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আউটকামের জন্য দায়ী।
.
আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে অফিস থেকে ফেরার পর জিমে যেতে পারেন বা সোফাতে শুয়ে টিভিও দেখতে পারেন। আপনি যদি চান কোন কারনে আপনার বউয়ের সাথে ঝগড়া হওয়ার পর সবকিছু ভুলে পিছনে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেন বা আপনার ইগোকে প্রশ্রয় দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়েও আসতে পারেন।
.
এরকম ছোট ছোট চয়েজগুলোই আমাদের সবকিছুর আউটকামগুলোকে নির্ধারন করে: আপনি সারাজীবন সুস্থ্য থাকবেন নাকি রোগের বয়ে বেড়াবেন, আপনি একটা দীর্ঘ এবং মধুর সম্পর্ক পাবেন নাকি আপনার মেয়েকে জবাব দিতে হবে কেন তার মাকে আপনি ডিভোর্স দিয়েছিলেন।
.
কিন্তু আমরা এরকম ছোট ছোট চয়েজগুলোতে বেশি মন দিই না, যদি আমি আপনাকে এখন দুটো অপশন দেই: আপনাকে এখন ১ টাকা দিব যেটা আগামী ১ মাস প্রতিদিন দিগুন হবে অথবা এখনই একবারে ১০ কোটি টাকা দিব; তাহলে আপনি এর মধ্যে কোন অফারট নিতে পছন্দ করবেন।
.
বেশিরভাগ মানুষই, হয়তো প্রায় সবাই ২ নাম্বার অপশন অর্থাৎ ১০ কোটি টাকাই নিবে। আচ্ছা তাহলে আমি ১ নাম্বার অফারটা নিজের কাছে রেখে দিলাম। এবার দেখা যাক ১ মাস পর এর আউটকাম কি আসে।
.
৫ দিন পর আমার কাছে আছে ১৬ টাকা আর আপনার কাছে ১০ কোটি। ১০ দিন পর আমার কাছে আছে ৫১২ টাকা আর আপনার কাছে সেই ১০ কোটি। ২০ দিন পর আমার কাছে ৫,২৪,২৮৮ আর আপনার কাছে সেই ১০ কোটি টাকা। আপনি এত টাকায় অনেক মজাতেই আছেন।
.
এবার ৩১ দিন পর আপনার কাছে আছে এখনো সেই ১০ কোটি কিন্তু আমার কাছ আছে ১০৭,৩৭,৪১,৮২৪ অর্থাৎ ১০৭ কোটি টাকা। যেটা কিনা আপনার থেকে ১০ গুন বেশি।
.
এবার তো বুঝা যাচ্ছে আইনস্টাইন কেন Compound Interest ব্যাপারটাকে 8th Wonder of World বলেছেন। সাকসেস জিনিসটাও ঠিক এই প্যাটার্নটাই ফলো করে।
.
Darren Hardy বলেছেন, "After 31 months or 31 years, the person who uses the positive nature of the compound effect appears to be an overnight success."
.
যেমন রুপক অর্থে রাশেদ, বিজয়, জুয়েল তিন বন্ধুর উদাহরন দেখা যাক। তিনজনই একরকম পরিবেশে বড় হয়েছে, একই জায়গায় থাকে আর ইনকাম মোটামুটি একই রকম। আর হ্যা ধরা যাক তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে এবং সবারই ওয়াইফের সাথে একটু মনোমালিন্য চলছে।
.
নতুন মাস বা বছরের শুরু থেকে রাশেদ সবসময় যা করে সেটাই করতে থাকল, কারন তার মনে হয় এটাতেই সে খুশী আছে। হ্যা শুধু কখনো কখনো সবার ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করা শুরু করল।
.
অন্যদিকে বিজয় একটি Daily Checklist বানিয়ে নিজের মধ্যে কিছু ছোট ছোট Insignificant Positive Change আনা শুরু করল। যেমন-
১- প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একটা ভাল বইয়ের ১০ পৃষ্ঠা পড়া।
২- প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার বা ফেরার সময় গাড়িতে বসে বা সুবিধামত সময়ে ৩০ মিনিট কোন Self Help/Motivational ভিডিও দেখা।
৩- নিজের ডেইলি ডায়েট প্ল্যান থেকে ১২৫ ক্যালরি কমালো।
৪- প্রতিদিন এক্সট্রা অন্তত ২ লিটার পানি খাওয়া।
৫- প্রতিদিন ১ মাইল হাটা।
৬- ব্যবসায়ীক স্বার্থ জড়িত প্রতিদিন অন্তত এমন ২/১ জনকে ফোন দিয়ে খোজখবর নেয়া বা সম্পর্কোন্নয়ন।
৭- নিজের বউকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে শুধুমাত্র ১ দিন বাইরে ডিনারের জন্য যাওয়া।
.
এবার অন্যদিকে জুয়েল কিছু ছোট ছোট Insignificant Negative Change আনা শুরু করল। যেমন:
১- প্রতিদিন লাঞ্চে একটু করে জাংকফুড খাওয়া।
২- কাজের চাপের অজুহাতে সপ্তাহে ৩/৪ দিন জিম মিস দেয়া।
৩- প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ১ বোতল কোল্ডড্রিঙ্কস খাওয়া।
৪- টিভিতে ফেভারিট শো দেখার জন্য ইভিনিং ওয়াক বন্ধ করে দেয়া।
৫- সময়ের অভাবের অজুহাতে অফিসিয়াল যোগাযোগ কমিয়ে দেয়া।
৬- ব্যস্ততার অজুহাতে বউয়ের সাথে বাইরে যাওয়াও বন্ধ করে দিল।
.
পরব্ররতী ৫ মাসে ৩ বন্ধুর তেমন কোন পার্থক্য দেখা গেল না। ১০ মাস পরেও একই। এবার বিজয় একটু একটু ফ্রাস্ট্রেট হতে লাগল। কেননা এখনো সে কোন পজটিভ রেজাল্ট দেখতে পায়নি তাও সে কোনরকমে জেদ ধরে চালিয়ে গেল, যেখানে জুয়েল কম কাজ করে জীবনকে উপভোগ করতে থাকল। আর রাশেদও খুশিতেই আছে।
.
কিন্তু ২৫ মাস পর হঠাৎই এদের মধ্যে কিছুটা বড় পার্থক্য দেখতে পাওয়া গেল, আর ২৭ মাস পর সেটা আরো ক্লিয়ারলি দেখতে পাওয়া গেল।
.
And after 31 months the differences become poles apart.
.
রাশেদ এখন আরো বেশি কম্পলেইন করে সবার ব্যাপারে। সে বেশিরভাগ সময়ই Bore এবং Purposeless অনুভব করে।
.
জুয়েল রোজ একটু একটু জাংকফুড খেয়ে এবং জিম বাদ দিয়ে ১৫ কেজি ওজন বাড়ালো, সাথে নানান রোগব্যাধি। যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ার ফলে বিজনেসের অবস্থাও খারাপ হতে লাগল। ফলস্বরূপ আর্থিক অবস্থাও খারাপ হয়ে গেল সেই সাথে বউয়ের সাথেও সম্পর্ক খারাপ হয়ে ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গেল।
.
Small negative changes compounded for 31 months brought a horrific result.
.
এবার আসা যাক বিজয়ের ব্যাপারে। এই ৩১ মাসে সে প্রায় ৫০ টি বই এবং ৪৬৫ ঘন্টা উপকারী ভিডিও দেখে নিয়েছে যেটাতে তার Knowledge & Wisdom দুটোই আগের থেকে অনেকগুণ বেড়ে গেল।
.
প্রতিদিন শুধু ১২৫ ক্যালরি কমিয়ে আর ১ মাইল হেটে ১৫ কেজি ওজন কমালো যে কারনে সে এখনো আগের মতই স্লিম আর হ্যান্ডসাম। প্রতিদিন মাত্র ২ লিটার পানি খেয়ে মোট প্রায় দুই হাজার লিটার পানি খেয়ে নিল যা কিনা তার নিজের ভিতরে অনেক রোগকে বেড়ে ওঠা কমিয়ে দিল।
.
আর প্রতিদিন মাত্র দুইটা কল করে সে মোট ১৮০০ কল দিল যাতে সম্পর্ক ভালো হল ফলে বিজনেসও বাড়তে থাকল।
সপ্তাহে মাত্র একদিন বউকে ডিনারে নিয়ে গিয়ে মোট ১২৪ টা ডিনার ডেট করে ফেলল, যাতে তার বউ খুশী হল, নিজেদের সম্পর্কটাও মজবুত হল।
.
Strong insignificant changes compounded for 31 months brought an outstanding result for him.
.
.
কিন্তু!!
যদি সাকসেস পাওয়া এতটাই সোজা হয় আর আমরা সবাই প্রসেসটাও জানি, তাহলে কেন আমরা এই সূত্রটা ফলো করতে ব্যর্থ হয়ে যাই?
.
লেখকের মতে চারটি ফাঁদ আছে যার কারনে আমরা ব্যর্থ হই বা Consistency ধরে রাখতে পারি না।
.
1- Starting Results Are Invisible
.
ভাবুন যদি আপনি আজ একটা বার্গার খান আর পরদিন সকালে ১৫ কেজি ওজন বাড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠেন তাহলে কি আপনি কোনদিনও একটা বার্গার খেতেন? অথবা আজ একটি সিগারেট খান আর পরদিন সকালে আপনি গলায় ক্যান্সার নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন, তাহলে কি আপনি কোনদিনও একটা সিগারেট খাওয়ার সাহস করতেন?
.
কিন্তু সমস্যাটা হল শুরুতে কোন পরিবর্তনই চোখে ধরা পরে না। কিছু মাস বা কিছু বছর পর হঠৎ যেন রাতারাতি কিছু ভয়ানক ফলাফল সামনে এসে যায়, যতক্ষণে সেটাকে আটকানোর আর সুযোগ থাকে না।
.
এই ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে সবসময় এটা মনে রাখতে হবে, "Every choice you make ignites a butterfly effect" মানে আপনাকে সতর্ক হয়ে প্রতিটা চয়েজ মন দিয়ে নিতে হবে।
.
2-Deceptiveness
.
লস এঞ্জেলসগামী কোন বিমান যদি ১ ডিগ্রিও Off Route হয়ে যায় তো সেই প্লেন লস এঞ্জেলস থেকে ১৫০ মাইল দূরে অন্য কোন দ্বীপে গিয়ে ল্যান্ড করবে। এবার আপনি ভাবুন যদি আপনিও নিজের জীবনে শুধুমাত্র ১ ডিগ্রীও Off Route হয়ে যান ১০ বা ১৫ বছরের জন্য, তাহলে জীবনের কোথায় গিয়ে ল্যান্ড করবেন!
.
এটা থেকে বাঁচার জন্য একটা গাইডলাইন থাকা খুবই দরকার। যেমন একটা Daily Checklist যেটা একটা ফুটপ্রিন্টের মত আপনাকে On Track থাকার জন্য সাহায্য করবে। যদি আপনি কোন কারনে কিছুদিনের জন্য অফট্র‍্যাক হয়েও যান তখন এই চেকলিস্টটা আপনাকে অন ট্র‍্যাকে ফিরে আসার জন্য অনেকটা সাহায্য করবে।
.
3- Immediate Gratification
.
আপনার কাছে দুটো অপশন আছে, ডিনারের পর আপনি একটা হট চকলেট কেক খেতে পারেন বা শুধু ১ গ্লাস পানি খেতে পারেন। আপনি পানি বেছে নিলেন আর আপনার একটা বন্ধু নিল কেক। বন্ধু খুব আনন্দে ওই কেকটাকে আপনার চোখের সামনে মজা করে খেতে লাগল। আর এদিকে আপনি শুধু পানি খাচ্ছেন যেটার এতটুকুও কোন স্বাদ নেই। তখন কেমন লাগবে আপনার?
.
এটাই ফাঁদ!
যদি আপনি শর্ট টার্মে দেখেন তাহলে কোন ভাল চয়েজ বেছে নিলে তাতে আপনি কিছুই পান না কিন্তু যদি একটা খারাপ চয়েজকে বেছে নেন তাহলে আপনি অনেক খুশী আর মজা লাভ করেন।
.
Which is a great paradox.
.
যেমন Darren Hardy বলেছেন,
"Short term pleasures create long term pains and short term pains create long term pleasures.
.
জীবনে একবার তো আপনাকে কষ্ট করতেই হবে, আপনি এটাকে Skip করতে পারবেন না। এই কষ্ট দুই ধরনের হয়: Pain of Discipline এবং Pain of regret.
কিন্তু ডিসিপ্লিনের কষ্টে ওজন শুধু কয়েক গ্রাম এবং কিছুদিনের যেখানে রিগ্রেটের কষ্টের ওজন কয়েক টন এবং আজীবনের।
এবার চয়েজ আপনার।
.
4- What is easy to do is also not easy to do.
.
চেকলিষ্ট Maintain করা, প্রতিদিন শুধুমাত্র দুই বোতল পানি খাওয়া, ১ মাইল হাটা; এইসব কাজ করা খুবই সহজ।
হ্যা সহজ তো বটেই কিন্তু এটা করা অনেকটা মুশকিলও।
.
লেখক বলেছেন শুধুমাত্র একটা জিনিস এরকম আছে যেটা Successful এবং Unsuccessful দুধনের লোকেদের মধ্যেই Common, তাদের কেউই ভাল চয়েজটা বেছে নিতে ভালবাসে না।
.
হ্যা এটাই সত্যি!
হট চকলেট কেকের পরিবর্তে শুধু স্বাদহীন পানি খেতে কেউই ভালবাসে না, কিন্তু সাকসেসফুল লোকেরা তাও যেকোন ভাবে তাদের Will Power বা নিজের Why Power- কে কাজে লাগিয়ে সেই কাজটা করে নেয়।
.
যেমন মোহাম্মদ আলী বলেছেন,
"I hated every minute of training but I love being a world champion."
.
তো এই ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য আপনার ওই Why টাকে খুজে বের করতে হবে। এই Why যত পাওয়ারফুল হবে আপনিও ততটাই পাওয়ারফুল হবেন।
.
So prepare a Checklist on daily basis, which will guide you throughout the year to stay on the right track.
.
One thing is fixed that you can never escape from the compound effect, either u earn it or you pay for it.

Collected

A desperate success story

স্টোরিঃ সুজি_নাকামুরা 

টমাস এডিসনের বৈদ্যুতিক বাল্বের ভার্সনগুলোর একটা বড় সমস্যা আছে। এখানে বিদ্যুৎ থেকে প্রথমে ফিলামেন্টে তাপশক্তি তৈরি হয়, তারপর সেই তাপ থেকে আলো তৈরি হয়। এফিশেন্সী মাত্র ১০-১৫%। অর্থাৎ মোট শক্তির মাত্র দশভাগের একভাগ আলো তৈরি হয়; বাকিটা নষ্ট।    

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে খেলতে খেলতে একধরণের নতুন বাতি তৈরি করে ফেলেন, সংক্ষেপে ডাকা হয় 'LED' (এল ই ডি)। যেখানে মলেকুলার লেভেলে পদার্থকে ম্যানিপুলেট করে সরাসরি ফোটন নির্গত করা হয় হয়। ফলে মোট শক্তির ৭০ পার্সেন্টকে আলোতে রুপান্তরিত করা যায়।  

এলইডি এর আসল মহাত্ম হলো এটাকে ইচ্ছামত ছোট করা যায়। চাইলেও আগের লাইট বাল্বগুলোকে বেশী ছোট বানাতে পারবেন না। কারন ফিলামেন্ট এবং সেমি-ভ্যাকিউম টিউবের আকারের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেখানে এলইডি কে একটা ডটের সমানও বানানো যায়। সুতরাং বলা যায় এলইডি না থাকলে কম্পিউটার ও ফোনের স্ক্রিন তৈরি করা সম্ভব হত না।  

যাইহোক, লাল ও সবুজ রঙ্গের এলইডি তৈরি করা হয়ে গেলেও নীল এলইডি বানাতে গিয়ে প্রচুর হিমশিম খাচ্ছিলেন ইঞ্জিনিয়াররা। বিভিন্ন কোম্পানি প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রায় ফতুর হয়ে যাবার দশা হয়েছিল। নীল LED তৈরি করা গেলে RGB স্ক্রিন তৈরি করা সম্ভব হত সহজেই। আজকের গল্প সুজি নাকামুরা নামের একজন জাপানিজ টেকনিশিয়ানকে নিয়ে, যিনি প্রায় নিজের একক চেষ্টাতে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।   

নাকামুরার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা খুব ভালো হয়নি, ফলে সাধারণ লোকাল একটা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করতে হয়। স্বপ্ন ছিল থিওরেটিক্যাল ফিজিসিস্ট অথবা গণিতবিদ হবেন। এক শিক্ষক বলল যে পদার্থবিজ্ঞানে ভাত নাই, সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই ভালো হবে। অতঃপর ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলেন যেহেতু এটা ছিল ফিজিক্সের সবথেকে কাছাকাছি।  

ভার্সিটির প্রথম দুই বছরে নানা রকম ইরিলিভেন্ট কোর্স দেখে নাকামুরা হতাশ হয়ে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। এই সময় ফিজিক্সের বিভিন্ন বই পড়ে কাটাতো। থার্ড ইয়ারে থাকতে সেমিকন্ডাক্টরের উপর একটা কোর্স করার পর আবার ক্লাস করার আগ্রহ ফিরে এল। 

মাস্টার্সে নাকামুরা চাইছিল কোন একটা থিওরেটিক্যাল কাজ করতে। কিন্তু তার প্রফেসর টাডা ছিলেন জাঁদরেল এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। সুতরাং বাধ্য হয়ে তাকে এক্সপেরিমেন্টাল কাজই করতে হয়। সে নিজেও তখন জানত না যে এই এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সই তাঁর জন্য ব্লেসিং হয়ে আসবে। তাকে একসময় নোবেল এনে দিবে।  

প্রফেসর টাডার ল্যাব ছিল ভাঙ্গারির দোকানের মত। ভাঙ্গাচোড়া টেলিভিশন খুলে সেখান থেকে স্পেয়ার পার্টস নেয়া হত। নাকামুরা যখন কাজ করত তখন তাকে স্টিলের দোকানে কাজ করা শ্রমিকের থেকে আলাদা দেখাতো না। প্রতিটা স্কিলই নাকামুরার কাজে লেগেছিল পরবর্তীতে।     

মাস্টার্স শেষে কাজ নেন নিশিয়া নামে ছোট একটা কোম্পানিতে। জাপান তখন ইলেক্ট্রনিক্সে বেশ নাম কামাচ্ছে, ছোট বড় অনেক ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি গড়ে উঠেছে। নিশিয়া কোম্পানি টেলিভিশনের জন্য পার্টস বানাতো। ল্যাবের ফসফরাস লিক থেকে প্রায়ই বুম করে শব্দ হত, কলিগেরা যেয়ে দেখত ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে আর নাকামুরা এক কোণায় বসে কাশছে। একসময় বিষয়টা এত নরমাল ব্যাপার যায় যে কলিগেরা বিস্ফোরণের শব্দ পেলেও আর পাত্তা দিত না।    

তখনকার বড় বড় কোম্পানী ছিল সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, বেল ল্যাব ইত্যাদি। এই কোম্পানিগুলো ব্লু এলইডি তৈরি করতে ফেইল করেছে। তখন নিশিয়ার মালিক একটা বড় বাজি ধরলেন। নাকামুরাকে দায়িত্ব দেয়া হলো এই উচ্চভিলাষী প্রজেক্টের, বাজেট ৩ মিলিয়ন ডলার দেয়া হল। 

ব্লু এলইডি বানানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো হাইকোয়ালিটি ক্রিস্টাল বানানো। সামান্য খুঁত থাকলেই সেটা আর কাজ করবে না। নাকামুরাকে বলা হল ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা থেকে এক বছরের জন্য ঘুরে আসতে। সেখানকার পোলাপান নাকি হাইকোয়ালিটির ক্রিস্টাল বানানোর নতুন ধরণের রিয়্যাক্টর নিয়ে কাজ করে। এই মেশিনে একটা গরম চেম্বারের ভেতর নজেল দিয়ে বাষ্প ইনজেক্ট করে ক্রিস্টাল বানানো হয়। 

নাকামুরা গেলেন এক বছরের জন্য, কিন্তু সময় খুব একটা ভালো কাটলো না। আগেই বলেছি নাকামুরার মাস্টার্স ছিল খুব সাধারণ ভার্সিটি থেকে আর করতেন টেকনিশিয়ানের কাজ। পোশাক আশাকে কখনোই স্কলার মনে হত না, তার ওপর ইংরেজিও কাঁচা, কোন পেপারও পাবলিশ হয়নি। সেই ল্যাবে কাজ করত পিএচডি ছাত্ররা, যারা ছিল তার থেকে বয়সে ছোট। ওরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করত।  

এই অভিজ্ঞতা নাকামুরার জেদ বাড়িয়ে দিল। তিনি বলেন- “I feel resentful when people look down on me, At that time, I developed more fighting spirit – I would not allow myself to be beaten by such people.”

তাকে ভালো রিয়্যাক্টরে কাজ করতে দেয়া হল না, নষ্ট একটা রিয়্যাক্টর দেয়া হল। নাকামুরা প্রথম ১০-১২ মাস প্রচুর খাটনি করে মেশিনটা কিভাবে কাজ করে বুঝে নিলেন আর ঠিকমত এসেম্বল করলেন। তারপর সময় শেষ হলে তিনি নিশিয়া কোম্পানির জন্য নতুন একটা রিয়্যাক্টর অর্ডার করলেন। সাথে ঠিক করলেন যেভাবেই হোক একটা পিএচডি নিতে হবে। 

তখন কিন্তু তাঁর বয়স ৩৫, এই বয়সে অন এভারেজ মানুষ পিএইচডি শেষ করে ফেলে।  

এখন রিয়্যাক্টরতো আনা হলো, তো প্রশ্ন হচ্ছে এখানে কোন ধরণের ক্রিস্টাল বানানো যেতে পারে? হাতে আছে অপশন দুইটা- জিঙ্ক সেলেনাইড আর গ্যালিয়াম নাইট্রাইড। জিঙ্ক সেলেনাইড ছিল তখনো পর্যন্ত ব্লু এলইডি গবেষনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অপশন। এটা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। অন্যদিকে গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের কিছু সমস্যা ছিল কারণ এর হাইকোয়ালিটি ক্রিস্টাল বানানো অনেক কঠিন। বেল ল্যাবের মত কোম্পানি গ্যালিয়াম নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খু কাজ করে রায় দিয়েছে যে এই দিকে যাওয়া কানা গলিতে পরার মতনই।    

তখন জাপানে নিয়ম ছিল কেউ যদি একটা বিষয়ে ৫ টা পেপার পাবলিশ করতে পারে তাকে পিএইচডি দেয়া হবে। নাকামুরা ভাবলো, ‘আমি হয়তো ব্লু এলইডি বানাতে পারবো না। কিন্তু গ্যালিয়াম নাইট্রাইডে অনেক নতুন কাজ করার স্কোপ আছে, তাতে অন্তত একটা পিএচডি পাওয়া যাবে’।  

জাপানের একটা বড় বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স হলো। সেখানে জিঙ্ক সেলেনাইড নিয়ে কাজ করেছে এমন লোক ছিল ৫০০, আর গ্যালিয়াম নাইট্রাইড নিয়ে কাজ করছে এমন লোক আছে নাকামুরাসহ মাত্র ৫ জন। এর মধ্যে দুইজন হলেন ইশামু আকাজাকি ও হিরোশি আমানো। এরা দুইজন ক্রিস্টাল তৈরির প্রথম সমস্যা অলরেডি সমাধান করে ফেলেছেন। 

বাকি আছে দুইটা সমস্যা- পি-টাইপ বানানো ও ডিফেক্ট যথাসম্ভব কমানো। আকাজাকি ও আমানোরা মিলে পি-টাইপ বানিয়েছে, কিন্তু কোয়ালিটি খুব একটা ভালো না। নিশিয়ায় ফিরে নাকামুরা প্রথম ৬ মাস বহু চেষ্টা করে সাধারণ ক্রিস্টালও বানাতে পারলেন না। ডেস্পারেট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন রিয়্যাক্টরটা নিজের মত চেঞ্জ করে নিবেন। ফ্লোরিডায় ১০ মাস ভাঙ্গাচোরা রিয়্যাক্টর জোড়া দিয়ে যে স্কিল অর্জন করেছেন সেটা অমূল্য হয়ে ধরা দিল। 

এই সময়ে নাকামুরার রুটিনের কথা বলা যাক। প্রতিদিন ৭ টায় ল্যাবে আসতেন। ৭ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত কাটিং ও ওয়েল্ডিং চলত। এমন কিছু নাই যেটা পরীক্ষা করে দেখা হয় নাই। কখনো মেশিনের হাইট বাড়ানো, পাইপ বাঁকিয়ে দেয়া, গ্যাস নজেলের শেইপ চেঞ্জ করে নতুন করে ওয়েল্ড করা ইত্যাদি।  

তারপর দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত চলত এক্সপেরিমেন্ট, এটা দেখার জন্য যে মেশিনের নতুন ভার্সন ভালো রেজাল্ট দিচ্ছে কিনা। ৭ টায় বাসায় যেয়ে, খেয়ে দেয়ে ঘুম। আবার সকালের ৭ টায় কাজ শুরু। নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটে লেখা আছে নাকামুরা এই কাজ করে গেছেন দিনের পর দিন কোন ছুটি না নিয়ে। সপ্তাহের ৭ দিনই কাজ করতেন। বছরে কেবল একবার ছুটি নিতেন, জাপানিজ নববর্ষের দিনে। 

বছর খানেক পর, নাকামুরা নতুন একটা পরিবর্তন আনলেন রিয়্যাক্টরে। বাষ্প ইনজেক্ট করার নজেল ছিল একটা, তিনি ওয়েল্ড করে উপরে আরেকটা নজেল লাগিয়ে দিলেন। এবার দুই দিক থেকে বাষ্প পড়বে সাবস্ট্রেটের উপর- টু ফ্লো সিস্টেম। ১৯৯০ সালের এক শীতের দিনে ল্যাবে বানানো স্যামপল নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পেলেন। গ্যালিয়াম নাইট্রেটের এত পিউর ক্রিস্টাল এর আগে কেউ বানায় নি। তিনি সেদিনটাকে বলছেনে- জীবনের সবথেকে এক্সাইটিং সময়। 

নাকামুরা তার প্রোটোটাইপ ব্লু এলইডি নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন আমেরিকায়। শ্রোতারা তাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। নাকামুরা কিন্তু তখনো কাজ থামাননি, তখনো এটা ছিল একটা প্রটোটাইপ। এর দুই বছর পর নিশিয়া পৃথিবীর প্রথম ব্লু LED এর কথা প্রকাশ করে।  

দেখেন সুজি নাকামুরা কোন প্রিভিলেজ থেকে শুরু করেন নি, ভালো ডিগ্রি বা ভালো ল্যাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। সত্যি বলতে গেলে তাঁর যায়গায় ৯৯% পার্সেন্ট মানুষ লেগে থাকার কোন কারণ খুঁজে পেত না। এই মানুষদের মধ্যে আমি নিজেও পরি।  

কারণ তাঁর থেকে ভালো বেতনে, অনেক ভালো ল্যাবে ভালো মেশিনপাতি দিয়ে, তার উপর ভালো প্রফেসরের আন্ডারে অনেকে একই গবেষণা করছিল। 'ওদের তুলনায় আমি একা কি বা এমন করতে পারব?'- এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। এই কাহিনী আমার একটা পছন্দের সিনেমার ডায়ালগের কথা মনে করিয়ে দেয়-   

: But is there a line? You know, maybe you go too far, and you discourage the next Charlie Parker from ever becoming Charlie Parker?

: No, man, no. Because the next Charlie Parker would never be discouraged.

(সূত্রঃ Veritasium, নোবেল প্রাইজের ওয়েব সাইট)