Wednesday, April 21, 2021

মালিকের ভালোবাসা সিক্ত আমল 'রোযা'

 

|| মালিকের ভালোবাসা সিক্ত আমল 'রোযা' ||
তাদাব্বুর — “সূরা আল-বাকারাহ ১৮৩-১৮৫”
এ আয়াতগুলিতে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সিয়াম অর্থাৎ রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কিসের জন্য আমরা রোযা রাখি, রোযা রেখে কী লাভ, কাদের জন্য রোযা রাখায় ছাড় আছে ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছেন।
এ আয়াতটি লক্ষ করুন—
“হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যে রকম তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।” [আল-বাক্বারাহ ১৮৩]
এখানে আল্লাহ পাক সুস্পষ্ট ভাবে রোযা রাখার উদ্দেশ্যকে তুলে ধরেছেন। রোযা বলতে শুধু না খেয়ে থাকাকে নয়, বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি সচেতনতা বাড়ানো। প্রথমে বোঝা দরকার তাকওয়া কী।
তাকওয়া শব্দটির অর্থ সাধারণত করা হয়—আল্লাহকে ভয় করা। এটি পুরোপুরি সঠিক অনুবাদ নয়, কারণ ‘ভয়’ এর জন্য আরবিতে ভিন্ন শব্দ রয়েছে—যেমন খাওফ خوف, খশিয়া خشي, হিযর حذر; শুধু কু’রআনেই ১২টি আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গভীরতার ভয়, সতর্কতা, আতঙ্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে ‘তাক্বওয়া’ হচ্ছে ‘সবসময় পূর্ণ সচেতন’ থাকা বা আল্লাহর কথা মনে রেখে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখা।[১][২]
ধরুন, সরকারের কোনো বিশেষ নিয়মের ভেতর আপনার উপর নজরদারির ঘোষণা করা হলো যে, আপনি কখনো আইন ভঙ্গ করেন কিনা সেটা খতিয়ে দেখা এবং রেকর্ড করার!
আপনার বাসার সবগুলো রুমে ক্যামেরা বসানো হলো। যেখানে যেখানে যান সেখানেও ক্যামেরা লাগানো হলো। এক কথায় আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় আপনার দিকে ক্যামেরা তাক করে রাখা হলো। আপনি কী বলছেন, কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী দেখছেন, সবকিছু প্রতি মুহূর্তে রেকর্ড করা হচ্ছে! কল্পনা করুন, যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কিরকম হবে? আপনি প্রতিটা কথা বলার আগে চিন্তা করবেন যে, আপনার কথাগুলো মার্জিত হচ্ছে কি না, আপনার হাঁটা-চলার ধরন ঠিক আছে কি না, কারো উপর খারাপ আচরণ করছেন কি না, উল্টোপাল্টা কিছু করলে সেটা আবার রেকর্ড হয়ে গেলো কি না! আপনি টিভিতে যেসব হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, মুভি দেখেন, যেসব গান শুনেন, ইন্টারনেটে যে সব বাজে সাইটে ঘুরে বেড়ান, সেগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেলে লোকজনের কাছে মান-সন্মান থাকবে কি না। এই যে ক্যামেরার প্রতি আপনার চরম সচেতনতা এবং চরম সতর্কতা, এটাই তাক্বওয়া। আল্লাহ পাকের প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই এর থেকে আরও অনেক বেশি সচেতনতা থাকা উচিত।
এখন প্রশ্ন হলো, রোজার সাথে তাকওয়ার সম্পর্ক কী?
কেউ যখন রোযা রাখে, সে অনেক লম্বা একটা সময় শারীরিক চাহিদা, কামনা-বাসনা, যৌন প্রবৃত্তি থেকে স্বইচ্ছায় দূরে থাকে। ক্ষুধায় তার পেট মোড়ায়। হাত বাড়ালেই খাবার। ইচ্ছে করলেই সে রুমের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে লুকিয়ে পছন্দের খাবারটুকু গোগ্রাসে খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু না! সে এটা করে না, সে মনে করে; 'কেউ না দেখলেও তো আল্লাহ পাক দেখছেন!' আবার একসময় তার পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এক গ্লাস ঠান্ডা পানির জন্য হাহাকার করে ওঠে বুকের ভেতরটা! অথচ, হাত বাড়ালেই পানির গ্লাস, ঠান্ডা স্বচ্ছ মিঠা পানি! কিন্তু সে খায় না, সে নিজেকে বোঝায়, “মাগরিব আসুক। এর আগে এক ফোঁটাও পানি খাওয়া যাবে না। এটাই আল্লাহ পাকের হুকুম।”
সারাদিন অফিসে-স্কুলে-কলেজে তার চোখের সামনে নানা প্রলোভন ঘুরে বেড়ায়। কিছুক্ষণ পর পর বিপরীত লিঙ্গের হাতছানি। ইচ্ছে করলেই সে চোখ উঠিয়ে সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাতে পারে। আবার বাসায় আসলেই টিভি ছেড়ে দিয়ে গুনাহে লিপ্ত হতে পারে। ইন্টারনেটে ঢুকে চুপিচুপি সে অশ্লীলতার সাগরে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু না, সে নিজেকে বোঝায়, “আমি রোজাদার। আমি এখন কোনো খারাপ কিছু দেখতে পারি না, কোনো খারাপ কিছু করতে পারি না। কোনো গুনাহই করতে পারি না।” দিনে কয়েকবার সে সুযোগ পেয়েছে মিথ্যা বলে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার, নিজের দোষ ঢাকার, অন্যায়ভাবে সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার, অন্যের গীবত করার। কিন্তু সে এসব করে না, সে নিজেকে সংযত করে বলে; “আমি তো রোযাদার, মিথ্যা বলে, গীবত করে রোযার ক্ষতি করতে পারি না। আমার রোযাকে মূল্যহীন বানাতে পারিনা।”
আবার যখন আমরা রোজা রাখি না, তখন আমাদের শারীরিক চাহিদা আসলেই আমরা সেটা মিটিয়ে ফেলি, পাপ কাজের ইচ্ছা জাগলেই আর হালাল-হারামের তোয়াক্কা করি না। ক্ষুধা লাগলেই খাই। পিপাসা পেলেই পান করি। কামনা জাগলে, তা সহজে পূরণ করে ফেলি। সুযোগ পেলেই মিথ্যা বলি, ঘুষ খাই, অন্যায় করি, গীবত করি। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে ক্রমেই প্রবৃত্তির দাস বানিয়ে ফেলি। যার ফলে দিনে দিনে কুপ্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকি। প্রবৃত্তি জিততে থাকে, আর আমরা হারতে থাকি। কিন্তু যখন আমরা রোযা রাখি, প্রতিদিন একটা বিরাট সময় আমরা আমাদের প্রবৃত্তিকে শক্ত হাতে দমন করে রাখি। কিছুক্ষণ পর পর প্রবৃত্তি মাতাচাড়া দিয়ে উঠে, আমাদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে চায়। কিন্তু তখনি আমরা সেটাকে পরাজিত করে নিজের উপর আবার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেই। এভাবে একটা মাস আমরা প্রবৃত্তির উপর জিতে যাওয়ার শক্তপোক্ত ট্রেনিং নিতে থাকি। তখন আমাদের নফস ধীরে ধীরে বশে চলে আসে। এবং আল্লাহ পাকের নির্দেশ মানা, অন্যায় থেকে দূরে থাকাটা তখন আমাদের জন্য আরও সহজ হতে থাকে। এভাবেই আমরা রোযা রেখে তাকওয়া অর্জন করি। [১]
রমযান তাই গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য প্রশিক্ষণের মাস! একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
প্রাচীন আরবরা ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ করতে যেত। কিন্তু উটের মতো উত্তপ্ত মরুভূমিতে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য ঠিক ঘোরা মোটেও উপযুক্ত নয়। এরা পানি ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। একারণে আরবরা ঘোড়াকে মরুভূমির প্রখর উত্তাপে বার বার দৌড়িয়ে মরুভূমিতে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দিত। এভাবে ঘোড়াকে প্রচণ্ড তাপে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি করাকে তারা সিয়াম বলত। সিয়াম, যাকে আমরা রোযা বলি, মুমিনদের জন্য এটাও মূলত একধরনের মিলিটারি ট্রেনিং! এটি আমাদের শক্ত করে, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য শারীরিক এবং মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়। যাতে আমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারি। [১][১৬]
একজন মুমিনের রোযা অবস্থায় গুনাহ কেনই বা হবে?
এতোদিন যেগুলো বৈধ ছিলো, সেগুলোই যখন রোযা অবস্থায় খাওয়া বা পান করা হারাম। যেমন: ভাত, গোশত, রুটি, খেজুর, পানি...ইত্যাদি।
আর এতোদিন থেকে যেগুলো অবৈধই ছিলো, হারামই ছিলো, যেমন: গান শোনা, মুভি দেখা, হারাম রিলেশন, পর্ণগ্রাফী, হস্তমৈথুন, মিথ্যা, গীবত ইত্যাদি। সেগুলো আবার রোযা রাখা অবস্থায় চালিয়ে যাওয়া কিভাবে যুক্তিসঙ্গত?
তাই একজন রোযাদার শুধু খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকাকেই নয় বরং সমস্ত গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাকে “রোযা রাখা” মনে করে। আর এটাই পুরোপুরি তাকওয়াপূর্ণ রোযা। উপরিউক্ত আয়াতে এ ধরনের তাকওয়ার কথাই বোঝানো হয়েছে, যে তাকওয়া সমস্ত গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
এরপরের আয়াতে আল্লাহ পাক আমাদেরকে দেখিয়েছেন, কোন কোন পরিস্থিতিতে রমযানে রোযা রাখা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয় এবং তিনি কতোটা সহজতর করে দিয়েছেন!—
“রোযা নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের জন্য। তারপরেও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাবে অন্য সময়ে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। যারা এর শক্তি রাখে তারা একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে (রোযার) ফিদয়া আদায় করতে পারবে। এছাড়া কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন পূণ্যের কাজ করে তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। আর তোমাদের মধ্যে যদি সমঝ থাকে, তবে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো।” [আল-বাক্বারাহ ১৮৪]
এই আয়াতে ফিদয়া আদায় করার কথা বলা হয়েছে। তা আসলে কি! এটা কি সবার জন্য প্রযোজ্য? চলুন বিষয়টা বিশ্লেষণ করা যাক।
ফিদয়া: প্রথমদিকে যখন রোযা ফরজ করা হয় তখন এই সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল যে, কোনও ব্যক্তি রোযা না রেখে তার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে ফিদয়া আদায় করতে পারবে। পরবর্তীতে ১৮৫ নং (যা সামনে আসছে) আয়াতে এ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয় যে, যে ব্যক্তিই রমযান মাস পাবে তাকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। অবশ্য যারা বৃদ্ধ, রোযা রাখার শক্তি নেই এবং ভবিষ্যতে রোযা রাখার মতো শক্তি ফিরে আসারও কোন আশা নেই, তাদের জন্য এ সুবিধা এখনও বাকি রাখা হয়েছে। [৩]
ফিদয়ার এই বিষয়টির মাধ্যমে সূক্ষ্ম একটি ব্যপার আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ পাক তাঁর কোনো হুকুম আচমকা নাজিল করেননি। বরং বান্দাদের সুবিধার্থে ধীরে ধীরে নাজিল করেছেন এবং সাধ্যের অতীত বোঝা চাপান নি বরং নানাবিধ সুবিধাও রেখেছেন।
অসুস্থতা, অক্ষমতায় নিজের উপর জোর করে, অসুস্থতা বাড়িয়ে রোজা রাখতে আল্লাহ পাক আমাদেরকে বলেননি। আমাদের মধ্যে অনেকেই চেষ্টা করি জোর করে আল্লাহকে খুশি করার। অথচ, আল্লাহ পাক আমাদেরকে কোনো জবরদস্থি করতে বলেননি।
তাফসিরগুলোতে এই নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। একাধিক সাহাবি (রাঃ) থেকে আসা মত অনুসারে; কারো যদি অসুস্থতা বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। গর্ভবতী বা শিশু বাচ্চাকে দুধ পান করান এমন মা, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষরা রমজান মাসে রোজা রাখতে কষ্ট হলে বা স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি থাকলে, প্রতিটি রোজার বদলে একদিন করে একজন গরিব মানুষকে সাধ্যমত খাওয়াবে। একইভাবে সফরে থাকলেও রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়, যদি রোজা রাখার ফলে কষ্টের সৃষ্টি হয়।[১১][৬] তবে একাধিক মাযহাবের মত অনুসারে কেউ যদি রমজানের পরে রোজা রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে গরিব খাওয়ানো যাবে না, নিজে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। সুতরাং অসুস্থতা সাময়িক হলে এবং মা’দের রমজানের পরে রোযা রাখতে হবে, গরিব খাওয়ালে হবে না।
কী ধরণের অসুস্থতা হলে এবং কী ধরণের সফর হলে রোজা না রাখলেও হবে, এ নিয়ে বিভিন্ন ফিকহ-এর আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।[১১][৩][৬] যেহেতু আল্লাহ পাক এখানে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, তাই তারা আশংকা করেছেন যে, মানুষ ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেবে এবং একটু অসুস্থ হলেই, বা সামান্য সফরে গেলেই রোজা রাখা ছেড়ে দেবে। তাই তারা সফরের দৈর্ঘ্য কতটুকু, কতদিনের হতে হবে, এ নিয়ে কিছু শর্ত দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য হাদিস থেকে এই শর্তগুলোর পক্ষে ইজমা হওয়ার মতো যথেষ্ট দলিল পাওয়া যায়নি বলে একাধিক তাফসিরবিদদের মত।[৩][৬] তাদের বক্তব্য হচ্ছে; আল্লাহ পাক এখানে কোনো শর্ত দেননি, কারণ রোজা রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন। কেউ যদি আল্লাহর সাথে প্রতারণা করতেই চায়, নিজের প্রবৃত্তির কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিতে চায়, তাহলে তার জন্য এই সব শর্ত থাকা বা না থাকাটা একই কথা। যে সবসময় সুযোগ খুঁজে কীভাবে আইনের ফাঁকফোকর বের করে পার পেয়ে যাওয়া যায়, তাকে হাইকোর্ট দেখিয়ে খুব একটা লাভ হয় না। বরং এই সব মানুষকে ঠিক করতে গিয়ে অন্য সবার জন্য ধর্মের মধ্যে অতিরিক্ত কড়াকড়ি করলে, তা উলটো মানুষকে ধর্মের প্রতি নিরুৎসাহিত করে।[৬]
আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম ধর্ম আল্লাহ পাক-ই আমাদেরকে দিয়েছেন, কোনো মানুষ তা নির্ধারণ করেনি। কখন মানুষকে শক্ত নিয়ম দিতে হবে, কখন ছাড় দিতে হবে, ছাড় দিলে তার সুদূর প্রসারি ফলাফল কী হবে —এটা আল্লাহ পাক যে কোনো মানুষের থেকে ভালো জানেন। সুতরাং কোনো এক প্রজন্মের ইসলামকে হালকা ভাবে নিয়ে অবহেলা করা দেখে, সে প্রজন্মের আলেমরা যদি ইসলামে নানা শক্ত নিয়ম, শর্ত যোগ করেন, তাহলে সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবসময় কল্যাণকর নাও হতে পারে, বরং তাদের প্রতি অন্যায় হয়ে যেতে পারে। একারণে আল্লাহ পাক যদি কোনো নিয়ম মানার বেলায় শিথিলতা দেন, তাহলে আমাদের আল্লাহর পাকের প্রজ্ঞার উপর আস্থা রাখতে হবে।[৬]
চলুন এর পরের আয়াতটি নিয়ে ভাবা যাক—
“রমজান মাস- যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদের যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” [আল-বাক্বারাহ ১৮৫]
রমযান মাস যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের জন্য কতো পালনীয় সেটা বোঝা যায় এই মাসেই কুর’আন নাজিল হওয়ার মাধ্যমে। তাই রমযান মাস হচ্ছে কুর’আন উদযাপনের মাস। এই মাসে কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্ক যাতে আরও গাঢ় হয় এজন্য এই আয়াতে আল্লাহ পাক কুরআনের বৈশিষ্ট্যের দিকে ফোকাস করে বলেছেন; “...যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়।...” কুর'আনের এই বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সামনে রেখে আমরা যেন পুরো রমযান মাস কুর'আনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে বাকি ১১ মাস তা জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি, আয়াতটি সেই তার্গেটকেই নির্দেশ করে।
আবার এই আয়াতে আরেকটি চমৎকার বিষয় নিহিত আছে যা আল্লাহ পাক ও আমাদের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসার এক বিশাল ভুবনের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। এ আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন;
“... আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না।”
কতো চমৎকার একটি আয়াত তাইনা! যে আল্লাহ পাক আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের নাড়ীনক্ষত্র আদ্যোপান্ত যাঁর কতৃত্বে, তিঁনি যেমন ইচ্ছে তেমনি ভাবে আমাদের পরিচালনার ক্ষমতা রাখেন, অধিকার রাখেন। এমত দ্বা সত্ত্বেও তিঁনি আমাদের উপর এমন কিছু হুকুম রাখতে চান না, যা বিন্দুমাত্রও জটিলতা সৃষ্টি করে, কষ্টদায়ক হয়ে যায়। বরং সবকিছু সহজ করতে চান!
এটা যে কতোবড় উদারতা এটা বোঝাতে গিয়ে আমি একটি উদাহরণ সামনে নিয়ে আসতে চাই। সেটা হলো —
আরবের জাহেলিয়াত যুগে দাস প্রথা চালু ছিলো। নিয়ম হলো দাস কেনার পর তাকে যা ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে গাধার মতো খাটিয়ে নেওয়া যাবে। মালিকের হুকুমকৃত কাজটি করতে গিয়ে জান বের হয়ে গেলেও দাসের কোনো অধিকার নেই মালিকের বিরুদ্ধে কথা বলার। তাকে যা পরতে দেওয়া হয় সেটাই পরিধান করবে, যা খেতে দেওয়া হবে সেটাই তাকে খেতে হবে।
ঠিক এই ব্যপারটাই আল্লাহ এবং আমাদের মধ্যে ভাবুন এবং তার সাথে উপরিউক্ত আয়াতটির কথা চিন্তা করুন। আহ্... কতো চমৎকারই না আমাদের রব! কতোই না ভালোবাসেন তিঁনি আমাদের! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!
আমরাই শুধু আমাদের অজ্ঞতার কারণে ভুল বুঝি! যেমন, আমাদের ভেতর অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে, আমরা মনে করি; আমরা আল্লাহর পাকের জন্য যত কষ্ট করবো, তত সওয়াব, এতে প্রাণ চলে যায় যাক! কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়।
বরং আল্লাহর কখনই চান না আমরা যেন নিজেদেরকে জোর করি, ইচ্ছা করে কষ্ট দেই। তিনি চান আমাদের জীবনটা যেন সহজ, সুন্দর হয়। আমরা যেন দুনিয়ার হাজারো প্রলোভন থেকে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তারপর একদিন জান্নাতে গিয়ে চিরজীবন আনন্দে থাকতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে অনেকেই ইবাদতের মধ্যে পালনের কাঠিন্যতা দেখিয়ে, হাজারো শর্ত জুড়ে দিয়ে ধর্মকে অনেক কঠিন করে উপস্থাপন করেন। যার ফলাফলে, নতুন প্রজন্ম ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
যেমন, আমাদের মাঝে অনেকেই, কোনো ব্যক্তিকে অসুস্থ বা রোযা দিতে অক্ষম দেখেও কঠোর হুমকির সাথে ফতোয়া দিয়ে দেয় যে, ‘রোযা না রাখলে সরাসরি জাহান্নামের লাকড়ি হয়ে জ্বলবি!’ ‘যতো সমস্যাই থাক রোযা দিতেই হবে, দিতে দিতে যদি মরেও যাস, তবুও রোযা ছাড়া যাবে না। নতুবা জাহান্নামের আগুনে চিরস্থায়ী ভাবে জ্বলতে থাকবি!”
অথচ আল্লাহ পাক আমাদের উরপ এমন কোনো হুকুম চাপান নি যার কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়! বরং তিঁনি আমাদের উপর এমন ভাবে জীবন-বিধান দিয়ে দিয়েছেন, যেভাবে জীবন পার করলে এই দুনিয়াতেই আমরা হাসিখুশি থাকতে পারব, নিজের জীবন, পরিবারে, সমাজে, দেশে শান্তি নিয়ে আসতে পারব। একই সাথে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনাবিল, অফুরন্ত শান্তিতে জান্নাত উপভোগ করতে পারব। তিনি আমাদেরকে বলেননি এই দুনিয়াতে নিজেদের উপরে ইচ্ছা করে কষ্ট দিতে। বরং তিনি পৃথিবীতে অসংখ্য হালাল আনন্দের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন এবং সেগুলো উপভোগ করার নির্দেশ কু’রআনেই দিয়েছেন। যেমন—
“আল্লাহ তোমাদেরকে এই জীবনে যা দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে এর পরের জীবনকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করো, কিন্তু সেই সাথে এই দুনিয়াতে তোমার যে প্রাপ্য রয়েছে, সেটা ভুলে যেও না। অন্যের সাথে ভালো কাজ করো, যেভাবে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে দুর্নীতি ছড়ানোর চেষ্টা করবে না। দুর্নীতিবাজদের আল্লাহ পছন্দ করেন না!” [আল-কাসাস ২৮:৭৭]
বল, “কে তোমাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য এবং ভালো-পবিত্র খাবার উপভোগ করতে মানা করেছে, যা তিনি তার বান্দাদের জন্যই তৈরি করেছেন?” বলে দাও, “এগুলো তাদেরই জন্য যারা এই দুনিয়াতে বিশ্বাস করে: কিয়ামতের দিন এগুলো শুধুমাত্র তাদেরই হবে।” এভাবেই আমি আমার বাণীকে পরিষ্কার করে দেই বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। [আল-আরাফ ৭:৩২]
সূরা বাকারাহ-এর এই আলোচ্য আয়াত তিনটির মূলকথা একটাই; জীবনকে উপভোগ করতে হবে আল্লাহর প্রতি অনুগত থেকে, কৃতজ্ঞ থেকে এবং পাপের ব্যাপারে সবসময় সাবধান থেকে। তাঁকে ভালোবাসতে হবে সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। রোযা শুধু খাওয়া থেকে বেঁচে থাকার নাম নয়, বরং সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার নাম।
সূত্র:
[১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
[২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
[৩] তাফসীরে তাওযীহুল কু’রআন (প্রথম খন্ড,পৃ:১১৫) — মুফতি মোহাম্মদ তাকী উসমানী দাঃবাঃ
[৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
[৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
[৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
[৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
[৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
[৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
[১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
[১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
[১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
[১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
[১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
[১৫] তাফসির আল জালালাইন।
[১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ।
Collected

No comments:

Post a Comment