নিয়ত যেভাবে বদলে যায়-
দ্বীনের জন্য দরদ, ভালোবাসা থেকে অনেকেই নিজেকে দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত করে। কেউ প্রকাশনী দেয়, কেউ কোথাও উস্তাদ হয়, কেউ দাওয়ার সার্থে অডিও বানায়, ভিডিও বানায়, কেউ বই লিখে আবার কেউ কেউ কেবল ফেসবুকে পোস্ট দেয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সবার নিয়ত কেবল আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকা, মানুষকে ভুলের পথ থেকে সরিয়ে সত্যের পথে নিয়ে আসা।
.
প্রথম প্রথম অধিকাংশের নিয়ত খাঁটি ই থাকে, গুটিকয়েক বাদে। সময়ের পালাক্রমে শয়তান তার চাল বিস্তার করে, আর অন্যদিকে এই সকল দ্বীনের দরদী মানুষেরা অনেকেই নিজেদের ঈমান, আমল, ইখলাসের যত্ন নেয়ায় গাফেল হয়ে পড়ে, জীবনের ব্যস্ততায় আটকে যায়।
.
ফলে এক সময় দেখা যায়, অবচেতন মনে নিয়তের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করে। প্রকাশক বৃহত্তর কল্যাণের উদ্দেশ্যে বই বের করার পরিবর্তে ট্রেন্ডি, অধিক সেল হবে সম্ভাবনাময় বই বের করে মার্কেটে টিকে থাকাকে আর মুনাফাকে ধীরে ধীরে উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয়।
.
কেউ কেউ জীবনযাপনের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক রাখতে গিয়ে নিজের যোগ্যতা না থাকা সত্বেও কোন একাডেমির কোর্স ইন্সট্রাকটর হয়ে যায়, হালকার উপর ঝাপসা বয়ান দিয়ে নিজেকে যোগ্য হিসেবে তুলে ধরে, ফলে ইল্ম আর উদ্দেশ্য থাকেনা, থাকে খ্যাতি বা অর্থ। পরে দেখা যায়, তার সেই ফিল্ডে কোন একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ই নেই!
.
কারো কারো ইল্মের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে ঠিক ই, কিন্তু ওয়াজের ময়দানে টিকে থাকার জন্য দেখা যায় বেফাস, শরীয়া কম্প্রোমাইজ করে এমন সব কথা বলে ফেলে যা কোন ঈমানদার এর মুখে মানায় না, অথচ তারা ভাইরাল বক্তা, অনুসরণীয় মডেল হয়ে বসেন, উদ্দেশ্য তখন অন্যের ইসলাহ এর পরিবর্তে বেশি বেশি মাহফিলের ডাক পাওয়া আর পরবর্তী মাহফিলগুলোতে বেশি হাদিয়া পাওয়া মূখ্য হয়ে উঠে।
.
কেউ কেউ ইসলামিক অডিও, ভিডিও বানায় ইসলামের সঠিক বার্তা, শত্রুদের ষড়যন্ত্র প্রকাশের জন্য, উম্মাহ কে সতর্ক করার জন্য, পরে একসময় দেখা যায়, এইসব করতে করতে নিজের পেইজ, ইউটিউব চ্যানেল থেকে অর্থ ইনকাম ই মূখ্য হয়ে উঠে, মানুষের প্রশংসার জন্য সত্য এবং প্রয়োজনীয় কাজ ছেড়ে ট্রেন্ডি, ভাইরাল হবার মত টপিকের দিকেই ছুটে যায়৷
.
তুলনায় অল্প সংখ্যক কিছু ভাইয়েরা নিজের দ্বীনের উপলব্ধিতে, ইসলামের বিরুদ্ধে সব রকমের শত্রুদের মোকাবেলার জন্য নিজের হাতে বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র কলম তুলে নেন, এক সময় পর্যন্ত নিয়ত ঠিক থাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বই বের হয়, বেস্ট সেলার হন অনেকেই, বা হওয়ার পথে থাকেন কেউ কেউ। তখন কারো কারো অন্তরে ঢুকে যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার মোহ, বিখ্যাত লেখক হবার আকাংখা। ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে, পাঠক সন্তুষ্টি হয়ে যায় মূল নিয়াহ, তখন পাঠকপ্রিয় টপিকে লেখা চলতে থাকে, বা পাঠকপ্রিয় হয়ে যাবার পর বই বের করা প্রয়োজন না হলেও একের পর এক বই বের করা সেক্যুলার বিখ্যাত রাইটারদের মত এক অভ্যাস হয়ে যায়, প্রকাশকদের অনুরোধে লিখতেই হয়!
.
এমনকি ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে দ্বীন নিয়ে লিখতে লিখতে অনেকের নিয়তও এক সময় সেলিব্রেটি লেখক হওয়াতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। শুরুর দিকে একটা লেখা যেভাবে কেবল আল্লাহর জন্য, উম্মাহকে সত্যের পথে ডাকার জন্য হতো কেবল, সেগুলো তখন লাইক কমেন্ট শেয়ারের ভার্চুয়াল বাণিজ্যে আটকে পড়ে।
.
এভাবেই দ্বীনের জন্য জজবা ভালোবাসা, সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তের পরিবর্তে ধীরে ধীরে অন্তরগুলো কলুষিত হতে থাকে, আর তা অর্থ, খ্যাতি, আলোচনায় থাকা, প্রবৃত্তির সুখ এইসব দ্বারা কখন যে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়, টের ই পাওয়া যায়না।
অনেক আগে, কোন এক বইয়ে একজন ইমামের ঘটনা পড়েছিলাম৷ একবার তিনি কোন নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন, মাঝি তার নৌকায় লুকিয়ে কী যেনো নিয়ে যাচ্ছে। যখন তিনি সেটা যাচাই করতে গেলেন, দেখতে পেলেন যে অনেকগুলো বোতল বা পাত্রে ভরে মদ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখনকার শাসকের জন্য।
.
এই অবস্থা দেখে নাহি আল মুনকার, অসৎ কাজে বাধা দেয়ার আল্লাহর যে হুকুম সেই হুকুম পালনের নিয়তে একে একে সবগুলো মদের পাত্র ভাংতে লাগলেন। এভাবে ভাংতে ভাংতে যখন শেষ পাত্রটা বাকি তখন হঠাৎ করেই সেটা না ভেংগে ছেড়ে দিলেন।
.
শাসক তাকে দরবারে ডেকে পাঠালেন, উনি গেলেন, উনাকে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে শাসক কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেনো তিনি এমন কাজ করেছেন, আর কেনোই বা একটা মদের পাত্র বাকি রাখলেন।
.
উনি উত্তরে জানালেন, উনি যখন মদের পাত্রগুলো ভাংগা শুরু করেন তখন তার অন্তরে ছিল কেবল আল্লাহর নাহি আল মুনকারের নির্দেশ মানার নিয়ত, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু এভাবে ভাংতে ভাংতে শেষ পাত্র ভাংগার আগ মুহূর্তে তার অন্তরে আসা শুরু করলো, "আরে আমি তো খুব সাহসিকতার কাজ করে ফেলছি, খুব ই উত্তম, বাহবা পাওয়ার কাজ করে ফেলছি, এমন সাহস কয়জন ই বা দেখাতে পারবে একজন রাজার বা শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে"!
.
নিয়তে এই গড়বড় উপলব্ধি করার সাথে সাথেই নিজেকে তিনি থামিয়ে নিলেন, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে অন্য কোন উদ্দশ্যে সেই মহৎ কাজটা করা যে রিয়া বা ছোট শির্কের দিকে নিয়ে যাবে, সেটা আচ করতে পেরেই সম্পূর্ণ কাজ টা শেষ করলেন না! সুবহান আল্লাহ প্রতি মুহূর্তে অন্তরের অবস্থার কী সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ!
.
এই ঘটনাটা খুব মনে ধরেছিল, নিয়ত যে কত গুরুত্বপূর্ণ, আর তা যে কত সূক্ষ্মভাবে ভেতরে ভেতরে নড়বড় হতে থাকে তা বোঝার জন্য খুব ই উপকারি একটা শিক্ষা। আমাদের সকলের উচিত নিজেদের নিয়তকে সার্বক্ষণিক যাচাই এর মধ্যে রাখা, হয়তো অনেক বড় বড় কাজ হয়ে যায় অনেকের দ্বারা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিয়তে ভ্রান্তি চলে আসে, যা খেয়াল করা হয়না।
.
এমনকি এই যে পোস্ট টা এখন লিখছি, আর একটু পর পোস্ট করবো, না জানি এর নিয়তেও নিজেই ধরা খেয়ে যাই, আল্লাহ হিফাযত করুন। দিন শেষে অনেক বড় বড় খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যদি আখিরাতে গিয়ে ফলাফল শূণ্য, উল্টা জাহান্নামে যেতে হয়, তার চেয়ে বরং এই ঢের ভালো, অল্প ইখলাস সম্পন্ন আমলে (অবশ্যই ফরজ, সুন্নাত, ওয়াজিব বাদ দিয়ে নিয়) জান্নাতে যেতে পারাটাই অনেক অনেক উত্তম, সেটাই সাফল্য।
.
কী লাভ এত এত ইখলাস বিহীন আমল দিয়ে, যেখানে দিন শেষে জাহান্নামের প্রথম তিনজনের ( ফেইক শহীদ, আলিম, দানশীল) পরিণতি বরণ করতে হয়! আমল কম হোক, অন্তত তা খাঁটি হোক, শুদ্ধ হোক। খাঁটি নিয়তে অধিক আমল, অধিক খিদমত করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা!
আল্লাহ আমাদের নিয়তকে কেবল তার সন্তুষ্টির জন্য খালিস করে দিন, আমীন।
No comments:
Post a Comment