দারুণ এক ‘বিজনেস পলিসি’।
অথচ মানুষটা দেখতে শুনতে নিতান্তই গোবেচারা। পেশায় কসাই। তার প্রচলিত আর পাঁচ-দশটা কসাইয়ের চেয়ে তার ব্যবসার ধরণ ভিন্ন। অন্যরা প্রতিদিন গোশত বিক্রি করে। এই মানুষটা সপ্তাহে শুধু একদিন-শুক্রবার ছুটির দিন গোশত বিক্রি করে। বাকি দিনগুলোতে খালি দোকান খুলে বসে থাকে। প্রতি সোম-মঙ্গলবারের দিকে কোত্থেকে বিরাট, তাগড়া, দশাসই এক গরু নিয়ে আসে। কোনো সপ্তাহে মহিষ।
গরু-মহিষ আনার আগে থেকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রচারণা চালাতে শুরু করে। শুক্রবার রাত থেকেই প্রচার শুরু হয়। দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়া পথিককে সালাম দিয়ে বলে
-ভাই, আগামি সোমবারে গরু আইব। দোয়া রাইখেন।
নিয়মিত যারা ক্রেতা তাদের কাছে খবর পাঠায়। মসজিদের হুজুরের কাছে দোয়া চায়। ছোট শিশুরা তার প্রচারণার বাইরে থাকে না,
-বাজান, গরু গোশত দিয়ে ভাত খাইছ? আমগো গরুর লাইগা দোয়া কইর। সোমবারে গাবতলি হাট থিকা আনমু।
গরু কেনার আগাগোড়া প্রক্রিয়া সম্পর্কেও নিয়মিত আপডেট দিতে থাকে। এই পর্বে থাকে গরুর ঠিকুজি-কুলজি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ,
-ও ভোইন, এবারের গরুটা কিন্তু এক্কেবারে খাঁটি। নোয়াখালির চর আলেকজান্ডার থেকে সরাসরি আমদানি করা। পিউর ঘাসলতা খাওয়া গরু। চাষ বা খামারের না। এই গরুর গোশত যে একবার খাইছে, সারাজীবন তার স্বাদ জিভে লেগে থাকবে।
আপডেট চলতে থাকে,
-ভাইজান, আজ গরুর মালিকের সাথে কথা ফাইনাল। রাতে ঢাকায় ঢুকবে।
গরুর ট্রাক কখন কতদূর পৌঁছল, সেটার ধারাবাহিক ধারাভাষ্য চলতে থাকে। গরু আনতে যাওয়ার আগে হুজুর ডেকে দোকানে দোয়া করায়। জিলিপি বিলায়। গরু আনতে যাওয়ার সময় দোকানে একজনকে বসিয়ে যায়। তার কাজ হল, দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া প্রতিটি ব্যক্তিকে গরুর আপডেট জানানো।
কসাই গরু আনতে যাওয়ার সময়, নিয়মিত ও অনিয়মিত ক্রেতাদের কাছে ফোন করে দোয়া চেয়ে নেয়। গরু নিয়ে মহল্লায় প্রবেশের দৃশ্যটাও দেখার মতো। কসাইয়ের সহকারিরা ফুলের মালা, মোবাইল, ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত থাকে। গরু ও কসাই উভয়কেই মালা দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। দোকানের কাছাকাছি এলে, কোনো সপ্তাহে কসাইয়ের মা, কখনো বাবা, কখনো অন্য কোনো মুরুব্বির হাতে গরু বা মহিষের রশি ধরিয়ে দেয়া হয়। তারা দোকানের সামনে রাখা খুঁটির সাথে রশিটা বাঁধেন। গরুর শুভাগমন উপলক্ষ্যে হালকা মিষ্টি বিতরণ হয়।
এরপর থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্ব। কখনো দেখা যায় কসাই নিজহাতে গরুকে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। কখনো ফুলের মালা দিয়ে গরুর সাথে সেলফি তুলছে। গরুর গায়ে বসা তো দূরের কথা, পাশ দিয়েও কোনো মশা-মাছি যায় কি না, সেদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নজর রাখছে। ভুলে কোনো মাছি এদিকে এসে পড়লে, ওটাকে তাড়াতে তাড়াতে গলিছাড়া করে তারপর দম নেয়।
বাকিসময় কসাই বসে বসে গরুর সাথে গল্প করে। কত কী যে বলে। জীবনে যা করেছি, যা করেনি, সবই গরুকে বলে। নিজের বা পাড়ার ছেলে-মেয়েদেরকে গরুর পিঠে বসিয়ে ছবি তোলে।
গরু জবেহ করা হয় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে। গরু জবেহ করতে যাওয়ার সময়ও অনেক নাটকীয়তা। শেষবারের মতো গরুটাকে মালা পরানো হয়। গরুটাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না থেকে শুরু করে, আরো নানা আনুষ্ঠানিকতা।
ফজরের পরপরই দোকানে দোকানে গোশত উঠে যায়। দোকানের এককোণে তরতাজা গোশত রান্না হতে থাকে। অত্যন্ত ছোট ছোট টুকরায় কুটে কিছু গোশত রান্না করা হয়। ক্রেতাদেরকে ডেকচি থেকে ধোঁয়া ওঠা গোশত খেতে দিয়ে বলে,
-খেয়ে দেখুন। মজা না লাগলে কিনবেন না।
ক্রেতা না হলেও যারা দেখতে আসে, তাদেরকেও গোশত চাখতে দেয়। ছোট বাচ্চা এলে, তাকেও দেয়। ধনী-গরিব সব বাচ্চাই এক টুকরা পায়। গোশতের লোভে গরীব ছেলেমেয়েরা দোকানে ভীড় করে। হাঁড়ি খালি হওয়া পর্যন্ত রান্না করা গোশত বিলানো চলতে থাকে। গোশত শেষ হলে ছোট্ট চামচে করে গোশতের ঝোল দেয়া হয়।
জুমার আগেই গোটা গরু বিক্রি শেষ।
No comments:
Post a Comment