রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি
। চোখ দুইটা বড্ড জ্বালা করছে। একটাও খালি রিকশা নাই। মনে মনে কল্পনা করি ঠাডা
পড়ছে রিকশার উপর। হেসে ফেলি। এই রে পাশে কখন অধরা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
এই মেয়ের সমস্যা কি? একটু আগে
খোঁজ নিয়ে গেছে, এখন আবার ! দুষ্টু বুদ্ধি মাথার ভিতর
তিড়িং বিড়িং লাফ দিতে থাকে! পাশ থেকে অধরার কাচ ভাঙ্গা হাসির শব্দ শুনতে পাই।
মেয়েটা আবার শুরু করেছে। এবার আর থামানো যাবে না, হাসতেই
থাকবে। উল্টো ঘুরে দৌড় দেয়ার চিন্তা অনেক কষ্টে দমন করলাম। কিন্তু অধরার পরের
কথা শুনে ঢোঁক গিলেই ঝেঁড়ে দৌড় দিলাম উল্টা দিকে। কিন্তু হায়, এখানেও কবি উলঙ্গ! জামা ধরে ফেলেছে অধরা! আর জামার বোতাম টান দিলেই
খুঁলে যায়। পট পট করে সব বোতাম খুলে গেছে। হায় খোদা! ধরণী এখনও দ্বিধা হচ্ছে না
কেন বুঝলাম না। আমেরিকায় গিয়া উঠতাম, বহুত শখ আমেরিকায়
যাওয়ার। খুলনায় এত গুলা ম্যানহোল কিন্তু আশে পাশে তাকিয়ে একটাও দেখতে পেলাম না।
হায়, ঈশ্বার নীরব, কবি উলঙ্গ!
কি করব ভাবতে ভাবতেই আবার অধরার কাঁচ ভাঙ্গা হাসির শব্দ। নাহ, মেয়েটাকে শায়েস্তা করা দরকার। গম্ভীরভাবে পিছন ফিরলাম। কিন্তু এ কি!
মেয়েটার মুখে শ্রাবনের মেঘ জমে গেছে। যে কোন সময় দখিনা জানলা খুলে ঝড় আসবে।
তাড়াতাড়ি বলা শুরু করলাম-'শোনো আমি একটু.......'
মাঝপথে থামিয়ে দেয় অধরা। 'আজ তোমার
জন্মদিন সুমন'। চমকে উঠি আমি। মনে পড়ে যায় সেই ছোট্ট
বেলার কথা
খুব ছোট বেলায় বাবা-মা
জন্মদিনে কোন উপহার দেয়নি বলে খুব অভিমান করেছিলাম। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে যখন
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাই, উঠে দেখি
আমার রুমের টেবিলের পুরোটা জুড়ে এক বিশাল কেক! আজ বাবা-মা দুজনেই গ্রামে থাকেন।
বাবা ইদানিং ভালো চোখে দেখতে পাননা। মা প্রচন্ড অসুস্থ। ছোট ভাইটার লেখা পড়ার খরচ
আমাকেই দেখতে হয়।
আবার চমকে উঠি অধরার কথায়-'শুভ জন্মদিন সুমন' তোতলামি এসে
যায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। অপ্সরীর মত লাগছে ওকে।
হঠাৎ ঠাস করে চড়। -'তুমি কি কিছু বোঝ না? আমার সাথে
ঠিক মতো কথা বলনা কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? বল সুমন?' আমি আরো অবাক! মাঝখান দিয়ে
ব্যাগড়া বাঁধাল চোখ দুটো। এতক্ষন অনেক কষ্টে পানি আটকে রেখেছিলাম। এবার টপ টপ করে
পড়া শুরু হল।
কিছুক্ষন পর আবিষ্কার করলাম
আমি বটগাছটার নিচে বসে আছি। ভার্সিটি লাইফে আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। মন খারাপ
হলেই এখানে চলে আসি। চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকি। ছোট্ট একটা ছেলে থাকে এখানে। সারা
গায়ে ময়লা লেগে থাকে। কিন্তু ওর পবিত্র হাসিটা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। আমাকে
দেখলেই দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে 'কেমন
আছো ভাইয়্যা?' পিচ্চিটার মুখে ভাইয়্যা ডাক শুনলেই মন
ভালো হয়ে যায়।
-ঐ এত কি ভাবো?
*কিছু না।
-চোখে পানি কেনো?
*জানিনাহ, এমনি।
অধরা ওর ওড়না দিয়ে চোখ
মুছে দেয়।
-এই দুষ্টু ছেলে,
কি দেখো অমন করে?
*আ-আমি কিছু দেখিনা
-হিহিহি.....
*হাসো ক্যানো?
-অ্যাই তুমি নিজের যত্ন
নাওনা কেন?
*কই?
-তোমার মুখ ব্রনে ভরে
গেছে
*ও আচ্ছা
-তুমি জান তোমার চেহারা
কত সুন্দর? তুমি কত হ্যান্ডসাম?
*না জানতাম না। এখন
জানলাম।
-ফাইজলামি করবা না;
তোমার ব্রনের জন্যেই শুধু খারাপ দেখায়
*হুমমম
-কি হল
*কই কিছুনা তো?
-তুমি ঠিকমতো মুখের
যত্ন নেবে
*আচ্ছা
-আর বেশি বেশি পানি
খাবে
*ঠিক আছে
-ফেসওয়াশ দিয়ে
নিয়মিত মুখ ধুবে
*হুমম
-আর আর--
*কি?
-নাহ কিছু না। জান কত
মেয়ে আমার দিকে হিংসার চোখে তাকায়?
*নাহ জানতাম না। তবে
এখন জানি।
-উফফ সব কিছুতেই তোমার
ফাজলামি।
*আচ্ছা যাও, আর ফাজলামি করব না। এখন কারণটা বল।
-কারন তুমি
*মানে কি?
-মানে তুমি অনেক
হ্যান্ডসাম; আর যখন তুমি আমার সাথে ঘোর তখন তারা হিংসায়
ছাই হয়ে যায়
*তাই নাকি?
-হ্যাঁ
*তোমার কেমন লাগে?
-কি কেমন লাগে?
*এই যে ওরা জেলাস ফিল
করে?
-আমার অনেক ভাল লাগে।
*ও আচ্ছা।
-তুমি খুশি হওনি?
*না
-কেন?
*জানি না
-মানে?
*বাদ দাও
-আচ্ছা
হঠাৎ মায়ের ফোন আসে। মায়ের
ফোন রিসিভ করতেই বুঝি কিছু একটা হয়েছে।
মা কান্না চেপে বলেন 'বাবা, তুই কবে আসবি? তুই তাড়াতাড়ি আয় বাবা। তোর আব্বার শরীরটা ভালো না।' আমি আসব বলে ফোন রেখে দেই। বুঝতে পারি, বাবার
প্রেশার এর সমস্যা আবার বেড়েছে।
অধরার কাছ থেকে রাস্তায়
নেমে যাই। পকেটে শুধু একটা সিগারেটের বিচ্ছিন্ন অংশ আছে। মেসে হেঁটেই যেতে হবে।
মেসে ফিরে আবিষ্কার করি বুয়া আসেনি। রান্না ঘরে গিয়ে আরেকবার অবাক হই, মেসে চাল আনা নেই। সকাল বেলাও দেখেছিলাম চাল নেই।
বিবর্ণ সিগারেটটা নিয়ে ছাদে উঠে যাই। লাইটারটা জ্বেলে সিগারেটটা জ্বালিয়ে আকাশে
ধোঁয়া ছাড়ি। হঠাৎ আকাশে একটা প্লেন দেখতে পাই। খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
ছোটবেলার স্মৃতিগুলা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ধীরপায়ে।
ছোট বেলায় বাবার সাথে যখন
প্রায়ই ঘুড়ি উড়াতাম তখন বাবা বলতেন 'বাজান, ঐ ঘুড়ি চালাইতে পারবা তো?' আমি বলতাম-পারমু বাজান। যখন মাঝে মাঝে আকাশে প্লেন দেখা যেত বাবা বলতেন
'বাজান, ঐ ঘুড়িটা আকাশে চালাইতে
পারবা?' আমি বলতাম-হ বাজান, পারমু।
বাবার চোখ আনন্দে জ্বল জ্বল করত। আরো একটু যখন বড় হই, বাবা
আকাশে প্লেন দেখলেই বাচ্চা মানুষের মত বলে উঠত , 'বাজান,
আমার রাইজকইন্যারে তুমি ঘুড়ি চালায়ে আনতে পারবা তো?' আমি জবাব দিতাম 'হ বাজান, আমি পারমু।'
ভাবতে ভাবতেই চোখে পানি এসে
যায়। হাতের সিগারেটটা ফেলে উঠে দাঁড়াই। মোবাইলটা বেজে ওঠে পকেটে। বের করে দেখি
আননোন নাম্বার। রিসিভ করলাম কিছুটা বিরক্তভাবে। মেঘলার ফোন। অধরার ছোট বোন। ফোন
ধরেই মেয়েটা কেঁদে দিল। 'ভাইয়্যা,
আপনি তাড়াতাড়ি সেন্ট্রাল হসপিটালে আসেন। আপু খুব অসুস্থ।
ভাইয়্যা, প্লিজ আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।'
ফোন রেখেই দৌড়ে রুম থেকে
জামাটা পড়ে ছুটলাম হাসপাতালে। কাছেই ছিল। পৌছে গেলাম দু মিনিটেই। অধরার ফ্যামিলির
সবাইকে দেখলাম বাইরে দাঁড়িয়ে। বুঝে গেলাম যা বোঝার। আস্তে করে ঘরে ঢুকলাম। চোখ
বুজে আছে আমার অপ্সরী। মুখের গোলাপী আভাটাও মলীন হয়নি। হাতদুটো জোর করে মুঠিতে
চেপে ধরলাম। আস্তে করে চোখ মেলে তাকাল অধরা। মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো। একবার
চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে বলল-'নিজের
যত্ন নিয়ো সুমন। আর লাল টুকটুকে একটা মেয়েকে বিয়ে করো। তোমাদের খুব সুন্দর একটা
মেয়ে হবে। ওর নাম রেখো অধরা। ওকে আগলে রেখো সুমন। আর আর আমায় ভুলে যেয়ো। অনেক
অনেক ভালো থেকো সুমন।' অধরার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল
গড়িয়ে বালিশে পড়ে। কিন্তু যে আমার চোখে
সবসময় চোখে পানি জমে থাকতো, সেই আমার চোখে কোন পানি জমে না। মেঘের ঘনঘটা কোথাও পাই
না। রুম থেকে বের হয়ে আসি আমি। খুব নির্লিপ্ত ভাবে মেসে ফিরি। জামা কাপড় গুছিয়ে
নেই। এই শহুরে যান্ত্রিকতায় আর নয় একটি নিশ্বাসও। গ্রামের পথে পালিয়ে আসি। চোখ
আবার জ্বালা করে ওঠে। বাষ্প জমা হয়। পকেটে হাত দিয়ে কিছুটা হোঁচট খাই। পকেটে
রুমালটা নেই। মনে পড়ে সেই ছোট্ট স্মৃতিগুলো। অধরাই রোজ বাইরে বেরোবার সময় মনে
করিয়ে দিত রুমাল সাথে নিতে। আর কোনদিন ভুল করে না নিয়ে গেলে নিজের রুমালটাই
দিয়ে দিত। রুমাল দিয়ে দেয়ার পর ওর প্রচন্ড কষ্ট হত। তারপরও আমাকে কিছু বলত না।
উল্টো তখন ছায়ার মত লেগে থাকত আমার চোখ মুছে দেয়ার জন্য।
পাখির ডাকে বাস্তবে ফিরে
আসি। বাড়িতে পৌছেই ছুটে যাই আমার বাবার কাছে। আমার স্বপ্ন দেখানো প্রিয় বাবা।
অসুস্থ হয়ে শয্যাশয়ী ।
*'বাবা, আমি তোমার ঘুড়িতে করে তোমার রাজকন্যাকে আনতে পারিনি।
-বাজান কি হইছে তোর?
*বাবা, ঘুড়ির সুতো কেটে তোমার রাজকন্যা অনেক দুরে চলে গেছে বাবা। অনেক বেশি
দুরে
-শক্ত হ বাজান। তোকে
আরো শক্ত হতে হবে। তোর মাটারে দ্যাখ, তোর দ্যাশটারে দ্যাখ,
কাঁনতেছে। এই দ্যাশটা তো তোর জন্য কত ঘুড়ি দিল। বাজান, তুই পারবি না এই দ্যাশটার জন্য তোর একটা ঘুড়ি দিতে? তোর হাতে এখনও অনেক ঘুড়ি আছে বাজান। এই দ্যাশটার জন্য হলেও তোর
ঘুড়িগুলা কাটতে দিসনা বাপজান।'
বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসি।
আমার পুরোনো রুমটার তালা খোলা। রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে অবাক হই আমার ছোটবেলার
ঘুড়িটা দেখে....
আমার প্রিয় ঘুড়িটা নিয়ে
সেই প্রিয় খেলার মাঠটাতে চলে আসি। আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। নাটাই-টা
আস্তে আস্তে ছাড়ি। দুর থেকে আরো দুরে চলে যায় ঘুড়ি। নাটাইয়ের সূতোও একসময় শেষ
হয়ে যায়। তবুও মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকি দূর আকাশের দিকে, ঘুড়িটার দিকে। অনেকগুলো ঘুড়ি অপেক্ষা করছে আমার
জন্যে। কিভাবে, কিভাবে এদের একা ফেলে চলে যাব
আমি??
উৎসর্গঃ আমার লেখা প্রথম গল্পটি আমার প্রিয় বড় ভাইয়া দাইফ ভাইয়াকে উৎসর্গ করলাম। উৎসর্গ কথাটা কেমন যেন শোনায় তারপরও কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিনা। দাইফ ভাইয়ার লেখাতেই আমি প্রথম দেখেছিলাম কিভাবে আবেগের বৃষ্টি ঝড়াতে হয়। দাইফ ভাইয়ার লেখা গুলো আর দাইফ ভাইয়ার জন্য রইল অনেক অনেক ভালোবাসা।
লিখেছেন-Hasib Al Muhaimin
লিখেছেন-Hasib Al Muhaimin
গল্পটি নেয়া : https://www.facebook.com/notes/ভালবাসা-এবং-কিছু-আবেগের-গল্প/ঘুড়ি/212392268840930