Tuesday, June 22, 2021

৪৬. নিকটাত্মীয় বা স্বামীর মৃত্যুতে মহিলাদের শোক পালন করার বিধিবিধান: Marriage education series

 No photo description available.

নিকটাত্মীয় বা স্বামীর মৃত্যুতে মহিলাদের শোক পালন করার বিধিবিধান:
▬▬▬▬◖◯◗▬▬▬▬
 
যদি পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সন্তান, স্বামী বা অন্য কোন নিকটাত্মীয় মারা যায় তবে মহিলার জন্য শোক পালন করা বৈধ। স্বামীর ক্ষেত্রে চার মাস দশ দিন ওয়াজিব (আবশ্যক)। আর অন্যদের ক্ষেত্রে সবোর্চ্চ তিন দিন বৈধ; আবশ্যক নয়। 
তবে স্ত্রী স্বামীকে খুশি রাখতে যদি অন্য কোন মানুষের মৃত্যুতে স্ত্রী শোক পালন না করে তবে সেটাই উত্তম। কারণ, স্বামীর সুখ কামনাতেই নারীর জন্য অজস্র কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
 
◈◈ শোক পালনের দলিল:
স্বামীর মৃত্যুতে শোক পালনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
 
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرً
 
"আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো, নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা।" (সূরা বাকারা: ২৩৪)
 
আবু সালামার মেয়ে যয়নব বলেন, শাম থেকে আবু সুফিয়ান রা. এর মৃত্যু সংবাদ আসার পর তৃতীয় দিন (তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনিন) উম্মে হাবিবা রা. কিছু হলুদ বা জাফরান (অন্য বর্ণনায় সুগন্ধি) আনতে বললেন। অত:পর তা আনা হলে তিনি তা তার চেহারার দু পাশে ও দু গালে এবং দু বাহুতে মাখলেন। অত:পর বলেন, এটা করার আমার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু আমি এজন্যই এমনটি করলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
 
« لاَ يَحِلُّ لاِمْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلاَثٍ ، إِلاَّ عَلَى زَوْجٍ ، فَإِنَّهَا تُحِدُّ عَلَيْهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا »
 
"যে মহিলা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে তার জন্য স্বামী ছাড়া কারও মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ নয়। স্বামীর মৃত্যুতে সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে।" (সহিহ বুখারি, অনুচ্ছেদ: স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে মহিলার শোক পালন করা)।
 
◈◈ শোক পালনের পদ্ধতি:
● ১) মৃতের প্রতি শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে মহিলা সকল প্রকার সৌন্দর্য গ্রহণ থেকে দূরে থাকবে।
● ২) আতর-সুগন্ধি ব্যবহার না করা। তবে তৈল, সাবান, রোগ-ব্যাধির জন্য ঔষধ ইত্যাদি ব্যবহারে অসুবিধা নাই যদিও তাতে সুগন্ধি থাকে। কারণ এগুলো মূলত: সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না।
● ৩) সৌন্দর্য বর্ধক পোশাক না পরা। বরং স্বামী মারা যাওয়ার আগে স্বাভাবিকভাবে যে পোশাক পরিধান করত তাই পরিধান করবে। তবে শুধু সাদা বা শুধু কালো পোশাক পরিধান করতে হবে-এমন ধারণা ঠিক নয়।
● ৪) সুরমা, কাজল ইত্যাদি ব্যবহার না করা।
● ৫) মেহেদী, খেজাব বা আলাদা রং ব্যবহার না করা।
● ৬) কোন ধরণের অলংকার-যেমন: দুল, চুরি, নাক ফুল, আংটি, নূপুর ইত্যাদি ব্যবহার না করা।
● ৭) বিয়ের প্রস্তাব বা বিয়ে থেকে বিরত থাকা।
● ৮) শোক পালনের দিন শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে থাকবে। এমনকি সে সময় যদি সে তার পিতার বাড়িতেও থাকে তবে স্বামীর মৃত্যুর খবর পেলে নিজ বাড়িতে ফিরে আসবে। তবে একান্ত প্রয়োজন-যেমন: বিপদের আশংকা, প্রয়োজন বশত: বাড়ি পরিবর্তন, চিকিৎসা বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ইত্যাদি জরুরি কাজে অন্যত্র যেতে পারবে।
● ৯) স্ত্রী যদি গর্ভবতী হয়ে থাকে তবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে অথবা চার মাস দশ দিন অতিবাহিত হলে তখন উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা সমূহ উঠে যাবে এবং অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।
মোটকথা, স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী এমন সব ধরণের আচরণ বা সৌন্দর্য অবলম্বন করবে না যা তাকে বিয়ের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে।
 
এটা এ কারণে যে এর মাধ্যমে, স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়, স্বামীর পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়, তাদের বেদনা বিধুর অনুভূতিতে সহমর্মিতা প্রকাশ হয় সর্বোপরি আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশের আনুগত্য করা হয়।
আল্লাহু আলাম।
 
▬▬▬▬◖◯◗▬▬▬▬
গ্রন্থনায়:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।

 

৪৫. বিয়েতে আত্মীয়-অনাত্মীয়: কোনটি উত্তম? নিকটাত্মীয় মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তানের কোন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কি? Marriage education series

 May be an image of text that says 'বিয়েতে আত্মীয় অনাত্মীয়: কোনটি উত্তম? নিকটাত্মীয় মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তানের কোন ক্ষতি হয় কি?'

বিয়েতে আত্মীয়-অনাত্মীয়: কোনটি উত্তম? নিকটাত্মীয় মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তানের কোন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কি?
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
প্রশ্ন: নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করলে সন্তানের নাকি বিভিন্ন সমস্যা হয়? এ ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
উত্তর:
নিকটাত্মীয় বা রক্ত সম্পর্কীয় ব্যক্তিকে বিয়ে করলে 'জিনগত রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ হবে, সন্তান বিকলাঙ্গ বা দুর্বল হবে আর আত্মীয়তার সম্পর্কহীন দূরের মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তান সুস্বাস্থ্য বান, মেধাবী ও খুব ভালো হবে' এ জাতীয় কথা নিতান্তই ভিত্তিহীন, দলিল বিহীন ও বাস্তবতা বিবর্জিত। কুরআন-হাদিসের আলোকে তো প্রমাণিত নয় বরং বাস্তবতা ও বিজ্ঞানের আলোকেও তা সঠিক নয়।
 
প্রথমত: আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, কুরআন ও হাদিস যা হালাল করেছে তাতে কোন সমস্যা থাকবে না বা তাতে ক্ষতির কোন কারণ নাই এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নাই। এতে কোন ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলে সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী মহামহিম আল্লাহ তা কখনোও হালাল করতেন না। অথচ তিনি নিকটাত্মীয় বা রক্ত সম্পর্কীয় মেয়েদেরকে বিয়ে করা হালাল করেছেন।
 
◈ আল্লাহ তাআলা বলেন,
 
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَاجَكَ اللَّاتِي آتَيْتَ أُجُورَهُنَّ وَمَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ مِمَّا أَفَاءَ اللَّـهُ عَلَيْكَ وَبَنَاتِ عَمِّكَ وَبَنَاتِ عَمَّاتِكَ وَبَنَاتِ خَالِكَ وَبَنَاتِ خَالَاتِكَ
 
"হে নবী, আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে...।" (সূরা আহযাব: ৫০)
◈ কোন নারীদেরকে বিয়ে করা যাবে না তা মহান আল্লাহ সূরা নিসা এর ২৩ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। (যেমন: মা, কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, শাশুড়ি প্রমুখ) এর বাইরে যেকোনো নারীকে বিয়ে করা জায়েজ। আর বিয়ে নিষিদ্ধ নারীদের মধ্যে চাচাতো, ফুফাতো, খালাতো, মামাতো বোন এবং তাদের কন্যগণ অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এসকল নিকটাত্মীয় মেয়েদেরকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি নেই।
 
উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীগণ বলেন, মহান আল্লাহ কুরআনে যে নারীদেরকে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছেন তাদের সাথে বিয়ে হলে বাস্তবিকভাবে নানা জেনেটিক সমস্যা হতে পারে‌। এর বাইরে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।
 
◈ তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়কে বিয়ে করেছেন। যেমন: তিনি তার ফুফু মাইমুনা রা. এর কন্যা যয়নাব বিনতে জাহাশ (সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ রা. এর বোন) কে বিয়ে করেছেন।
 
◈ তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা বিনতে আবি বকর রা., হাফসা বিনতে উমর রা.ও বংশীয় দিক দিয়ে তার রক্ত সম্পর্কীয়। 
 
◈ তিনি তার কলিজার টুকরা কন্যা ফাতিমা রা. কে তার চাচাতো ভাই আলী বিন আবি তালিব রা. এর সাথে বিয়ে দিয়েছেন।
 
◈ সেই সাথে আমাদের চারপাশে অসংখ্য বৈবাহিক জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় না।
গবেষকগণ বলেন,"শুধু বাংলাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা মোট বিবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এমনকি এই প্রবণতা দক্ষিণ ভারতেও দেখা যায়।" (biyeta)
তবে নিকটাত্মীয় স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের মাঝে জিন বাহিত রোগ-ব্যাধি সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা যদি কোথাও ঘটেও থাকে তাহলে তা নিতান্তই অপ্রতুল; ব্যাপক নয়।
সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে শরিয়তের হালালকৃত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনভাবেই সঙ্গত হতে পারে না।
 
◯◯ সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রহঃ
অনাত্মীয় মেয়েকে বিয়ে করার নির্দেশ বাচক হাদিস সম্পর্কে শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
"এ হাদিসের কোন ভিত্তি নেই বরং নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করার অধিক উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করেছেন।
আর কিছু ফকিহ যারা দূরবর্তী মেয়েদেরকে বিয়ে করার কথা বলে তাদের কথার কোন ভিত্তি নাই। বরং সে স্বাধীন। ইচ্ছে করলে, নিকটাত্মীয় মেয়েকে বিয়ে করতে পারে-যেমন: চাচাতো বোন, খালাতো বোন। আবার ইচ্ছা করলে, দূরের কাউকে বিয়ে করতে পারে। এতে কোনও অসুবিধা নেই।
যারা বলে যে, দূরের মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তান বেশি সু স্বাস্থ্যবান ও ভালো হবে তাদের একথার কোন ভিত্তি নেই। কোন দলিল নেই। বরং যদি নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করা সহজ হয় তবে ভালো। এটাই উত্তম। কারণ এতে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন আরও মজবুত হয়। আর যদি দূরের মেয়ে বেশি দ্বীনদার এবং বেশি ভালো হয় তবে দূরের মেয়েকে বিয়ে করাই ভালো।
মোটকথা, দ্বীনদার মেয়েকে বিয়ে করার চেষ্টা করতে হবে-চাই সে নিকটাত্মীয় হোক অথবা না হোক। নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
تُنْكَحُ المَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ: لِمَالِهَا، وَلِحَسَبِهَا، وَجَمَالِهَا، وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ، تَرِبَتْ يَدَاكَ
"চারটি গুণের কারণে নারীকে বিবাহ করা হয়- নারীর ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, রূপ-সৌন্দর্য ও দীনের কারণে। কিন্তু তুমি দীনদার নারীকে অগ্রাধিকার দিয়ে সফল হও। (অন্যথায়) তোমার দু হাত ধূলায় ধূসরিত হোক!" (অর্থাৎ দীনদার নারীকে প্রাধান্য না দিলে বিপর্যয় অবধারিত)।
[আবু হুরায়রা. হতে বর্ণিত- সহিহ বুখারি/ ৫০৯০ ও সহিহ মুসলিম ১৪৬৬]
সুতরাং একজন ইমানদার ব্যক্তি ভালো দ্বীনদার নারী অনুসন্ধান করবে যদিও তা নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে না হয়। অনুরূপভাবে একজন মহিলাও একজন সৎ স্বামী অনুসন্ধান করবে, খোঁজখবর নিবে যদিও সে অনাত্মীয় হয়।" (শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট থেকে)
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব