টমাস এডিসনের বৈদ্যুতিক বাল্বের ভার্সনগুলোর একটা বড় সমস্যা আছে। এখানে বিদ্যুৎ থেকে প্রথমে ফিলামেন্টে তাপশক্তি তৈরি হয়, তারপর সেই তাপ থেকে আলো তৈরি হয়। এফিশেন্সী মাত্র ১০-১৫%। অর্থাৎ মোট শক্তির মাত্র দশভাগের একভাগ আলো তৈরি হয়; বাকিটা নষ্ট।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে খেলতে খেলতে একধরণের নতুন বাতি তৈরি করে ফেলেন, সংক্ষেপে ডাকা হয় 'LED' (এল ই ডি)। যেখানে মলেকুলার লেভেলে পদার্থকে ম্যানিপুলেট করে সরাসরি ফোটন নির্গত করা হয় হয়। ফলে মোট শক্তির ৭০ পার্সেন্টকে আলোতে রুপান্তরিত করা যায়।
এলইডি এর আসল মহাত্ম হলো এটাকে ইচ্ছামত ছোট করা যায়। চাইলেও আগের লাইট বাল্বগুলোকে বেশী ছোট বানাতে পারবেন না। কারন ফিলামেন্ট এবং সেমি-ভ্যাকিউম টিউবের আকারের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেখানে এলইডি কে একটা ডটের সমানও বানানো যায়। সুতরাং বলা যায় এলইডি না থাকলে কম্পিউটার ও ফোনের স্ক্রিন তৈরি করা সম্ভব হত না।
যাইহোক, লাল ও সবুজ রঙ্গের এলইডি তৈরি করা হয়ে গেলেও নীল এলইডি বানাতে গিয়ে প্রচুর হিমশিম খাচ্ছিলেন ইঞ্জিনিয়াররা। বিভিন্ন কোম্পানি প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রায় ফতুর হয়ে যাবার দশা হয়েছিল। নীল LED তৈরি করা গেলে RGB স্ক্রিন তৈরি করা সম্ভব হত সহজেই। আজকের গল্প সুজি নাকামুরা নামের একজন জাপানিজ টেকনিশিয়ানকে নিয়ে, যিনি প্রায় নিজের একক চেষ্টাতে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
নাকামুরার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা খুব ভালো হয়নি, ফলে সাধারণ লোকাল একটা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করতে হয়। স্বপ্ন ছিল থিওরেটিক্যাল ফিজিসিস্ট অথবা গণিতবিদ হবেন। এক শিক্ষক বলল যে পদার্থবিজ্ঞানে ভাত নাই, সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই ভালো হবে। অতঃপর ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলেন যেহেতু এটা ছিল ফিজিক্সের সবথেকে কাছাকাছি।
ভার্সিটির প্রথম দুই বছরে নানা রকম ইরিলিভেন্ট কোর্স দেখে নাকামুরা হতাশ হয়ে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। এই সময় ফিজিক্সের বিভিন্ন বই পড়ে কাটাতো। থার্ড ইয়ারে থাকতে সেমিকন্ডাক্টরের উপর একটা কোর্স করার পর আবার ক্লাস করার আগ্রহ ফিরে এল।
মাস্টার্সে নাকামুরা চাইছিল কোন একটা থিওরেটিক্যাল কাজ করতে। কিন্তু তার প্রফেসর টাডা ছিলেন জাঁদরেল এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। সুতরাং বাধ্য হয়ে তাকে এক্সপেরিমেন্টাল কাজই করতে হয়। সে নিজেও তখন জানত না যে এই এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সই তাঁর জন্য ব্লেসিং হয়ে আসবে। তাকে একসময় নোবেল এনে দিবে।
প্রফেসর টাডার ল্যাব ছিল ভাঙ্গারির দোকানের মত। ভাঙ্গাচোড়া টেলিভিশন খুলে সেখান থেকে স্পেয়ার পার্টস নেয়া হত। নাকামুরা যখন কাজ করত তখন তাকে স্টিলের দোকানে কাজ করা শ্রমিকের থেকে আলাদা দেখাতো না। প্রতিটা স্কিলই নাকামুরার কাজে লেগেছিল পরবর্তীতে।
মাস্টার্স শেষে কাজ নেন নিশিয়া নামে ছোট একটা কোম্পানিতে। জাপান তখন ইলেক্ট্রনিক্সে বেশ নাম কামাচ্ছে, ছোট বড় অনেক ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি গড়ে উঠেছে। নিশিয়া কোম্পানি টেলিভিশনের জন্য পার্টস বানাতো। ল্যাবের ফসফরাস লিক থেকে প্রায়ই বুম করে শব্দ হত, কলিগেরা যেয়ে দেখত ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে আর নাকামুরা এক কোণায় বসে কাশছে। একসময় বিষয়টা এত নরমাল ব্যাপার যায় যে কলিগেরা বিস্ফোরণের শব্দ পেলেও আর পাত্তা দিত না।
তখনকার বড় বড় কোম্পানী ছিল সনি, প্যানাসনিক, তোশিবা, বেল ল্যাব ইত্যাদি। এই কোম্পানিগুলো ব্লু এলইডি তৈরি করতে ফেইল করেছে। তখন নিশিয়ার মালিক একটা বড় বাজি ধরলেন। নাকামুরাকে দায়িত্ব দেয়া হলো এই উচ্চভিলাষী প্রজেক্টের, বাজেট ৩ মিলিয়ন ডলার দেয়া হল।
ব্লু এলইডি বানানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো হাইকোয়ালিটি ক্রিস্টাল বানানো। সামান্য খুঁত থাকলেই সেটা আর কাজ করবে না। নাকামুরাকে বলা হল ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা থেকে এক বছরের জন্য ঘুরে আসতে। সেখানকার পোলাপান নাকি হাইকোয়ালিটির ক্রিস্টাল বানানোর নতুন ধরণের রিয়্যাক্টর নিয়ে কাজ করে। এই মেশিনে একটা গরম চেম্বারের ভেতর নজেল দিয়ে বাষ্প ইনজেক্ট করে ক্রিস্টাল বানানো হয়।
নাকামুরা গেলেন এক বছরের জন্য, কিন্তু সময় খুব একটা ভালো কাটলো না। আগেই বলেছি নাকামুরার মাস্টার্স ছিল খুব সাধারণ ভার্সিটি থেকে আর করতেন টেকনিশিয়ানের কাজ। পোশাক আশাকে কখনোই স্কলার মনে হত না, তার ওপর ইংরেজিও কাঁচা, কোন পেপারও পাবলিশ হয়নি। সেই ল্যাবে কাজ করত পিএচডি ছাত্ররা, যারা ছিল তার থেকে বয়সে ছোট। ওরা তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করত।
এই অভিজ্ঞতা নাকামুরার জেদ বাড়িয়ে দিল। তিনি বলেন- “I feel resentful when people look down on me, At that time, I developed more fighting spirit – I would not allow myself to be beaten by such people.”
তাকে ভালো রিয়্যাক্টরে কাজ করতে দেয়া হল না, নষ্ট একটা রিয়্যাক্টর দেয়া হল। নাকামুরা প্রথম ১০-১২ মাস প্রচুর খাটনি করে মেশিনটা কিভাবে কাজ করে বুঝে নিলেন আর ঠিকমত এসেম্বল করলেন। তারপর সময় শেষ হলে তিনি নিশিয়া কোম্পানির জন্য নতুন একটা রিয়্যাক্টর অর্ডার করলেন। সাথে ঠিক করলেন যেভাবেই হোক একটা পিএচডি নিতে হবে।
তখন কিন্তু তাঁর বয়স ৩৫, এই বয়সে অন এভারেজ মানুষ পিএইচডি শেষ করে ফেলে।
এখন রিয়্যাক্টরতো আনা হলো, তো প্রশ্ন হচ্ছে এখানে কোন ধরণের ক্রিস্টাল বানানো যেতে পারে? হাতে আছে অপশন দুইটা- জিঙ্ক সেলেনাইড আর গ্যালিয়াম নাইট্রাইড। জিঙ্ক সেলেনাইড ছিল তখনো পর্যন্ত ব্লু এলইডি গবেষনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অপশন। এটা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। অন্যদিকে গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের কিছু সমস্যা ছিল কারণ এর হাইকোয়ালিটি ক্রিস্টাল বানানো অনেক কঠিন। বেল ল্যাবের মত কোম্পানি গ্যালিয়াম নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খু কাজ করে রায় দিয়েছে যে এই দিকে যাওয়া কানা গলিতে পরার মতনই।
তখন জাপানে নিয়ম ছিল কেউ যদি একটা বিষয়ে ৫ টা পেপার পাবলিশ করতে পারে তাকে পিএইচডি দেয়া হবে। নাকামুরা ভাবলো, ‘আমি হয়তো ব্লু এলইডি বানাতে পারবো না। কিন্তু গ্যালিয়াম নাইট্রাইডে অনেক নতুন কাজ করার স্কোপ আছে, তাতে অন্তত একটা পিএচডি পাওয়া যাবে’।
জাপানের একটা বড় বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স হলো। সেখানে জিঙ্ক সেলেনাইড নিয়ে কাজ করেছে এমন লোক ছিল ৫০০, আর গ্যালিয়াম নাইট্রাইড নিয়ে কাজ করছে এমন লোক আছে নাকামুরাসহ মাত্র ৫ জন। এর মধ্যে দুইজন হলেন ইশামু আকাজাকি ও হিরোশি আমানো। এরা দুইজন ক্রিস্টাল তৈরির প্রথম সমস্যা অলরেডি সমাধান করে ফেলেছেন।
বাকি আছে দুইটা সমস্যা- পি-টাইপ বানানো ও ডিফেক্ট যথাসম্ভব কমানো। আকাজাকি ও আমানোরা মিলে পি-টাইপ বানিয়েছে, কিন্তু কোয়ালিটি খুব একটা ভালো না। নিশিয়ায় ফিরে নাকামুরা প্রথম ৬ মাস বহু চেষ্টা করে সাধারণ ক্রিস্টালও বানাতে পারলেন না। ডেস্পারেট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন রিয়্যাক্টরটা নিজের মত চেঞ্জ করে নিবেন। ফ্লোরিডায় ১০ মাস ভাঙ্গাচোরা রিয়্যাক্টর জোড়া দিয়ে যে স্কিল অর্জন করেছেন সেটা অমূল্য হয়ে ধরা দিল।
এই সময়ে নাকামুরার রুটিনের কথা বলা যাক। প্রতিদিন ৭ টায় ল্যাবে আসতেন। ৭ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত কাটিং ও ওয়েল্ডিং চলত। এমন কিছু নাই যেটা পরীক্ষা করে দেখা হয় নাই। কখনো মেশিনের হাইট বাড়ানো, পাইপ বাঁকিয়ে দেয়া, গ্যাস নজেলের শেইপ চেঞ্জ করে নতুন করে ওয়েল্ড করা ইত্যাদি।
তারপর দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত চলত এক্সপেরিমেন্ট, এটা দেখার জন্য যে মেশিনের নতুন ভার্সন ভালো রেজাল্ট দিচ্ছে কিনা। ৭ টায় বাসায় যেয়ে, খেয়ে দেয়ে ঘুম। আবার সকালের ৭ টায় কাজ শুরু। নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটে লেখা আছে নাকামুরা এই কাজ করে গেছেন দিনের পর দিন কোন ছুটি না নিয়ে। সপ্তাহের ৭ দিনই কাজ করতেন। বছরে কেবল একবার ছুটি নিতেন, জাপানিজ নববর্ষের দিনে।
বছর খানেক পর, নাকামুরা নতুন একটা পরিবর্তন আনলেন রিয়্যাক্টরে। বাষ্প ইনজেক্ট করার নজেল ছিল একটা, তিনি ওয়েল্ড করে উপরে আরেকটা নজেল লাগিয়ে দিলেন। এবার দুই দিক থেকে বাষ্প পড়বে সাবস্ট্রেটের উপর- টু ফ্লো সিস্টেম। ১৯৯০ সালের এক শীতের দিনে ল্যাবে বানানো স্যামপল নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পেলেন। গ্যালিয়াম নাইট্রেটের এত পিউর ক্রিস্টাল এর আগে কেউ বানায় নি। তিনি সেদিনটাকে বলছেনে- জীবনের সবথেকে এক্সাইটিং সময়।
নাকামুরা তার প্রোটোটাইপ ব্লু এলইডি নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন আমেরিকায়। শ্রোতারা তাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। নাকামুরা কিন্তু তখনো কাজ থামাননি, তখনো এটা ছিল একটা প্রটোটাইপ। এর দুই বছর পর নিশিয়া পৃথিবীর প্রথম ব্লু LED এর কথা প্রকাশ করে।
দেখেন সুজি নাকামুরা কোন প্রিভিলেজ থেকে শুরু করেন নি, ভালো ডিগ্রি বা ভালো ল্যাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। সত্যি বলতে গেলে তাঁর যায়গায় ৯৯% পার্সেন্ট মানুষ লেগে থাকার কোন কারণ খুঁজে পেত না। এই মানুষদের মধ্যে আমি নিজেও পরি।
কারণ তাঁর থেকে ভালো বেতনে, অনেক ভালো ল্যাবে ভালো মেশিনপাতি দিয়ে, তার উপর ভালো প্রফেসরের আন্ডারে অনেকে একই গবেষণা করছিল। 'ওদের তুলনায় আমি একা কি বা এমন করতে পারব?'- এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। এই কাহিনী আমার একটা পছন্দের সিনেমার ডায়ালগের কথা মনে করিয়ে দেয়-
: But is there a line? You know, maybe you go too far, and you discourage the next Charlie Parker from ever becoming Charlie Parker?
: No, man, no. Because the next Charlie Parker would never be discouraged.
(সূত্রঃ Veritasium, নোবেল প্রাইজের ওয়েব সাইট)