৭. স্বামীর আনুগত্য করার আবশ্যকতা এবং তার অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ার বিধান
স্বামীর আনুগত্য করার আবশ্যকতা এবং তার অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ার বিধান
▬▬▬▬▬▬
প্রশ্ন: একজন মহিলা কুরআন-হাদিস অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেন এবং পর্দাও করেন। কিন্তু বাইরে যাওয়ার জন্য স্বামীর আদেশ মানতে চান না। যেমন: স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও ভাইয়ের পাত্রী দেখার জন্য বাড়ি থেকে চলে গেল। তার দাবি, আমি আম্মার সাথে গিয়েছি। এটা আমার জন্য অনুমতি আছে। কিন্তু স্বামী এতে রাজি নয়।
প্রশ্ন হল, এভাবে উক্ত মহিলার জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? এ ক্ষেত্রে স্বামীর করণীয় কি?
উত্তর:
স্ত্রীর জন্য স্বামীর আনুগত্য করা ফরয যদি তা গুনাহের কাজ বা সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো কাজের নির্দেশ না হয়।
সুতরাং স্ত্রীর জন্য জরুরি হল, বিশেষ কোনো কাজে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে স্বামীর নিকট অনুমতি নেয়া। স্বামী অনুমতি দিলে পরিপূর্ণ পর্দা সহকারে এবং নিজেকে ফিতনা থেকে হেফাযতে রেখে স্ত্রী বাইরে যেতে পারে। দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার হলে অবশ্যই তার পিতা, ভাই ইত্যাদি মাহরাম পুরুষের সাথে যাবে। কিন্তু স্বামী যদি তাকে যেতে নিষেধ করে তাহলে স্ত্রীর জন্য তা লঙ্ঘন করা বৈধ নয়। অন্যথায় সে স্বামীর 'অবাধ্য' হিসেবে গণ্য হবে এবং গুনাহগার হবে।
পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই এই আনুগত্য করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা পুরুষকে পরিবারের মূল পরিচালনার দায়িত্ব এবং স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। (সূরা নিসা: ৩৪ নং আয়াত)।
সুতরাং স্ত্রী যদি এই আনুগত্যের বিষয়টিকে উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ না করে তাহলে পরিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমীন।
জ্ঞাতব্য যে, ইসলামের বিধান হল, কোন স্ত্রী যদি স্বামীর 'অবাধ্য' হয় বা তার আনুগত্য করতে অস্বীকার করে তাহলে তার জন্য স্ত্রীর ভরণ-পোষণ দেয়া বন্ধ করার অধিকার রয়েছে।
ইসলামে স্বামীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার আনুগত্যের বিষয়টি নিম্নোক্ত হাদিস থেকে সুষ্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِغَيْرِ اللهِ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا وَالَّذِى
نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ تُؤَدِّى الْمَرْأَةُ حَقَّ رَبِّهَا حَتَّى تُؤَدِّىَ حَقَّ زَوْجِهَا وَلَوْ سَأَلَهَا نَفْسَهَا وَهِىَ عَلَى قَتَبٍ لَمْ تَمْنَعْهُ-
“যদি আমি কাউকে নির্দেশ দিতাম আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সিজদা করার, তাহ’লে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।ঐ সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার জীবন, মহিলারা ঐ পর্যন্ত আল্লাহর হক আদায় করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে স্বামীর হক আদায় না করে, এমনকি স্বামী যদি যাত্রা পথে ঘোড়ার পৃষ্ঠেও তাকেও আহবান করে তখনও তাকে বাধা না দেয়।” (ইবনে মাজাহ হা/১৮৫৩; সহীহাহ হা/১২০৩।)
সুতরাং স্ত্রীর জন্য স্বামীর অবাধ্যতা করে বাইরে কোথাও যাওয়া জায়েয নয় যদি নিজের বাবা-মা বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি হোক না কেন।
এর দলিল হল, বিখ্যাত ইফকের ঘটনায় মা আয়েশা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট তার বাবা-মার কাছে যাওয়ার অনুমতি চাওয়ার হাদিস:
তিনি বলেন:
أتأذن لي أن آتي أبوي
"(হে আল্লাহর রাসূল,) আপনি কি আমাকে আমার বাবা-মার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিবেন?" (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
ইরাকী বলেন, আয়েশা রা. এ কথা থেকে বুঝা গেল, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার পিতামাতার বাড়িতে যাবে না।" (ত্বরবুত তাসরীব ৮/৫৮)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রা. এক বিবাহিত মহিলার ব্যাপারে বলেন-যার মা অসুস্থ ছিল:
طاعة زوجها أوجب عليها من أمها ، إلا أن يأذن لها
" মা'র চেয়ে স্বামীর কথার আনুগত্য করা তার জন্য অধিক অপরিহার্য। তবে স্বামী যদি তাকে অনুমতি দেয় তাহলে ভিন্ন কথা।" (শারহু মুনতাহাল ইরাদাত ৩/৪৭)
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি বলেন:
لا يجوز للمرأة الخروج من بيت زوجها إلا بإذنه ، لا لوالديها ولا لغيرهم ؛ لأن ذلك من حقوقه عليها ، إلا إذا كان هناك مسوغ شرعي يضطرها للخروج
"কোন মহিলার জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া জায়েয নয়। পিতামাতা বা অন্য কারো নিকট নয়। কারণ এটি তার উপর স্বামীর হক। অবশ্য যদি শরিয়ত সম্মত বিশেষ কোনো কারণ থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।" (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ১৯/১৬৫)
তবে স্বামীর কর্তব্য হল, সময়-সুযোগ ও প্রয়োজন বুঝে স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যে তার পিতামাতা ও অন্যান্য মাহরাম নিকটাত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া যদি এতে ক্ষয়-ক্ষতি ও ফেতনার আশঙ্কা না করে।
অবশ্য একান্ত জরুরি অবস্থায় স্বামীর অনুমতি ছাড়াও বাইরে যাওয়া জায়েয আছে। যেমন, বাড়িতে থাকা যদি তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ হয়, ঘর ভেঙ্গে পড়ে, জরুরি চিকিৎসা, ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় ইত্যাদি।
পরিশেষে বলব, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিশ্বাস, ভালবাসা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে যে কোনো সমস্যা সমাধান করা যায়। এগুলো দাম্পত্য জীবনে অপরিহার্য দাবী। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের চাহিদা ও হক আদায় করবে এবং প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখবে। তাহলে মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়া থেকে রক্ষা পাবে ইনশাআল্লাহ।
তবে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও দাম্পত্য জীবনের বৃহত্তর স্বার্থে উভয়কে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দুজনের দাম্পত্য জীবন ভরে থাকবে অবারিত সুখ, শান্তি ও অনাবিল ভালোবাসায় ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব
fb id: AbdullaahilHadi