" আপনার মেয়ে বিয়ের পরে অন্য একটা ছেলের জন্য বিষ খেয়েছে, ওরকম মেয়ে তো থাকার থেকে না থাকাই ভালো! ভালোই হয়েছে মরে গেছে। এরকম মেয়েদের মরাই উচিৎ। খুব তো হুজুরগীরি দেখাতো অথচ তলে তলে এতো কিছু। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ঘুমটার নিচে যে খ্যামটা নাচে। কেন যে আম্মা রনি ভাইয়ের জন্য এরকম একটা দুশ্চরিত্রা ক্ষ্যাত মেয়ে পছন্দ করেছিলেন? রনি ভাইয়ের জীবনটা একেবারে নরক হয়ে গেলো। এতো সুন্দর স্মার্ট একটা ছেলে তাকে রেখে যদি বউ বাইরে গিয়ে আকাম-কুকাম করে তাহলে তার জীবনটা কি আর জীবন থাকে!" কথাগুলো বলে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল সুমুর বড় জা মালিহা। মনে মনে বেশ ভালো লাগছে তার। এই মেয়ে একেবারে শাশুড়ীর প্রাণ বায়ু ছিলো এবার দেখুক মালিহার থেকে ভালো আর কেউ নেই! ট্রেনে উঠে সুমুর বাবাকে দেখতে না দেখতেই এতো গুলো কথা বলে ফেলল সুমুর বড় জা।
সুমুর বাবা নাদিম শেখ নিরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন সুমুর শশুড়বাড়ির প্রতিটি মানুষকে। সুমুর শাশুড়ীর মুখ বেশ গম্ভীর। সুমুর শশুর, শাশুড়ী, বড় জা আর বড় ভাসুর । নাদিম শেখ ভেবে পায়না মানুষ এতোটা কান্ডজ্ঞাণহীন হয় কিভাবে? সুমু তার একটা মেয়েই। সেই মেয়েটা কাল রাতে মারা গেছে সেই কষ্টটা সামলাতেই পাথর হয়ে গেছেন তিনি আর এই মানুষগুলো এসেছে তার নিত্য তৈরি হওয়া কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। হায় মানুষ, কবে তোমরা আসল মানুষ হবে? কবে তোমাদের ছোটো ছোটো কথার আঘাতে অন্যের হ্রদয়ের ক্ষত বিক্ষত হওয়া দেখবে?
একবুক কষ্ট নিয়ে সুমুর মায়ের দিকে তাকালো নাদিম শেখ। তার কোলের উপরে চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে সুমুর মা। কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলে গেছে একদম। কয়েকটা ঘন্টায় যেনো কতো বড় ঝড় বয়ে গেছে চেনা পরিচিত মুখটায়। তাও ভালো হয়েছে সুমুর মা ঘুমে নাহলে কথা গুলো শুনে আরো বেশি কষ্ট পেতো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নাদিম শেখ। হটাৎ খেয়াল হলো তিনি আজ জানালার পাশের সিটটাতে বসেছেন। অথচ বিয়ের এতোগুলা বছরে সবসময় সুমুর মা বাচ্চাদের মতো জেদ করে জানালার পাশের সিটটাতে বসেছে। এই দীর্ঘ ৩১ বছরে কখনোই এই নিয়মের ব্যাঘাত ঘটেনি। আর আজ? সুমুর মায়ের এতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মাথায় নেই!
বিয়ের ৯ বছর পরে কোনো এক বৃষ্টিমুখর রাতে সুমুর অস্তিত্বের খবর জানতে পেরেছিলেন নাদিম শেখ । এতোটা খুশি তিনি জীবনে আর কবে হয়েছিলো মনে পড়ে না। তারপর আস্তে আস্তে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! যেদিন সুমু জন্ম নিলো। সেইদিনটা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে নাদিম শেখের। তার মা ছোট্ট একটা পরী এনে দিলেন তার কোলে। পাখির ছানার মতো ছোটো ছোটো হাত পা, ছোট্ট একটা মাথা। নাদিম শেখের আনন্দের দিনের তো সেই শুরু।
সুমুর ছোটো বেলা থেকে শুরু করে বিয়ে দেয়ার আগে পর্যন্ত এই একুশ বছরের প্রতিটা প্রতিক্রিয়া মনে করার চেষ্টা করলো নাদিম শেখ। খুব বেশি চেষ্টাও করতে হলো না তাকে স্মৃতি যেনো হরহর করে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। তার মেয়ে ছোটো থেকেই বেশ বুদ্ধিমতি ছিলো কিন্তু মনটা ছিলো তুলোর মতো নরম। আজ সুমুর বড় জা যেভাবে কথাগুলো বললো সুমুকে কেউ ভয়াবহ কষ্ট দিলেও সে এরকম কথা কখনোই বলতো না। ছোটো থেকেই মেয়েটার ছিলো ইসলামের প্রতি বেশ ঝোক। নামাজ, রোজা, আমল আর উত্তম আখলাক এর সুন্দর একটা উদাহরণ ছিলো সুমু। এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দিয়ে পার পেতো না নাদিম শেখ অমনি সুমুর হাজারটা যুক্তির ফেরে বিপদে পড়ে যেতেন তিনি।
একদিন তার সুমুটা একটা পাখির ছানা নিয়ে বাসায় আসলো। প্রশ্ন করলাম, " এটা কোথা থেকে এনেছো মা?" সুমু কিছুটা অপরাধী ও উৎফুল্লের সাথে পাখি আনার ঘটনা বললো। ছাদে চিলেকোঠার অইখানে একটা পাখির বাসা ছিলো। সেখানে চারটা পাখির ছানা দেখেছিলো সুমু আর নিচের ফ্ল্যাটের মেয়ে রাহা। তারপর অনেক কসরত করে সেই পাখির বাসা নিচে নামিয়ে দুইটা ছানা রাহা আর দুইটা এনেছে সুমু। নাদিম শেখ সেদিন সুমুকে বলেছিলো," সুমু মা তোমাকে যদি আমাদের কাছে থেকে কেউ অন্যকোথাও নিয়ে যায় আমাদের অনেক কষ্ট হবে না ? তোমরা যে পাখির ছানা গুলো নিয়ে এসেছো এখন পাখির আব্বু আম্মু যখন বাসায় এসে দেখবে তাদের ছানা গুলো সেখানে নেই পাখিগুলো অনেক কষ্ট পাবে না? আর কোনো জীবজন্তকে কষ্ট দিলে আল্লাহ যে অনেক গুনাহ দিবে মা। "
আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়েনি সেদিন সুমুকে। সুমু নাদিম শেখকে নিয়ে চিলেকোঠায় গিয়ে পাখির ছানা গুলো দিয়ে এসেছিলো। বাসায় এসেই সুমুর সেকি মন খারাপ! ওর মাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলো কি করলে আল্লাহ ওকে গুনাহ দিবে না? কোন কাজগুলো করলে আল্লাহ ওকে মাফ করে দিবে? ওর বারবার প্রশ্নের কারণে ওর মা হয়তো বলেছিলো, " আল্লাহর কাছে তওবা করে অই কাজ আর না করলে আল্লাহ মাফ করে দিবেন। "
তারপর ওর দাদুর কাছে জিজ্ঞাসা করেছে তওবা কিভাবে করে? ও তওবা করবে। ওর দাদু সেভাবে বুঝতে না পারাতে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেছে, " তওবা কিভাবে করে বাবা ?"
আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম ওর প্রশ্নে। তওবা কিভাবে করে সেটা ও জেনে কি করবে? পরে বুঝতে পারলাম ঘটনা। ওকে বললাম, "অজু করে আসো তো সুমু মা।" সুমু অজু করে একদম জায়নামাজ হিজাব নিয়ে এসেছে দেখলাম। ওকে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে বললাম। নামাজ শেষ হলে বললাম, " এখন আল্লাহ তোমাকে যে নেয়ামত গুলো দিয়েছে সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করো। আল্লাহর যে নাম গুলো তুমি মুখস্থ করেছো সেগুলো বলে আল্লাহকে ডাকো। আল্লাহকে বলো তুমি নিজের উপর জুলুম করেছো এখন তওবা করছো আর কখনো অই কাজ করবে না। তারপর আল্লাহর কাছে মাফ চাও।" তারপর আমার কথা মতো ও অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করলো। কান্নাও করলো দেখলাম। এরপর বড় হয়েও এই অভ্যেসটা বজায় রেখেছিলো সুমু।
তারপর ঘুমাতে যাওয়ার আগে পরে যখন মনে পড়ে তখনই ওর মাকে আর আমাকে এসে প্রশ্ন করছে ওকে আল্লাহ মাফ করে দিয়েছে কিনা। যখন বলি আল্লাহ অনেক দয়ালু মা। আল্লাহ তোমাকে অবশ্যই মাফ করে দিবে। তখন খুব খুশি হয়ে যায় ওর মায়া মায়া মুখটা। এখনো চোখ বন্ধ করলে সব যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠে নাদিম শেখের কাছে। দিনে কতোবার যে এই একই প্রশ্ন করতো আর যখন বলা হতো আল্লাহ অনেক দয়ালু তোমাকে অবশ্যই মাফ করে দিবে প্রতিবারই খুশিতে জ্বলজ্বল করতো সুমুর মুখটা।
সুমুর হয়েছিলো একদম ওর মায়ের মতো দেখতে। শুধুমাত্র ওর নাকটা হয়েছিলো নাদিম শেখের নাকের মতো বেশ তীক্ষ্ণ। নাক তীক্ষ্ণ হয় কিভাবে সেটা জানা নেই নাদিম শেখের তবে ওর নাক নিয়ে কথা উঠলে সবাই এটাই বলতো। তাই নাদিম শেখও সুমুর বেলায় ঠিক সেই উদাহরণটাই ভাবতো। আরেকটা জিনিসের সাথে সুমুর সাথে নাদিম শেখের বেশ মিল ছিলো সেটা হচ্ছে হাত পায়ের নখ। নাদিম শেখ মাঝে মাঝেই সুমুর সাথে বসে ওর হাত পায়ের নখের সাথে নিজের নখ মিলিয়ে দেখতো। একদম নাদিম শেখের নখের মতো নখ শুধু মাত্র আকারে হালকা ছোটো এই যা।
অনেক রাত হয়ে এসেছে ঠিক কয়টা বাজে তা ঠাওর করতে পারছে না নাদিম শেখ। ট্রেন চলছে একটা খটখট শব্দ করে। তাছাড়া আর তেমন কোনো শব্দ নেই আশেপাশে। সুমুর শশুরবাড়ির সবাই ঘুমে। তাদের কারো কোনো বিকার নেই এই মানুষদুটোর কষ্ট সম্পর্কে। তারা তাদের মতো অভিযোগ করেই যাচ্ছে। সুমুকে নিয়ে যে কথা গুলো বলছে ওরা যে অপবাদ গুলো দিচ্ছে তার মেয়েটার উপর অন্যসময় হলে হয়তো এদের মাথা ফাটিয়ে ফেলতো নাদিম শেখ। কিন্তু আজকে তার কিছুই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রবাদে আছে না,
" অল্প সুকে কাতর, অধিক সুকে পাথর "। পাথরই হয়ে গেছে নাদিম শেখ। অনেক চেষ্টা করেও একফোঁটা পানি আসছে না চোখে। কান্না আসলেই এক অদ্ভুত ব্যাপার। কখনো না চাইতেই চোখের কোনে উঁকি দেয় আর কখনো অনেক চেষ্টার পরেও দেখা মেলে না তাদের। নাদিম শেখ আল্লাহর প্রত্যেকটা ফয়সালাই হাসি মুখে মেনে নেয়। যুদ্ধ যতো কঠিন হোক আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়ে যায় একজন লড়াকু সৈনিকের মতো। কিন্তু আজ যে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না নাদিম শেখ। সুমু কি শুধু তার মেয়ে সুমু তো তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। আজ সেই অক্সিজেন টাই নাকি নেই। নেই মানে কোথাও নেই। আর কখনোই নাদিম শেখের অক্সিজেন হবে না তার সুমু মা।
নাদিম শেখ অনেক চেষ্টা করেও তার অবচেতন মনকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে সুমু আত্মহত্যা করেছে তাও আবার পর পুরুষের জন্য। নাদিম শেখের কেনো বেশি কষ্ট হচ্ছে সুমুকে হারানোর জন্য নাকি সুমু সম্পর্কে এসব বাজে কথা শোনার জন্য? ঠিক বুঝতে পারছে না নাদিম শেখ। অন্তরটা যেনো ফালা হয়ে গেছে সুমু নেই খবরটা শোনার পরে থেকে। আর তাতে নুন আর মরিচের গুঁড়ো ছিটানোর জন্য তো কথার অভাব নেই।
কিছুদিন পর পর নাদিম শেখের কাছে রনি ফোন দিয়ে সুমুর নামে বিচার দিতো। সুমু নাকি ওর কোনো কথা শুনে না। তারপর সুমুর সাথে কথা বলার সময় ওর মা আর নাদিম শেখ সুমুকে খুব বোঝাতো জামাইয়ের কথার অবাধ্য না হতে। কিছুদিন পর পর জামাইয়ের বিচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলো নাদিম শেখ। লাস্টে সুমুকে বলেছে জামাইয়ের কথা না শুনলে তোর সাথে আমরা কেউ কথায় বলবো না। সুমু বরাবরই চুপ করে থাকে আর শুনে যায়। কোনটা যে ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা বোঝার উপায় নেই। সুমুকে কোনো ফোন ইউজ করতে দিতো না রনি। আর রনি বেশ রাতে ফেরার কারণে শুক্রবার ছাড়া কথা বলতে পারতো না সুমুর সাথে। পঁচিশ দিন যাবত সুমুর সাথে কথা হয়না নাদিম শেখের। জামাইয়ের কথা শুনে না তাই একটু শাসন তো করতেই হয়। অবশ্য নাদিম শেখের কলিজাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো সপ্তাহে একটা দিন সুমু মায়ের সাথে কথা না বলে।
নাদিম শেখের কাছে ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় লাগছে। এতোক্ষণ মনের সাথে যতোই যুদ্ধ করুক তার ভেতরটা বারবার জানান দিচ্ছে সুমু কখনোই এরকম কাজ করতে পারে না। যে মেয়ে আল্লাহর ভয়ে একটা ছেলের দিকে পর্যন্ত তাকাতো না সেই মেয়ে মাত্র ১১ টা মাসে এতো পরিবর্তন হতে পারে না। যদিও কোনো ভাবেই ব্যাপারটা নাদিম শেখের বিশ্বাস হচ্ছে না কারণ সুমুর মা তো শোনার পরে থেকেই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে তার মেয়ে এরকম না এটা বলে। ঠিক এই একই কথাও নাদিম শেখ নয় নাদিম শেখের পুরো অস্তিত্ব জানে। তার মেয়ে কোনোভাবেই আত্মহত্যা করতে পারে না। কিন্তু তাহলে কেনো তার জামাই এরকম বললো। শুধু তাই নয় ওর জামাই এটাও বললো যে শুধু মাত্র এই ঘটনাটার জন্যই নাদিম শেখের কাছে জানাতো যে সুমু কথা শুনে না। কারণ এটা বলতে নাকি তার রুচিতে বাধতো। ভাবতো সময় দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। নাদিম শেখ যেনো এক সাগরের অতলে হাড়িয়ে যাচ্ছে কাকে বিশ্বাস করবে সে এতোগুলো বছরের দেখা সুমুকে না তার তার যুক্তিসংগত ভাবে কথা বলা মেয়ের জামাইকে।
সারারাত কষ্টের সাগরে সাতরে সাতরে অবশেষে তবে সকাল হলো। অবশেষে তার সুমুকে সে দেখতে পাবে। ট্রেন থেকে নেমে সবাই পৌছালো সুমুদের বাসায়। তিনরুমের একটা আলিশান ফ্ল্যাটে থাকতো সুমু আর রনি। বিছানার একটা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা তার মেয়েটা হ্যা অইতো তার মেয়ে। কষ্টগুলো যেনো দলা পাকিয়ে বুকের ভেতর একটা ধাক্কা দিয়ে উঠলো।
সুমুদের লাইব্রেরীর মতো রুমটাতে ঢুকলো নাদিম শেখ। তার মেয়েটার বই পড়ার প্রতি ছিলো অদম্য আগ্রহ। হঠাৎই চোখ পড়লো কালো চামড়ার মোটা ডাইরিটার উপর। নাদিম শেখ যদি খুব ভুল না করেন তাহলে এটা সুমুর ডাইরি। হ্যা এটা অবশ্যই সুমুর ডাইরি। ডাইরিটা নিয়ে নিলো নাদিম সাহেব।
ফিরতি ট্রেনের পথ ধরেছে সবাই। আলাদা একটা কামরা বুক করা হয়েছে নাদিম শেখদের জন্য। সুমুর শশুড়বাড়ির কেউ এই কামরায় আসেনি। তাদের নাকি লাশের সাথে এক কামরায় যেতে ভয় লাগে। শুধু ভয় পান না এই দুটো মানুষ। যাদের নয়নের মণি আজ লাশ হয়ে গেছে। সুমুর মায়ের কান্নার আওয়াজে আর ট্রেনের খটখট শব্দে অদ্ভুত এক শব্দ তৈরি হয়েছে কামরার ভেতরে । মেয়েটার মাথা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ যাবত তাকিয়ে রইলো নিষ্পাপ মুখটার দিকে। আবারো খুব চেষ্টা করছে নাদিম শেখ একটু কান্না করতে। সুমুর মায়ের মতো কেদে একটু হালকা হতে। হঠাৎ করেই নাদিম শেখের মনে পড়লো ডাইরিটার কথা। পাশের ব্যাগটা থেকে ডাইরিটা হাতে নিলো।
প্রথম পেইজ উল্টাতেই চোখে পড়লো সুমুর হাতের ছোটো ছোটো লেখাগুলো। এটা ২০১৯ এর মে মাসের একটা দিন। যেদিন সুমুর পা কেটে গিয়েছিলো। সেটা লিখে রেখেছে সুমু। নাদিম শেখ মনে করার চেষ্টা করলো সুমুর বিয়ের ডেট। হ্যা ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ বিয়ে হয়েছিলো সুমুর। পাতা উল্টে নাদিম শেখ চলে গেলো সেই ফেব্রুয়ারী মাসটাতে।
১১ ই ফেব্রুয়ারি,
" সেদিন যে ছেলেটা দেখতে এসেছিলো সেই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে যেনো রাজি না হয় বাবা। ছেলেটাকে আমার মোটেও ভালো লাগে নি। দাড়ি তো নেই আর না আছে টাকনুর উপর প্যান্ট। আল্লাহ একটা দ্বীনদার জীবনসঙ্গী দিও আমাকে। রাব্বানা হাবলানা,,,,,,"
১৪ ফেব্রুয়ারি,
"বাবা কিভাবে যেনো রাজি হয়ে গেলো। মাকে বললাম ছেলেটা তো দ্বীনদার না মা। মা বললো সমস্যা কি বিয়ের পরে বানিয়ে নিবি। মা বাবা দুজনেই মুটামুটি ইসলাম মেনে চলে। তাদের কাছে আমি এরকমটা একদমই আশা করিনি। আল্লাহ হেদায়েত না দিলে কিভাবে মানুষ দ্বীনের পথে আসবে? আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত হলেও বাবা বুঝবে। "
১৭ ই ফেব্রুয়ারি,
"আজ আমার বিয়ে। বিয়ে নিয়ে কতো কতো স্বপ্ন দেখেছি, কতো ভাবনা সেগুলো আর তেমন একটা কাজ করছে না আজ। কিভাবে কাজ করবে স্বপ্নের মানুষটার সাথে যে বাস্তব মানুষটার কোনই মিল নেই। তাছাড়া কিভাবে একজন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবো আমি এটাও ভাবনার ব্যাপার। বাবা শেষ পর্যন্ত আর বুঝেনি। আমিও পারলাম না এতোদিনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে। বাবা মা যা করবে আমার ভালোর জন্যই নিশ্চয়ই এই ভেবে চুপচাপ মেনে নিলাম সব। কেনো যে টাকাওয়ালা ছেলের জন্য আমাদের বাবারা দ্বীনদার ছেলেদের রিজেক্ট করে। "
লিখাটুকু পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নাদিম শেখ। সুমু রাজি ছিলো না বিয়েতে। তিনি কিভাবে এতোবড় একটা ভুল করলেন? দোষ তো তারই ছেলেদের অবস্থা দেখে তিনি যেনো পাগলই হয়ে গেছিলেন।
৭ ই মার্চ,
" আল্লাহগো তুমি জানো কি চলছে আমার ভেতর। মানুষটা নামাজ ও পড়ে না। শুধু জুমাবারে মসজিদে যায়। আমিতো এরকম ছেলে চাইনি আল্লাহ। "
১০ ই আগস্ট,
" এই নিয়ে তিনবার উনি আমার গায়ে হাত তুলেছে। কি করবো আমি? পর্দা যে আমার জন্য ফরজ কি করে আমি তোমার অবাধ্য হয়ে ওনার কথা শুনি? ওনার ফ্রেন্ডদের সামনে বোরকা পড়ে গিয়েছি বলে ওনার নাকি সব প্রেস্টিজ লো করে দিয়েছি আমি। "
১৬ অক্টোবর,
" আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে দুনিয়ার সব শখ আহ্লাদ ছেড়ে দিলাম। আমার আর প্রয়োজন নেই অন্যকারো ভালোবাসার। আমি আর কষ্ট পাবো না। ভেংগেও পড়বো না। যতো মারধর করে করুক আমি কোনোভাবেই বেপর্দা হয়ে কারো সামনে যাবো না।"
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নাদিম শেখ। তার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য এতোটা কষ্ট পেয়েছে তার সুমু। অথচ এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে নিয়ে এরকম একটা ঘটনা তৈরি করেছে ছি!
যে মেয়েটাকে ফুলের টোকা লাগতে দেননি এতোগুলা বছর সেই মেয়েটাকে এতোটা অত্যাচার করেছে পাষন্ডটা।
আপনা আপনি ধৈয্য হাড়িয়ে ডাইরিটার শেষ লিখাটায় চলে গেলেন নাদিম শেখ।
২৮ ই ডিসেম্বর
" এতো কিছুর মাঝেও আল্লাহ আমার জন্য একটা স্বস্তির খবর পাঠালো। আলহামদুলিল্লাহ আমি কনসিভ করেছি। এইতো আমার বেচে থাকতে আর কি লাগে। এইতো অনেক প্রশান্তি আমার!"
৬ ই জানুয়ারি, ২০২১
" আল্লাহগো আমার বাবুটার কিছু হতে দিও না। আমি অনেক দূরে চলে যাবো তবুও বাবুটার যেনো কিছু না হয়। আজকে অনেক মেরেছে আমাকে। বাচ্চাটা এবরশন করাতে বলে। বয়স হয়ে গেছে ৩২ এর উপরে এখনো নাকি বাবা হওয়ার বয়স হয়নি। থ্রেট দিয়েছে এবরশন না করালে আমাকে বিষ খায়িয়ে মেরে ফেলবে। আমি বাবার কাছে চলে যাবো। যদিও বাবা মার কাছে আমার নামে উল্টো পাল্টা বলেছে বলুক। অবশ্যই বাবা মা আমাকে বুঝবে। আমার সোনাটার তো কোনো দোষ নেই ওকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পথে বাধা হয়ে দাড়াবো না আমি। সুস্থ একটা পরিবেশ পাবে আমার সোনাটা। এরকম অসুস্থ পরিবেশে না থাকাই ভালো আমার বাবুর। কোন সন্তান মেনে নিতে পারবে যে তার বাবা চরিত্রহীন! আল্লাহগো বাবার সাথে কথা বলার ব্যাবস্থা করে দাও। আমি আর পারছি না এই অসুস্থ পরিবেশে থাকতে। যখন তখন আমার পেটে লাত্থি দিতে পারে। আমার বাবুটা যে তাহলে আর পৃথিবীর আলো দেখবে না।
ট্রেন চলছে নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার চিড়ে। তার মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছে এক বুড়ো। সে তার জীবনের অনেক বড় একটা ভুল বুঝতে পেরেছে কিন্তু সময় হাড়িয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুড়োটা চিল্লিয়ে বলে উঠলো, " আল্লাহগো সারাজীবন নিজেকে খুব দ্বীনদার মনে হতো। নামাজ, রোজা, নফল আমল, সুন্নাত ইবাদাত কতো ইবাদতই না করেছি। আজ সেসব তুচ্ছ মনে হচ্ছে আল্লাহ। আমিতো তোমাকে সত্যি ভালো বাসতে পারনি আল্লাহ। যদি পারতাম তাহলে তোমার উপর ভরসা করে মেয়েটাকে একটা দ্বীনদার পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারতাম। আমার একটা ভুলের জন্য আমার মেয়েটার জীবন যে নরক হয়ে গিয়েছিলো আল্লাহ ভুলের মাসুল ও আমার সুমু মা দিলো। আজ পৃথিবীর প্রত্যাকটা বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে আপনারা নিজেদের ঈমানের পরিক্ষা এই যায়গাটাতে এসে দিন। আপনার মেয়েটাকে কম আয়ের হলেও একটা দ্বীনদার পাত্রের হাতে তুলে দিন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। নাহলে আমার মতো হ্যা আমার মতো অনেক পরে এসে বুঝতে পারবেন। আপনাদের সুমুরা সবাই হয়তো আমার সুমুর মতো মারা যাবে না তবে যতোদিন বেচে থাকবে এক নরকের মতো জীবন যাপন করতে হবে।
আচ্ছা সুমু মার মৃত্যুর জন্য কে বেশি অপরাধী ? রনি নাকি নাদিম শেখ নিজে!
ভুল
Taiyeeba Tania