Sunday, July 25, 2021

ভালোবেসে সংশোধন

 

আপনি আপনার স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষকের মেয়েকে পছন্দ করেছেন। তাকে ভালোবাসেন, তার সাথে প্রেম করতে চান। অথবা আপনি আপনার মাদ্রাসার হুজুরের মেয়েকে পছন্দ করেছেন। এখন তাকে বিয়ে করতে চান।
নিজেকে ঐ ছেলের জায়গায় চিন্তা করুন। মনে করুন, আপনিই সেই ছেলে। এখন আপনার মানসিক অবস্থা আর ভয় কীরকম কাজ করছে? আপনি ঐ স্যারের/হুজুরের সামনে দাঁড়াতে পারবেন?
স্যাররা সবাই টিচার্স রুমে বসে আছেন অথবা হুজুর অন্যান্য হুজুরদের সাথে রুমে বসে আছেন। আপনি কি সাহস করে সবার সামনে গিয়ে বলতে পারবেন, “স্যার/হুজুর, আমি আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছি। তার সাথে প্রেম/বিয়ে করতে চাই।”
ঐ মুহূর্ত কল্পনা করতেই তো পা থরথর করে কাঁপার কথা! এরকম কথা কি সরাসরি মেয়ের বাবা, যিনি আমার শিক্ষক, তাকে বলতে পারবো?
আপনি চিন্তা করুন, আপনি এলাকার চেয়ারম্যান/কাউন্সিলরের মেয়েকে পছন্দ করেছেন। চেয়ারম্যান/কাউন্সিলরের সাথে অন্যান্য লোকেরা যখন বসে আছে, আপনি সাহস করে বলতে পারবেন- “আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই?”
স্বাভাবিকভাবে বুঝাই যাচ্ছে যে, এসব ক্ষেত্রে আমাদের জড়তা কাজ করবে। এমন জড়তা কাজ করাটাই তো স্বাভাবিক। তিনি তো আমার বন্ধু না যে, তাকে গিয়েই বলতে পারবো- ‘আমি আপনার মেয়ের সাথে প্রেম করবো’। তিনি আমার শিক্ষক, আমার এলাকার পাওয়ারফুল একজন ব্যক্তি।
সাহাবীদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতোটা ভরসার পাত্র ছিলেন চিন্তা করা যায়? মন খুলে নিজের সুখ-দুঃখ বলা যায়, এরকম মানুষ হিশেবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেমন ছিলেন, ভাবা যায়?
তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, মসজিদের ইমাম, একজন সেনাপতি এবং একজন কাউন্সিলর (পরামর্শদাতা)।
একবার এক যুবক সাহাবী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে যিনা (Sexual intercourse) করার অনুমতি দিন!”
আপনাকে যেটা কল্পনা করতে বলেছিলাম, সেটার চেয়েও অনেক-অনেক ভয়ঙ্কর কথা যুবক এসে জিজ্ঞেস করছেন। আপনি তো প্রেম বা বিয়ের জন্য স্যারকে বলতে দ্বিধাবোধ করছেন, কিন্তু ঐ সাহাবী আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে!
ঐ সাহাবী কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐরকম কোনো বন্ধু নন যে মন চাইলো আর যা ইচ্ছে বলে দিবেন। তা-ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য সাহাবীদের সাথে তখন বসা। বাকি সাহাবীরা তাকে ধমক দিলেন- “থামো, থামো’’। অর্থাৎ, তোমার এত্তো বড়ো সাহস? তুমি কী বলছো এগুলো?
ঐ যুবক রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতোটা ‘কমফোর্ট জোন’ হিশেবে চিন্তা করেছে ভাবা যায়? নিজের এমন ইচ্ছের কথাও তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে শেয়ার করছেন; যেসব বিষয়ের কথা সব বন্ধুও তার অন্য বন্ধুকে বলে না।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ডাকলেন- ‘‘আমার কাছে এসো।’’ সাহাবীরা তাকে ধমক দিলেন, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কাছে যেতে বললেন। এখন কি তিনি সজোরে তার গালে দুটো চড়-থাপ্পড় মারবেন? কিংবা সাহাবীদেরকে বলবেন, ‘একে ধরো, বেঁধে রাখো। শাস্তি দিয়ে দেখিয়ে দাও যে, এরকমটা কেউ করতে চাইলে কী পরিণতি হয়।’
না। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোনোটাই করলেন না। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি চিন্তা করুন আপনি সাহস করে আপনার শিক্ষককে সবার সামনে তার মেয়ের সাথে প্রেম/বিয়ের প্রস্তাবের পর তিনি কী রি-অ্যাক্ট করবেন।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি নিজের মায়ের জন্য এমনটা করতে পছন্দ করো?” অর্থাৎ তার সাথে অবৈধভাবে কেউ এটা করুক।
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রশ্নের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। সাহাবী বললেন যে, তিনি এটা পছন্দ করেন না। অতঃপর নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝালেন যে, তুমি যার সাথে এমনটা করবে, সে তো কারো না কারো মা।
এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মেয়ের সাথে এমনটা হোক, সেটা তুমি পছন্দ করো?” যুবক সাহাবী আবারো ‘না’ বললেন। আবার নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝালেন যে, তুমি যার সাথে এমনটা করবে, সে তো কারো না কারো মেয়ে।
এভাবে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বোন, ফুফু, খালার উদাহরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করে একই সমাধান দিলেন যে, তুমি যার সাথেই এমনটা করো না কেনো, সে কারো না কারো মা, বোন, মেয়ে, খালা, ফুফু। তুমি যেমন নিজের কারো সাথে এমনটা হোক চাও না, তেমনি তারাও তো এমনটা চায় না।
এই ধরণের বুঝানোর ভঙ্গিকে বলে ‘Empathy’। আরেকজনের সুখ বা দুঃখ নিজের মতো উপলব্ধি করা, সেটা বুঝা। সেই ইম্পেথির ফিলিংস যুবক সাহাবীর মধ্যে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাগিয়ে দিলেন। তাকে বকাঝকা করলেন না, মারলেনও না, ধমকও দিলেন না, অপমানও করলেন না।
বুঝানো শেষে তাঁর পবিত্র হাত যুবকের বুকে রাখলেন। এই ফিলিংসটাও একটু চিন্তা করুন। যে একটা পাপ কাজের জন্য এসেছিলো, তাকে বুঝানো শেষে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার বুকে হাত রাখছেন। চিন্তা করুন, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই হাত আমার-আপনার বুকে রাখছেন! কারণ, ঐ যুবকের অনুভূতি আমাদের প্রত্যেকেরই হয়। আমরা হয় বলি, নতুবা গোপন রাখি।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুবকের বুকে হাত রেখে দু’আ করলেন, “হে আল্লাহ! আপনি তার গুনাহ মাফ করে দিন, তার হৃদয়কে পবিত্র করে দিন এবং তাকে ব্যভিচার থেকে রক্ষা করুন।” [মুসনাদে আহমাদ: ২২২১১]
সেদিনের পর থেকে যুবকটি কোনোদিন যিনার দিকে ঝুঁকেননি। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ বুঝানো তার কতোটা কাজে লেগেছিলো একবার ভাবুন যে, তিনি যিনা করার কথাই মাথা থেকে বাদ দিয়ে দেন।
আমার নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কাছে এমন এক মানুষ ছিলেন যে, যার কাছে মনের দুঃখ এমনভাবে বলা যায়, যা একজন বন্ধুর কাছেও বলা যায় না। তাঁর কাছে সাধারণ মানুষের এক্সেস এতো সহজ ছিলো যে, মানুষ তাঁর কাছে যেতে সঙ্কোচবোধ করতো না। তাঁকে নিজের বাবা-মায়ের চেয়েও আপন মনে করতো। এটা শুধুমাত্র কুরআনের আক্ষরিক নির্দেশ মানার জন্যই ছিলো, এমন না। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সাথে এমন ব্যবহার করতেন যে, তারা নিজেদের সবচেয়ে আপন মানুষ হিশেবে তাঁকে কল্পনা করতো।
তিনি ধমক দিয়ে, মেরে, অপমান করে মানুষকে সংশোধন করেননি। ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছেন। এমন কাছে টেনে নিয়েছেন, এমন বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন, সেই পাপে ইচ্ছুক মানুষটি পরিণত হয় শ্রেষ্ঠ মানুষে। তাঁকে হত্যা করতে আসা মানুষগুলো ৫ মিনিটের মধ্যে তাঁকে তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বলে স্বীকৃতি দেয়।
এমন যাদুময়ী ভালোবাসা যার মধ্যে আছে, মানুষ সেই ভালোবাসার টানেই ছুটে যাবে তার কাছে।
।। ভালোবেসে সংশোধন ।।
- আরিফুল ইসলাম

No comments:

Post a Comment