আমার মা একজন ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গৃহিনী এবং আমাদের বাসার সেকেন্ড হায়েস্ট ইকোনমিক কন্ট্রিবিউটর। গৃহিনীরা আবার কীভাবে ইকোনমিক কন্ট্রিবিউশন করে এইটা অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাই একটা এক্সামপল দিয়ে এক্সপ্লেইন করি।
আমি যে পরিমাণ ভাত প্রতিবেলায় খাই, সেটার জন্য প্রায় ১৫০ গ্রাম মত চাল লাগে। আমরা যে চালের ভাত খাই সেটার ১৫০ গ্রামের দাম প্রায় ১৪ টাকা। আমরা দ্বিমুখী চুলার গ্যাস বিল দিই ১০৮০ টাকা, এর মানে এক চুলার জন্য মাসে ৫৪০ টাকা, দিনে ১৮ টাকা, ঘন্টায় ৭৫ পয়সা। ভাত রান্না করতে ২০ মিনিট লাগলে গ্যাস যাচ্ছে ২৫ পয়সার। এর সাথে ধরেন আরও ২৫ পয়সার পানি। তাহলে, ১৪+০.২৫+০.২৫=১৪.৫ টাকা, এর সাথে আম্মুর এফোর্ট যোগ হয়ে যে ভাত তৈরি হচ্ছে, সেই কোয়ালিটির ভাত রেস্টুরেন্টে খেতে আমার লাগতো মিনিমাম ৫০ টাকা। তার মানে, ৫০-১৪.৫=৩৫.৫ টাকা এইটা হচ্ছে প্রতিবেলায় শুধু আমার ভাতের জন্য আম্মুর এফোর্টের মূল্য। আমরা বাসায় চারজন লোক, চারজনের জন্য দুইবেলা করে ভাত রান্না করলে দিনেই বাঁচাচ্ছেন ২৮৪ টাকা, মাসে ৮৫২০ টাকা। 'বাঁচাচ্ছেন' মানে কিন্তু উল্টো করে এটাও বলা যায় উনি এই টাকাটা বাসায় কন্ট্রিবিউট করছেন।
এ তো গেলো শুধু ভাতের হিসাব। এই ছাড়া ভাতের সাথে আমরা যে তরকারি খাই, সকালে-সন্ধ্যায় নাস্তা খাই, চা খাই, ঘরে আম্মু যে কাজগুলো করেন, সব মিলিয়ে উনার কন্ট্রিবিউশন মাসে ৬৮ থেকে ৭৫ হাজার টাকার মত।
এবং, আমার আম্মুর মত লাখ লাখ আম্মুরা মিলে শুধু বাংলাদেশের ইকোনমিতে যে কন্ট্রিবিউশন করছেন, তার ভ্যালু প্রায় ৭ থেকে ১০ লক্ষ কোটি টাকা মাত্র। (সোর্স কমেন্টে)
এই যে হিসাবটা আপনাদের দিলাম, এই হিসাবের সিমিলার কিছু ছোটবেলা থেকে কোনো পাঠ্যবইয়ে পেয়েছেন? আমি পাই নি, বরং আমি উল্টোটাই দেখেছি। ইন্ডাস্ট্রিতে লেবার সেল করা নারীদের 'ওয়ার্কিং উমেন' হিসেবে প্রমোট করে বিপরীতে গৃহিণীদের কাজকে ছোট করে দেখার মানসিকতা স্লো পয়জনের মত পুশ করা হয়েছে। ছেলেকে বুঝানো হয়েছে তোমার মা যে কাজ করে সেটার তেমন কোনো ভ্যালু নাই, মেয়েকে শিখানো হয়েছে তোমার মায়ের মত হলে তোমারও সম্মান থাকবে না। এটার এন্ড টার্গেট যে আসলে কী, সেটা আশা করি বলে দিতে হবে না।
এই যে গৃহিণীদের কাজকে এতো ছোট করে দেখানো হলো, এটার পেছনের কারণটা কী? এই ব্যাপারে আমার অবজারভেশন হলো, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশনে লেবার সাপ্লাই বাড়ানো। আর সাপ্লাই বাড়লে দাম কমে যাবে, এই কোরিলেশন কারও অজানা থাকার কথা নয়। একটু বুঝিয়ে বলি। ধরেন একটা অফিসে একই পজিশনে দুইটা পোস্ট ফাঁকা আছে, কোম্পানির রিক্রুটমেন্ট বাজেট ২০০ টাকা। এখন, ক্যান্ডিডেট দুইজন হলে কোম্পানি দুইজনকেই ২০০ টাকা দিয়ে নিতে বাধ্য। কিন্তু, ক্যান্টিডেট যদি ৪ জন হয়, তখন কোম্পানি ৫০টাকা করে ৪ জনকে অনবোর্ড করবে, নাকি 'আরও ক্যান্ডিডেট আছে' বলে সবার সাথেই নেগোশিয়েট করে কম স্যালারিতে এমপ্লয়ি অনবোর্ড করার চেষ্টা করবে? এর মধ্যে কেউ হয়তো প্রয়োজনের চাপে কম স্যালারিতেই রাজি হয়ে যাবে। একটু মনে করে দেখেন, ৩০-৪০ বছর আগেও একজনের ইনকামে ১০ জনের একটা ফ্যামিলি অনায়াসে চলতে পেরেছে, টুকটাক সেভিংসও করতে পেরেছে, যেতা এখন প্রায় অসম্ভব। 'চলছে না' বলে স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই শ্রমবাজারে নিজেদের বিক্রির জন্য তুলে দিচ্ছেন, লেবার এক্সপ্লয়েটেশনে নিজেদের ক্রমাগত সঁপে দিয়ে আরও বেশি লেবার এক্সপ্লয়েটেশনের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
এ তো গেলো শুধু ইকোনমির হিসাব। এর সাথে, সময়ের অভাবের কারণে বিভিন্ন অ্যাপ্লায়েন্সের পিছনে লিভিং কস্ট বাড়া, প্রসেসড ফুড খেতে বাধ্য হওয়া এবং এর কারণে বাড়া মেডিকেল কস্টের হিসাব করলে যে কারোরই মাথা ঘুরবে, আমারও ঘুরেছিলো। আর ইমোশনাল লস তো টাকায় হিসাব করা যায় না, সেইটার ভ্যালু যার যার উপরেই ছেড়ে দিলাম।
লাস্ট দুইটা কথা বলি।
এক, গৃহিণী নারীরা পুরুষের উপর 'নির্ভরশীল', এই প্রোপাগান্ডাকে ডিনাই করতে শিখুন। নির্ভরশীলতা হতো যদি সহযোগিতাটা একপাক্ষিক হতো। পরিবারে আর্নিং পার্সন, হাউজহোল্ড ওয়ার্কিং পার্সনের ভূমিকাটা মিথোজিনিক, একজন আরেকজনকে সাপোর্ট দিচ্ছে, এখানে কোনো 'নির্ভরশীলতা' নেই।
দুই, একাডেমিয়াকে হোলি প্লেস ভাবা বন্ধ করুন। একাডেমিয়ার লক্ষ্য 'আলোকিত মানুষ করা' এটা সর্বৈব মিথ্যা, বরং একাডেমিয়ার ডিজাইনটা হচ্ছে 'দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ডগম্যাটিক স্লেভারি' ট্রেনিং দেয়া। আপনাকে, আমাকে যেই মানসিকতায় বড় করলে আমাদের শাসক, শোষকদের সুবিধা হয়, একাডেমিয়া সেভাবেই চেঞ্জ হয়। 'সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত' এই কথাটাকে বিশ্বাস করুন, নিজের ব্যক্তিগত পড়াশুনা, জ্ঞান চর্চা, চিন্তাভাবনা বাড়ান।
✍️ আহমেদ আব্দুল্লাহ রিফাত