সওদা-
১ম
খন্ড
(গল্পটি
বেশ বড় বিধায় দুটি খন্ডে শেয়ার
করা হবে)
*এক*
খুব
দ্রুত জামাটা গায় দিয়ে আমি
তৈরি হয়ে নিলাম । দেয়ালে ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায়
সাড়ে ন’টা
বাজে । দেরি হয়ে গেছে । ইদানিং
কোন কাজই সময় মতো করতে পারছিনা।
সব কাজে কোন না কোন কারণে দেরি
হয়ে যায় । বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ
সব কাজগুলো
। সাড়ে দশটার মধ্যে এফডিসিতে
পৌছতে হবে । অনেক ধরাধরির পর
বিখ্যাত পরিচালক
এহতে সামস্ সময় দিয়েছেন,
তাও
আবার পাঁচ মিনিট । মানুষের
সময়ের মূল্য যে কতো,
তা
এ সব বিখ্যাত মানুষগুলোকে না
দেখলে বোঝা যায় না। এই পাঁচ
মিনিট সময়ের
মধ্যে
তাকে পুরো চিত্র নাট্যটি
বোঝাতে হবে । যদি তার পছন্দ
হয়,
তা
হলে তিনি তার পরবর্তি
ছবির জন্য আমার লেখাটি নেবেন
। এটাই
কোন পরিচালকের সঙ্গে আমার
চিত্রনাট্য নিয়ে প্রথম সাক্ষাত
নয় । এর আগেও
অসংখ্য
বার অসংখ্য পরিচালক আমার
চিত্রনাট্য দেখেছেন । এবং
প্রতিবারই আমি প্রত্যাক্ষিত
হয়ে যন্ত্রনার শেষ সীমায় পৌছে
পার মাতাল হয়ে মেসে ফিরেছি ।
বাংলা সিনামায়
চাকবুম চাকবুম বিষয় না থাকলে
ঠিক জমে না । অথচ আমি সেই চাকবুম
চাকবুম জিনিষটাকে
আমার চিত্রনাট্য থেকে পুরোপুরি
বাদ দিয়ে দিয়েছি । চিত্রনাট্য
নেড়ে চেড়ে সিগারেটের
পেছনে দম দিতে দিতে এক এক জন
বলছেন,
“মিয়া
নাচ-গান
নাই এইটা কোন
সিনামা
হইলো ?
নাচে
গানে ভরপুর কিছু নিয়া আস,
পার্বলিক
নায়িকার উত্তাল নাচ দেখতে
চায় । নায়িকারে বৃস্টিতে ভিজাও
পানিতে চুবাও ,
প্রয়োজনে
বন জঙ্গলে নিয়া হাটুর
উপড়ে সাপের কামড় খাওয়াও তা
হইলেই না সিনামা হিট হইবো ”।
আমি
নায়িকারে বৃস্টিতেও
ভিজাতে পারছিনা আবার পানিতেও
চুবাতে পারছি না । না পারছি
হাটুর উপড় সাপের
কামড় খাওয়াইতে । তাই কোন পরিচালক
আমার চিত্রনাট্য গিলছে না ।
কাজেই
প্রত্যাক্ষিত
হয়ে মাতাল হয়ে পরিচালকদের
চৌদ্দগোস্টিকে গালিগালাজ
করে মেসে ফেরা ছাড়া
আমার কোন উপায় নাই ।
মধুমিতা
মেসের মালিক সদু ভাই আমাকে
বিশেষ ভালবাসেন বিধায় ঐ অবস্থায়
আমি মেসে ফিরতে
পারি । তা না হলে যে কি হতো কে
জানে । তা ছাড়া এ জগতের মানুষের
এ অভ্যাসটাকে
লোকে অনেকটা মেনে নিয়েছে । আজও
হয়তো ভাংঙ্গা মন নিয়ে মাতাল
হয়ে আমাকে গভীর রাত্রিরে মেসে
ফিরতে হবে । যতোটা
উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছি;
হয়তো
তার চাইতেই ঢের বেশি মনকষ্ট
নিয়ে ফিরে আসবো । তাই
বলে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র আমি
নই । একবার না পারিলে দেখ শতবার
নীতিতে বিশ্বাস
রেখে এগিয়ে চলেছি ।
টেবিলের
উপরে রাখা ব্যাগটা আরেকবার
পরীক্ষা করে নিলাম । লেখাটি
ঠিক মতো আছে কিনা
। গত রাতে পুরো চিত্রনাট্যটি
বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটাছেড়া
করেছি। পরে ফ্রেশ করে
নেওয়া যাবে । এখন সময় নেই ।
আলমারি খুলে এ মাসের বেতনের
শেষ পাঁচশ টাকার নোটটা
বের করে মানিব্যাগে নিলাম।
মাসের বাকি এখন ও দশ দিন । বাকি
দিনগুলো কিভাবে
কাটবে কে জানে ।
দরজায়
তালা দিয়ে । সিড়ি দিয়ে নীচে
নামতেই কাউন্টারের সামনে
দেখি সদু ভাই দাঁড়িয়ে
কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন ।
খুব সম্ভব এরা মেসের বাবুচি
হবে ।
আমাকে সিঁড়ি
দিয়ে তারাহুরো করে নামতে দেখে
সদু ভাই আমার দিকে একবার
তাকিয়ে-কাউন্টারের উপড়
রাখা পিক দানিতে পানের পিক
ফেলে বললেন,
“কি
রাইটার সাব ,
আবারও
মনে হয় যাইতাছ
?”
আমি
একটু থেমে মাথা নেড়ে বললাম ,
জি
সদু ভাই,
দোয়া
করবেন ?
“তা
এইবার কারে দেখাইবা ?”
“এহতে
সামস্ ।”
আমি ছোট্র করে নামটা বললাম ।
ক
ও কি মিঞা ?
ঐ
ব্যাটা তো হুনছি হিটের পর হিট
। ঠিক লোকরেই ধরছো মনে হয় । তোমার
দিয়া হইবোই হইবো এইডা আমি কইয়া
দিলাম । সদু ভাই এগিয়ে এসে
আমার কাঁধে চাপর
দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে জর্দ্দার
কড়া গন্ধ নাক এসে নাকে লাগল
। আমি চলে যাবার ভঙি
করে,
“বললাম,
“দোয়া
করবেন সদু ভাই ।”
দোয়া
তো করমুই,
এইডাই
তো এখন আমাগো বাংলাদেশে একমাত্র
ফ্রি জিনিষ । তা কুনহানে দেহা
করবা ওনার লগে ?
যাইবা
কই ?
এফডিসিতে
?
কও
কি ?
জ্বি,
ওনার
একটা সুটিং আছে.
ফাঁকে
আমার সঙ্গে কথা বলবেন ।
বা:
বেশ
ভাল । হাতে সময় থাকলে তোমার
লগে যাইতাম । এফডিসির ভেতরটা
দেহনের আমার
খুব সখ ।
সদু
ভাই,
আমি
তাহলে আসি,
দেরি
হয়ে যাচ্ছে,
হাতে
একদম সময় নাই । সাড়ে দশটার মধ্যে
পৌছাতে হবে । আমি হাত ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে
বললাম । আরে
তাইলে তো আসলেই সময় নাইকা ।
এহনতো অফিস টাইম । এখন গাড়ি
ঘোড়াও পাওয়া কঠিন;
চলো
আমার লগে দেহি নাসিরার গ্যারেজে
গাড়ি আছে কিনা । আমি চমকে উঠলাম
। কেননা
সদু ভাই এর সঙ্গে যাওয়া মানে
আরেক যন্ত্রনা । দেখা যাবে
গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে
দশটা বেজে যাবে । আমি তারাতারি
না,না
করতে করতে বললাম,
“আপনাকে
কষ্ঠ করতে
হবে না সদু ভাই,
আমি
খুঁজে নিবো ।”
আরে
মিঞ খুঁইজা নিবা বললেই হইলো
নাকি ?
গাড়ি
পাইতে হইবো না ?
চলো
আমার লগে। সদু
ভাই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা
লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
রাতের
জন্য পোলাও গোস্ত
করিস । আজ রাইটার সাহেবের জয়
হইবোই হইবো। আমি সদু ভাইয়ের
এই স্নেহের কাছে
পরাস্ত হয়ে তার পিছু পিছু মেস
থেকে বের হয়ে এলাম । বুক চিরে
বের হয়ে এলো একটা
দীর্ঘশ্বাস ।
নাসিরের
গ্যারেজে অতি সহজেই গাড়ি পাওয়া
গেল । গ্যারেজের দিকে হাঁটতে
হাঁটতে সদু
ভাই বললেন;
“চলো
আইজকা তুমি সফল হইবা কি হইবা
না তার একটা ছোট্র পরীক্ষা কইরা
ফেলাই ?
”কিভাবে
?
আমি
দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে
জিজ্ঞাসা করলাম । যদি
নাসিরার গ্যারেজে যাইয়াই
গাড়ি পাইয়া যাই তাইলেই মনে
করুম তুমি আজ সফল । ঐ পরিচালক
ব্যাটা তোমার বই লইবোই লইবো
।
আমি
এসব বিশ্বাস করি না । তাই মুখে
কিছু বললাম না । কিন্তু তবুও
দেখা গেল সত্যিই
গ্যারেজে
গাড়ি পাওয়া যায় কিনা সেটা
দেখার জন্য মনে মেনে বেশ উৎগ্রীব
হয়ে উঠলাম ।
নাসিরের
গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি,
দরজার
সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে
আছে। সদু ভাই
আমার
দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ,
তুমি
জিতা গেছ । যাও,
আইজকা
তোমারে
আর কেউ আটকাইতে পরবোনা কইয়া
দিলাম । প্রাথমিক বিজয়ে আমার
মনটাও খুশিতে
ভরে
উঠল ।
গ্যারজের
মালিক নাসির একটা ময়লা বিছানার
উপড়ে বসে চা খাচ্ছিল,
সদু
ভাইকে দেখে
তারাহুরো
করে নেমে এসে সালাম দিয়ে
জিজ্ঞাসা করল,
“কিছু
লাগবো ভাই ?
আমারে
খবর
পাঠাইলে
তো আমিই যাইতাম ।”
তা,তো
যাইতিই। এখন দেখ একটা গাড়িটারি
আছে কিনা,আমাগো
রাইটার সাব এফডিসিতে
যাইবো
।
এই
সিএনজিতে গেলে হয় না ভাই,
নাকি
গাড়িই লাগবো ?
নাসির
আমার দিকে তাকিয়ে
দরজার
সামনে দাড়িয়ে থাকা সিএনজিটা
দেখিয়ে বলল ।
গাড়ি
লাগবে না,
সিএনজিতে
হলেও চলবে । বলে আমি সদুভাইয়ের
দিকে তাকালাম ।
তোর
ড্রাইবার কই ?
আছে,
মনে
হয় মুততে গেছে । দাঁড়ান আমি
ওরে লইয়া আইতাছি । বলেই নাসির
দৌড়ে
গ্যারেজের
পেছনে চলে গেল ।
নাসিরারা
কামডা দেখলা,
এইসব
পোলাপান হালায় ম্যানার জানে
না;
তোমার
সামনে
ক্যামনে
কইলো মুততে গেছে । তুমি কিছু
মনে কইরো না । আইউক দিমুনে
কানের পেছনে
দু’ইডা
ভনচটকোনা,
হালায়
পুতে কইবোনা,
“বার্থরুমে
গেছে । যাও যাও তুমি জিএনজিতে
যাইয়া
বও । রাইতে তারাতারি আইয়া পইরো
পোলাও গোস্ত হইবো কিন্তু ।”
আমি মাথা
নেড়ে
সিএনজিতে উঠে বসলাম । প্রায়
সঙ্গে সঙ্গে সতেরো কি আঠারো
বছরের একটা ছেলে
এসে
,
সিএনজি
স্ট্যাট দিল ।
সদু
ভাই কাছে এসে বলল,
এক্কেবারে
ঝড়ের বেগে লইয়া যাবি । সময় মতো
পৌছাইতে না
পারলে
কিন্তু ঘারে খাবি । সদু ভাই
এর এই বাড়াবারি দৃস্টিকটু,
অনেক
সময় অসহ্য লাগে।
কিন্তু
প্রচুর অর্থ কড়ি ,
উদারতা
আর সান শওকতের জন্য সবাই সদু
ভাইকে বেশ সমিহ করে
চলতে
বাধ্য হয় ।
ছেলেটা
আমায় সত্যিই ঝড়ের বেগে নিয়ে
এলো । আজ সবই দেখি বেশ ভালয়
ভালয় হচ্ছে। রাস্তাতে
জ্যাম ছিল না বললেই চলে ।
এফডিসির গেটে বিশাল ভীর । নায়ক
নায়িকাকে দেখার
জন্য উৎসুক ভক্তদের অভাব নাই
। অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে গেটে
পৌছে গেট পাস দেখাতেই
আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল ।
১১
নম্বর ফ্লোরে এহতে সামস্
সাহেবের সূটিং চলার কথা । ১১
নম্বরটা কোথায় তা কয়েক জনকে
জিজ্ঞাসা করে ১১ পৌছে দেখি
বিশাল এক তালা ঝুলছে । গেটের
সামনে কয়েকজন গার্ড
বসে গল্প করছে । মনটা খারাপ
হয়ে গেল । অনেকটা অনিচ্ছা
সত্যেও গার্ডদের এহতে
সামস্ কথা জিজ্ঞাসা করতেই
একজন বলল,
স্যার,
ইউনিট
নিয়ে ১৩ নম্বর গেছে । ঐ হানে
যান,
১১
নম্বরের জেনারেটার খারাপ
হইছে তাই এইহানে সুটিং বন্ধ
। ১৩ নন্বরটা
কোন দিকে তা জেনে নিয়ে আমি
জোরে পা চালালাম ।
*দুই*
১৩
নম্বরে পৌছে আমি এহতে সামস্
সাহেবকে সালাম দিলাম । তিনি
আমাকে হাতের ইশারায়
বসতে বললেন । আমি পেছনে দিকে
একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম ।
এটা সেটা করে
পুরো সেট রেডি করতে করতে ২টা
বেজে গেল । লাঞ্চের পর সূটিং
শুরু হলো । সূটিং মানে
এক এলাহিকান্ড । আমি বেশ আগ্রহ
নিয়ে সুটিং দেখতে লাগলাম ।
এক একটা সট তিন চারবার
করে নেওয়া হচ্ছে । যে সটটা
আমার কাছে ওকে মনে হচ্ছে,
দেখা
যাচ্ছে সেটাই পরিচালক
সাহেব কাট করে আবার নতুন করে
টেক করছেন । টানা রাত সাড়ে
১১টা পর্যন্ত
সূটিং
চলে প্যাক আপ করা হলো । আমার
অবস্থা ততোখনে কাহিল । এতো
দীর্ঘ সময় প্রতিক্ষা
আমাকে আর কখন ও করতে হয়নি ।
কয়েকবার মনে হয়েছিল চলে যাবার
কথা । কিন্তু
নিজের স্বপ্ন ,
নিজের
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে
চলে যেতে পারিনি । আর তাছাড়া
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম
মানুষটা ব্যস্ত । নিজেকে এই
বলে শান্তনা দিয়ে
বেধে রেখেছি যে,
“কস্ট
না করলে,
কেস্ট
মেলে না ।”
প্রায়
পৌনে ১২টার সময় আমার ডাক পরলো
। পুরো সেট তখন প্রায় খালি হয়ে
গেছে । কয়েকজন
সেট থেকে এটা সেটা খুলে ব্যাগে
ঢুকাচ্ছে । এহতে সামস সাহেব
বেশ রাশ গম্ভীর
মানুষ । অপরিচিত জনের সঙ্গে
খুব একটা কথা বলেন না । পুরো
সূটিং চলাকালীন সময়
আমি তাকে একবারের জন্যও হাসতে
দেখিনি । আমাকে নিয়ে তিনি
বসলেন পরিচালকদের
রুমে । ওনার হাতে ছোট একটা
গ্লাস । আমি রুমে ঢুকে আবারও
সালাম দিতে উনি
,
মাথা
নেড়ে বসতে বললেন । তারপর গ্লাসে
আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে
বললেন –
কতো
দিন ধরে লেখালেখি করছো ?
জ্বী,ছোটবেলা
থেকেই ।
ছোটবেলা
থেকে ?
তিনি
ঠোট উল্টে তাচ্ছিল্যের একটা
ভঙ্গি করে আমার কথাটা রিপিট
করলেন
।
তা
দু’একটা
নাটক টাটক কি টিভিতে গিয়েছে
?
জ্বি
না ,
আমি
টিভির জন্য কোন নাটক লিখিনি
।
টিভিতে
না লিখে একেবারে চলচিত্রে ?
ছোট
থেকে না শুরু করতে হয় ।
বলে
তিনি আবারও গ্লাসে
চুমুক দিলেন ।
আমি
কিছু বললাম না । আমি মনে মনে
বললাম,
আমি
বড় থেকে ছোটর দিকে যাবো বলে
ঠিক
করেছি
। সুযোগ পেলেই মানুষ উপদেশ
ঝারতে শুরু করে । তার উপড়ে
হাতে যদি রঙ্গিন পানির
গ্লেলাস থাকে তা হলে তো আর
কথাই নেই । আমাকে
চুপ করে থাকতে দেখে তিনি গ্লাসে
আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন ,দেখি
কি এনেছো আমার
জন্য ?
বলে
তিনি হাত বাড়ালেন । আমি ব্যাগ
থেকে চিত্রনাট্যটা বের করে
হাতে
দিলাম
।
গ্লাসটা
টেবিলে রেখে তিনি চিত্রনাট্যটার
একটা একটা করে পাতা উল্টাতে
লাগলেন – আমার
বুক তখন ধুকধুক করছে । আমি মনে
মনে আল্লাহ,
আল্লাহ
করছি এই জন্য যে,
এবার যেন
আমাকে আর প্রত্যাক্ষিত হতে
না হয় । এবার যেন খুশি মনে ফিরতে
পারি । এ লাইনের
নিয়মই হচ্ছে একবার যদি কোন
পরিচালক একটা লেখা নিয়ে কাজ
শুরু করেন তা হলে
আর বসে থাকতে হয় না। একেরপর
এক কাজ আসতেই থাকে । যতো সময়
যাচ্ছিল তোতোই উত্তেজনার
আমার হাত পা কাঁপতে লাগল । আমি
কোন রকম বসে রইলাম । তিনি খুব
মনোযোগ দিয়ে
একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে
যাচ্ছেন । আর আমার অস্থিরতা
বেড়ে যাচ্ছে । অধীর
আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। আমি যেন
আমার সাফল্যের হাতছানি দেখতে
পাচ্ছি।
একসময়
তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
বললেন –
এটা তুমি লিখেছো ?
জ্বি
?
আমি
ছোট করে উত্তর দিলাম ।
তোমার
লেখাটা এক কথায় চমৎকার প্রচুর
কাজ করেছো বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু
এ লেখা নিয়ে তো
আমি কাজ করতে পারবো না । তোমার
এ গল্পটা হলিউডে হলে লুফে নিত
। কিন্তু আমাদের
দেশের পারিপাশ্বিক অবস্থার
জন্য এ গল্প চলবে না । আমি
দু:খিত
। তুমি অন্য একটা
গল্প নিয়ে আস ।
আমার
মন ভেঙ্গে গেল । আমি কিছু বললাম
না । উঠে দাঁড়ালাম ।
আমাকে
উঠতে দেখে তিনি বললেন “তোমার
হাতের টার্ন ভাল ,
আমি
তোমাকে একটা থিম দিচ্ছি
তুমি এটা নিয়ে কাজ করো ।”
সরি
স্যার,
আমি
শুধু নিজের থিম নিয়েই স্টরি
তৈরি করি । আমি ওনার হাত থেকে চিত্রনাট্যটা
নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে
এলাম । সঙ্গে সঙ্গে একঝাক
হতাশা আমায় ঝেকে
ধরলো । মনে হলো এ জীবনের কোন
মানে হয় না । এ জীবনের জন্য
শুধু ব্যর্থতা পর ব্যর্থতাই
অপেক্ষা করছে ।
অনেক
রাত হয়ে গেছে । পথ ঘাট একেবারে
জন শুন্য । কিভাবে মেসে পৌছাব
আমার সে চিন্তা
নেই । এফডিসি থেকে বের হয়ে
হাঁটতে লাগলাম । কয়েক কদম
হেঁটে মাছের আড়ৎটার
সামনে আসতেই একটা লোককে দেখতে
পেলাম । একটা খুটির সঙ্গে
হেলাম দিয়ে একপায়ে
দাঁড়িয়ে আছে
। পুরানো
কালো একটা কোট গায়ে দিয়ে আছে
। পা’দুটো
খালি । মাথাটা
কেমন অস্বাভিক রকমের বড় ।
লোকটাকে দেখে আমার পাগল বলে
মনে হলো । আমি না
দেখার ভান করে সামনে দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছিলাম । লোকটার
সামনে যেতেই লোকটা গলা
খাকারি দিল । আমি ফিরে তাকালাম
–
লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল,
তারপর
আমার দিকে
এগিয়ে এসে কোন রকম জড়তা ছাড়াই
বলল –
কি কিছু হলো ?
আমি
বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে
তাকালাম । লোকটা আবারও বলল,
কিছুই
হয়নি তাই না?
কি
হয়নি ?
আমি
চরম বিরক্তি নিয়ে পাল্টা
প্রশ্ন করলাম ।
তোর
চিত্রনাট্য তো ঐ বুড়ো ভামটা
নেয়নি,
তাই
না ?
আমি
বেশ অবাক হয়ে লোকটার দিকে
তাকালাম । এহতে সামস্ এর সঙ্গে
আমার কি কথা হয়েছে
তা তো এই পথের লোকটার জানার
কথা নয় । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞিস
করলাম,
কে আপনি
?
আমি
কে ?
সেটা
বড় কথা না ,
আমার
কথা সত্য কিনা সেটা বল ।
আমি
অনিচ্ছা সত্বেও মাথা নাড়লাম
। যার অর্থ হলো ,
হ্যা
,
তিনি
আমার লেখাটি নেননি ।
ঐ
বুড়ো ভামটা যে নিবে না তা আমি
আগেই জানতাম । বলে লোকটা খেক
খেক করে হেসে উঠলো।
হাসির শব্দে আমি কেমন জানি
ভয় পেয়ে গেলাম । মাছের আশটে
গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে
এসে লাগল ।
দু’পা
পিছিয়ে এসে প্রশ্ন করলাম আপনি
কে ,
কি
করে এসব জানলেন ?
বললাম
না ,
আমি
কে সেটা বড় ব্যাপার না । আমি
সব জানি । তোর অতীত জানি,
তোর বর্তমান
জানি;
আবারও
তোর ভবিষ্যতও জানি । লোকটা
আবারও ভয়াল ভাবে হাসতে লাগল ।
এবার
আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম
। কোন এক অজানা ভয়ে ভেতরটা
কেপে কেঁপে উঠল
। আমি কোনরকম তোতলাতে তোতলাতে
বললাম,
কি
চাই আপনার,
কি
চাই?
তোর
সঙ্গে সওদা করতে করতে চাই ?
লোকটা
হাসি থামিয়ে সরাসরি আমার চোখের
দিকে
তাকিয়ে
বলল । ভয়ন্কর হলুদ দু’টো
চোখের দিকে তাকিয়ে আমার পুরো
শরীর কাপতে লাগল ।
হঠাৎ
আমার মনে হলো আমার বমি পেয়েছে
। বমি করতে পারলে ভাল হতো ।
আমি আবারও
তোতলাতে
তোতলাতে বললাম,
কিসের
সওদা ?
তোর
খ্যাতি,
যশ্,
প্রতিস্ঠা
তোর সকল স্বপ্ন পুরণের সওদা
।
মানে
?
মানে
সোজা ,তুই
উঠে যাবি খ্যাতির চুড়ান্তে
যেখান থেকে সব কিছু অতি তুচ্ছ
বলে মনে হয়।
যেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে
হয় না । করবি এমন সওদা ?
আমি
তোকে সব সব
দেবো । লোকটা আমার মুখের কাছে
এসে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল
। বিশ্রী মাছের আশটে
গন্ধটার জন্য আমি আবারও পিছিয়ে
গেলাম । টের পেলাম তীব্র ভয়ে
আবার হাত পা থরথর
করে কাঁপছে । ভয়ন্কর কিছুর
শন্কায় আমি ছুটে পালাতে চাইলাম
। লোকটা মনে হয় আমার
মনোভাব বুঝতে পেরে খপকরে আমার
বাম হাতের কব্জির উপড়ে চেপে
ধরল । আমি তীব্র
ব্যর্থায় উহু করে শব্দ করে
উঠলাম । লোকটা হাসতে হাসতে
বলল ,
রাজি
আছিস ?
রাজি
আছিস ?
তুই
মনে মনে যেমনটা চেয়েছিস ঠিক
তেমনটাই হবে,তরতর
করে উঠে যাবি
খ্যাতির
চুড়ায় । এসব বুড়ো ভামরা লাইন
দিয়ে পরে থাকবে তোর লেখার
জন্যে ,
বল
রাজি
আছিস
কিনা । বলে ফেল,
বলে
ফেল ।
আমি
কয়কে মিনিটের মধ্যে যেন আমার
ভবিষ্যত দেখে ফেললাম । সকল
ভয়কে উপেক্ষা করে
বললাম
,
তাতে
আপনার কি লাভ ?
আমার
কি লাভ ?
বলে
লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল
। তাতে আমার পুরো শরীর আবারও
কাঁটা
দিয়ে উঠল ।
আমি
ভয়ে ভয়ে বললাম,
দেবার
মতো তো আমার কিছু নেই ।
তোর
সব আছে,
আমার
প্রয়োজনে আমি চেয়ে নেবে । তোর
প্রয়োজনে তুই চেয়ে নিবি । আছিস
রাজি
?
বলে
ফেল ,
বলে
ফেল ।
আমি
মনে মনে চিন্তা করলাম । হারাবার
মতো আমার কিছুই নেই । আবার
দেবার মতোও
নেই
কিছু । তা হলে লোকটা কি চাচ্ছে
?
ঠিক
তখনি আমার ভেতর থেকে কেউ একজন
বলে উঠল রাজি;
আমি
রাজি
। তোর
তো আপন কেউ
নেই,
তাই
হারাবারও কিছু নেই ।
তুই
তাহলে রাজি ?
লোকটা
আমার দিকে অদ্ভূত ঘোর লাগা
চোখে তাকাল ।
আমি
মাথা নেড়ে বললাম,
রাজি
। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আমার হাত
ছেড়ে দিল আমার কাছে
মনে
হলো পুরো হাতটা অবশ হয়ে গেছে
। আমি হাতটা ঝারতে ঝারতে লোকটার
চোখের দিকে
তাকালাম
। মনে হলো,
আমার
পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো । সঙ্গে
সঙ্গে আমি বর্মি করে
ফেললাম
। অনেকক্ষন বর্মি করার পর একটু
আরাম হলো । আমি লোকটার দিকে
তাকাতেই
দেখি
কেউ নেই। কালো খুঁটিটা যেন
আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে ।
আমি মাতালের মতো
টলতে
টলতে মেসের দিকে পা বাড়ালাম
।
*তিন*
মধুমিতা
মেসের সামনে ভীড়টা চোখে পরার
মতো । মূল রাস্তায় দু’টো
পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখলাম । অনেকক্ষন
হাঁটার ফলে প্রচন্ড ক্লান্তি
অনুভব করছি । মনে হচ্ছে
গোসল করতে পারলে ফ্রেস লাগত
। কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে
এতো লোকজন কি করছে
বুঝতে পারলাম না । কৌতুহল নিয়ে
মেসের ভেতরে ঢোকার জন্য পা
বাড়াতেই গেটের কাছে
একজন এসআই আমার পথ রোধ করে
দাঁড়াল । আমাকে আপাত মস্তক
এক নজর দেখে নিয়ে প্রশ্ন
করল,
“কে
আপনি ?”
জ্বি,
আমার
নাম রন্জু । এখানেই থাকি ।
এতো
রাতে কোথা থেকে এলেন ?
জ্বি
কাজ ছিল একটা ।
কি
কাজ ?
এফডিসিতে
একজনের সঙ্গে দেখা করতে
গিয়েছিলাম ।
করেন
কি ?
লেখালেখি
করি ?
গল্প,
উপন্যাস
,
চিত্রনাট্য
লিখি ।
ও
বই লিখেন ?
লোকটা
কি বুঝে প্রশ্ন করল বুঝলাম
না,
মাথা
নেড়ে বললাম,
হ্যা
।
তা,
কতো
দিন ধরে এখানে আছেন ?
বছর
তিনেক হলো ।
কাউন্টারের
কাছে ম্যানেজার বদরুলকে
দেখলাম,
দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে কাঁদছে । এতো বড় একজন
মানুষের
কান্না দেখতে ভাল লাগেনা ।
তার উপরে বদরুলকে তো আরো না
। আমাকে দেখে
বদরুল
রন্জু ভাই বলে ছুটে এসে জরিয়ে
ধরল ।
বদরুল
লোকটাকে আমার বিশেষ পছন্দ না
। আমি পারত পক্ষে ওর সঙ্গে কথা
বলি না ।
বদরুলও
আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে । সেই
বদরুলের এভাবে আমাকে জড়িয়ে
ধরায় আমি
অবাক
না হয়ে পারলাম না । মানুষের
আবেক কে কখনও উপেক্ষা করতে
নেই । হোক না সে
যেমনই
মানুষ । কিন্তু বদরুলের
ব্যাপারটা ভিন্ন । আমি বদরুলকে
ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম
অথচ
শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম;“কি
হয়েছে বদরুল ?
”
সদু
ভাই ;
বলে
বদরুল আবারও কাঁদতে লাগল ।
আমার কাছে মনে হলো বদরুল অভিনয়
করছে ।
আমি
দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা
করলাম,
সদু
ভাই কি ?
সদু
ভাই আর নেই ।
নেই
মানে কি?
কোথায়
গেছেন ?
ভনিতা
না করে আসল কথা বলো । আমি আস্থির
হয়ে উঠলাম ।
সদু
ভাই,
সদু
ভাই আত্মহত্যা করেছেন । বলে
বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে
লাগলো।
এবার
আর ওর কান্নাটাকে অভিনয় বলে
মনে হলো না ।
আমি
প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“কোথায়,
কেন
?”
উপড়ে
বলে,
বদরুল
আঙুল দিয়ে দোতালাটা দেখিয়ে
দিল।
দোতালার
শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটা
রুম আছে । সদু সেটাকে অফিস
হিসাবেই ব্যবহার
করেন
। পাশে একটা বিছানা পাতা আছে
মাঝে মাঝে রাতে থেকে গেলে
সেটাতে সদু ভাই
ঘুমান
।
আমি
এসআইয়ের দিকে উপড়ে যাবার
অনুমতি পাবার দৃস্টিতে তাকালাম
। এসআই আমার কাঁধে
হাত
রেখে বললেন,
যান।
তবে কিছু স্পর্শ করবেন না ।
এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।
ঠিক
আছে,
বলে
দ্রুত উপড়ে উঠে এলাম । বারান্দায়
চেনা অচেনা অনেক মানুষ । কয়েকজন
পুলিশ
ও রয়েছে । আমার রুমটা মাঝামাঝি
। আমার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার
সময়
দেখলাম
তালা দেয়া ।
যারা
আমাকে চেনে তারা আমাকে দেখে
সরে গিয়ে ভেতরে যারার রাস্তা
করে দিল । সদু
ভাইয়ের
রুমে ঢুকতেই আমি ভয়ন্কর রকমের
ভয় পেয়ে গেলাম,
ফ্যানের
সঙ্গে বিশ্রী ভাবে
সদু
ভাইয়ের দেহটা ঝুলছে । জ্বিবটা
মুখ থেকে বের হয়ে আছে । চোখ
দু’টো
খোলা ।
বিশাল
দুটো হাত দুপাশে ছড়ান । পুরো
শরীরে কোন কাপড় নেই । আমি
প্রচন্ড ভয় পেয়ে
গেলাম
। হঠাৎ টের পেলাম আমার মাথা
ঘুরছে। আমি কোন রকম বারান্দায়
এসে দাঁড়ালাম।
থানা
থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল
রিপোট তৈরি করে পোস্টমটেমের
জন্য লাশ
নামিয়ে
নিয়ে যাওয়া হলো । পুলিশ মেসের
বোর্ডারদের থানাতে না জানিয়ে
কোথাও না
যাবার
নির্দেশ দিয়ে চলে গেল । ঘড়িতে
তখন সাড়ে তিনটা বাজে। ইতিমধ্যে
আমি একটু
ধাতস্ত
হতে পেরেছি । সদু ভাই নেই ।
কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতটা
কেমন জানি করে
উঠছে।
বারবার সদু ভাইয়েই মুখটা চোখের
সামনে ভেসে উঠছে ।
রুমে
ঢুকে দেখি টেবিলের উপড় আমার
খাবার ঢেকে রাখা । তারমানে
হচ্ছে –
সদু ভাইয়ের কাছ
থেকে চাবি নিয়ে আমার খাবারটা
রুমে দিয়ে গেছে । আহা:
সদু
ভাই,
আমি
হঠাৎ কান্নায়
ভেঙ্গে পরলাম । বুক চেপে ধরে
খাটের উপড় বসে পরলাম। হঠাৎ
এফডিসির বাইরে দেখা
লোকটার কথাটা কানে ভাসতে লাগল,
তোর
তো আপন কেউ নেই ,
তাই
হারাবারও কিছু নেই
। তুই তাহলে রাজি ?
তুই
তাহলে রাজি ?
আমার
মনে হলো সদু ভাই আমার আত্মীয়
না হয়েও
অনেক বেশি আপন ছিল । অনেক,
অনেক
বেশি ।
পরের
দিন সাড়ে ১২টার সময় দরজার
প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো ।
তারাহুরো করে উঠে দরজা খুলে
দেখলাম বদরুল দাঁড়িয় আছে ওর
পাশেই পরিচালক এহতে সামস্ ।
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম
। আমার মেসে এহতে সামস্ এর মতো
পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি
।
আমি একটু
ঘাবরে গিয়ে বললাম –
স্যার আপনি ?
দেখ,
দেখি
তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম;
তা
তুমি কি ফ্রি আছো ?
তাহলে
তোমার সঙ্গে
কয়েকটা কথা বলে নিতাম ।
জ্বি
স্যার,
আসুন
ভেতরে আসুন । বলে আমি দরজা
থেকে সড়ে দাঁড়ালাম । এই প্রথম
রুমের ভেতরের
অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা
লাগল । এহতে সামস্ চারিদিকে
একবার নজর বুলিয়ে
টেবিল থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে
বসে পরলেন । আমি বললাম,
স্যার
যদি কিছু মনে
না করেন ;
আমি
হাত মুখটা ধুয়ে আসি । তিনি
মাথা নেড়ে বললেন,
সিওর
। তারপর এগিক
ওগিক তাকিয়ে বললেন,
তোমার
এখানে এসট্টে নেই ?
সিগারেট
ছাড়া আমি আবার একদম
চলতে পারি না। আমি খাটের নীচ
থেকে একটা ভাঙা চায়ের কাপ
অনিচ্ছা সত্বেও বের
করে টেবিলের উপর রাখলাম । এহতে
সামস্ কাপটা দেখে হেসে সিগারেট
ধরালেন । আমি
বদরুলকে চা বলে বার্থরুমে
ঢুকে গেলাম ।
এহতে
সামস্ সাহেব আমাকে দু’লাখ
টাকার একটা ক্যাশ চেক দিয়ে
একটা কাগজে সাইন
করিয়ে
নিলেন । আমার চিত্রনাট্যটি
নিয়ে তিনি কাজ করবেন । সূটিং
শুরু হবে মাস
দু’য়েকের
মধ্যেই । তখন আরো তিন লাখ
পেমেন্ট করবেন । জীবনের প্রথম
সাফল্যে আমি
থরথর
করে কাঁপতে লাগলাম । উত্তেজনায়
কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে
সেটাও ভাল করে
পড়তে
পারলাম না । এহতে সামস্ এর
দেখানো জায়গাতে সাইন করে চেকটা
হাতে নিলাম ।
হঠাৎ
সদু ভাইয়ের জন্য আবারও মনটা
কেদে উঠল । মানুষটা বেঁচে
থাকলে আজ সব চাইতে
বেশি
খুশি হতো । এহতে সামস্ সাহেব
বিদায় নেবার পর আমি ব্যাংকে
ছুটলাম। সদু
ভাইয়ের
আত্মার শান্তির জন্য কিছু
টাকা খরচ করবো ।
সদু
ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেসটা
যেন অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে
। দোতালার বেশ
কয়েকজন
বোর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে
মেস ছেড়ে চলে গেছে । অনেকেই
বলাবলি করছে
রাতের
বেলা তারা নাকি সদু ভাইকে
দেখেছে মেসের বারান্দা দিয়ে
খুরিয়ে খুরিয়ে
হাঁটতে
। কথাটা এ কান ওকান হয়ে আমার
কানে এসে পৌছলে আমি সেটাকে
মোটেও গুরুত্ব দেলাম
না । বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে
বুক ফুলিয়ে হাঁটতে দেখেছি,
মরে
গিয়ে সে কিনা
খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটবে ?
সব
চাইতে বেশি কথা ছড়াচ্ছে কাজের
বুয়া রেহানার মা । বুয়াটা
রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছে ।
সদু ভাইকে বুয়া নাকি রান্না
ঘরে দেখেছে । সকাল বেলা
বুয়া থালা বাসন ধুচ্ছিল,
তখন
হঠাৎ রান্না ঘরে খটর মটর শব্দ
শুনে বুয়া রান্না ঘরের
দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে,
সদু
ভাই খালি গায়ে চুলার কাছে কি
যেন খুঁছছে । বুয়া দরজার
কাছেযেতেই,
সদু
ভাই নাকি বলে উঠেছে,
ও
রেহানার মা ম্যাচটা কোথায়
রেখেছো ?
ম্যাচটা
দাও,
সিগারেট
খামু ।
বুয়ার
এ গল্পটাই সব চাইতে বেশি ছড়িয়ে
পরেছে । আশে পাশের দশ বাড়িতেও
এ নিয়ে
বিস্তর
আলোচনা চলছে । আমি এসব কথাবার্তাকে
মোটেও গুরুত্ব দেচ্ছি না।
কারো সঙ্গে এ
প্রসঙ্গে
আলোচনা ও করছি না । বার দুয়েক
বদরুল এসেছিল আমার সঙ্গে এ
বিষয়ে কথা
বলবে
। এর কথার শুরুতেই আমি ওকে
থামিয়ে দিয়ে বলেছি,
বদরুল
বাজে বিষয় নিয়ে কথা
বলে
আমার সময় নস্ট করবে না,
যাও
নিজের কাজ করো গিয়ে । বদরুল
আর কিছু বলেনি
মাথা
নীচু করে চলে গেছে । যতোসব
বাকোয়াস কথাবার্তা । আমি পূর্ণ
উদ্যোমে লেখা
লেখি
চালিয়ে যাচ্ছি । ইতিমধ্যে
একটি পত্রিকায় আমার ছোটখাটো
ইন্টারভিউও ছাপা
হয়েছে
। অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে
বিদ্যূতের গতিতে নতুন চিত্রনাট্য
লিখে চলেছি ।
পরপর
দু’টো
ফিকুয়েন্সের কাজও শেষ করে
ফেলেছি । ঝামেলা বাঁধল তৃতীয়টার
সময় । সদু
ভাইকে
মেসে দেখার ঘটনাগুলো আমি
গুরুত্ব না দিলেও আমার অজান্তেই
মেসের ভেতর একটা
কিছু
ঘটে যাচ্ছিল তার প্রমান পেলাম
আরো দু’দিন
পর । আমার পাশের রুমে থাকেন
ব্যাংক
কর্মকতা ওমর ফারুক সাহেব ।
সাদাসিদে অমায়িক লোক । কারো
আগে পিছে নেই ।
তিনি
কিনা রাতের বেলায় কি দেখে ভয়
পেয়ে হার্ট এ্যটাক করে হাসপাতালে
ভর্তি
হলেন
। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব
একটা কতাবার্তা না হলেও আমি
তাকে হাসপাতালে
দেখতে
গেলাম ।
ইদানিং
বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর
চেহারা বদলে গেছে । ঝকঝকে
তকতকে
হাসপাতাল
দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। ওমর
ফারুক সাহেব আছেন হাসপাতালের
দোতালার
একটি
কেবিনে । আমি তার কাছে পৌছে
দেখি তিনি আঙুর খাচ্ছেন । দশ
কি বারো বছরের
একটি
মেয়ে তার মুখে একটা একটা করে
আঙুর তুলে দিচ্ছে । আমাকে দেখে
ওমর ফুরুক সাহেব
একটু
লজ্জা পেলেও হেসে বললেন,
আসেন
লেখক সাহেব । আমি ভেতরে ঢুকে
হেসে জিজ্ঞেস
করলাম,
তা
এখন কেমন আছেন ?
জ্বি
ভাল । ওমর ফারুক সাহেবকে দেখে
মনে হলো তিনি আবারও লজ্জা
পেলেন ।
ও
কি আপনার মেয়ে নাকি ?
আমি
মেয়েটার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা
করলাম ।
জ্বি
। দেখুনতো কতো করে বলছি হাসপাতালে
ছোটদের আসার দরকার নেই,
কিন্তু
তবুও
নাছোড়বান্দা
আমাকে দেখতে নাকি আসতেই হবে
। মেয়েটার গায়ের রং শ্যামলা
কিন্তু
অনেক
মিস্টি । আমি মেয়েটাকে কাছে
টেনে জিজ্ঞাসা করলাম,
তোমার
নাম কি মা ?
মেয়েটা
ছোট করে বললো,
মায়া
।
বাঃ
সুন্দর নাম ।
তা,
তুমি
কোন ক্লাসে পড় ?
ক্লাস
থ্রি তে ।
আমিও
তো থ্রি তে পড়ি । যাক তুমি আর
আমি একই ক্লাসে পড়ি । আমি হেসে
বললাম ।
তুমি
মিথ্যা বলছো । তুমি তো বড় ।
তুমি আব্বুর লেখক বন্ধু ।
আব্বুর সঙ্গে থাকো । আমি সব
জানি
।
ওমা
তাই নাকি ?
তুমিতো
দেখছি তোমার আব্বুর বুড়ি মা
।
আমি
বুড়ি না আমার বয়স তো মাত্র
এগারো বছর । এমন সময় ওমর ফারুক
সাহেবের স্ত্রী
আসলেন
। তিনি মেয়েকে নিয়ে বাহীরে
গেলে ওমর ফারুক সাহেব আমাকে
বললেন,
ভাই
আমি
আর ঐ মেসে যাবো না । একটু সুস্থ্য
হলে জিনিষ পত্র সব নিয়ে আসবো
।
কিন্তু
কেন ?
মেসটার
দোষ হয়েছে । ওখানে খারাপ আত্মা
বাসা বেঁধেছে । আমি বলতে
যাচ্ছিলাম এসব
বাজে
কথা। কিন্তু কিছু বলার আগেই
ওমর ফারুক সাহেব বলে উঠলেন,
আমি
জানি আপনি এসব
বিশ্বাস
করেন না । তবুও বলছি,
সম্ভব
হলে আপনিও মেসটা ছেড়ে দিন ।
আপনি
ভয় পেলেন কি দেখে ?
আমি
সরাসরি ওমর ফারুক সাহেবের
চোখের দিকে তাকিয়ে
প্রশ্ন
করলাম ।
ওমর
ফারুক সাহেব একটু স র্সত নিয়ে
বললেন,
সদু
ভাইকে দেখে ।
সদু
ভাইকে ?
জ্বি
।
তা
কি দেখলেন ?
বার্থরুমে
যাবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায়
বের হয়েছ দেখি সদু ভাইয়ের
রুমের দরজা
খোলা
। আলো জ্বলছে । এতোরাতে সদুভাইয়ের
রুমে কে,
কি
করছে তা দেখার জন্য আমি
এগিয়ে
গেলাম । দরজার দাঁড়িয়ে ভেতরে
উকি দিতেই দেখি;
সদু
ভাই হাতে একটা মোটা
দড়ি
নিয়ে ফ্যানের নিচে একটা চেয়ারে
দাঁড়িয়ে আছেন । দড়িটা ফ্যানে
বাঁধার চেস্টা
করছেন।
আমি,
কে
?
বলার
সঙ্গে সঙ্গে সদু ভাই আমার দিকে
তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“ও
ব্যান্কার
ভাই চেয়ারটা একটু শক্ত করে
ধরো তো দেখি । মনে হচ্ছে পইড়া
যামু ।”
আমার
আর
কিছু মনে নেই । সঙ্গে সঙ্গে
বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব
করি । তারপর বুক চেপে ধরে
পরে
গেলাম। চোখ খুলে দেখি আমি
হাসপাতালে ।
ওমর
ফারুক সাহেবের কথা ফেলে দিতে
পারলাম না । একেবারে মনের
মধ্যে গেঁথে গেল ।
ভয়
হচ্ছে সংকামক ব্যধির মতো একবার
কারো ভেতর ঢুকে গেলে ডাল পালা
ছড়ায় অন্যের
ভেতরে
ঢোকার জন্য । নানান যুক্তি
দিয়েও এর কোন কূল কিনারা করতে
পারলাম না ।
একরাশ
চিন্তা নিয়ে এলোমেলো ভাবে
হাঁটতে হাঁটতে মেসে ফিরলাম
রাত ১১টার সময় ।