কয়েকজন ইনবক্সে প্রশ্ন করেছিলেন— পবিত্র কাবা, মসজিদে নববী অথবা মসজিদে আকসার ছবি বিশিষ্ট জায়নামাজে নামাজ আদায় করাতে কোনো সমস্যা আছে কিনা?
একটা ফেসবুক গ্রুপ, যাতে ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি হয় বেশি, তাতে আজ দেখলাম— এরকম জায়নামাজে নামাজ আদায় করা নাকি হারাম। কেউ যদি তাতে আদায় করে ফেলে তার জন্য নামাজ নবায়ন জরুরি। আর এমন অপরাধের ফলে সে গুনাহগার হবে। আসলে কি তাই?
প্রথম এবং মূল কথা হলো, যেকোনো পবিত্র জায়গায় নামাজ আদায় করলে নামাজ আদায় হয়ে যায়; চাই তা জায়নামাজ বিছিয়ে পড়ুক বা অন্য যেখানেই হোক। তবে প্রাসঙ্গিক কারণ যুক্ত হলে অনেক সময় হুকুম বদলে যায়।
জায়নামাজে নামাজ পড়া বিষয়ে আলোচনা এখানে মূখ্য। জায়নামাজ যদি পবিত্র হয়, তাহলে তাতে নামাজ আদায় করাতে কোনো বাঁধা নেই। পড়ে নিলে আদায় হয়ে যাবে।
তাহলে কারুকার্য বিষয়ক জায়নামাজে নামাজ আদায়ের বিধান কী?
জায়নামাজে যদি কোনো প্রাণীর কারুকার্য না থেকে জড়পদার্থের নকশা থাকে, চাই তা পবিত্র কাবা, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা অথবা অন্য যেকোনো জড়পদার্থ হোক— নামাজ আদায় হয়ে যাবে৷ তবু এমন কারুকার্য বিশিষ্ট জায়নামাজ ব্যবহার না করাই ভালো। তার কারণ, এতে নামাজে মনোযোগের ব্যঘাত ঘটে৷ মন কারুকার্যের সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরাফেরার সম্ভাবনা রাখে। যদি সত্যিকার্থে মনোযোগ নষ্ট হয়, তাহলে নামাজ মাকরূহ হয়ে যাবে।
আর যদি তেমন কিছু না হয়, তাহলে অসুবিধা নেই। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি— কোনোটারই অবকাশ নেই।
আশঙ্কামুক্ত থাকার জন্য পবিত্র কা'বা, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসার ছবি সম্বলিত জায়নামাজ ছেড়ে স্বাভাবিক জায়নামাজ ব্যবহার করাই উত্তম।
ফেসবুক গ্রুপে যিনি হারাম বলেছেন, তিনি দলিল হিসাবে বলেন—
পবিত্র কা’বা, মসজিদে নববী এবং বাইতুল মুকাদ্দাস হচ্ছে, মহান আল্লাহ পাকের শেয়ার বা নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রত্যেকের জন্যই ফরজ এবং অশেষ কল্যাণের কারণও বটে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
ذٰلِکَ ٭ وَ مَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ اللّٰهِ فَاِنَّهَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ ﴿۳۲﴾
অর্থ: "এটাই হল আল্লাহর বিধান; আর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে, সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।" [১]
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণ হলো যে, মহান মহান আল্লাহ পাকের নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সকলের জন্যই ফরজ। আর সেগুলোর অবমাননা করা সম্পূর্ণই হারাম ও নাজায়িজ। এ হিসাবে এগুলোর ছবি বিশিষ্ট জায়নামাজ ব্যবহারও হারাম।
এ হলো তার দাবি ও দলিল। মজার বিষয় হলো, সে আয়াতের কারিমার পূর্ণ তাফসির বুঝেনি। তাফসির বুঝার জন্য যে সুন্নাহ তথা নবীজি ও খোলাফায়ে রাশিদিনের আমল দেখতে হয়, সেটা তার অজ্ঞ মস্তিষ্কে কাজ করেনি।
সুন্নাহ কী বলে আসুন জেনে আসি— নবীজির জীবনী/সীরাতের কিতাবগুলোতে উল্লেখ আছে, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে আজান দিতে আদেশ করেছিলেন। তখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু সরাসরি কা'বার ছাদে উঠে আজান দিয়েছেন। অন্য কোথাও দাঁড়াননি।
এরকমভাবে নববী ও সাহাবী যুগে সরাসরি বাইতুল্লাহর ছাদে উঠেই আজান দিতো, কেউ সমস্যা মনে করতো না। তাছাড়া বায়তুল্লাহ শরীফের ভিতরে নামাজ পড়া বৈধ, এ ব্যপারে ইজমা হয়ে গেছে। তাহলে সামান্য ছবিতে কেন মাকরূহে তাহরিমি বা হারাম হবে! বরং জায়নামাজে ছবি থেকে মনোযোগ নষ্ট করলেই তবে মাকরূহ। তার দলিল—
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা একটি কারুকার্য খচিত চাদর গায়ে দিয়ে নামাজ আদায় করলেন। আর নামাজে সে চাদরের কারুকার্যের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পরলো। নামাজ শেষে তিনি বললেন, এ চাদরখানা আবু জাহমের নিকট নিয়ে যাও, আর তার কাছ হতে আমবিজানিয়্যাহ (কারুকার্য ছাড়া মোটা চাদর) নিয়ে আস। এটা তো আমাকে নামাজ থেকে অমনোযোগী করে দিচ্ছিল। [২]
সুতরাং বুঝা গেলো, নামাজে অমনোযোগী করে, এমন যা কিছু পাওয়া যাবে, সবই মাকরূহ।
আর একটা কথা, আমরা কা'বার পূজা করি না, যেমনভাবে হিন্দু বা মুশরিকরা মূর্তিপূজা করে। তারা মূর্তিপূজা যখন করে, তখন তাকে খোদা মনে করেই করে এবং এর উপর উঠাকে মনে করে পাপ। পরে ফেলে দেওয়ার সময় কী করে, তা ভিন্ন হিসাব।
কা'বাকে সামনে রেখে আমরা আজীবন ইবাদত করি এবং করবো। তার জন্য কা'বা একটা দিক মাত্র। মুসলমানদের ঐক্য ধরে রাখা এবং নামাজের জন্য নির্দিষ্ট একটা দিক নির্ধারণের জন্যই কা'বা। নয়তো মানুষজন বিভিন্ন দিকে নামাজ পড়তো, আর এর উপর ভিত্তি করে ইসলামকে যে যার যার মতো করে বানিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল। এমন যাতে না হয়, তার জন্য নির্দিষ্ট একটি দিক, যা পৃথিবীর একেবারে মাঝখানে, তাকে নির্ধারণ করা হয়।
কা'বাকে সম্মুখে রেখে সেজদার মানে কাবাকে সেজদা করা না, আমরা বরং আল্লাহকে সেজদা করি। কা'বা শুধুমাত্র একটা দিক নির্ণয়। কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটিও তাই প্রমাণ বহন করে—
، فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ المَسْجِدِ الحَرَامِ
অর্থ: "সুতরাং আপনি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করুন। [৩]
এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেলো কা'বাকে দিক নির্ণয়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কা'বা এখানে পূজনীয় নয়।
কা'বা যে পূজনীয় নয়, তার আরেকটি উদাহরণ হলো, একবার হজরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাওয়াফ করার সময় হাজরে আসওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং একথা বললেন, আমি জানি অবশ্যই তুমি একটা পাথর, যে ক্ষতিও করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আমি যদি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। [৪]
সুতরাং বুঝা গেলো, আমরা কা'বা এবং মক্কায় অবস্থিত আল্লাহর অন্যান্য নিদর্শনাবলিকে সম্মান করি একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মান করতেন বলে।
একটা সময় বায়তুল্লাহ শরীফে উঠে আজান দিতো, এ দলিল দাঁড় করিয়ে আবার বায়তুল্লাহকে একেবারে স্বাভাবিক ও তুচ্ছ বানিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ, আল্লাহ তা'য়ালা এটাকে নিজের ঘর বলেছেন। তার আদব রক্ষা করতে হবে। আদব রক্ষার নামে আবার অতিরিক্ত বাড়াবাড়িও ঠিক না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যেভাবে যার সম্মান দিয়েছেন, আমাদের সেভাবেই তাকে সম্মান করতে হবে। আমাদের চেয়ে তারা ইসলামকে ভালো বুঝতেন। বরং বলা ভালো, ইসলামের মূল উৎসই তারা।
সুতরাং জায়নামাজে পবিত্র কা'বার ছবি থাকলে নামাজ হবে না, এটা হারাম— এমন কথা ঠিক না। হারাম এবং মাকরূহ তখনই হবে, যখন এর সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয় এসে যুক্ত হবে। তবে তাকওয়ার দাবি হলো, আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, এমন সব কিছু এড়িয়ে চলা।
আল্লাহ ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন৷ আমিন।
_______________
[১] সূরা হজ্ব, আয়াত: ৩২
[২] সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ৩৭৩
[৩] সূরা বাকারা, আয়াত:১৪৪
[৪] সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ১৫২০