প্রেম আছে বলেই নাকি পৃথিবীএতো সুন্দর। আর প্রেমের মাঝে মান অভিমান না থাকলে নাকি ভালোবাসা খাঁটি হয়না। আবার প্রকৃত প্রেমে প্রাপ্তিতে সুখ নেই বিরহে প্রকৃত সুখ বলে বিভিন্ন কবিসাহিত্যিকেরা মনে করেন। কিন্তু সেই পবিত্র প্রেমে যদি থাকে ছলছাতুরি কিংবা প্রতারণা। তবে সেই প্রেম হয়ে ওঠে যাতনার কারণ। আর এই যাতনা সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো কাজও করে বসে অনায়াসে।
অপরদিকে যাতনা সম্পর্কে কবি বলেছেন, যাতনা যাতনা কিসেরী যাতনা?/বিষাদ এতই কিসেরী তরে?/যদিই বা থাকে, যখন তখন/কি কাজ জানায়ে জগৎভরে? (পরার্থে-কামিনী রায়)। ব্যাক্তিগত দুঃখ কষ্ট যদি প্রচার করা হয়, তাতে শান্তি মেলে না, দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। বরঞ্চ দুঃখের তীব্রতা বেড়ে যায়। নিজের দুঃখবোধকে অন্তরে সংগোপনে লালন করে রাখার মধ্যেই হৃদয়ে আসে প্রশান্তির ভাব। রাত্রে আকাশে হাজার হাজার তারা যেমন স্নিদ্ধ আলোকে পৃথিবীর বুকে ঢেলে দেয় প্রশান্তি, তেমনি হৃদয়ে লুকানো বিষাদ মানুষের অন্তরকে গভীর স্বস্তিতে ভরে তোলে। মানুষের জীবনে আছে দুরন্ত আশা, আছে নিরাশার বেদনা তাকে যন্ত্রণায় দগ্ধ ও বিদ্ধ করে। এক অপার শূন্যতাবোধ জীবনকে করে তোলে অর্থহীন। কিন্তু এছাড়াও জীবনের একটি জাগ্রত অস্তিত্ব আছে, যে অস্তিত্ব মানুষের চৈতন্যে জাগায় আকাক্সক্ষা। শত বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে নতুন আশায় উজ্জ্বীবিত হয়। অপরদিকে নিজের দুঃখকে অন্যের কাছে শেয়ার করলে নাকি দুঃখটা একটু হালকা হয়। আমরা সেকালের সিনেমায় দেখতাম নায়ক দুঃখ পেলে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গান গাইতো আর নায়িকা দুঃখ পেলে খটাস করেদরজা বন্ধ করে ধপাস করে বিছানায় পরে বালিশ গুঁজে কাঁদত। আর এভাবেই দেখতাম তাদের দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে দুঃখের বহিঃপ্রকাশটা আত্মহত্যা করার মাধ্যমে জানান দিচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। কয়েকটি কাহিনীপ্রকাশ করছি। ছেলেটির নাম সুমন (ছদ্মনাম) আর মেয়েটি সুলতানা (ছদ্মনাম)।
একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি। দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে বছর তিনেক পূর্বে। তারা পরস্পর আত্মীয়ও বটে। দু’জনের প্রেম চলছিল সংগোপনে। পরে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা দু’পরিবারের মধ্যে জানাজানি হয়। দু’জনের সম্পর্ক চলাকালে ছেলেটির ছলনাময়ী প্রেমিকা শাহেদ নামের অন্য একজনের প্রেমে পড়ে। কিন্তু তা সুমনের অগোচরো। সুচতুর সুলতানা কিন্তু দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখে। সুলতানার অপর প্রেমিক শাহেদও সুলতানার নিকটআত্মীয়। ফলে শাহেদ সুলতানার বাড়িতে প্রায় আসা যাওয়া করত। শাহেদ ঘন ঘন আসা যাওয়ার ফলে সংগোপনেসুলতানার সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। যখন জানাজানি হয় সবার সন্দেহের তীর বিঁধে সুমনের দিকে। কারণ সবাই জানে সুমনের সাথে তার সম্পর্কের কথা। পরে মেয়েটিকে কে সর্বনাশ করেছে জানতে চাইলে মেয়েটিও মিথ্যাবলে। সে জানায় সুমনের সাথে তার দৈহিক সম্পর্কের কারণে সে অন্তঃসত্ত্বা। তখন শালিসানরা সবাই সুমনের সাথে মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু সত্যটা গোপন থেকে যায়। সুমন মেনে নিতে পারেনি তার ওপর এই মিথ্যা অপবাদ। কিন্তু কিভাবে সে প্রমাণ করবে সুলতানার গর্ভের সন্তান তার নয়। কিন্তু মেয়েটি যে তার সাথেপ্রতারণা করেছে প্রেমের অভিনয় করে এবং অন্যের ঔরসের সন্তান সুমনের উপর দায় দিয়ে। অপবাদ,কলংকের দায় নিয়ে সুমন ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। মধ্যেখানে শাহেদ অপরাধী হয়েও পার পেয়ে যায় শুধুমাত্র সুলতানা সত্য গোপন করার কারণে। কলংকিত মেয়েটি নিজের ভুলে দু’কূল হারিয়ে এক অজানা আশংকায় দিনাতিপাত করছে । অপর একটি কাহিনী-অত্যন্ত গরীব ঘরের মেয়ে মালতী (১৮)।
তিন বোনের মধ্যে সে মেজো। পিতা দিন মজুর। আর মা এ বাড়ি ও বাড়ি রান্নাবান্নার কাজ করে কোনো মতে সংসার চালায়। দু’টো জীর্ণশীর্ণ ছনের ঘরেরমধ্যে কোনো মতে রাত চলে যায়। কিন্তু যখন অঝোরে বৃষ্টি ঝরে কিংবা কোনো অতিথি আসলে তাদের কাউকে না কাউকে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। পার্শ্ববর্তী বাড়িতে মালতী মামাতো বোন তার স্বামী সন্তান নিয়ে থাকেন। মামাতো বোনের মেয়ে রিতা তার সমবয়সী। তাই বাড়িতে কোনো মেহমান এলে কিংবা যেকোনে দূর্যোগে মালতী থাকেন তাদের ঘরে। সেদিনও সে তার মামাতো বোনেরমেয়ের সাথে একই বিছানায় শুয়েছিল। হঠাৎ মাঝরাতে কারো হাতের স্পর্শে মালতীর ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ রগড়াতেরগড়াতে উঠে দেখে রিতার পিতা তার দুলাভাই রাম। এতরাতে কোনো বিপদ নাকি দুলাভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে রাম জরুরী কথা আছে বলে বাইরে নিয়ে যায়। জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে হিংস্র শিপাঞ্জির মতো রাম মালতীকে ঝাপটে ধরে মুখে কাপড় গুঁজেসারারাত পাশবিক অত্যাচার চালায়। এবং কাউকে এ বিষয়েকিছু না বলার জন্য বলে। পরেমেয়েটিকে আরো কয়েকবার ভয়ে দেখিয়ে শারীরিকভাবে মিলিত হতে বাধ্য করে। মেয়েটি লোকলজ্জ্বার ভয়ে কাউকে কিছু না বলে দুঃসহ স্মৃতিগুলো সংগোপনে রাখে। ফলে এক পর্যায়ে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। সে এখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অপরদিকে তারপিতার বয়সী লম্পট দুলাভাই রাম আসন্ন বিপদ দেখে পালিয়ে গেছে। মেয়েটির পরিবার এ বিষয়ে গ্রামের জনপ্রতিনিধিদের কাছে নালিশকরলে দায়ীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেননি কেউ এগিয়ে আসেননি বলেও জানা যায়। ফলে কলংকের দায় নিয়ে মেয়েটি কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা চালায়। কিন্তু অন্যদের সহায়তায় সে রক্ষা পেলেও তার সদ্যজাত সন্তানের ভবিষ্যত কি হবে? দুঃশ্চরিত্র দুলাভাইয়ের লালসার শিকার মালতীর গর্ভের সন্তান কি পরিচয়ে বড় হবে? হয়তো একদিন মেয়েটি কলংকের দায় নিয়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আত্মহত্যা করবে? কিন্তু বেঁচে যাবে ঐ সব লোক। এ সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে, বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনাবোধ।