**শবসাধকের কাল্ট – শেষ পর্ব**
রুমে ফিরে দেখি মুখতার বাজার করে ফিরে এসেছে।আজ গরুর গোশত এনেছে দু কেজি।
ইশতিয়াক থাকবে ভেবেছিল। আমাদের চা দিয়ে বাজারে গেল মুখতার। ইশতিয়াক চা খেতে
খেতেই আদিত্যর ফোন পেল। ওরা আজ রাতে বান্দরবান যাচ্ছে। আদিত্য আরেক ছন্নছাড়া।ওর
ফোন পেয়েই ব্যাগ গুছিয়ে নিল ইশতিয়াক। ভাঙতি টাকা ফেরত দিয়ে মুখতার বলল, আপনার বন্ধু স্যারে চইলা গেছেন সার? বললাম, হ্যাঁ। আপনি এখন
চা খাইবেন ছার? না। এখন চা খাব না। আমি গফুর
আসকারী বাড়িতে চা খেয়েছি সে টা আর মুখতারকে বললাম না। থাক তাইলে । বেহুদাই মাংস
নষ্ট হইল। আপনার বন্ধু স্যারে চইলা গেলেন। ওহো। তুমি তো আবার মাছ-মাংস খাও না। না
সার খাই না। তাহলে কিছু মাংস বাসায় নিয়ে যেও।
তাইলে কাঁচা মাংসই দিয়েন। কথাটা শুনে আমার ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। কেন কাঁচা মাংস
কেন?
রান্না করা গোশতই নিয়ে যাও। বউবাচ্চাকে দিও। মুখতার উত্তর
দিল না। মাথা নীচু করে রইল। আমি মজা করে বললাম,কি মুখতার? তুমি কি কাঁচা মাংস খাও-টাও নাকি? খাই ছার। মাঝে মইধ্যে। মৃদু চমকে উঠলাম।
বল কি! তুমি কাঁচা
মাংস খাও। কেন?
আমার চোখ ছাড়াবড়া হয়ে যাওয়ার কথা। মুখতার ফিসফিস করে বলল, আমি পাগল মানুষ ছার। পাগল? কে বলল। কেউ বলে না। আমি বলি ছার। আমার বউ মরল। আমি পাগল হইয়া গেলাম। ওহ্ হো।
তোমার বউ মারা গেছে? জি ছার। আমার বউ
মারা গেছে। তারপর থেকে আমি পাগল। খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কীভাবে বুঝলে যে তুমি পাগল? তোমাকে তো আমার ঠিক পাগল মনে হয় না। বাজারের হিসেব ঠিকমতো
দাও,
তরকারীতে কোনওদিন ঝাল বেশি কিংবা লবন কম হয়নি? তাহলে? মুখতার ন্যাড়া
মাথা চুলকে বলল, আপনি আমারে মায়া করেন স্যার। এই
জইন্যে আমি যে পাগল সেইডা আপনি বুঝবার পারেন না। এই কথা বলে সে চলে গেল। আমি বেশ
কনফিউসড হয়ে গেলাম।
দুপুরের পর একবার হাসপাতালে যেতে হল। জিন্নাত আলী আউটডোরে বসে আছে দেখলাম।
মাথায় ব্যান্ডেজ। পাশে একজন নার্স। কাছে গিয়ে বললাম, কি হয়েছে? জিন্নাত আলী
কাঁদো কাঁদো গলায়বলল, ইটা দিয়া
মুখতারে আমার মাথা ফাটাইয়া দিছে ছার। কে মাথা ফাটিয়েছে বললে? নার্স বলল, মুখতার স্যার,আপনার পিয়ন স্যার। ওহ্। অবাক হলাম। তবে আর কিছু জিজ্ঞেস
করলাম না। কোয়াটারে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজল। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে মনে
হল জিন্নাত আলীর মেয়ে মুমতাজ আপ্লাসস্টিক অ্যানেমিয়ায়ভুগত। বাংলায় এই অসুখটাকে
বলে অবর্ধক রক্তশূন্যতা। অস্থিমজ্জার কোষ যথেষ্ট পরিমানে নতুন রক্তকোষ উৎপাদন করতে
পারে না। আবদুর রহমান- এর শরীরেও ওই একই লক্ষণ দেখেছি … রুমে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসলাম। মুখতার ভাত বেড়ে
রেখেছে । আজও তার চোখ দুটি লাল দেখলাম। রাতে মুখতার- এর চোখ দুটি লাল থাকে ।
নেশাটেশা করে মনে হল। কোন দিন জিজ্ঞেস করিনি। অবশ্য এখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আজ জিন্নাত আলীর মাথা ফাটিয়েছ শুনলাম? টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মুখতার। বলল হ ছার। মুখতার
ঝালঝাল করে গরুর গোশত রান্না করেছে । ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? লোকটা ভালা না
ছার। কেন ভালা না? জিন্নাত আলীয়ে
তাবিজ-কবচ করে। বাণটোনা করে। লোকটা পিশাচ। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। বললাম তাবিজ কবচ
করে মানে?
জিন্নাত আলী গুণীণ নাকি? হ,হে গুণীণ। তয় বদ গুনীণ। বুঝাম গুণীণ। তাই বলে লোকটা পিশাচ
হতে যাবে কেন? গ্রামেগঞ্চে অনেক ওঝা-গুণীণ আছে।
হ। আছে। তারা কি সকলে বদ? না। তাহলে তার
মাথা ফাটালে কেন? জিন্নাত আলী কেস
করবে না?
হুহ্ । কেছ করব। হালারপুতের সেই সাহস আছে নি। পাবলিকরে সব
বইলা দিমু না। কি বলে দেবে? আমি ছোট প্লেট
থেকে লেবু তুলে রস বার করছিলাম। আমার হাত থেমে গেল।
মুখতার চুপ করে থাকে। একটু পর ফিসফিস করে বলে, জিন্নাত আলী আমার শ্বশুর লাগে। কী! জিন্নাত আলী তোমার শ্বশুর? আমার গলায় ভাত আটকে যাচ্ছিল। হ। তার মাইয়া মুমতাজে আমার
বউ। বউ?
সেকি! তুমি না আজ বললে তোমার বউ মারা গেছে। মুখতার এর মুখটি
বেদনাতুর হয়ে উঠল। করুন কন্ঠে বলল, বউয়ে একলগে না থাকলে তো মারা যাওনের কেছ ছার। হুমম। বেশ কনফিউসড হয়ে গেলাম।
এই লোকটা আমাকে বারবার কনফিউসড করে দিচ্ছে। বললাম, তা তোমার বউ একসঙ্গে থাকে না কেন? জিন্নাত আলী আমার বউরে লইয়া যায়। নিয়ে যায় কেন? এই কথা বলা যাবে না। মুখতার আর মুখ খুলল না। তবে বেশ কিছু
ক্লু পেলাম।আমার মস্তিস্ক সেসব জোড়া লাগিয়ে ফেলল। জিন্নাত আলী গুপ্ত কোনও
তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা করে। মুমতাজের তাতে ভূমিকা আছে। আর সেটা মুখতার জানে, কিন্ত পছন্দ না। ব্যাপারটা নিয়ে কালই একবার গফুর আসকারী
সাহেব- এর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ভদ্রলোক তন্ত্রসাধনা নিয়ে অনেক কিছু জানেন। তবে
আজ গফুর আসকারী সাহেবের বাসায় পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম। আবদুর রহমানও পালিয়ে চলে গেছে
বললেন । তার এই পালিয়ে যাওয়ার কারণ কি? রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠছে ঠিকই । কিন্তু সন্দেহ কাকে করব ঠিক বুঝতে পারছি না। মুখতার চলে গেল। আমি সিগারেট ধরালাম। তারপর আলো নিভিয়ে
শুয়ে পড়লাম। আজও ঘুম আসবে কিনা জানি না। ইনসমনিয়ার রোগীদের অষুধ দিই ঠিকই তবে
আমি নিজে ইনসমনিয়ার অষুধ খাই না। ঘুমের জন্য বরং মেডিটেশন করি। যুক্তরাষ্ট্রের
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ লথ-এর এক গবেষণায় জানা গেছে অনিদ্রা দূর করতে মেডিটেশন
একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। তা ছাড়া আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফর
ইনসমেনিয়া অনিদ্রা দূর করার ক্ষেত্রে যে মেথড সাজেস্ট করে তার মূলই হচ্ছে
মেডিটেশন। সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর পায়ের পাতায়
কনসেনট্রেট করলাম। ধীরে ধীরে মনোযোগ উঠিয়ে নিয়ে আসব বুড়ো আঙুলের ডগায়।
… তারপর পায়ের আঙুলের গোড়ায় …
টের পেলাম জানালায় ঝিরঝির বৃষ্টি …
ভেজা হাওয়া ঢুকছিল ঘরে .. আজ ঘুম আসবে কি? …
নীচে কুকুর ডাকছে। …
শরীরে গভীর অবসাদ টের পাচ্ছি …
দূরে ঝমঝম ঝমঝম ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। … ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা মনে নেই।
সচেতন হওয়ার পর মনে হল আবছা আলোয় গফুর আসকারীর বাগান দেখলাম মনে হল। বাগানে
সাদা কাপড় পরা কয়েজন লম্বা লম্বা লোক। স্বপ্ন দেখছিলাম? বাগানে পচাগন্ধও পেলাম।(স্বপ্নে কি পচা গন্ধ পাওয়া সম্ভব?) … ঘরে অন্ধকার। আর সেই বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দটা নেই। এখন ক’টা বাজে? ঠিক বুঝতে
পারলাম না। এলজিটা বালিশের পাশে । ওটা তুলে দেখলাম ৩টা বেজে ১১ মিনিট। ঘন্টা কয়েক
ঘুমিয়েছি তাহলে? অন্ধকারেই একটা
সিগারেট ধরালাম। আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। উঠে বসলাম। জানালায় জ্যোস্নার ফুটফুটে
আলো। তার মানে আকাশে মেঘ-টেঘ নেই। এমন সব জ্যোস্নার রাতে দূরের নির্জন ঘুমন্ত
চরাচর দেখতে দেখতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। নীচে তাকিয়ে
দেখি মর্গের সামনের চাতালে কারা যেন … আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম
জিন্নাত আলী, তার মেয়ে মুমতাজ আর গফুর আসকারী
হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই আমার মাথার ভিতরে কুয়াশা ছড়িয়ে যায়।
শরীর অবশ ঠেকল। ঘাড়ের পিছন দিক ঠান্ডা হয়ে উঠতে থাকে। মর্গের দরজাটা খোলা। দু-জন
লোক ধরাধরি করে একটি শব মর্গ থেকে বের করে আনল। তারপর শবটা চাতালের ওপর শুইয়ে
দিয়ে সিদে হয়ে দাঁড়াল।
মুখতার ও আবদুর রহমান কে চিনতে পারলাম। আবদুর রহমান তাহলে পালিয়ে যায়নি? গফুর আসকারী আমাকে মিথ্যে বলেছেন। কেন? তাহলে কি গফুর আসকারী গোপন কাল্টএর সদস্য? কাল্টটি শবসাধনা করে? জন্নাত আলী অদ্ভূত আসনে বসল শবের মাথার কাছে। সেই কি কাল্ট-গুরু? গফুর আসকারী শবের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। বৃদ্ধকে আজ কাল … অনেক রাতে মর্গের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে আসার কথা
বললাম। তিনি কি জানেন আমি তাদের দেখছি?
তারপরও মর্গে এসেছেন? তাদের এত
আত্মবিশ্বাসের উৎস কী। ওই মর্গ কি ওই শবসাধক-কাল্টের পবিত্র বেদি? হঠাৎ চমকে উঠে জ্যোস্নার অলোয় দেখি আরও অনেক মানুষ গাছপালা
ভেদ করে ধীরে ধীরে জড়ে হচ্ছে মর্গের সামনের চাতালে। এদের অনেককেই আমি চিনি আমি
চিনতে পারলাম। এরা এই শহরেরই বাশিন্দা। এদের অনেকের ট্রিটমেন্টও করেছি। প্রত্যেকেই
কমবেশি অ্যানেমিয়ার রুগী। ঘরের বাতাসে পচা মাংসের গন্ধ পাচ্ছি। আমার হাত থেকে
সিগারেট খসে পড়ল। টের পাচ্ছি আমার হার্টবিট ভীষণ বেড়ে যাচ্ছিল। দ্রুত ভাবছি …এই শহর থেকে আমার এখুনি পালিয়ে যেতে কত সময় লাগবে?
সমাপ্ত
গল্প: ইমন জুবায়ের
No comments:
Post a Comment