রুকইয়ার গোসল
রুকইয়ার সাপ্লিমেন্টগুলোর মাঝে শুরুর দিকেই রয়েছে রুকইয়ার গোসল। খুবই উপকারী বিষয়। এর একটা বিশেষ ফায়দা হচ্ছে, অন্যান্য পদ্ধতিতে রুকইয়ার করার পর রুকইয়ার গোসল করলে অনেক আরাম পাওয়া যায়। এছাড়া জিনের রুগীর জন্য যদি কয়েকদিন রুকইয়া করা লাগে, তাহলে প্রতিদিনের রুকইয়ার করা শেষে রুকইয়ার গোসল করিয়ে দিলে তাৎক্ষনিক ভাবে জিন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এছাড়া সিহর এবং নজরের রুকইয়া তো রুকইয়ার গোসল ছাড়া অপূর্ণই মনে হয়!
রুকইয়ার গোসলের অনেক অনেক পদ্ধতি আছে, আমরাও আজ বেশ কিছু রুকইয়ার গোসলের সাথে পরিচয় হব।
রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকেই বেশ কয়েক ধরণের রুকইয়ার গোসল প্রচলিত রয়েছে।
যেমন, বদনজর বিষয়ে রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ভাগ্যের চেয়েও আগে বেড়ে যায় এমন কিছু যদি থাকতো, তবে সেটা হতো বদনজর। যদি (নজরের জন্য) তোমাদের গোসল করতে বলা হয়, তবে এজন্য গোসল করো।” (মুসলিম)
নজরের গোসল বলতে যেটা পাওয়া যায়, আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন: যে ব্যক্তির বদ-নজর অন্যের উপর লাগতো, তাকে ওযু করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হতো। এরপর ঐ পানি দিয়ে তাকে গোসল করানো হতো, যার উপর বদ-নজর লাগতো। (মুসলিম) এভাবে একবার গোসল করলেই সাধারণত বদনজর ভালো হয়ে যায়।
এছাড়া অন্য দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেটা দিয়ে গোসল করার উদাহরণও রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরাম থেকে রয়েছে।
সাবিত ইবনু কাইস ইবনু শামমাস রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার অসুস্থ ছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে যান এবং এই দোয়াটি পড়েন:
اكْشِفِ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ (হে মানুষের প্রভু রোগমুক্ত করুন)
এরপর তিনি বাতহান প্রান্তরের এক মুঠ মাটি নিয়ে একটি পাত্রে রাখেন এবং পানিতে ফুঁ দিয়ে পানিটা ঐ পাত্রে ঢেলে দেন। পরে সে পানি তার সমস্ত শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। (সুনান আবি দাউদ)
বিন বায রহিমাহুল্লাহ. রুকইয়ার গোসলের নিয়ম বর্ণনা করার সময় উপরোক্ত হাদিস উল্লেখ করেছেন দলিল হিসেবে। এখানে শরীরে ছিটিয়ে দেয়া কারণ হয়তো, এমনিতেই অসুস্থ, আবার গোসল করালে তো কষ্ট হতো। তাই শুধু পানি ছিটিয়ে দিয়েছেন।
এছাড়া বিন বায রহ. বিষয়টা আরও সহজ করে বলেছেন, তা হচ্ছে –
যাদুতে আক্রান্ত রোগীর উপর অথবা কোন একটি পাত্রে পানি নিয়ে “নিচে উল্লেখিত” (১১টা) আয়াত এবং দোয়াসমূহ পড়ে পানিতে ফুঁ দিবে। এরপর যাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তি সে পানি পান করবে। আর অবশিষ্ট পানি দিয়ে প্রয়োজনমত একবার বা একাধিক বার গোসল করবে। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করবে।
এই গোসলের নিয়মটাই, এটা আমরা সিহরের কমন রুকইয়ায় বলে থাকি। তবে একটু সংক্ষেপে –
“একটি বোতলে পানি নিন, এরপর- ক. সুরা আ’রাফ ১১৭-১২২ খ. ইউনুস ৮১-৮২ গ. সুরা ত্বহা ৬৯নং আয়াত ঘ. এরপর সুরা ফালাক, সুরা নাস – সব ৩বার করে পড়ুন আর ফুঁ দিন। এই পানি থেকে দুই বেলা আধা-গ্লাস করে খাবেন, আর প্রতিদিন গোসলের পানিতে মিশিয়ে গোসল করবেন।”
তবে এভাবে বোতলে না রেখে, যদি প্রতিদিন পানি খাওয়া বা গোসলের আগে আয়াতগুলো পড়ে ফুঁ দেন, এরপর সেটা খান বা ব্যবহার করেন তাহলে আরও উত্তম হয়।
যাদুর চিকিৎসায় বিখ্যাত রুকইয়ার গোসল হচ্ছে বরই পাতা বেটে কিছু দোয়া পড়ে পানিটা খাওয়া এবং গোসল করা। তবে এই গোসলের সময় পড়ার দোয়াগুলো কেউ অল্প কয়েকটা বলেছেন, কেউ বেশি বলেছেন।
ইমাম কুরতুবি রহ. সুরা বাক্বারা ১০২ আয়াতের আলোচনা করতে গিয়ে এই গোসলটার কথা বলেছেন, তবে উনি শুধু আয়াতুল কুরসি পড়তে বলেছিলেন। ইবনে কাসির রহ. সেটা উদ্ধৃত করে আয়াতুল কুরসির সাথে সুরা ফালাক, সুরা নাস পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই দুজনের কথার সারাংশ হচ্ছে শাইখ ওয়াহিদ বিন আব্দুস সালামের বলা নিয়মটা। আমরা এখন সেটাই জানবো –
বরইয়ের সাতটি সবুজ পাতা পিষে পানিতে ঢেলে নাড়তে থাকুন এবং নিম্নের আয়াতসমূহ পড়ে ফুঁ দিতে থাকুন।
১. আয়াতুল কুরসি
২. সুরা ফালাক
৩. সুরা নাস
এরপর সেই পানি রোগী তিন ঢোক পান করবেন এবং বাকিটা দিয়ে গোসল করবেন। সে পানিতে অন্য পানি মেশাবে না ও উক্ত পানি গরমও করবে না।
আর এভাবে কয়েকদিন গোসল করবেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ রুগী সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে আশা করা যায় প্রথম গোসলেই যাদু নষ্ট হয়ে যাবে। (আস সরিমুল বাত্তার, ২২তম সংস্করণ, ২১৪পৃষ্ঠা)
বিন বায রহিমাহুল্লাহ এই গোসলের নিয়ম বর্ণনা করেছেন শাইখ আব্দুররহমান বিন হাসানের ফাতহুল মাজিদ (সালাফি ভাইদের একটি আকিদার কিতাব) থেকে, তবে সেখানে অনেক কিছু পড়তে বলেছেন। তাঁর লিস্ট হচ্ছে –
1. সূরা ফাতিহা।
2. আয়াতুল কুরসি।
3. সূরা আরাফের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো। (১০৬-১২২নং আয়াত)
4. সূরা ইউনুসের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো। (৭৯-৮২নং আয়াত)
5. সূরা ত্বহা এর যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো। (৬৫-৬৯নং আয়াত)
6. সূরা কাফিরুন।
7. সূরা ইখলাস – ৩বার
8. সূরা ফালাক – ৩বার
9. সূরা নাস – ৩বার
সাথে কিছু দোয়া পড়া। যেমন-
10. “আল্লাহুম্মা রাব্বান নাস! আযহিবিল বা’স। ওয়াশফি, আনতাশ শাফী। লা শিফাআ ইল্লা শিফাউক। শিফাআন লা ইয়ুগা-দিরু সাকামা।” [৩ বার]
11. “বিসমিল্লাহি আরক্বীক মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ু’যীক। মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন হাসিদিন; আল্লাহু ইয়াশফীক। বিসমিল্লাহি আরক্বীক।” [৩ বার]
(মাজমুউল ফাতওয়া ওয়া মাক্বালাত, শাইখ বিন বায- ৮ম খণ্ড, ১৪৪পৃষ্ঠা)
এটাকে মিনিফাইড করার জন্য এক কাজ করা যেতে পারে, লিস্টটা এরকম হতে পারে।
১. ফাতিহা
২. আয়াতুল কুরসি
৩. সিহরের আয়াতগুলো, অর্থাৎ
সুরা আ’রাফ ১১৭-১২২
সুরা ইউনুস ৮১-৮২
সুরা ত্বহা ৬৯নং আয়াত
৪. সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস
পানিতে বরই পাতা গুলিয়ে আমরা এগুলো একবার করে পড়ব! তাহলে খুব বেশি দীর্ঘ হল না, আবার মোটামুটি সবকিছুই পড়া হয়ে গেল। ইনশাআল্লাহ এতে আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে।
আর আমরা (রুকইয়াহ সাপোর্ট বিডি) রুকইয়ার গোসল বলতে স্বাভাবিকভাবে যেটা বুঝিয়ে থাকি তা হচ্ছে,
“একটা বালতিতে পানি নিবেন। তারপর পানিতে দুই হাত ডুবিয়ে যেকোনো দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস, শেষে আবার কোনো দরুদ শরিফ-সব ৭বার করে পড়বেন। পড়ার পর হাত উঠাবেন এবং এই পানি দিয়ে গোসল করবেন।”
(প্রথমে এই পানি দিয়ে গোসল করবেন, তারপর চাইলে অন্য পানি দিয়ে ইচ্ছামত গোসল করতে পারেন। যার সমস্যা সে পড়তে না পারলে অন্য কেউ তার জন্য পড়বে, এবং অসুস্থ ব্যক্তি শুধু গোসল করবে।)
এই গোসলের নিয়মটা আমি জেনেছিলাম, মুম্বাইয়ের মুফতি জুনাইদ সাহেবের কাছে। এই গোসলটা সচরাচর আমরা বদনজরের রোগীকে করতে বলি, তবে যাদু এবং জিনের রোগীর জন্যেও এটা আলহামদুলিল্লাহ অনেক উপকারী।
পরের কথা হচ্ছে, যেহেতু এই গোসলের হুবহু নিয়ম হাদিস থেকে নেয়া না, বরং হাদিস থেকে মূলনীতি গ্রহণ করে উলামাদের ইজতিহাদ থেকে উদ্ধৃত। তাই আমি এখানেও ফাঁকি দিতে চেষ্টা করি! কখনও কখন সব তিনবার করে পড়ি, কখনও শুরু শেষের দরুদ শরিফ এক-দুইবার পড়ি। আর সুরা কাফিরুন যে শেষ কবে পড়েছিলাম আল্লাহ মালুম! তো আমি রুকইয়ার গোসল করলে সাধারণত যেভাবে করি-
“কয়েকবার দরুদ শরিফ পড়ি। এরপর সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, ইখলাস, ফালাক, নাস – এগুলো সাধারণত ৩বার, সময় থাকলে ৭বার পড়ি। সাথে কিছু রুকইয়ার দোয়া পড়ি।” এরপর এটা দিয়ে গোসল করি।
যেদিন পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকা হয় না, সেদিন এসব তিনবার করে পড়ি আর বালতির পানিতে ফুঁ দেই। সব পড়া শেষে গায়ে পানি ঢালি…।
ব্যাস হয়ে গেল রুকইয়ার গোসল!
এখানে মূলনীতি হচ্ছে, যা সরাসরি সুন্নাহ থেকে নেয়া হবে, সেটা হুবহু ওই সংখ্যাতেই বা ওই পরিমাণেই করবেন। আর যদি এটা ইজতিহাদ হয়, তবে অভিজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞেস করে সুন্নাহ সংখ্যা (তিন, সাত, তেত্রিশ, সত্তর, একশ) এরকম কমবেশি করতে পারেন। এক্ষেত্রে বেশি পড়লে বেশি ফায়দা, কম পড়লে কম। তবে আপনার জন্য কতটুকু পড়লে ভালো হবে, এবিষয়ে অভিজ্ঞ কারও সাথে কথা বলে নিলে ভালো হয়। অথবা প্রয়োজনে রুকইয়া সাপোর্ট গ্রুপ তো আছেই।
বারাকাল্লাহু ফিকুম, সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহ।